শা ম সু জ্জা মা ন খা ন
এক
আমরা বাঙালির ‘লোকশিল্প’বিষয়ে বর্তমান রচনাটির বয়ন, অন্তর্বয়নের সূত্রে এর সংজ্ঞা-সূত্র, অর্থ-জিজ্ঞাসা, নান্দনিকতা ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা এবং মানবিক ও সাংস্কৃতিক বাক্সময়তার প্রবহমানতাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। বর্তমান বিশ্বে এ-ধরনের বিষয়কে নানা জটিল তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত অনুপুঙ্খতায় বহুমাত্রিকভাবে বুঝবার চেষ্টা করা হয়। এ প্রবন্ধে আমরা সে-রকম বিশদ তর্ক-তদন্ত (discourse) কণ্টকিত জটিল তাত্ত্বিকতায় যাব না। বরং ঐতিহ্য-অন্বেষায় সমাজ পরিবর্তনের অভিঘাতে লোকশিল্পের রূপান্তর প্রক্রিয়ার ধরনকে সামনে আনার লক্ষ্যে আমাদের সমাজ-ইতিহাসভিত্তিক একটি নিজস্ব মডেল খুঁজে দেখব। ফলে, আমাদের আলোচনায় পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক লোকজীবনের (folklife) ভাষ্যকারদের মতো সংকালিক (synchronic) বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে আমাদের বয়ান শুধু ‘স্মল সেটিং’(small setting) অর্থাৎ লোকশিল্পের কারখানা, যন্ত্রপাতি, উপাদান-উপকরণ ও উৎপাদনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং লোক ও কারুশিল্পীদের কর্ম-বিভাগ ও জীবনধারা ও তাদের শিল্পের সম্পর্ক-নির্ভরই শুধু হবে না। আমাদের ইতিহাসের প্রাচীনতার জন্য পাশ্চাত্যের সংকালিক বা সিনক্রনিক পদ্ধতির সঙ্গে আমাদের প্রাচীন ইতিহাসভিত্তিক অর্থাৎ উপযোগী ডায়াক্রনিক (Diachronic) পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগকেই গুরুত্ব দেব। ফলে ‘বিগ সেটিং’(Big Setting) ইতিহাসের পটে সংশ্লিষ্ট শিল্পের স্থানিক পারিপার্শ্বিকতা কীভাবে এর গড়ে ওঠায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে তার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রসঙ্গসূত্র-নির্ভর (Contextual) গবেষণা গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে (Contextual) বা আরো স্পষ্ট করে বললে সংশ্লিষ্ট পটভূমির (Relevant context) আলোকে লোকশিল্পের বিশ্লেষণ করা হয়।
সিনক্রনিক গবেষণায় micro study প্রাধান্য পায়। তবে লোকশিল্পকলার বিশেষ অর্থ (meaning), কাজ (Function) ও তাৎপর্য এবং যে-সামাজিক রুচি ও নান্দনিক মূল্যচেতনার ফলে এ শিল্পকলার ঐতিহ্য-সংলগ্নতা বিশেষ গোষ্ঠী বা সমাজের (community) কাছে মূল্যবান সে-সমাজের চিন্তাচেতনা,
আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্ববীক্ষা (world view)- নিরপেক্ষভাবে ব্যাখ্যাবিচারে (interpretation) বস্তুনিষ্ঠ ও প্রকৃত বাস্তবতা (empirical reality) উদ্ঘাটিত হয় না। গবেষকের জন্য এক্ষেত্রে শুধু একপাক্ষিক ফিল্ডওয়ার্র্কই যথেষ্ট নয়; গবেষককে মনে রাখতে হবে তার তথ্যদাতা শিল্পী সক্রিয়-ঐতিহ্যবাহী (active tradition bearer) এবং গবেষক নিষ্ক্রিয় ঐতিহ্যপ্রেমিক (Passive tradition bearer)। এ দুজনের অব্যাহত অন্তরঙ্গ সংলাপের মাধ্যমেই শুধু বিশেষ কোনো লোকশিল্পের অর্থ, প্রতীক বা মর্মবাণী সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। লোকশিল্পের চর্চা লোকশিল্পীর জীবনচর্চাও বটে। সেজন্যই মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ÔWe have to turn our attention first of all to the artist himself.Õ তবে ১৯৬০-এর দশকের আগে পশ্চিমি বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন দেশের ফোকলোর তথা লোকশিল্প চর্চায় লোকশিল্পীর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টির ব্যাখ্যা বিচার শুরু হয়নি।
