logo

কাইয়ুমের কাজের দিকে তাকিয়ে

বো র হা ন উ দ্দি ন খা ন জা হা ঙ্গী র
কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম থেকেই লোকজ ঐতিহ্যের মধ্যে কাজ করেছেন, লোকজ ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক ব্যবহার করে লোকজ রীতি শক্তিশালী করেছেন, তিনি ভেবেছেন হয়তো এভাবে শিল্পকে সর্বজনীন করা যায়। তিনি চোখে তুলে এনেছেন প্রকৃতি এবং নিসর্গ, তিনি গুনগুন করে বলেছেন : গোলাপ তো গোলাপ তো গোলাপই; নদী তো নদী তো নদীই। তিনি কল্পনা করেছেন প্রকৃতি এবং নিসর্গের রূপান্তর, কিন্তু লোকজ রীতি তাঁকে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শোনায়নি। তিনি ধার করেছেন লোকজ ঐতিহ্য থেকে লোকজ বিষয়, এবং লোকজ বিষয়কে তিনি শতবার শতভঙ্গিতে এঁকেছেন। এই অাঁকাকে তিনি পেইন্টেড ইমেজ এবং রিয়ালিটির সম্পর্ক ভেবে লোকজ বিষয় ভেঙেছেন, লোকজ বিষয় তাঁর কাছে মনে হয়েছে অফুরন্ত। অফুরন্ত বিষয় পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে তাঁর চোখ, তাঁর কবজির জোর, আবেগের ঐকান্তিকতা।
কাইয়ুমকে কি ইম্প্রেশনিস্ট বলা যায়? বলাটা বোধহয় অমূলক নয়। তিনি সবসময় সাবজেকটিভিটির প্রাকার ভেঙেছেন। এই ভাঙার প্রয়াসই লোকজ বিষয়, ভাঙার প্রয়াস। তাঁর দিক থেকে তাঁর মেজাজের ভূমিকা একটা বড়ো ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মেজাজের ভূমিকা পর্যবসিত হয়েছে দেখার ধরনের ভেতর। দেখার ধরনটা হচ্ছে প্রকৃতি কিংবা নিসর্গের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। যোগাযোগ কিংবা মেলবন্ধন তাঁর চোখকে সমন্বয়ের দিকে নিয়ে গেছে। বিষয় বাদে, বলা যায় লোকজ বিষয় বাদে তিনি অসহায়। বিষয়ের জায়গায় তিনি কি রাখবেন। প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ তিনি সবসময় স্টাডি করেছেন। এই স্টাডি অসম্ভব শক্তি নিয়ে তাঁর কাজে উৎসারিত হয়েছে। তাঁর চোখ কিংবা প্রকৃতির মহানতা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। নারী এবং তার পর্ণকুটির, কৃষক এবং তার পশু, নদী এবং তার নৌকো : এসব বিষয়ের পরম্পরতা তিনি বারবার এঁকেছেন, অফুরন্ত মমতায় তাঁর রেখা এবং রং এসব বিষয় তাঁকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। যেন বিষয় ঈশ্বরকে তৈরি করেন আর ঈশ্বর বিষয়কে বহুবিস্তৃত করে দেন। তাঁর বিষয়ের দিকে তাকালে আমি আশ্বস্ত হই। বাস্তবতাকে আমি খুঁজে পাই। লোকজ বিষয়ের মধ্যে আমি একটি থেরাপিউটিক ক্ষমতা আবিষ্কার করি। এ কারণে কাইয়ুমের কাজ পপুলার।
কাইয়ুম কি জয়নুলের উত্তরসূরি? জবাবটা আংশিক সত্য। জয়নুল যেভাবে রিয়ালিটি দেখেছেন, সেভাবে কাইয়ুম দেখেননি। জয়নুলের কাছে রিয়ালিটি মেটাফিজিক্যাল। এই অবস্থান থেকে জয়নুল শ্রমজীবী মানুষ এঁকেছেন আর সেখানে কাইয়ুম এঁকেছেন নিসর্গ, তার নিসর্গে ছড়ানো লোকজ ঐতিহ্য উৎসারিত বিষয়। জয়নুল নিসর্গে ছড়ানো বিষয়ের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন শ্রমজীবী মানুষের ওপর। এই মানুষগুলি পরিশ্রম করে করে ফতুর হয়ে যাচ্ছে, তাদের চোখে বুকে ঘ্রাণে পরিব্যাপ্ত একটা শূন্যতা, এই শূন্যতা