ম ন জু রু ল হ ক
সমুদ্রতীরের উন্মুক্ত চত্বরে বসানো একশো সত্তর মিটার দীর্ঘ রেড কার্পেটে তারকা আর অতিথিদের নানারকম সাজসজ্জায় হাস্যোজ্জ্বলভাবে হেঁটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মার্চের ২২ তারিখে যাত্রা শুরু করা পঞ্চম ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বিভিন্ন বিভাগের বিজয়ীদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে ৩০ মার্চ এর সমাপ্তি টেনেছে। আটদিনের এই চলচ্চিত্র উৎসবের এবারের আয়োজন ছিল নানা দিক থেকেই ব্যতিক্রমী। বিচারকমণ্ডলীতে এবার প্রথমবারের মতো যুক্ত থেকেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। এছাড়া ওকিনাওয়ার স্থানীয় সরকার এবার চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে আরো গভীরভাবে সংযুক্ত থেকে উৎসবকে সত্যিকার অর্থে ওকিনাওয়া জেলার নিজস্ব এক আন্তর্জাতিক সমাবেশ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
জাপানের সর্বদক্ষিণের এই দ্বীপজেলা বিগত কয়েক দশক ধরে নানারকম সমস্যার কারণে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। মার্কিন সামরিক ঘাঁটির যত্রতত্র উপস্থিতি এবং সেইসঙ্গে এলাকার অর্থনীতি জাপানের অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকার আলোকে সার্বিক অর্থে নেতিবাচক সেইসব সংবাদ ওকিনাওয়াবাসীকে মোকাবিলা করতে হওয়া কঠিন বাস্তবতার প্রতিফলন তুলে ধরে। সেরকম অবস্থায় নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগের সুযোগ তাদের জন্য করে দিয়ে ছায়াছবির মধ্য দিয়ে ওকিনাওয়াকে এশিয়ার প্রধান একটি আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করে নেওয়ার লক্ষ্যে জাপানের ওসাকাভিত্তিক বিনোদন প্রতিষ্ঠান ইয়োশিমোতো কোওগিও ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করেছিল। সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত সেই চলচ্চিত্র উৎসব প্রথমবারের আয়োজন সফল প্রমাণিত হওয়ার পর ওকিনাওয়ার গিনোওয়ান শহরের স্থানীয় প্রশাসন পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং চলচ্চিত্র উৎসবকে জাপানের সেই দূরবর্তী অঞ্চলের প্রধান একটি সাংস্কৃতিক আয়োজনে রূপান্তরিত করে নিতে নানারকম সহযোগিতার দুয়ার আয়োজকদের জন্য খুলে দেয়। এছাড়া বেশ কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও পরবর্তী সময়ে উৎসবের আয়োজনে নিজেদের যুক্ত করে নিলে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব নিয়মিত এক বার্ষিক আয়োজন হয়ে ওঠে।
এবারের এই পঞ্চম আয়োজন উদ্যোক্তাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও সবরকম প্রতিবন্ধকতা যে ইতোমধ্যে দূর হয়ে গেছে তা অবশ্য আয়োজকরা এখনো মনে করেন না। উৎসব চলাকালে এই প্রতিবেদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির সভাপতি ও জাপানের বৃহত্তম বিনোদন কোম্পানি ইওশিমোতো কোওগিওর প্রধান নির্বাহী হিরোশি ওসাকি যেমন বলেছেন, জনগণের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেলেও চলচ্চিত্র উৎসবের মতো ব্যয়বহুল আয়োজন নিয়মিতভাবে করে যেতে হলে আর্থিক সচ্ছলতার নিয়মিত উৎস নির্ধারণ করে নেওয়া দরকার। স্থানীয় সরকারসমূহের অংশগ্রহণ সময়োচিত এবং অর্থবহ হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি অর্থ জোগানো তাদের পক্ষে ততটা সম্ভব নয় এবং সেটা ঠিক কাক্সিক্ষত নয় বলেও হিরোশি ওসাকি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর তাই প্রায় পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোগে আয়োজিত ওকিনাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবের বেলায় এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ না থেকে গেলেও আর্থিক দিক থেকে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বিবেচনায় রাখা একেবারে অযৌক্তিক নয় বলে তিনি মনে করেন এবং এ কারণেই এবারের উৎসবের