দুই
ফোকলোরের একটি প্রধান শাখাকে বলা হয় বস্তুগত লোকসংস্কৃতি বা Material Culture. লোকশিল্প এই বস্তুগত সংস্কৃতির এক শক্তিশালী উপবিভাগ। এর অন্য উপবিভাগ হলো : কারুকলা, লোকস্থাপত্য এবং লোকজ খাদ্য। লোকশিল্প মানবসৃষ্ট শিল্পগুণসমৃদ্ধ নৃসাংস্কৃতিক উপাদান। একাডেমিক ও ব্যবহারিক পরিভাষায় একে Artifact বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট লোকশিল্প গবেষক ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা বারবারা এ ব্যাবকক (Barbara a Babcock) বলেছেন, , ÔThe word (arte + factum) literally means something made by skill or craft and may refer to any artificial product. In common usage artifact denoted an object manufactured or modified by human hands. (Folklore, Cultural Performances and Popular Entertainments╛Ed. Richard Bauman. P. 204. Oxford University Press, 1992).
পাশ্চাত্য পৃথিবীতে বিশেষভাবে আমেরিকায় ১৯৬০-এর দশকে যে-আধুনিক ফোকলোর চর্চা শুরু হয়েছে তার ঝোঁক সংকালিক (synchronic Paradigm) প্রপঞ্চতে। অর্থাৎ কোনো কারখানা ও তার সংলগ্ন স্থান, কর্মী, যন্ত্রপাতি উপাদান-উপকরণ ইত্যাদি নিয়ে সমকালীনতার পটে বিন্যস্ত করে গবেষণা। অন্যদিকে সভ্যতার প্রাচীনতার কারণে আমাদের দেশে লোকশিল্প বিচারের ধরনটি (Paradigm) ইতিহাসের পটে স্থাপিত (diachronic) করে করা অনিবার্য। শেষোক্ত ধরনের বিশ্লেষণ প্রকৃত প্রস্তাবে জটিল এবং বহুতল বিস্তারিত বলে আমাদের দেশে সহজ পন্থা হিসেবে বিবরণমূলকতাই গবেষণার নামে প্রাধান্য পায়। এ পদ্ধতির চর্চায় জাতীয়তাবাদী ও রোমান্টিক চেতনার কালের আবেগ ও প্রাক্তনের স্মৃতি (Nostalgia) যুক্ত হয়ে লোকশিল্পের একটা মেসেজ দেয় বটে তবে তা নিতান্তই ঐতিহ্যগর্ব ও স্টেরিওটাইপ (sterotype)-জাত হয়ে ওঠে। এ-ধারার গবেষণায় বিশেষ শিল্পকলার রূপান্তর, বিন্যাসগত ভিন্নতা বা ক্রিয়াগত (Functional) পরিবর্তনের চিত্র উন্মোচনের সুযোগ থাকে না। কিন্তু সমাজ, এমনকি ঐতিহ্যগত সমাজেরও পরিবর্তন হয়। আমাদের সমাজেও পরিবর্তন হচ্ছে বহুকাল ধরেই। এখন তা দ্রুততর ও বহুমুখী হয়েছে। গড়ে উঠেছে বিশাল মধ্যবিত্ত সমাজ। সমাজ পরিবর্তনের এ-প্রক্রিয়ায় লোকশিল্পকলাও পরিবর্তিত হচ্ছে। আসলে লোকশিল্পকলার নতুন সামাজিক রুচি ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। আমাদের লোকশিল্পের বর্তমান ধারার দিকে তাকালেই তা চোখে পড়ে।
তিন
গুরুসদয় দত্ত১ ও অজিত মুখার্জি২ আমাদের লোকশিল্পের উদ্ভব খুব প্রাচীনকালে বলে মনে করেন। পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন মহেনজোদারো বা মেসোপটেমিয়ার শিল্পকলার সঙ্গে এর সম্পর্কের কথাও বলা হয়।
