logo

কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো আপস করিনি : কাইয়ুম চৌধুরী

কাইয়ুম চৌধুরী – তাঁকে গণ্য করা হয় বর্তমান বাংলাদেশের শিল্পকলার অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ হিসেবে। চিত্রকলাকে দেশের গণ্ডি থেকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করে তুলতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শিল্প-সমালোচকরা তাঁকে অভিহিত করেন ‘রঙের রাজা’ হিসেবে। রং নিয়ে তিনি দীর্ঘকাল তাঁর স্বপ্নকে রাঙিয়েছেন। আমাদের প্রকাশনা শিল্পকেও তিনি সমানভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বিরাশি বছর বয়সে এসে তিনি এখনো যে-কোনো তরুণের চেয়ে বেশি সজীব, সৃষ্টিশীল। শিল্পকলার পাশাপাশি নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। দিনের সারাটা সময় ব্যস্ত থাকেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও সম্প্রতি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর আজিমপুরের বাসায় শিল্প ও শিল্পীকে সময় দিয়েছেন। কথা বলেছেন নানা বিষয়ে। নিজের শিল্পী হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। বিগত দিনের অনেক স্মৃতিচারণ করেছেন। কাইয়ুম চৌধুরীর এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে অনেক প্রসঙ্গ,
না-বলা কথা, নানা অধ্যায়। যা তিনি আগে কখনো কোথাও বলেননি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন – মাহবুব রেজা
প্রশ্ন : আপনি এত পেশা থাকতে চিত্রশিল্পী হয়ে উঠলেন কীভাবে? এটা কি শৈশব থেকেই আপনার মধ্যে কাজ করেছিল, নাকি শৈশবের কোনো রঙিন স্মৃতি এর সঙ্গে জড়িত?
কাইয়ুম চৌধুরী : আমি প্রথমেই একটা কথা বলে শুরু করতে চাই। মানুষ কিন্তু হিসাব করে তার জীবন সাজাতে পারে না। আসলে হিসাব করে কখনো কোনো কিছু হওয়াও যায় না। তবে একথা ঠিক, একেকজনের একেক রকমের ইন্সপিরেশন থাকে। আমার মধ্যে বোধ হয় সে ধরনের কোনো ইন্সপিরেশন ছিল – না হলে আমি এত পেশা থাকতে কেন ছবি আঁকাআঁকির বিষয়টি বেছে নিলাম? ছবি আঁকা আমি মন থেকে গ্রহণ করেছিলাম। নিজের একান্ত আনন্দের জন্য ছবি আঁকার বিষয়টিকে বেছে নিয়েছিলাম। আমার এখন বিরাশি বছর চলছে। যখন ভাবি ষাট-সত্তর বছর ধরে আমি কেবল ছবি আঁকছি, তখন সত্যি সত্যি অবাক লাগে। নিজের মধ্যেই এক ধরনের অপার বিস্ময় কাজ করে। আমি আমার ছবি আঁকা নিয়ে কোনো তত্ত্বকথা বলব না। শুধু এতটুকু বলতে পারি, ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকের ভেতর আঁকিবুঁকি দেখে মনের মধ্যে একটা ঘোর কাজ করত। ভাবতাম, আচ্ছা, আমি যদি কখনো বইয়ের ভেতর কাজ করা শিল্পীদের মতো কাজ করতে পারতাম!
শৈশবে সবাই কাগজ-পেনসিল নিয়ে আঁকাআঁকি করে। আমিও সে রকম আঁকতে চেষ্টা করতাম। তবে বুক ইলাস্ট্রেশন আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করত। বিশেষ করে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। দেব সাহিত্যকুটির থেকে প্রকাশিত বই আমাদের ঘরে প্রায়ই আসত। প্রতুলের কাজ দেখে সত্যি সত্যি আমার খুব ভালো লাগত। সেই ছবি দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম, আমিও একদিন এই রকম ছবি আঁকব। দেব সাহিত্য ছাড়াও সন্দেশ আসত বাড়িতে। সন্দেশে সমর দে, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীসহ অনেকের কাজ দেখতাম। কী ভীষণ সুন্দর কাজ! এছাড়া উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন অনন্য – তিনি কিন্তু পেশাদার শিল্পী ছিলেন না। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য, বাচ্চাদের ভালোবেসে এত চমৎকার সহজ ছবি সন্দেশে আঁকতেন, যা দেখলে মন ভরে যেত। উপেন্দ্রকিশোর রায়ও আমার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে আমার মনে হয়েছে, উপেন্দ্রকিশোর রায় কিন্তু বাচ্চাদের সাইকোলজি খুব ভালো বুঝতে পারতেন। আর যে কাজটা করে তিনি বিখ্যাত বাঙালি হয়ে আছেন, তা হলো মুদ্রণশিল্প। এছাড়া ফটোগ্রাফিকে মুদ্রণশিল্পে নিয়ে আসার পেছনেও তাঁর অবদান অসামান্য। মুদ্রণশিল্পে স্ক্রিনের পয়েন্ট মেলানো খুব কঠিন একটা কাজ – তিনি সেই কাজটি নিখুঁতভাবে করে বাংলা মুদ্রণশিল্প ও প্রকাশনাকে অগ্রসর করতে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। সে সময়কার ইংলন্ডের বিখ্যাত ম্যাগাজিন পেনরোজ, যাতে প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্প বিষয়ক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ছাপা হয়, সেখানেও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মুদ্রণবিষয়ক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। পেনরোজ অ্যানুয়াল এখনো বের হয়।
আমি ছোটবেলায় পড়া ফাঁকি দিয়ে প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা দেখে তাঁকে নকল করে আঁকতে চেষ্টা করেছি। শুধু প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় নন, আরো অনেকের ছবি, যাঁদের ছবি মনে ধরত তাঁদের ছবি দেখে আঁকার কসরত করেছি। ছোটবেলায় ছবি এঁকে যে রকম আনন্দ পেতাম এখনো আমি একটি ছবি আঁকতে পেরে সেই একইরকম আনন্দ লাভ করি। এখন আমার ছবি দেখে কেউ যদি আনন্দ পায় আমার মধ্যেও আনন্দের প্রশান্তি কাজ করে। আমি মনে করি, একটি ছবি আঁকা শেষ করে শিল্পী যে আনন্দটা পান সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি আমার ক্ষেত্রে এই আনন্দটাকে সবসময় উপভোগ করি – কখনো কখনো প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সেটা শেয়ারও করি।
