আ বু ল ম ন সু র
জয়নুল আবেদিনকে আমরা শিল্পাচার্য আখ্যা দিয়েছি ও বঙ্গের এ-পূর্বাংশে দৃশ্যকলাচর্চার অগ্রপথিকরূপে স্বীকার করে নিয়েছি। এর যাথার্থ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে আমরা তাঁকে পূজ্য সামগ্রী-বিশেষ হিসেবে পৃথক আর দূরবর্তী করেও রেখেছি। এর ফলে জয়নুল আবেদিনের শিল্পকৃতির কোনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের প্রয়াস এদেশে হয়নি বললেই চলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তিনি আছেন শিলীভূত এক আইকন রূপে, তাঁর সমকালে জয়নুলের সৃজনকৃতির গৌরব ও গুরুত্ব কোথায় নিহিত তার পরিচয় কখনো স্পষ্ট আকৃতিতে পরিস্ফুট হয়নি। এর ক্ষতি আমাদের সকলের।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার মাধ্যমে সর্বভারতীয় শিল্পজগতে স্বকীয় বিশিষ্টতায় জয়নুল আবেদিনের আত্মপ্রকাশ। মহাযুদ্ধ ও তেতাল্লিশের মন্বন্তর শিক্ষিত বাঙালির মানসলোকে এক প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর স্বপ্নাবিষ্ট আর ভাবাবেগতাড়িত রোমান্টিক মানসভূমিকে অকস্মাৎ যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেল রূঢ় বাস্তবের তীব্র কশাঘাত। সাহিত্য-শিল্পকলা-সংগীত-নাটকে এর অভিঘাত এসে পড়লো, প্রতিবাদী প্রতিফলন ঘটলো শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায়। গল্প-উপন্যাসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পরিমল গোস্বামী, সুবোধ ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ আরো অনেকে, কবিতায় সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন প্রমুখের রচনায় ফুটে উঠেছিল নবভঙ্গির সমাজসচেতন সাহিত্যদৃষ্টি। অবশ্য বাম ভাবাদর্শিক রাজনৈতিক চেতনা ছিল এর পশ্চাতে প্রধান অনুপ্রেরণা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রণোদনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ সালে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’ এবং ১৯৪৩ সালে ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’। বিশেষ করে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের উদ্যোগে নাটক ও সংগীতের এক নব্যধারার জাগরণ ঘটে। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান যথাক্রমে বাংলা নাটক ও সংগীতের ক্ষেত্রে আজো মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
চিত্রকলার ক্ষেত্রেও বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা এগিয়ে এসেছিলেন এই মানবিক বিপর্যয়ের রূপায়ণে। তবে এটি ছিল এমন এক সার্বিক বিপর্যয় যা যে-কোনো সংবেদনশীল মানুষকে স্পর্শ না করে পারেনি। ফলে আমরা দেখতে পাই মন্বন্তরকে বিষয় করে প্রায় সকল প্রধান বাঙালি শিল্পী কিছু না কিছু সৃষ্টি করেছেন। নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, গোপাল ঘোষ, মুরলীধর টালি, হরেন দাস, ভবেশ সান্যাল, সুনীলমাধব সেন, প্রাণকৃষ্ণ পাল, রথীন মৈত্র, পরিতোষ সেন প্রমুখ বিবিধ ধারার শিল্পীদের তুলিতে বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছিল বাংলার দুর্ভিক্ষ। মন্বন্তর নিয়ে সম্ভবত এঁদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন রামকিঙ্কর