উড়ে এসেছে ‘না’ থেকে, অনিঃশেষ কোথাও-না থেকে। এই শূন্যতা মৃত্যুর নয়, এই চতুর্দিক ব্যাপ্ত শূন্যতা জয়নুল এঁকেছেন, আশাহীন ভরসাহীন অস্তিত্ব। শ্রমজীবী মানুষটার শ্রম খসে খসে পড়ে যাচ্ছে, তাকে উদ্ধার করার কেউ নেই, না ঈশ্বর না প্রকৃতি না নিসর্গ। তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবি কিংবা খেয়াপারের প্রতীক্ষা কিংবা নবান্ন কিংবা মনপুরা : সবকিছু থেকে ধ্বনিত ‘না’, সবকিছু থেকে ধ্বনিত আশাহীন ভরসাহীন অস্তিত্ব। এই মানুষগুলো মেহনত করে কোথাও পৌঁছোয় না। এই মানুষগুলিকে ঘিরে আছে ধ্বংস। জয়নুলের রিয়ালিটি এ কারণে মেটাফিজিক্যাল। অন্যদিকে ভারতীয় রিয়ালিটির মেটাফিজিক্যাল দিক এঁকেছেন মকবুল ফিদা হুসেন, নারী শরীরে উন্মোচিত করেছেন নান্দনিকতা, ব্যক্তি নারী মিলে গেছে পৌরাণিক নারীতে, আবার পৌরাণিক নারীতে উন্মিলিত বাস্তব নারী, এই রিয়ালিটির ভিত্তিকেন্দ্র মূল মেটাফিজিক্যাল। কাইয়ুম উধাও করেছেন জয়নুলের রিয়ালিটির মেটাফিজিক্যালিটি, একই সঙ্গে হুসেনের রিয়ালিটির পৌরাণিকতা স্বীকার করেননি। তিনি বারবার গেছেন নিসর্গের রিয়ালিটির কাছে, নিসর্গে তিনি ভরে দিয়েছেন লোকজ বিষয় আর লোকজ বিষয়ের শেষ নেই, অফুরন্ত তার উৎসধারা। এই জন্য কি তিনি একই বিষয় বারবার এঁকেছেন,
ক্লান্তিহীনভাবে? নারীর বসে থাকার ঢং, কিংবা গরুর হাম্বা চিৎকার খানাখন্দ খেতখামার ঢেকে দিচ্ছে, কিংবা নদীর ঢেউ মিলিয়ে দিচ্ছে নারীর শরীর : এই রিয়ালিটির মধ্যে জয়নুলের কিংবা হুসেনের দার্শনিকতা নেই, তিনি চোখ মেলে বারবার গেছেন একই বিষয়ের কাছে।
কিন্তু আশি বছরে পৌঁছে তিনি বদলে নিলেন সবকিছু। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে আনলেন। কতগুলো প্রশ্ন তিনি নিজেকে করা শুরু করেছেন। লোকজ ঐতিহ্য, লোকজ রীতি, লোকজ বিষয়ের ব্যবহার কি স্থানিকতা নয়? লোকজ বিষয়, লোকজ রীতি, লোকজ ঐতিহ্য কতদূর পর্যন্ত গ্লোবালাইজেশনের বিরোধী? এটা কি সত্য নয় বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা শিল্পের স্বাভাবিক প্রবণতা? এই প্রবণতার চারপাশে কি দেয়াল তোলে না পুনরাবৃত্তিত লোকজ বিষয়? কোনো সংস্কৃতি স্থানিকতা দ্বারা আবদ্ধ নয়, সেজন্য ব্রিটিশ আমলের স্থানিক রীতি শিল্পীরা বাদ দিয়ে অগ্রসর হয়েছেন (হাভেল কিংবা অবনীন্দ্রনাথ অনুসৃত হননি)। ঢাকায় জয়নুলরা লোকজ রীতি ভেঙেছেন এবং লোকজ বিষয় বারবার ব্যবহারে ক্লান্তি বোধ করেছেন। তার একটা কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্প পরস্পরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, মিলে যাচ্ছে, আমাদের নিজস্ব শিল্প নিজের আর থাকছে না, আমাদের শিল্প সবার শিল্প হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের ইতিহাসে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং শৈল্পিক মেলবন্ধনের বহু নজির আছে।