শৈশবের নানা স্মৃতি, নানা ঘটনাও আমাকে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বেশ সহযোগিতা করেছে। আমি আজকে যে প্রফেশনে আছি সেখানে যদি আনন্দ না থাকে তবে তো আমি সেই প্রফেশনে দাস হয়ে গেলাম। আমি কখনো দাস হতে চাইনি। এখনো আমি পৃথিবীর নানা দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের কাজ দেখি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এসব কাজ দেখার সময় আমি কোনো থিওরি (ঞযবড়ৎু) খুঁজতে যাই না। ব্যাখ্যা খুঁজতে যাই না। শিল্পীদের কাজ দেখি আর সেই কাজের মধ্য থেকে কাঠামো তৈরির মুনশিয়ানা অবলোকন করি, রঙের আনন্দ নেওয়ার চেষ্টা করি, তুলি আর ব্রাশের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিল্পী যে আনন্দ ভোগ করেছেন আমিও তার ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করি। আমি মনে করি, একজন শিল্পী যখন একটি কাজ শেষ করেন তখন সেই কাজ আর দশজন শিল্পীর আনন্দের অংশ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এ রকম – শিল্পীর ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে তাতে তাঁর আর ‘হক’ থাকে না – তখন তা হয়ে যায় সবার। বিষয়টিকে আমি আবার এভাবেও দেখি, ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে সেই ছবিটা ঈশ্বর প্রদত্ত বিষয় হয়ে যায়। আরো একটা জিনিস আমি মানি, তা হলো আমি মনে করি প্রকৃতি থেকে যেমন শিল্পের জন্ম হয়, তেমনি শিল্পীরও জন্ম হয়। একজন শিল্পীকে তাই বারবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হয়। প্রকৃতি শিল্পীকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। প্রকৃতির মধ্যে যে সৌন্দর্য থাকে, যে রহস্য থাকে, শিল্পীর হাতে তা পুনর্জন্ম লাভ করে।
প্রশ্ন : প্রকৃতির পুনর্জন্ম হয় শিল্পীর হাতে – বিষয়টা যদি ব্যাখ্যা করতেন।
কাইয়ুম চৌধুরী : এর ব্যাখ্যা অনেকভাবে দেওয়া যায়। তবে আমি খুব সাধারণভাবে বিষয়টিকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। ধরা যাক, কেউ একজনের সমুদ্রসৈকতে ডুবতে থাকা সূর্যাস্ত দেখে খুব ভালো লাগল, কিন্তু তিনি সেই সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর সামনে অপরূপ ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত তিনি তো আর ফিরে পাবেন না। এখন সেই মানুষ যদি কখনো কোনো শিল্পীর আঁকা অপরূপ সূর্যাস্ত দেখতে পান তখন তিনি শিহরিত হয়ে ভাবেন, আরে! এই ডুবে যাওয়া অপরূপ সূর্যাস্ত তো আমি এর আগে একবার দেখেছিলাম। প্রকৃতির সব সৌন্দর্য সাধারণের চোখে সবসময় ধরা পড়ে না। শিল্পীই তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দ্বিতীয়বার দেখিয়ে দেন। এভাবে শিল্পীর হাত ধরে প্রকৃতির সৌন্দর্য বলেন, আর রহস্য বলেন তা পুনর্বার জন্মলাভ করে।
প্রশ্ন : রং আর ক্যানভাসকে কবে থেকে ভালোবাসতে শুরু করলেন। রং আর ক্যানভাসকে আপনি অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যে কারণে শিল্প-সমালোচকরা আপনাকে ‘রঙের রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। আপনি কি নিজেকে সত্যি সত্যি ‘রঙের রাজা’ ভাবেন?
কাইয়ুম চৌধুরী : আসলে একজন শিল্পীর মাধ্যম হলো কাগজ আর পেনসিল। এসবকে অবলম্বন করে শিল্পী যে সৃষ্টি করেন সেটা তাঁকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। এখন একজন শিল্পী পেনসিল দিয়ে একটি বিন্দুকে একটি লাইনে রূপান্তর করেন, আবার সেই লাইনকে শিল্পী কতভাবে প্রেজেন্ট করতে পারেন, লাইনের সহযাত্রী হয়ে কতভাবে ভ্রমণে অংশ নেন সেটা ভাবাই যায় না। আমি মনে করি, এই পেনসিল হলো ইটস এ উইপন ফর এন আর্টিস্ট। শিল্পী নানা মাধ্যমে তাঁর কাজ করতে পারেন। পেনসিল থেকে রং, প্যাস্টেল, ওয়াটারকালার; অন্যদিকে কাগজ থেকে ক্যানভাস – ক্যানভাস ছবিকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
আমি কখন থেকে রং আর ক্যানভাসকে ভালোবাসতে শুরু করলাম তা হিসাব করে বলাটা খুব কঠিন। তবে আমি খুব সচেতনভাবে রং, ক্যানভাসকে নিজের মতো আপন করে নিয়েছি, এটা বলতে পারি। রং আর ক্যানভাসের মধ্য দিয়ে শিল্পী যে কতরকম ইফেক্ট আনতে পারেন তা বিস্ময়কর। আমি রং আর ক্যানভাসকে অন্যরকম মাত্রায় নিয়ে গিয়েছি, এই কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথের একটা কথা আছে, জীবনে যত আনন্দ তা এই সৃষ্টির মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে। আমিও অন্যদের মতো সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি।
আমি ‘রঙের রাজা’? (কথাটা বলে তিনি শব্দ করে হাসতে লাগলেন আর মাথা দোলাতে থাকলেন, যার অর্থ দাঁড়ায় মোটেও না) শিল্প-সমালোচকরা আমার সম্পর্কে নিঃসন্দেহে ভুল বলেছেন। আমি একজন নগণ্য আঁকিয়ে মাত্র। ‘রঙের রাজা’ হওয়া বিশাল ব্যাপার। তবে রং আমি খুব পছন্দ করি। মানুষের জীবনের অন্য আরেক নাম রং। রং ছাড়া কি কোনো কিছু হয়? মোটেই না। যখন শুনি কারো সংগ্রহে আমার ছবি আছে তখন খুব ভালো লাগে। মনে আনন্দ লাগে – এই আনন্দটাও কিন্তু রং। আনন্দকে আমি রং বলে মান্য করি।