বেজ, জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোর, সুধীর খাস্তগীর, গোবর্দ্ধন আশ, অতুল বসু, সূর্য রায়, পূর্ণ চক্রবর্তী, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। তবে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের সেই মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয় যে তিনজন শিল্পীর হাতে বাস্তব অভিজ্ঞতায়, ক্ষোভ-ক্রোধ ও সত্যিকারের সহমর্মিতায় বিধৃত হয়েছিল তাঁরা হলেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও সোমনাথ হোর। উল্লেখ্য, চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ উভয়েই ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সার্বক্ষণিক কর্মী এবং দুর্ভিক্ষের রূপায়ণ তাঁদের কাছে ছিল প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক দায়িত্ব ও পুঁজিবাদী শোষণের স্বরূপ উদ্ঘাটন ও উপস্থাপনের উপায়। এছাড়া শিল্পী হিসেবে দুজনেরই অবস্থান ছিল গ্রামবাংলায়, বিষয়বস্তুর একেবারে অভ্যন্তরে। অন্যদিকে জয়নুল কোনো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উপলব্ধির দ্বারা চালিত হননি, তিনি এ চিত্রমালা অঙ্কনে প্রণোদিত হয়েছিলেন নিতান্ত ব্যক্তিগত মানবিক তাগিদ থেকে। দুর্ভিক্ষের বিপর্যয়কে তিনি দেখেছেন কলকাতার ফুটপাতে মানবতার চরম লাঞ্ছনার চিত্ররূপে। তাঁর চেনা পূর্ব বাংলার গ্রামের কিষানকে, লাজনম্র পল্লীবধূকে কলকাতার রাস্তায় উদ্বাস্তু-বেআব্র“ হয়ে কুকুর-বেড়ালের মতো মরতে দেখে নির্মম ও উদাসীন নাগরিক সভ্যতার প্রতি তীব্র ঘৃণায় আন্দোলিত হয়েছিলেন জয়নুল। তাঁর চিত্রমালা সে ঘৃণার ফুঁসে ওঠা উদ্গিরণ।
পাঠ সমাপ্ত করার পর জয়নুলের সামনে সমসাময়িক রীতি হিসেবে ছিল প্রধানত ‘বেঙ্গল স্কুল’-প্রভাবিত কাব্যিক ভাবালুতা বা রোমান্টিকতায় মোড়ানো বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কন, অথবা স্বাদেশিক চেতনার পরিপূরক হিন্দু ধর্মীয় বা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা ইতিহাস বা সাহিত্যের কোনো মহীয়ান ও আবেগঘন বিষয়। প্রতিনিধিত্বশীল ভূদৃশ্য বা নৈমিত্তিক জীবনদৃশ্য যে তাঁর আগে এ উপমহাদেশের আধুনিকশিল্পে রূপায়িত হয়নি তা নয়। অবনীন্দ্রনাথের ইতিহাস-পুরাণ বা সাহিত্য-আশ্রিত শিল্পেও কলকাতার শ্রমমুখর পথঘাট ও বিপণিকেন্দ্র উঁকি দিয়ে যায়। নন্দলালের ভক্তিমার্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি বজায় থাকলেও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে তাঁর শিল্পেও বোলপুরের প্রাত্যহিক ভূদৃশ্য ও সাঁওতালজীবন বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের নিরীক্ষার সঙ্গে সম্ভবত কলকাতাবাসী জয়নুলের পরিচয় ছিল না। কলকাতা আর্ট স্কুলের, যেখানে জয়নুলের শিল্পশিক্ষা, শিক্ষার্থীরা প্রধানত আসতো শহুরে হিন্দু পরিবার থেকে, যারা বিষয় হিসেবে মূলত চয়ন করতো ধর্মীয় বা পৌরাণিক ঘটনা, অথবা ভূদৃশ্য হলে কলকাতার নগরচিত্র, নয়তো রোমান্টিক সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতি। যুদ্ধ ও মন্বন্তর এবং রাজনৈতিক সচেতনতা চল্লিশের দশকেই এক ধরনের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছিল এবং ভাববাদী সৌন্দর্যবোধ থেকে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে শিল্পীদের প্ররোচিত করেছিল। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, গোপাল ঘোষ, অবনী সেন, গোবর্দ্ধন আশ, মুরলীধর টালি, হরেন দাস এবং আরো কারো কারো কাজে প্রকৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। তবে এসব শিল্পীর সৌন্দর্যচেতনায় ঐতিহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসলে তেমনভাবে ঘটেনি, ফলে তাঁদের কাজ কখনই ভাবপ্রবণতার গণ্ডি থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। প্রত্যক্ষতার ছোঁয়া থাকলেও তাঁদের আঁকা ভূদৃশ্য পুরোপুরি নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারেনি, কদাচিৎ তা প্রকৃতির রূপবিভঙ্গের আবেগাক্রান্ত অতিশায়নকে অতিক্রম করতে পেরেছে। একইভাবে শ্রমশীল মানুষের রূপায়ণ দেখি নন্দলাল-দেবীপ্রসাদ ছাড়াও পরবর্তী গোবর্দ্ধন আশ, হরেন দাস, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অবনী সেন ও আরো অনেকের কাজে এবং সেখানেও দেহজ শ্রমের কর্কশতাকে ঢেকে রাখে লালিত্যময় সৌন্দর্যের বোধ।
এই মোহমুগ্ধ সৌন্দর্যচেতনার আবিষ্টতার বিরুদ্ধেই জয়নুলের অবস্থান। তাঁর দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালার মধ্যেই এদেশীয় শিল্পে প্রথমবারের মতো জীবনের তীব্র তাপ তার অশ্র“-ঘামসহ অনুভব করা যায়। দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী চিত্র রচন-প্রচেষ্টায় তাঁর জন্য বিষয়ের একটি সংকট তৈরি হয়। সে সংকট তিনি মোচন করেছেন সমসাময়িক ভাবাবেগমণ্ডিত চিত্রধারা পরিহার করে পূর্ব বাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনের প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপনের সঙ্গে দুর্ভিক্ষচিত্রের পরিলেখ-রেখার সম্মিলন ঘটিয়ে। জয়নুল তাঁর আশৈশব চেনা ভূমিপুত্র পল্লীবাসীকে রূপায়িত করেছেন নিসর্গলগ্ন করে, তাকে বেষ্টন করে থাকা নিসর্গের সঙ্গে অবিরাম সহাবস্থান ও সংঘর্ষের মধ্যে। নিসর্গের সঙ্গে মানবের চিরায়ত দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের এক পুনর্নির্মাণ যেন রচিত হয় তাঁর ‘নবান্ন’ স্ক্রলচিত্রে। ঊনসত্তরের গণজাগরণের প্রেক্ষাপটে সম্প্রদায়-চিহ্নহীন বাঙালিজীবনের আনুপূর্বিক এক বয়ান উপস্থাপন করে গণজাগরণের চেতনার সমান্তরাল বোধকে বিবৃত করেন তিনি, অস্বীকার করেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিশ্বাসের ভিত্তিকে। একইভাবে ১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিবাত্যায় বিধ্বস্ত উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের প্রতিক্রিয়ায় আঁকা
‘মনপুরা’ স্ক্রলচিত্রের ধর্ম-পরিচয়হীন মৃতের স্তূপ যেমন আঘাত হানে ধর্ম-পরিচয়ের বিভাজন-বিশ্বাসে, তেমনই মৃতের উত্থিত হাতের ভঙ্গিতে যেন প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে প্রত্যাঘাতের প্রতিজ্ঞা। এভাবে প্রকৃতির একইসঙ্গে শ্রীময় ও করাল রূপ এবং তার সঙ্গে গ্রামীণ ভূমিসংলগ্ন জীবনের এ আদিম ও দ্বান্দ্বিক অবস্থান জয়নুলের চিত্রে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী রূপকল্প হিসেবে বিধৃত হয়েছে। বলা যেতে পারে, ভারতীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসে তাঁর ছবিতেই সর্বপ্রথম কায়িক শ্রমের নিষ্ঠুর কর্কশ রূপ, প্রকৃতির রুদ্র-নির্মম বিস্তার তার সকল বাস্তব অনুষঙ্গে ধরা দিয়েছে। একইসঙ্গে তাঁর ছবিতে বিম্বিত হয়েছে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের অপরাজেয় রূপ, যা তাঁকে দিয়েছে তাৎক্ষণিকতার সীমা-অতিক্রমী ব্যঞ্জনা।
তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ও পরবর্তীকালে কালো পরিলেখ বা বহিঃরেখার প্রাধান্যে রচিত প্রকৃতির পটে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনগাথার যাবতীয় সৃজনকে একত্র করে বিবেচনা করলে জয়নুল আবেদিনের মৌলিকত্ব ও অবদানকে চিহ্নিত করা সহজ হতে পারে। তাঁর দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালার প্রতি খুব নিবিষ্টভাবে দৃকপাত করলেই উপলব্ধি করা সম্ভব যে, এগুলো নিছক রেখাচিত্র মাত্র নয়। এর সংক্ষিপ্ত অথচ নিশ্চিত রেখা কেবলমাত্র অবয়বকে বেষ্টন করে পরিলেখ রচনাই করেনি, আকৃতির ত্রিমাত্রিকতা ও উচ্চাবচকেও প্রতিভাত করছে। শুকনো কালির মোটা ঘষটানো রেখার ব্যবহার বিষয়ের কর্কশতার সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ, তেমনি শিল্পীর রেখাঙ্কনের মুন্শিয়ানাকে প্রতিভাত করে তোলার জন্যও যথাযথ নির্বাচন। ক্ষুধাদীর্ণ উদ্বাস্তু মানুষগুলোর শরীরের ভগ্ন-বিদীর্ণ প্রায়-জান্তব অবয়বে ও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের অপ্রাকৃত অভিব্যক্তিতে লাঞ্ছিত মানবতার রূপ যে তীব্রতায় প্রকাশমান হয়েছে তাতে এগুলো নিছক রেখাচিত্র বা তাৎক্ষণিকতার সীমা অতিক্রম করে চিরায়তের ব্যঞ্জনা অর্জন করেছে। উপবাসক্লিষ্ট গ্রামীণ মানুষের হাড্ডিসার দেহের পাশে ধূর্ত শহুরে কাকের পরিপুষ্ট শরীর এ দুর্ভিক্ষের অন্তঃস্থিত নির্মম বৈপরীত্যকেও যেন প্রতিভাত করে তোলে সুতীক্ষè রূপকে। ভগ্নদেহ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, বিপর্যস্ত-পরাজিত, তবু তাদের শরীর এক সমুন্নত বিপুলতায় অধিকার করে রাখে প্রায় সম্পূর্ণ পটের জমি। এভাবে ওই সব ক্লিষ্ট মানুষের ললাটে জয়নুল এঁকে দেন অপরাজেয় মানব-অস্তিত্বের জয়টিকা। তাঁর দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালার ভেতরেই সমন্বিত ছিল অন্তর্নিহিত এক প্রকাশশক্তি ও শিল্পোৎকর্ষ। এই চিত্রমালাই তাঁকে বাতলে দিয়েছে পথ, যে-পথে অগ্রসর হয়ে তিনি উপমহাদেশীয় শিল্পঐতিহ্যে অন্ত্যজ শ্রেণির গ্রামীণ মানুষ ও প্রকৃতির এক নবতর ভাষ্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায় সূচিত হয়ে তাঁর পরবর্তী পথপরিক্রমায় আমরা লক্ষ করি অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল-যামিনী রায় ও চল্লিশের বাস্তবতাপন্থীদের সঙ্গে জয়নুলের পার্থক্য। রোমান্টিকতার রেশ ছিন্ন করে জীবনের শ্রমমগ্ন বাস্তবিকতায় উত্তরণ, ধর্ম-প্রভাবিত বিষয়ের নিগড় থেকে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার উদ্বোধন। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালারও একদিকে যেমন রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের লাঞ্ছনার অমানবিক দিক, তার ভেতরেই আবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও অন্ত্যজ মানুষের বাৎসল্য, আত্মত্যাগ ও পারিবারিক সহমর্মিতার মনুষ্যত্বমণ্ডিত দিকটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন জয়নুল। এভাবে আমাদের নাগরিক খোলসের আড়াল ভেঙে দেন তিনি, সামনে দাঁড় করিয়ে দেন তাঁর গ্রামীণ কিষানের গরিমাদৃপ্ত মুখচ্ছবি। তাঁর স্বকীয়তা-চিহ্নিত এই অঙ্কনরীতিতে পরবর্তী সময়েও যত ভূদৃশ্য, মানুষী রূপ তিনি এঁকেছেন, সর্বত্রই পল্লীবাংলার প্রকৃতি ও মানুষের অবয়বে বুলিয়ে দিয়েছেন সমুন্নত মহিমার ব্যঞ্জনা। বিষয়ের সামান্যতাকে এভাবে অতিক্রম করেন তিনি, উপস্থাপনের বৈশিষ্ট্যে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে জয়নুলের খসড়া-সদৃশ রেখাচিত্রমালা। তাঁর শিল্পবোধ ও জীবনোপলব্ধির যৌগক্রিয়ায় এসব চিত্রমালা এ-অঞ্চলের শিল্প-ইতিহাসে জাগতিক সত্যরূপের এক নবতর পাঠ রচনা করে।
তাঁর সৃষ্টির গুরুত্বকে আমরা সঠিক প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করতে বোধহয় ব্যর্থ হয়েছি। তাঁর স্বকীয়তাকেও আমরা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারিনি। ফলে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে জয়নুলের প্রাসঙ্গিকতাও আমাদের কাছে অনেকখানি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। ভারতীয় চিত্র-ঐতিহ্যে তিনি যুক্ত করেছিলেন বিষয়ের নতুনত্ব – একদিকে গ্রামীণ শ্রমের রূঢ়তা-চিহ্নিত অথচ মহিমান্বিত রূপ, অন্যদিকে সেই শ্রমে নিয়োজিত মানুষের বাস্তুচ্যুতি, দারিদ্র্য ও অমানবিক দুর্গতির শক্তিমান ভাষ্য। এ অঞ্চলের শিল্প-ঐতিহ্যে যে কাব্যাক্রান্ত ভাবালুতার প্রচলন ছিল জয়নুলের ছবিতেই তার প্রায় সম্পূর্ণ অবসান রচিত হয়। তাঁর সৃষ্টিতেই সর্বপ্রথম দেখা গেল নির্মম বাহুল্যহীন বাস্তবতা, রেখার প্রখর শক্তিময় ব্যবহারে বাস্তবের এক ভিন্নতর দ্যোতনা। বাস্তবতা শুধু অবয়বের প্রসাধনহীন নির্দয় উপস্থাপনেই নয়, বাস্তবতা ধর্ম-পুরাণমগ্নতার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক শ্রেণি-সচেতন সমাজ-অবস্থার রূপায়ণে। বাস্তবতা স্বপ্নচারিতার বিরুদ্ধে, বাস্তবতা প্রতিবাদেরও। প্রতিবাদ মানবতার লাঞ্ছনার, নিপীড়নের, সমাজের বিরাজমান ভেদনীতির বিরুদ্ধে। গ্রামীণ জীবনের সরল সৌন্দর্যের পুনঃ পুনঃ রূপায়ণে তিনি জানান দেন তাঁর প্রতিবাদকে, প্রত্যাখ্যানকে, তাঁর ক্রোধকে, সেই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নকে। রাজনীতি-সংলগ্ন না হয়েও তাই তাঁর সৃষ্টি রাজনীতির কথা বলে, সমাজ পালটানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলে, সংগ্রামের প্রেরণা জোগায়। আজীবন নগরবাসী থেকেও তিনি যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই থাকেন অসংস্কৃত, কথা বলেন অপরিশীলিত দেশি ভাষায়, শহুরে চতুরতার বিরুদ্ধে বজায় রাখেন তাঁর সরল কিন্তু দুর্মদ চরিত্র। এও তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। যেন এক গ্রামীণ স্বভাবকবি, গায়েন অথবা পটশিল্পী, শিল্পের আধুনিক প্রকরণ নয়, পুরাতনী মেঠো ভাষায় পরিবেশন করেন কৃষক-জীবনের দুঃখগাথার বয়ান, সরল কিন্তু মানবিক চেতনায় সিক্ত। নিজের মানসভূমে আজীবন জয়নুল যুক্ত থাকেন সেই জীবনদর্শনের সঙ্গে। এখানেই তাঁর শিল্পীসত্তা এবং মানবসত্তা হয়ে ওঠে পরস্পরের পরিপূরক।