কর্মসূচিতে এশিয়ার কন্টেন্ট বাজারের ওপর সেমিনার ও প্রদর্শনীর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় বলে মি. ওসাকি জানান। যে-কোনো চলচ্চিত্র উৎসবকেই শুধু বিনোদন কাঠামোর বাইরে ছায়াছবির ব্যবসায়িক দিকগুলোর ওপর এ কারণে নজর দিতে হয় যে, প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে চলচ্চিত্রশিল্পকেও অবশ্যই হতে হয় কৌশলী ও নতুন পথের সন্ধানী। কন্টেন্ট বাজার সেই দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করে অংশীদারিত্বের পথ তৈরি করে দেওয়ার সুযোগ, বিশেষ করে এশিয়ার সম্প্রসারমাণ চলচ্চিত্র খাতের জন্য করে দিতে পারে বলে মি. ওসাকির ধারণা।
উৎসবের জন্য জমা দেওয়া ছায়াছবির সংখ্যা এবং দর্শক উপস্থিতি, উভয় দিক থেকেই এবারের উৎসব ছিল আগের চারটি উৎসবের চেয়ে অনেকাংশে বিস্তৃত। ভৌগোলিক বিস্তৃতির দিক থেকে এবারে যেমন প্রথমবারের মতো তুরস্ক, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়া ওকিনাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়। এছাড়া দর্শক উপস্থিতির দিক থেকেও এবারের এই পঞ্চম আয়োজন আগের সব কটি উৎসবকে ছাড়িয়ে গেছে। আটদিন ধরে চলা চলচ্চিত্র উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শক সমাগমের মোট সংখ্যা ছিল চার লাখ বাইশ হাজার, চতুর্থ চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ে যে সংখ্যা হচ্ছে বারো হাজার বেশি। ফলে ধারণা করা যায়, উৎসবের সাফল্য সম্পর্কে আয়োজকরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আশাবাদী মনোভাব পোষণ করতে সমর্থ হবেন।
ওকিনাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবের আরেকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছবি দেখার জন্য টিকিট কেনার ব্যবস্থা না থাকা। অর্থাৎ কোনোরকম প্রবেশমূল্য ছাড়াই দর্শক উৎসব চলাকালীন ছবি দেখতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, এমনকি বিনা খরচে উৎসবের জায়গায় যাওয়া-আসার ব্যবস্থা সাধারণ দর্শকদের জন্য করে দিতে ওকিনাওয়ার প্রধান শহর নাহা থেকে উৎসবের জায়গা গিনোওয়ান শহরের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে একাধিক শাটল বাস চলাচলের ব্যবস্থাও উৎসব কমিটি করে দিয়েছিল।
‘হাসি ও শান্তি’ – মানবজীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি এনে দেওয়ার আবশ্যকীয় এই দ্বৈত মৌলিক পূর্বশর্তকে থিম বা মর্মবাণী হিসেবে ধরে নেওয়া ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতাও সেরকম দুটি ভাগে বিভক্ত। হাসি ও শান্তি, উভয় বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত ছবিগুলো থেকে একটি করে ছবিকে দর্শক এবং সেইসঙ্গে সারা জাপান থেকে বেছে নেওয়া চলচ্চিত্র অনুরাগীদের ভোটে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার দেওয়া হয়। এর বাইরে উভয় বিভাগের সব কটি ছবি থেকে একটি ছবিকে চার সদস্যের বিচারকমণ্ডলী সেরা ছবির পুরস্কার ‘গোল্ডেন শিশা’র জন্য বেছে নেন। এবারের উৎসবে বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন হলিউডের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক জোয়েল শুমাখার। ওকিনাওয়া চলচ্চিত্র উৎসবে স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুগ্ধ এই হলিউড ব্যক্তিত্ব বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে খোলামেলা এক আলাপচারিতায় উৎসবের এই দিকটির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ওকিনাওয়ার এই দিকটি থেকে সারাবিশ্বের চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজকদের অনেক কিছু শিখে নেওয়ার আছে।