আমাদের লোকশিল্প কিন্তু রঙের আধার। পৃথিবীতে যত রং আছে আমি মনে করি তার চেয়েও বেশি রং আমাদের লোকশিল্পে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমাদের লোকশিল্প পৃথিবীর যে-কোনো লোকশিল্পের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বাংলার লোকশিল্প আমাকে শিল্পী করেছে। আমি অবাক হই গ্রামীণ শিল্পীদের কথা ভেবে, যাঁদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই অথচ কী নিপুণ তাঁদের কাজ, কী নিপুণ তাঁদের রং নির্বাচন। গ্রামীণ শিল্পীরা তাঁদের ব্যবহার্য (ঈৎধভঃ) জিনিস দিয়ে নিছক আনন্দের জন্য শিল্প রচনা করেন। তাঁরা যে সমস্ত রং দিয়ে শিল্প তৈরি করেন তা আমাদের ভাবনার পরিসরকে বিস্তৃত করে। যেমন শখের হাঁড়ি, সরা তৈরিতে তাঁরা যে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন তা আমাদের চিত্তকে দোলা দেয়, মনকে জাগ্রত করে। গ্রামীণ শিল্পীরা এক পাখিকে কতরকম রঙে যে রাঙিয়ে তোলেন! তাঁদের তৈরি রঙিন পাখি দেখে অবাক হতে হয়। পুরনো শাড়ির পাড় থেকে সুতো বের করে তা দিয়ে নকশিকাঁথা তৈরি করেন। এককথায় মিনিমাইজেশন অব অবজেক্ট, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাছাড়া গ্রামের শিল্পীরা কাঠের ঘোড়া, হাতি যেভাবে কাঠ কেটে তৈরি করেন, তা আমাকে আশ্চর্য করে। কাজের মাধ্যম এবং সময় এই লোকশিল্পীদের পরিমিতিবোধকে জাগ্রত করে। সময়টা খুব জরুরি লোকশিল্পীদের কাছে। কম সময়ে বেশি সামগ্রী তৈরি তাঁদের বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করে। এসব হাতি, ঘোড়ার নির্মাণকৌশল ও তাঁদের পরিমিতিবোধ আমাকে অবাক করে।
আমি আমার কাজের মধ্যে গ্রামীণ শিল্পীদের সেই ভাবধারা তুলে ধরবার চেষ্টা করি। আমি তাঁদের কাজের ঘরানা ফলো করারও চেষ্টা করি। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রামীণ শিল্পীদের ফর্ম (ঋড়ৎস)টাকে অনুধাবন করি। ওঁদের রঙের ব্যবহারের দিকটি আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। ওঁদের কাজের মধ্যে আমরা সিমপ্লিফিকেশন (ঝরসঢ়ষরভরপধঃরড়হ)-এর বহুমাত্রিক ব্যবহারও দেখতে পাই। শখের হাঁড়ির উদাহরণ দিই। জয়নুল আবেদিন স্যার সবসময় আমাদের বলতেন, গ্রামীণ শিল্পীদের পরিমিতিবোধ, সেন্স অব প্রোপোরশন অনেক বেশি। তিনি বলতেন, দেখো, ওঁরা যে মাটির হাঁড়ি বানায় তা কতরকম। হাঁড়ির এই রকমভেদ কিন্তু প্রয়োজনীয়তা থেকে এসেছে। ভাত রান্নার জন্য এক রকম হাঁড়ি, মাছ রান্না করার জন্য আরেক রকম হাঁড়ি; আবার দেখা যাচ্ছে মুড়ি ভাজার জন্যও অন্য আরেক ডিজাইন। জয়নুল আবেদিন স্যার বলতেন, ডিসটোরশন (উরংঃড়ৎঃরড়হ) অনুযায়ী, প্রয়োজনের তাগিদে ওঁরা মনোহারী হাঁড়ি তৈরি করে নিজেদের শিল্পীসত্তাকে ফুটিয়ে তোলেন। এখানে পিকাসোর কথা এসে যাচ্ছে। আফ্রিকাকে সবসময়ই বলা হতো ডার্ক কন্টিনেন্ট। পিকাসো আফ্রিকার রংবেরঙের মুখোশ (গঁংশ) দেখে ভারি অবাক হলেন। পিকাসো দেখলেন, আফ্রিকার মুখোশের মধ্যে চমৎকারভাবে নানা উপকরণ উঠে এসেছে। মাছ, হরিণ, পাখি, কুমির, বাঘসহ কতরকম নকশা যে মুখোশের মধ্যে উঠে এসেছে! পিকাসো আফ্রিকার সেই মুখোশ দেখে নতুন করে শিল্প তৈরি করলেন। তাহলে কী দাঁড়াল? আফ্রিকা নট অনলি ডার্ক কন্টিনেন্ট, আফ্রিকা অলসো মোস্ট মডার্ন কন্টিনেন্ট। পিকাসো তাঁর অবজারভেশন (ঙনংবৎাধঃরড়হ) দিয়ে দেখলেন এবং শিল্প তৈরি করলেন। একজন শিল্পীকে মনের আনন্দে কাজ করার পাশাপাশি মনের আনন্দে তাঁকে পর্যবেক্ষণও করে যেতে হবে। পর্যবেক্ষণও একজন শিল্পীকে অনেক কিছু দেয়।
প্রশ্ন : আপনি তো জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলামের মতো নামকরা শিল্পীদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন এবং সেই সূত্রে তাঁদের খুব কাছে থেকে দেখারও সৌভাগ্য হয়েছিল আপনার। শিক্ষক এবং শিল্পী হিসেবে তাঁদের কেমন করে দেখেছেন?
কাইয়ুম চৌধুরী : তখনকার দিনে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। স্যারদের মনে হতো না যে তাঁরা আমাদের স্যার। পড়াশোনার ব্যাপারে তাঁরা আমাদেরকে একরকম ছেড়েই দিতেন। তাঁরা আমাদেরকে কোনো ঘেরাটোপের মধ্যে রাখতেন না। আমাদের মধ্যে অনেকেই তখন স্যারদেরকে ‘ভাই’ বলে ডাকতাম। শিক্ষক হিসেবে তাঁদের পেয়ে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছে – একথা বলাই যায়। তবে জয়নুল আবেদিনের কথা না বললেই নয়। আমি যদি জয়নুল আবেদিনের সংস্পর্শে না আসতাম তাহলে এই দেশটাকে কখনো চেনা হতো না আমার। দেশপ্রেম জাগ্রত হতো না। দেশ চেনানোর ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদিন স্যার আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ, আমরা দেশের মর্মটা বুঝি না। প্রশাসনের অনেকের মধ্যে এই জিনিসটা বেশি রকম মাত্রায় দেখা যায়। চোখের সামনে নদী, খাল-বিল, হাওর, মাঠ, জলাশয়, সরকারি জমি – সব দখল হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই ভাবছে দেশটা বুঝি একটা ভূখণ্ড; কিন্তু এটা তো ভুল ধারণা।
জয়নুল আবেদিন স্যার আমার মধ্যে গ্রামীণ লোকশিল্পের ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি নিজেও কম বিস্মিত হইনি গ্রামীণ শিল্পীদের কাজ দেখে, তাঁদের রঙের ব্যবহার দেখে। তাঁরাই তো আসল রঙের রাজা। আমার ছবির বিষয়ে ঘুরেফিরে তাই বারবার গ্রামীণ বিষয়-আশয় ফুটে উঠেছে। গ্রামীণ নকশাকে আমি বিভিন্নভাবে আমার কাজে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। গ্রামবাংলার নাম-না-জানা অসংখ্য শিল্পীর কাছে আমি ঋণী।
প্রশ্ন : আপনারা আর্ট কলেজে পড়ার সময় কোথায় আড্ডা মারতেন? সেই আড্ডায় কারা কারা থাকতেন? সে সময়ের কোনো স্মৃতি, কোনো ঘটনা –