এ-বিষয়ে বিস্তৃত গবেষণা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মহাস্থানগড় এবং গুপ্ত ও পাল যুগের বিশেষ করে পাহাড়পুর, ময়নামতি এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলায় চন্দ্রকেতু গড়ে প্রাপ্ত উপাদানকে আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। কারণ ওই সব সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাংলার লোকজজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কিছু পোড়ামাটির কাজ পাওয়া গেছে। শুধু অষ্টম-নবম শতকের বা তার আগের কাজই নয়, ময়নামতি লালমাইয়ে প্রাপ্ত পরবর্তীকালের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার স্মারক যেসব লোকশিল্পকলার উপাদান, বিশেষ করে পোড়ামাটির কাজ বা টেরাকোটা পাওয়া গেছে তা তৎকালীন সাধারণ মানুষের জীবনমাত্রার চমৎকার নিদর্শন। এসব উপাদান প্রধানত ব্যবহারিক উপযোগিতামূলক (useful and utilitarian), মৃৎশিল্প নয়; কারণ মৃৎশিল্পের ভাস্কর্যগুণ এখানে নেই। প্রাচীন মৃৎপাত্র যথা বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি তাই ইতিহাস-বিচারে মূল্যবান হলেও শিল্প-বিচারে গুরুত্বহীন। তবে মানুষ তো শুধু উপযোগিতা অনুসন্ধানীই নয়, শিল্পরসপিপাসুও বটে। এই শিল্পরস পিপাসা থেকেই তৈরি হয়েছে টেরাকোটা শিল্প। এ ধরনের শিল্পকলার চরমোৎকর্ষের পরিচয় আছে দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের অপূর্ব নান্দনিকতায় ভাস্বর টেরাকোটা প্লাগের বিন্যাসে। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, কান্তজির মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার প্যানেলের সাহায্যে পৌরাণিক যুগ থেকে মধ্যযুগ, প্রাক-আধুনিক যুগ পর্যন্ত নানা কাহিনি, উপাখ্যান এবং ইতিহাসকে তুলে ধরা আছে।
টেরাকোটার কাজ বাংলাদেশে কেন বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এ কলারীতিটি এখনো ভিন্ন তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনায় কেন টিকে আছে তার কারণ বোঝা কঠিন নয়। নির্মাণ ও বস্তুগত উপাদান সৃষ্টিতে ভূপ্রাকৃতিক কারণে বাঙালি শিল্পী ও নির্মাতার প্রধান মাধ্যম হয় ইট ও পোড়ামাটি। অতএব শত সহস্র বছর আমাদের বাস্তুভিটা নির্মাণে মাটি পোড়ানো ইট ও অনুষঙ্গী উপাদান যেমন ব্যবহৃত হয়েছে তেমনি টেরাকোটার মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যিক বস্তুগত শিল্পকলাও লোক-ভাস্কর্য হিসেবে টিকে থেকেছে এবং নতুন রূপ ও সমকালীন চিন্তাচেতনারও প্রকাশমাধ্যম হয়েছে। প্রাচীনকালের মন্দির ও প্রাসাদ অলংকরণের ওই লোকজ মাধ্যমটি ধর্মীয় আবহের খোলস ছেড়ে ব্যবহৃত হয়েছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও। কান্তজির মন্দিরই তার উদাহরণ। এমন ব্যাপক, মনসংবদ্ধ, সূক্ষ্ম ও ব্যঞ্জনাধর্মী শিল্প নৈপুণ্যতা এদেশে বিরল। আমাদের লোকশিল্পীদের এ এক অনন্যকীর্তি। আধুনিককালে নবভাস ও বিষয়ে বিন্যস্ত হয়েছে। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার মর্মবাণীকেও ধারণ করছে টেরাকোটা শিল্প। এই ধারায় খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবেই বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর বটতলার নজরুল মঞ্চের বেদির তিন দিকের দেয়ালে আছে এর ব্যবহার। এর উদ্দেশ্য বাঙালির হাজার বছরের ভাষার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাজার বছরের লোকায়ত শিল্পকলার সংযোগে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের মাধ্যমে আধুনিকতার