হাসি ও শান্তি – এই দুই বিভাগে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ছবির সংখ্যা এবারে ছিল যথাক্রমে নয় ও এগারোটি। হাসির বিভাগে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেয়েছে হংকংয়ের পরিচালক জ্যাকি চানের সাসপেন্সভিত্তিক কমেডি চাইনিজ জোডিয়াক। চীনের উনিশ শতকের চিং রাজবংশের হারানো এক সম্পদ উদ্ধারে চালানো দুঃসাহসী প্রচেষ্টায় উদ্ধারকারী দলকে বিচিত্র যেসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, তারই এক কৌতুকপূর্ণ উপস্থাপনা হচ্ছে দর্শকদের মনোরঞ্জনের খোরাক জোগানো এই ছবি।
অন্যদিকে শান্তি বিভাগে সেরা পুরস্কারে ভূষিত তাইওয়ানের মহিলা চলচ্চিত্র পরিচালক তিয়েন ইয়ু-ফুর ছবি দেবীর সুখী জীবন হচ্ছে অনেক বেশি বাস্তবধর্মী এক ছায়াছবি, তাইওয়ানের পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী পুরুষদের বিয়ে করে ঘরসংসার করতে আসা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের রমণীদের মোকাবিলা করতে হওয়া সমস্যা হচ্ছে যে ছবির মূল বিষয়। তবে পরিচালক অবশ্য গতানুগতিক কাঠামোতে ছবিকে আবদ্ধ না রেখে চলে গেছেন মানবজীবনের সুখ-দুঃখের আরো অনেক গভীরে, যা কি না ছবিটিকে করে তুলেছে দর্শকদের মনে সহজেই দাগ কাটার মতো অর্থে অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী। আর এ কারণেই প্রদর্শনী কক্ষ থেকে ফিরে আসার মুখে তাইওয়ানের সাংবাদিক জো আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন চোখ আমার ভিজে গিয়েছিল কি না।
ছবির নায়িকা দেবী হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা এক বধূ, যার বয়স্ক স্বামী বেকার ও মদ্যপ। ঘটনা অবশ্য ক্রমশ আবর্তিত হয় পরিবারের পুত্রসন্তানকে ঘিরে, গায়ের রং ও চেহারা ভিন্ন হওয়ায় যে পুত্রকে স্কুলে সহপাঠীদের হাসিঠাট্টা আর নিপীড়নের শিকার হতে হয়। সেই পুত্রকে নিয়ে দেবীর জীবনের আরেকটি অধ্যায় সম্পর্কে আমরা জানতে পারি আরো বেশ কিছু পরে, ইন্দোনেশিয়ার এক কফি ক্রেতা যখন কফি কেনার জন্য উপস্থিত হন তাইওয়ানের কফি চাষের সেই অঞ্চলটিতে। দেবীর স্বামী মদ্যপ ও মারকুটে হওয়া সত্ত্বেও পুত্রের সঙ্গে পিতার যে সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে, সেটাই ছবিকে করে তুলেছে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, মানবিক আর আবেগময়। পিতা সেখানে সত্যিকার অর্থে জন্মদাতা পিতা কি না, পিতা ও পুত্র দুজনের কাছেই সেটা আর নতুন করে যাচাই করে দেখার বিষয় হয়ে নেই। আর সেই সঙ্গে দেবীর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তাইওয়ানি অভিনেত্রী জেইড চোও। সবকিছু মিলিয়ে দেবীর সুখী জীবন হয়ে উঠেছে এরকম এক ছবি, যা কি না দর্শক মনে সহজেই আলোড়ন তুলতে সমর্থ।
দুই বিভাগের মোট উনিশটি ছবির মধ্যে থেকে চার সদস্যের আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার ‘গোল্ডেন শিশা’র জন্য বেছে নিয়েছেন বলিউডের ছবি বরফিকে। ভারতে একাধিক পুরস্কারে ভূষিত অনুরাগ বসু-পরিচালিত বরফি হচ্ছে দৃষ্টি ও বাকপ্রতিবন্ধী এক বালকের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের প্রতিনিধিত্বকারী বালিকা শ্র“তির গড়ে ওঠা সখ্যের কাহিনি। পারিবারিক চাপের মুখে শ্রুতি সেই বালকের কাছ থেকে সরে গেলেও ঘটনাক্রমে বেশ কয়েক বছর পর আবারো যখন তাদের সাক্ষাৎ ঘটে, বালকের জীবনে তখন দেখা দিয়েছে ভিন্ন এক তরুণী ঝিলমিল, যা কি না ত্রিভুজ প্রেমের জটিল এক পথের ইঙ্গিত সহজেই দেয়।
পরিচালক অনুরাগ বসু নিজে অবশ্য পুরস্কার গ্রহণের জন্য ওকিনাওয়ায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন সহযোগী প্রযোজক রুচী পাঠক।
ওকিনাওয়া আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ছবি এবার জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে উদ্যোক্তারা আশা করছেন, এক বছর পরের উৎসবে বাংলাদেশের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়াও কন্টেন্ট বা ছবি কিংবা টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরির নতুন ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন আয়োজনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ তাঁরা দেখতে পারবেন।
(ওকিনাওয়া, ৩০ মার্চ ২০১৩)