কাইয়ুম চৌধুরী : আমি আর্ট কলেজে ভর্তি হই ১৯৪৯ সালে। আমরা আর্ট কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচ। আমার সঙ্গে পড়ত মুর্তজা বশীর, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, হুমায়ুন কাদির, আমিনুর রহমান, আনোয়ার, আলী রেজাসহ আরো অনেকেই – সবার নাম এ মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। ১৯৫৪ সালে আমরা আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে যাই। আমরা আড্ডা মারতাম নানা জায়গায়। নবাবপুরের ক্যাপিটাল, গুলিস্তানের রেক্স রেস্তোরাঁয়, লা সানি রেস্তোরাঁ, আরমানিটোলায়; আড্ডা মারতাম বিউটি বোর্ডিংয়ে। বিউটিতে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই আসতেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, খালেদ চৌধুরী, যিনি প্রভু নামে বহুল পরিচিত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ফজল শাহাবুদ্দীন, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ফজলে লোহানী, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সন্ধানীর গাজী শাহাবুদ্দিনসহ আরো অনেকেই আসতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে।
আমার বাবা কাজ করতেন
কো-অপারেটিভ ব্যাংকে। বদলির চাকরি। বাবা যখন ময়মনসিংহে তখনই জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তখন স্কুলে পড়ি। এসএসসি পাস করার পর আমি আর্ট কলেজে ভর্তি হই। আর্ট কলেজ তখন পুরান ঢাকার সদরঘাটে। এখনকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলের দুটি কামরায়।
আর্ট কলেজে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তুমুল আড্ডায় মেতে থাকতাম। সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্বও বেশ প্রগাঢ় হয়ে গিয়েছিল। ফজলে লোহানী তখন অগত্যা নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। ফজলে লোহানী আমাকে দুটি স্ক্রিপ্ট দিয়ে বলেছিলেন, এগুলোর কভার করে দিতে হবে। জার্নাল শ্রাবণে ও কথা সরিৎ সাগর নামের স্ক্রিপ্ট। কী কারণে জানি না পরে এগুলো আর বের হয়নি। বই যখন বের হলো না তখন আমার মধ্যে একটা অন্য ধরনের ব্যাপার কাজ করতে লাগল। স্কুলে থাকতে আমি টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বই কিনতাম। বইয়ের প্রতি আমার একটা ভালোবাসা ছিল। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে প্রকাশক হব, এই ভেবে নিজেই ‘আলফাবিটা’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম। পেছন থেকে অর্থ জোগানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন জহির রায়হান। সৈয়দ শামসুল হকের বুনো বৃষ্টির গান এই নামের একটা কবিতার বইও বেশ উৎসাহের সঙ্গে ছেপেছিলাম। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বইটা আর মার্কেটিং করা হলো না। সারাক্ষণ আড্ডা আর কাজ নিয়ে থাকলে কি প্রকাশক হওয়া যায়? আমার আর প্রকাশক হওয়া হলো না। প্রকাশক হতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে আমি হয়ে গেলাম শিল্পী।
প্রশ্ন : দাপুসোনার জন্য আপনার লেখা একটি ছড়ার বই। এই বইয়ের ভূমিকা আপনি খুব মজা করে লিখেছিলেন। ভূমিকায় ছিল এ রকম, ছড়াকার কাইয়ুম চৌধুরী গেলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে প্রচ্ছদ আর ইলাস্ট্রেশন করাতে। তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ছড়াকার কাইয়ুম চৌধুরীকে ব্যস্ততার কথা বলে ঘোরাতে লাগলেন। এরকম করে প্রায় দুই বছর পার হলো।
কাইয়ুম চৌধুরী : (প্রশ্নটি শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি) হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে। দাপুসোনার জন্য বইটি বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছিল। আমার একটা দুর্নাম আছে, আমি কাজ নিয়ে ঘোরাই। শামসুর রাহমানের একটা বই বাংলা একাডেমি থেকে বের হবে। আমার কাছে এলো। আমি এটা নিয়ে ব্যস্ত, সেটা নিয়ে ব্যস্ত, এই করে করে সাত বছর পার হয়ে গেল অথচ আমি বইটির প্রচ্ছদ করতে সময় পাই না। ওদিকে শামসুর রাহমানও গোঁ ধরে বলতে লাগল, কাইয়ুম চৌধুরী কাজ না করলে আমার বই বের হবে না। আমার দেরি দেখে বাংলা একাডেমি পরে বইটার প্রচ্ছদ কালাম মাহমুদকে দিয়ে করিয়ে বের করেছে।
আমার চারটি ছড়ার বই রয়েছে। তাই তাই তাই, তনুর সাথে রং রেখাতে, দাপুসোনার জন্য ও রং ঝিলমিল। তবে শেষের বইটির সব রেডি হয়ে আছে। যে-কোনো সময় বইটি বেরিয়ে যাবে।
এছাড়া সন্ধানীকে কেন্দ্র করে সে সময় আমাদের মধ্যে একটা দুর্দান্ত আড্ডা জমে উঠেছিল। শুধু আড্ডা নয়, একটা গোষ্ঠীও তৈরি হয়ে গেল। সন্ধানীর স্বত্বাধিকারী গাজী শাহাবুদ্দিন, নির্বাহী সম্পাদক বেলাল চৌধুরী ছিলেন মধ্যমণি। সেই গোষ্ঠীতে কে না ছিল! ষাট ও সত্তরের দশকের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শিল্পী-সাহিত্যিকরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনার ছাত্র ধ্র“ব এষ আমাকে জানিয়েছে, আপনার একটা কাজ ছিল, যেখানে নৌকার গলুইয়ে আপনি মাছের চোখ এঁকেছিলেন। এই ছবি দেখে জয়নুল আবেদিন নাকি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। বিষয়টি কি আপনার মনে পড়ছে? নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখ – এই ধারণাটা কোত্থেকে পেয়েছিলেন আপনি?