নবব্যঞ্জনা সৃষ্টি। অন্যদিকে আবহমান শিল্প-সৃজন ঐতিহ্যের ব্যবহার করে বেদির সৌন্দর্যে একটি স্বকীয় ও নতুন মাত্রা যোগ করা। বাংলা একাডেমী এই টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ভাস্কর্যের ব্যবহার করেছে একাডেমী সেমিনার কক্ষের দেয়ালে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের একটি বাস্তব মূর্তিকল্প ধরে রাখা হয়েছে পোড়ামাটির কাজে। এতে ঐতিহ্যের আধারে একালের গণসংগ্রামের স্মারক ইতিহাস নান্দনিক বিভায় মূর্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনসহ কিছু হোটেল এবং ব্যক্তিগত আবাসন ভবনেও পোড়ামাটির কাজের নতুন ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ইদানীং। ঐতিহ্যসচেতন এই আধুনিকতাও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পরিচয়বাহী। সাবেককালের সামন্ত এলিটরা কান্তজির মন্দিরে পোড়ামাটির প্যানেল ব্যবহার করে যে অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টির ঐতিহ্য স্থাপন করেছিলেন একালেও সে-ঐতিহ্য ইতিহাসের প্রগতি ধারায় স্থান করে নিচ্ছে ভিন্নতর তাৎপর্যে। অতএব লোকশিল্পকলার অনড় (Static) কোনো ঐতিহ্য শুধু নয়, ধারাবাহিকতায় অন্বিত (Continuity) এক নব মাত্রিকতার শিল্পমাধ্যমও হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে বিপ্লবী প্রেরণা প্রকাশক নব নন্দনতত্ত্বের উদ্ভাবনাময় আঙ্গিক।
চার
ÔTurning mere earth into recognizable, integral forms, translating the natural into the cultural, the potter knows power and builds confidence through the repetitive solution of a problem complex enough to task the hands and fill the mind.Õ Ñ Henry Glassie.
বহু আগে মৃৎশিল্পের গবেষণায় ঐতিহাসিক দৃষ্টি ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় এনথোগ্রাফিক ফিল্ডওয়ার্ক-ভিত্তিক কাজ এদেশে করেছিলেন গুরুসদয় দত্ত প্রমুখ; একালে করেছেন বাংলাদেশ-প্রেমিক মার্কিন লোকশিল্প গবেষক অধ্যাপক হেনরি গ্লাসি। অথচ বাঙালি জীবনে মৃৎশিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অধিষ্ঠিত। কৃষিজীবী বাঙালি
গার্হস্থ্য জীবনে মাটির বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল-কলসি-মালসা, মাইট-মটকি-কোলা-খোরা-রাইঙ্গ-পিদিমদানি – আরো কত বিচিত্র উপাদান দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হতো এবং এখনো হয়। অতএব আমাদের জাতিতাত্ত্বিক বাস্তব জীবনযাত্রার সঙ্গে মৃৎপাত্রের সম্পর্ক যেমন প্রাচীন তেমনই খুব ঘনিষ্ঠও বটে। আমাদের বিশাল গ্রামবাংলায় এর চহিদাও প্রচুর। মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা নানা তৈজসপত্রের এই বিপুল চাহিদা মূলত উপযোগিতা-নির্ভর। সে-বিবেচনায় উপর্যুক্ত কাজকে আমরা উপযোগিতাবাদী দ্রব্য (Utilitarian Object) বলতে পারি। প্রাচীনকাল থেকে এ-ধরনের কাজ আমাদের জীবনযাত্রার নিত্য ব্যবহার্য বস্তু হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু মানুষ তো শুধু নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটিয়েই