এভাবে আমাদের অস্তিত্বের বহু ব্যাখ্যা খুঁজে পাই। বহু ব্যাখ্যা হচ্ছে সময় ও স্থানের স্মৃতি ও কল্পনার বিবিধ সূত্র। সকল সংস্কৃতি সার্বক্ষণিক ঘূর্ণনের বিষয়। স্থানিক সংস্কৃতি কিংবা লোকজ সংস্কৃতির বিভিন্ন ইমেজ এবং টেক্সট পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের ঘিরে ধরে। সেজন্য ইতিহাস, লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাস খন্ড খন্ড হয়ে যায়। এ সমস্যা একদিকে জয়নুল, অন্যদিকে কাইয়ুম টের পেয়েছেন। তার দরুন এ রিয়ালিটি দেখার ধরন সমগ্র হারায় এবং খন্ড খন্ড হয়ে যায়। খন্ড খন্ড রিয়ালিটির কোনো কেন্দ্র নেই। কেন্দ্রহীন রিয়ালিটি দীর্ঘদিন ধরে বিষয় দিয়ে ভরেছেন কাইয়ুম। লোকজ ঐতিহ্য, লোকজ রীতি, লোকজ বিষয়, তাঁকে নান্দনিক করেছে। কিন্তু নান্দনিকতা তো শিল্পের সবকিছু নয়।
আমরা আইডেনটিটির পলিসেন্ট্রিক সার্কেলের মধ্যে বসবাস করি। আমরা আস্তে আস্তে উপলব্ধি করি, যেমন কাইয়ুম করছেন, ফর্ম এবং কন্টেন্টের শুদ্ধতা, আসলে একটা নন-কনসেপ্ট, প্রতিটি সাংস্কৃতিক ফর্ম (লোকজ ফর্ম, লোকজ রীতি, লোকজ বিষয়) মূলত সংকর, বিভিন্ন ফর্মের মেলবন্ধন। এখানে পৌঁছেই কাইয়ুম নিজের পুরনো কাজের দিকে চোখ ফিরে তাকিয়েছেন। লোকজ বিষয় ছেড়ে অগ্রসর হওয়ার পথ কোন দিকে। কিংবা বিষয়হীনতা কি ঠিক রাস্তা?
আশি বছরে পৌঁছে কাইয়ুম ভিন্নভাবে প্রকৃতিকে জিতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতি হচ্ছে সিলিন্ডার, স্ফিয়ার, কোণ : সবকিছুই এসবের মধ্য দিয়ে জিতে নেওয়া যায়। বিষয়হীনতা হচ্ছে প্রকৃত বিষয়; সেজাঁ যেমন বুঝেছেন। মনে হয় সবই সরল, সরলীকরণের রাস্তা চতুর্দিকে ছড়ানো। কিন্তু তা কতটুকু সত্য? বিষয়ের ঐতিহ্যিক জটিলতা বাদ দিয়ে তিনি রিয়ালিটির জটিল ইমেজের ভেতর রাস্তা খুঁজেছেন। তিনি ফর্মগুলোকে কিউব, কোণ, সিলিন্ডারের বিভিন্ন সমাবেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি গাছপালা নদী নারী পশুপাখি না খুঁজে, একটা চেষ্টার মধ্যে নিজেকে যুক্ত করেছেন। চেষ্টাটা হচ্ছে যিনি দেখেন এবং যা দেখা হয়, তার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করা। এই সম্পর্ক বিষয়ের মধ্যে দিয়ে হতে হবে, যা কিনা কাইয়ুম করেছেন আশি বছরের পূর্ব থেকে। বিষয়হীনতা নিয়েও সম্পর্ক তৈরি করা যায়। প্রকৃতির রেফারেন্স বাদ দিয়ে স্পেস ব্যবহার করার দিকে কাইয়ুম ঝুঁকেছেন। এ বাস্তবতা হয়তো তাঁর চোখে প্রকৃতি-উদ্ভূত ক্লিশে ভাঙা শুরু করেছে। বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হওয়ার ভিন্ন এক উদ্ভাবন তাঁর এসব কাজ। তিনি কি আমাদের শেখানো শুরু করেছেন কি করে বাস্তবের বিরুদ্ধে কল্পনাকে দাঁড় করানো যায়?
মাইক ফেদার স্টোনের কথা মনে পড়ে : একটা সুষম স্টাইল নির্মাণের চেয়ে পরিচিত স্টাইলের রেঞ্জ কিংবা পরিচিত স্টাইল বড়ো করার মধ্যে সাহস বেশি (১৯৯১)। কাইয়ুম দেখেছেন শিল্প ও প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যকার সীমারেখা মুছে দেওয়ার মধ্যে এবং বিভিন্ন কোড মেলানোর মধ্যে নানা রাস্তার খোঁজ পাওয়া যায়। সেজন্য কি তিনি আশি বছরের অতীতকে বিদায় জানিয়েছেন? তাঁর দিক থেকে একটা অজানা রাস্তায় পা বাড়িয়েছেন? আমরা যারা তাঁর কাজের সঙ্গে বড়ো হয়েছি, তাঁর কাজের দিকে তাকিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার সাহস এভাবে বেড়ে যায়।

Leave a Reply