কাইয়ুম চৌধুরী : কেন মনে পড়বে না? ধ্র“ব তোমাকে পুরোটা বলতে পারেনি ঠিকমতো। নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখ বলাতে আমার অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন আর্ট স্কুল থেকে পাস করে বেরিয়েছি। এখানে-সেখানে কাজ করি। কোনো
চাকরি-বাকরি নেই – ফুলটাইম বেকার। তখন তো আর অত
ফার্ম-টার্ম ছিল না। হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা। আগেই বলেছি, ’৫৪ সালে পাস করে আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়েছি। এর মধ্যে জয়নুল আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে ১৯৫৮ সালে আর্ট কলেজে চাকরি দিলেন। সে সময় স্মল কটেজ ইন্ডাস্ট্রির হাত ধরে ডিজাইন সেন্টার তৈরি হলো। কামরুল হাসান তখন ডিজাইন সেন্টারের দায়িত্ব নিয়েছেন। আবেদিন স্যার চাইলেন ডিজাইন সেন্টার আর্ট কলেজের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে কিন্তু কামরুল ভাই তা চাইলেন না। স্যার আমাকে ডিজাইন সেন্টারে জোর করে নিয়ে গেলেন; কিন্তু আমি সেখানে এক বছরও কাজ করতে পারলাম না। আমার সঙ্গে বনিবনা হলো না। আমি কাজ ছেড়ে দিলাম। ১৯৬১ সালে আমি আবার ফুলটাইম বেকার হয়ে পড়লাম। বেকার হয়ে যাওয়ার কারণে আমার আড্ডাও গেল বেড়ে। তখন চিত্রালীতে খুব আড্ডা হতো। অবজার্ভার ভবন থেকে অবজার্ভার, পূর্বদেশ আর চিত্রালী বের হতো। তো একদিন অবজার্ভারে আড্ডা দিচ্ছি। সে সময় সেখানে এসে হাজির হলেন অবজার্ভারের ম্যানেজিং এডিটর আবদুল গনি হাজারী। উনি আমাকে আড্ডা মারছি দেখে বললেন, ‘তুমি কি কোথাও কাজ-টাজ করো?’ আমি বললাম, ‘না। ফুলটাইম বেকার।’ তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি কি অবজার্ভারে জয়েন করবে?’ আবদুল গনি হাজারীর প্রস্তাবে আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। এটা ১৯৬৩ সালের কথা। বলা হয়নি, এ সময় আমি হুট করে বিয়েও করে ফেলেছি। ফলে একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ছিলাম। সংসার, বাড়িভাড়ার খরচ সামলাতে হিমশিম খাই। অবজার্ভারে চাকরি হয়ে যাওয়ায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।
একবার এক একুশে ফেব্র“য়ারিতে প্রেসক্লাবে বসে আড্ডা মারছি, তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন অবজার্ভারের নিউজ এডিটর এবিএম মূসা। আমাকে দেখে তিনি বললেন, ‘কাইয়ুম, তুমি কি প্রেসক্লাবের সদস্য?’ আমি বললাম, ‘না।’ তারপর মূসা ভাই বললেন, ‘তুমি অবজার্ভারের আর্টিস্ট অথচ প্রেসক্লাবের সদস্য না – এটা কি কখনো হয়?’ তারপর মূসা ভাই আমাকে প্রেসক্লাবের সদস্য করে নিলেন। সেদিন ছিল ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি। তখন প্রেসক্লাবে আড্ডা মারতেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সালাম সাহেব, এমআর আখতার মুকুল, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ওবায়েদ-উল হকসহ আরো জাঁদরেল সব সাংবাদিক। অবজার্ভারে যখন কাজ করতাম তখন মাঝেমধ্যে ওবায়েদ-উল হক সাহেব আমাকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠাতেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি বেশ গল্প করতেন। অসম্ভব সিনেমাপাগল মানুষ ছিলেন তিনি। কখনো কখনো তিনি আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। মনে আছে তাঁর সঙ্গে একবার লাভ ইন দ্য আফটারনুন ছবিটি দেখেছিলাম। অড্রে হেপবার্ন ছিলেন নায়িকা আর নায়ক ছিলেন গ্যারি কুপার।
আমি অবজার্ভারের সানডে ম্যাগাজিন আর চিত্রালীর কাজ করতাম। থাকতাম নয়াপল্টনে। আমার বাসা থেকে জয়নুল আবেদিন স্যারের বাসা খুব একটা দূরে নয়। মাঝখানে একটা পুকুর ছিল। পুকুরের এপারে জয়নুল আবেদিন আর ওপারে আমি। তখন রোববার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ছুটির দিন হলেই আবেদিন স্যারের বাড়ির সামনে একটা রক ছিল, সেখানে জম্পেশ আড্ডা জমত। রকে বসে সেসব আড্ডায় যোগ দিতেন মনসুরউদ্দীন (হারামণি খ্যাত), কবি জসীমউদ্দীন, কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, কামরুল হাসানসহ আরো অনেকে।
অবজার্ভারের পাশাপাশি আরো দু-এক জায়গায় টুকটাক কাজ করছি। বাড়িভাড়া, সংসার খরচ, আড্ডার খরচ – সব মিলিয়ে টাকার চিন্তাটা মাথায় ছিলই। একদিন আমি এক রোববার আবেদিন স্যারের বাসায় গিয়েছি। সেদিন আড্ডায় কেউ আসেননি। স্যার আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বললেন – কী করছি খোঁজখবর নিলেন। স্যার জানতেন আমি অবজার্ভারে কাজ করি। এর মধ্যে স্যার হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘আচ্ছা, আইজকা তোমাগো পত্রিকায় একটা ইলাস্ট্রেশন দেখলাম নৌকার গলুইয়ে মাছের চোখ। খুব সুন্দর ছবি তো? কে আঁকছে তুমি জানো?’
আমি বললাম, ‘স্যার, আমি এঁকেছি।’
স্যার তখন বললেন, ‘এই নৌকা তুমি কই দেখলা?’
আমি বললাম, ‘সিলেটে এ ধরনের নৌকা দেখা যায়।’
স্যার বললেন, ‘তুমি তো এই রকম গলুইয়ে মাছের চোখের ছবি নিয়া কাজ করতে পারো। দুইটা নৌকা, চারটা মাছের চোখ। তিনটা নৌকা ছয়টা মাছের চোখ, অনেকগুলা নৌকা অনেকগুলা চোখ, নৌকাগুলা যখন পানির স্রোতে আগাইয়া যাইব তখন পানির কাঁপনে মাছের চোখও দেখবা কেমন কাঁপব – এইসব নিয়া কাজ করতে পারো না?’
আবেদিন স্যারের কথায় আমার চোখের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি তখন দেখলাম, নদীর পানিতে নৌকা ভাসছে। গলুই ভাসছে। গলুইয়ের সামনে মাছের চোখও ভাসছে। নদীতে পানির কাঁপন – সেই কাঁপনে মাছের চোখেও কাঁপনের ধারা। আমার কী হলো স্যারের এ কথার পর আমি আর স্যারের বাসায় থাকলাম না। দ্রুত চলে এলাম নিজের বাসায়। ডিজাইন সেন্টারের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়াতে পেইন্টিং করা আমার একরকম বন্ধই ছিল। চাকরির পাশাপাশি দুটি বাড়তি উপার্জনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে করতে পেইন্টিং করা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আবেদিন স্যারের কথায় আমার মধ্যে যেন হুঁশ ফিরল। আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘরে ঢুকেই বউকে বললাম, আমার ইজেল কই? ক্যানভাস কই? আমার এ রকম অস্বাভাবিক আচরণে বউও যেন একটু অবাক হলো। সে আমাকে দেখে ভাবল, আরে! লোকটার কী হলো! বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই কিনা জানতে চাইছে ইজেল কই? ক্যানভাস কই?
আমার বউ আমার এ রকম অদ্ভুত আচরণ দেখে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে?’
আবেদিন স্যারের কথায় আমার মাথার মধ্যে কাজ করার উদগ্র বাসনার বিষয়টা জেঁকে বসল। সেদিন ঘরে ফিরে গিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করে দিলাম। আমার সারাদিনের রুটিন বলতে সকালবেলা উঠে অবজার্ভারে যাই কাজ করতে। অবজার্ভার থেকে আড্ডায় না গিয়ে সোজা বাসায় ফিরি – বাসায় ফেরার পথে রায়সাহেব বাজার থেকে ঘরের জন্য বাজার করে নিয়ে আসি। বাজার এনে বউয়ের হাতে দিয়ে বলতাম, আমাকে এক কাপ চা দাও। এক কাপ চা খেয়ে সন্ধ্যার আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম। রাত ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠে ভাত খেয়ে ছবি আঁকতে বসতাম। সারারাত কাজ করতাম। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকাল দশটার দিকে উঠে নাশতাপানি খেয়ে অফিসে চলে যেতাম। এভাবেই চলতে লাগল আমার দিনকাল।
একদিন আমি আবেদিন স্যারের বাসায় গেলাম। আমাকে পেয়ে তিনি বললেন, ‘কী ব্যাপার, রাইতের বেলা তুমি কী এত কাম করো! সারারাইত দেহি তোমার ঘরের বাতি জ্বালাইন্যা। তুমি কি রাইতে ঘুমাও না? আমি রাইত বারোটায় বাথরুমে গেলেও দেহি তোমার ঘরের বাতি জ্বালাইন্যা, রাইত তিনটার সময়ও দেহি একই কারবার – ঘটনা কী?’
আমি বললাম, ‘স্যার, কাজ করি।’
আবেদিন স্যার আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে আমাকে আরো ভালো করে দেখতে লাগলেন। কিছু বললেন না।
সে সময় ছুটির দিন আমি বউকে নিয়ে প্রায়ই আজিমপুরে শ্বশুরবাড়ি যেতাম। সারাদিন থেকে রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়া করে অনেক রাতে ঘরে ফিরতাম। একদিন রাত বারোটার দিকে আমার বাসায় ফিরেছি, হঠাৎ দরোজায় কে যেন নক করছে। আমি ভাবলাম, এত রাতে আবার কে এলো? দরোজা খুলে দেখলাম আবেদিন স্যারের ছোট ভাই জোনাবুল ইসলাম দরোজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁকে দেখে অবাক। বললাম, ‘এত রাতে কী ব্যাপার!’
জোনাবুল ইসলাম বললেন, ‘মিয়া ভাই আপনেরে ডাকছে। কী জানি জরুরি কথা আছে।’
জোনাবুল ইসলামের কথা শুনে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। এত রাতে স্যার আমাকে ডাকছেন কেন?
জোনাবুল ইসলামের সঙ্গে আমি আর আমার বউ রাত বারোটায় স্যারের বাসায় গিয়ে দেখি স্যার লুঙ্গি আর কাঁধে গামছা নিয়ে রকে বসে আছেন। সিগ্রেট টানছেন। স্যার আমার দিকে তাকালেন।
আমি স্যারের কাছে গেলাম। স্যার আমার দিকে এগিয়ে এসে করলেন কি, বেশ জোরে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কাইয়ুম, তুমি লাহোরে অল পাকিস্তান ন্যাশনাল এক্সিবিশনে ফার্স্ট প্রাইজ পাইছ। ওরা সন্ধ্যার সময় আমারে টেলিগ্রাম কইরা তোমার খবর জানাইছে। সন্ধ্যার থেকা আমি তোমাকে খুঁজতাছি।’
সেই রাতে স্যারের থাপ্পড় খেয়ে আমার টনক নড়ল। নৌকার গলুই, মাছের চোখের ছবি এঁকে আমি পুরস্কার পেয়েছি। সেই থেকে আমি আর কখনো বসে থাকিনি। আমি যতেœর সঙ্গে আমার কাজটা করে গেছি। কাজের ক্ষেত্রে কোনো আপস করিনি।
প্রশ্ন : আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। ছাত্রদের কাছেও আপনি অসম্ভব জনপ্রিয় – এই জনপ্রিয়তার কারণ কী?
কাইয়ুম চৌধুরী : আসলেই শিক্ষকতার সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন ধরে জড়িয়ে আছি। আমার শিক্ষকতার পেশায় আসার পেছনেও কিন্তু জয়নুল আবেদিনের সরাসরি হাত ছিল। আগেই বলেছি, প্রথমবার আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলাম ১৯৫৮ সালে। তখন সেখানে তিন বছর চাকরি করার পর নানা কারণে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাইরে গ্রাফিক্সে নানা ধরনের কাজ করেছি। পত্রিকার কাজ করেছি, প্রকাশনার কাজ করেছি, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। এভাবে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অনেক ধরনের কাজ করেছি।
আমি তখন থাকি নয়াপল্টনে। আগেই বলেছি, আমার বাসা জয়নুল আবেদিন স্যারের বাসার পেছনে ছিল। আর্ট কলেজের চাকরি ছেড়ে দিলেও জয়নুল আবেদিন স্যার আমার খোঁজখবর ঠিকই রাখতেন। আমিও প্রায়ই স্যারের বাসায় যেতাম আড্ডার লোভে! এর মধ্যে লাহোরে অল পাকিস্তান ন্যাশনাল এক্সিবিশনে ফার্স্ট হওয়ার পর আমি জয়নুল আবেদিন স্যারের বাসায় গেলে স্যার একদিন আমাকে একা পেয়ে বললেন, ‘কাইয়ুম, তুমি কি আবার আর্ট কলেজে চাকরি করবা?’
স্যারের কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, ‘স্যার, সরকারি চাকরি একবার ছেড়ে দিলে কি আবার তাতে যোগদান করা যায়?’
স্যার বললেন, ‘যোগদান করণ যায় কি না যায় সেইটা আমি দেখুম।’
আমি তখন বললাম, ‘অবশ্যই আমি আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করব।’
১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বার আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। আমার বিষয় ছিল পেইন্টিংস কিন্তু আমি যোগদান করলাম গ্রাফিক ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে।
আমি ছাত্রদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় কিনা তা বলতে পারব না। তবে আমি যখন ক্লাসে ঢুকি তখন আমি ছাত্রদের নার্ভটা বোঝার চেষ্টা করি। ছাত্রদের কাছে আমি কখনো বড় বড় তত্ত্বকথা ঝাড়ি না, সোজা ভাষায় ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করি। ছাত্রদের ভালো কিছু শেখানোর চেষ্টা করেছি। আর ছাত্রদের সবসময়ই আমি বলি, তোমরা ছবি আঁকাটা ভালো করে শেখো; পাশাপাশি সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমাসহ সংস্কৃতির নানা অঙ্গনের বিষয়ও বোঝার চেষ্টা করবে। জয়নুল আবেদিন স্যার আমাদেরকে সবসময়ই একটা কথা বলতেন, ভালো ছবি আঁকতে পারলেই কিন্তু ভালো শিল্পী হওয়া যায় না। জয়নুল আবেদিন স্যার যখন কলেজ থেকে আমাদের পিকনিকে নিয়ে যেতেন তখন সবসময়ই আমাদের সঙ্গে নামকরা সব মানুষদের নিয়ে যেতেন। কবি জসীমউদ্দীন, সঙ্গে হারমোনিয়াম ঘাড়ে আবদুল আলীম, প্রফেসর অজিত গুহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীন, ঢাকার ডিসি প্রায়ই আমাদের সঙ্গী হতেন। পরে বুঝেছি স্যার উনাদের নিয়ে যেতেন আমাদের এনলাইটেন্ড করার জন্য। সে সময় আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে ক্লদ কোলভিন নামে এক কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি খুব ভালো নিগ্রো স্পিরিচুয়াল গান গাইতে পারতেন। স্যার একবার তাঁকে নিয়ে এলেন – আমরা সেই তখন তাঁর মাধ্যমে পল রবসনের নাম জানলাম।
প্রশ্ন : শিক্ষকতার পাশাপাশি আপনি বহুমাত্রিক কাজের সঙ্গেও জড়িত। এত সময় বের করেন কীভাবে? নাকি নেশার ঘোরে এসব বহুমাত্রিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন…
কাইয়ুম চৌধুরী : এক কথায় বলতে পারো নেশার ঘোরে। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে থেকে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডায় পড়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, সেই আড্ডাটা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল, যা আমি আর্ট কলেজ থেকে শিখতে পারিনি। একসময় সন্ধানীর জন্য অনেকটা সময় নিঃস্বার্থভাবে দিয়েছি। একটা ভালো, সৃজনশীল কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারলে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। এমনও দেখা গেছে, সন্ধ্যায় অবজার্ভারের প্রেসে গিয়েছি সন্ধানী ছাপাতে – সারারাত প্রেসে দাঁড়িয়ে থেকে সকালে ছাপা ও বাঁধানো হওয়া সেই পত্রিকা নিয়ে ঘরে ফিরেছি। সেই নেশাটা এখনো আমার মাথার ভেতরে কাজ করে। এখনো আমি অনেক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রেখেছি।
প্রশ্ন : আপনাদের আগে জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া প্রমুখের কাজের একটা নিজস্ব ধরন, ঢং বা ভড়ৎস ছিল। আপনারা এসে সেই ধরন বা ভড়ৎস থেকে সরে গিয়ে একটা নতুন ধরন বা ভড়ৎস-এর সৃষ্টি করলেন। তো এই নতুন ঢং বা ধরনের মাধ্যমে আপনারা শিল্পকলায় কী বার্তা দিলেন?
কাইয়ুম চৌধুরী : মানুষের জীবন তো চলমান আর শিল্পীর জীবন তারও চেয়ে বেশি চলমান। সে সর্বক্ষণ তার মতো করে চলতেই থাকে। একজন শিল্পীর থেমে যাওয়া হলো তার মৃত্যু হয়ে যাওয়া। আমাদের আগে জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের কাজের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। এই দুজনই বাংলার লোকশিল্পকে ঘিরে কাজ করতেন। তাঁদের কাজের মধ্যে আলাদা ঘ্রাণ বা সুর বা টোন থাকত, যা আমাকে আকর্ষণ করত। বিশেষ করে কামরুল ভাই লোকশিল্প থেকে কাজ করতেন – আমি তাঁর ছবি দেখে মুগ্ধ হতাম। একটা সময় নিজের একটা ঢং তৈরি করতে চেষ্টা করতাম, যা হবে আমার একান্ত নিজের। এখানে আরো একটা ব্যাপার, আমার ব্যাচের অনেকেই শিল্পকলায় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলেন – আমার কিন্তু যাওয়া হয়নি। সুযোগ আসেনি। নিজেকে সান্ত্বনা দিতাম এই বলে – ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি রয়ে যাব এই বাংলার পারে’। তাই আমার কাজে বারবার দেশের মাটি, রং, ঘ্রাণ এসেছে নানাভাবে।
একজন শিল্পী তো হুট করে একদিনে তাঁর কাজের ধরন বা ফর্ম তৈরি করতে পারে না। কাজের এই ফর্মটা আস্তে আস্তে তৈরি করতে হয়। তবে নিজের একটা ইনডিভিজুয়াল ফর্ম তৈরি করতে না পারলে শিল্পীর নিজস্বতা থাকে না। সব শিল্পীরই একটা নিজস্বতা থাকা দরকার। নিজস্বতা থাকার পাশাপাশি শিল্পীকে তাঁর বাইরে গিয়ে কাজ করার মুনশিয়ানা দেখানোর যোগ্যতাও রাখতে হবে। এখন আমার ছবিতে সিগনেচার না করলেও বোঝা যাবে এটা আমার ছবি। এখন ছবির মধ্যেও শিল্পীদের একটা ব্র্যান্ড তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারছি না। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে একটি অসাধু চক্রের কল্যাণে আমাদের অনেক শিল্পীর ছবি কপি হয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, যা দুঃখজনক। এতে শিল্পীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রশ্ন : শিল্প-সমালোচকদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, শিল্পী নিত্যনতুন মাত্রায় তাঁর কাজ করবেন। বহুমাত্রিকতা তাঁর কাজের অনুষঙ্গ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অনেক শিল্পী ‘টাইপড’ হয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা একই রকম কাজ করতে থাকেন, যা তাঁকে নির্দিষ্ট করে তোলে। শিল্পীদের এই ‘টাইপড’ হয়ে যাওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন? শিল্পীর এই ‘টাইপড’ হয়ে যাওয়া কি তাঁর ব্যর্থতা না সীমাবদ্ধতা?
কাইয়ুম চৌধুরী : শিল্পীদের ‘টাইপড’ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি না। অবশ্য এর কারণ আছে। একজন শিল্পীকে তাঁর কাজের ক্ষেত্রে বারবার পরিবর্তন আনা দরকার। কেউ কেউ হয়তো সেই পরিবর্তনটা আনতে পারেন না, তবে তাঁর মধ্যে পরিবর্তনের চেষ্টাটা থাকা দরকার। আর চেষ্টার পরও যদি কেউ পরিবর্তনটা আনতে না পারেন তবে সেটা তাঁর ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে হবে। কখনো কখনো শিল্পীর অজান্তে কেউ কেউ ‘টাইপড’ হয়ে যান। শিল্পীর উদ্ভাবনী ক্ষমতার ঘাটতি থাকলে তিনি এমনিতে ‘টাইপড’ হয়ে যাবেন। যেমন আমি ‘টাইপোগ্রাফি’ (ঞুঢ়ড়মৎধঢ়যু) নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। শিল্পীদের মধ্যে ভাঙাচোরার এই মানসিকতা থাকতে হবে। বর্তমানে আমার ছবির বিষয়বস্তুতে এসেছে লোকশিল্পের নকশা। নকশাধর্মী গাছ, পাখি, মানুষ, চাঁদ, সূর্য লোকশিল্পীরা যেভাবে তাঁদের কাজে ব্যবহার করেছেন, যেমন নকশি কাঁথা, নকশি পিঠা, লক্ষ্মীর সরা, শখের হাঁড়ি, সেই ফর্মগুলোকে আমি আমার মতো করে ক্যানভাসে উপস্থাপন করছি। জানি না কতদূর এগোতে পারব।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার অনেক পূর্ব থেকে আপনি এদেশের প্রকাশনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে আমাদের প্রচ্ছদশিল্প আপনার হাতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে আপনি প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, এখনো করে যাচ্ছেন – প্রচ্ছদ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
কাইয়ুম চৌধুরী : আগেই বলেছি, ছোটবেলায় দেব সাহিত্যকুটিরের বইয়ে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ দেখে মনের মধ্যে একটা লালিত স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে তাঁর মতো শিল্পী হতে পারলে জীবন সার্থক হবে। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন আমার মধ্যে ছিলেন। প্রতুলের পর প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় আমাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন। সিগনেট থেকে প্রকাশ হওয়া বইপত্রে সত্যজিতের অসাধারণ সব প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন দেখে মাথা খারাপ হয়ে যেত। সত্যজিতের সব কভার দেখে মনে হয়েছে তিনি পুরো বইয়ের কনটেন্টকে (ঈড়হঃবহঃ) প্রচ্ছদের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছেন। একবার সত্যজিতের সঙ্গে দেখা হলে আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনার প্রচ্ছদ দেখে মনে হয় পুরো বইয়ের কনটেন্টকে আপনি কীভাবে বইয়ের প্রচ্ছদে আনেন? টাইপোগ্রাফি নিয়ে আপনার কাজগুলোও আমার ভীষণ ভালো লাগে।’
সত্যজিৎ রায় টাইপোগ্রাফি নিয়ে বললেন তাঁর শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কথা। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়
শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন। বিশ্বভারতী পত্রিকার লোগো উনার করা। সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন, তিনি টাইপোগ্রাফি নিয়ে যা করেছেন তার সবই তাঁর শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছিলেন। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সত্যজিৎ দি ইনার আই নামে একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন।
প্রশ্ন : প্রচ্ছদের কথা যখন এসেই গেল তখন আপনি কি বলবেন, আমাদের প্রচ্ছদশিল্প কি তার নান্দনিকতার সীমা অতিক্রম করেছে? আপনাদের পর কাদের প্রচ্ছদ আপনার কাছে ভালো লাগে?
কাইয়ুম চৌধুরী : আমার আগেও অনেকে অনেক অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন। জয়নুল আবেদিন আর কামরুল হাসান প্রচ্ছদে অনেক ভ্যারিয়েশন এনেছিলেন। তাঁরা প্রচ্ছদে বৈচিত্র্যও দেখিয়েছেন। জয়নুল আবেদিন-কামরুল হাসানদের প্রচ্ছদ দেখে আমরা প্রচ্ছদ করার সাহস পেয়েছিলাম। শুধু প্রচ্ছদে কেন, শিল্পকলায় নান্দনিকতার সীমা অতিক্রম করার কোনো কিছু নেই। কালাম মাহমুদ, রফিকুন নবী, হাশেম খান, কাজী হাসান হাবীব, সমর মজুমদার, ধ্র“ব এষ, অশোক কর্মকার – এঁদের কাজ আমার ভালো লাগে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অলংকরণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সুবিধার আশ্রয় নিয়ে কিছু শিল্পী তাঁদের মেধাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছেন বলে আমার মনে হয়।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ – দুটোর প্রত্যক্ষদর্শী আপনি। তখন কীভাবে আপনার দিন কেটেছে? তখন কোথায় ছিলেন আপনি?
কাইয়ুম চৌধুরী : ভাষা আন্দোলনের সময় আমি আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমরা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও আমাদের বন্ধু মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন প্রমুখ প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তবে যেদিন অর্থাৎ একুশে ফেব্র“য়ারি ঢাকায় গুলি হলো সেদিন নিমতলী জাদুঘরে আমাদের একটা চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। উদ্বোধন করার কথা ছিল তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী মিসেস নূনের। পরে আর সেটা হয়নি – ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজার রোডে। আমার শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমাদের আজিমপুরের বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা। বাড়ি ছাড়তেও হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় বোনের সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতেও ছিলাম বেশ কিছুদিন। এখনো একাত্তরটা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে আছে।
প্রশ্ন : একজন মনোযোগী পাঠক হিসেবে সব মহলে আপনার সুনাম আছে। আমরা জানি, আপনি এখনো প্রচুর পড়াশোনা করেন। সর্বশেষ কার বই পড়লেন?
কাইয়ুম চৌধুরী : আমার বাসায় চিত্রকর্মের চেয়ে বইয়ের সংখ্যা সবসময়ই বেশি ছিল। এখন আগের মতো আর পড়াশোনা অতটা করতে পারি না। এত বেশি কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি যে, ঠিকমতো সময় বের করে উঠতে পারি না। সর্বশেষ পড়েছি অতুলপ্রসাদ সেনকে নিয়ে অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের লেখা স্মৃতিকথা। পাহাড়ি সান্যাল নামকরা অভিনেতা ছিলেন। তিনি অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে গান শিখেছিলেন। পাহাড়ি সান্যাল গানও গাইতেন চমৎকার। অভিনেতা হওয়ার আগে তিনি গায়ক হিসেবে বেশি নাম কুড়িয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে পাহাড়ি সান্যালের গান নিয়েছিলেন। স্মৃতিকথাটা অসাধারণ। একটা সময় ছিল যখন আমি গল্প, উপন্যাস, প্রচুর পড়তাম। এখন বেশি বেশি পড়ি আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণমূলক, প্রবন্ধ, ইতিহাসনির্ভর লেখা।
প্রশ্ন : অবসর সময়ে কী করেন? চলচ্চিত্র আর সংগীতের প্রতি রয়েছে আপনার প্রগাঢ় ভালোবাসা। এসব কি একজন শিল্পীকে তাঁর সৃষ্টিতে সহায়তা করে?
কাইয়ুম চৌধুরী : আমি ছোটবেলা থেকেই গান আর চলচ্চিত্রের পোকা ছিলাম। ময়মনসিংহ থেকে আমরা ১৯৪৮ সালে ঢাকায় চলে আসি। সে সময় ঢাকায় এখন যেখানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সেখানে ব্রিটানিয়া বলে টিনের চালার একটা হলঘর ছিল, যেখানে ইংরেজি ছবি দেখানো হতো। ব্রিটানিয়া হলঘরের সামনে লেখা থাকত হাউস অব ইংলিশ মুভিজ। এখন আমরা সিনেমার যে পোস্টার দেখি তার মাপ ২৩-৩র্৬র্ । কিন্তু সে সময় পোস্টারের মাপ ছিল ২৩-৩র্৬র্ র চার গুণ বড়। সেসব বড় বড় পোস্টার দেখলে ছবি দেখার খুব ইচ্ছে হতো।
এখনো আমি পুরনো দিনের হলিউডের যেসব ছবি দেখেছি তার ডিভিডি জোগাড় করে দেখি আর পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করি। জীবনের এতগুলো সময় পার করে এখন মনে হয়, ফেলে আসা দিনগুলোই আসলে জীবনের সেরা সময়।
পুরনো বাংলা গান শুনি, বাংলা ছবি দেখি। ফিরে যাই কৈশোরে, ফিরে যাই যৌবনে। টাইম মেশিনে ভর করা আর কি। 

Leave a Reply