সন্তুষ্ট হতে পারে না; তার আছে ধর্মীয় বোধ এবং সাংস্কৃতিক চাহিদা; সংগতি থাকলে তার কিছু শখ ও আনন্দও পূরণ হওয়া চাই। এই বোধ ও চাহিদা থেকেই মৃৎশিল্পের কোনো কোনো উপাদানে হৃদয়ের কিছু রং ও হাতের শিল্পিত কারুকাজ মিশিয়ে নিয়েছে বাঙালি। এর কোনোটায় পড়ছে ধর্মীয় চেতনার ছোপ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিতান্তই মনের মাধুরী মাখানো রেখা ও রং। পূজায় দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ বা লক্ষ্মীর সরাকে যদি প্রথম শ্রেণিতে ফেলি তাহলে শখের হাঁড়িকে ফেলতে পারি দ্বিতীয় ভাগে। এই দুই উপাদানই বাঙালির চিত্রিত লোকশিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন। পূজার সময়ে মূর্তি বা প্রতিমা নির্মাণ হয় সারাদেশে এবং লক্ষ্মীর সরা ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। শখের হাঁড়ি তৈরি হতো প্রধানত রাজশাহী শহরের নিকটবর্তী বাঁরা গ্রামে এবং নওগাঁর পুটিয়া উপজেলার বাঙালপাড়া গ্রামে। সরাচিত্র ধর্মীয় হলেও শখের হাঁড়ি ধর্মনিরপেক্ষ। এর নকশার আঁকজোক এবং ব্যবহারে আছে শিল্পিত দক্ষতা ও নিপুণ মুন্শিয়ানা।
সামাজিক অগ্রগতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগ ও সস্তায় বিকল্প উপাদান পাওয়া যায় বলে লোকশিল্পের ভুবনে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আগে বলেছি মৃৎশিল্প একসময়ে প্রধানত ছিল প্রয়োজনের উপকরণ (Utilitarian Object) এবং গ্রামবাংলায় এর ব্যবহার ছিল বিকল্পরহিত। এখন প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র এ-জায়গা দখল করে নিয়েছে। এর কারণ, এর দাম খুব বেশি নয়, এগুলো ভঙ্গুর নয় এবং নগদ পয়সা না হলেও পুরনো কাপড়, ধানচাল বা অন্য কোনো জিনিসের বিনিময়েও এসব কেনা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন মেলামাইনের তৈজসপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের ধারায় মৃৎপাত্র কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি; অন্যদিকে মাটির কাজের একটি বিকল্প উৎসমুখ খুলে গেছে। এ ধরনের কাজে ধর্মীয় বিষয়ক মূর্তিকলায় যে গভীর বোধ, দার্শনিকতা ও নান্দনিক পারিপাট্য ছিল তা নেই; তবে শখ ও প্রয়োজনের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে অলংকৃত নানা ধরনের মৃৎসামগ্রী।
শহর-মফস্বলের উৎসব অনুষ্ঠানে চিত্রিত হাঁড়ি, ঘট ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে। নাগরিক গৃহসজ্জা ও বিয়ের অনুষ্ঠান, এমনকি অফিসাদিতেও উদ্ভাবনাময় ও রুচিশীল হাঁড়ি, কলস, হাতি, ঘোড়া, বিচিত্র সরা, ছাইদানি, কলমদান, ফুলদানি, নতুন সামাজিক রুচির উপাদান জুগিয়ে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংযোগ ঘটিয়েছে। এসব চিত্রিত উপাদানকে অনেকে হয়তো লোকশিল্প বলতে চাইবেন না। কিন্তু এদের মধ্যে কোনো কোনো কাজে শিল্পগুণ যুক্ত হওয়ায় তা লোকশিল্প হিসেবে গণ্য হবে। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার মনসার চালি ভাস্বর্যগুণে চমৎকার লোকশিল্পের রূপ নিয়েছে।
নাগরিক ও শৌখিন ভোক্তার দিকে লক্ষ রেখে মৃৎশিল্পীরা যেমন কল্পনাসমৃদ্ধ নতুন পণ্য নির্মাণ করছেন তেমনি তার বেচাকেনার কেন্দ্রও গড়ে তুলেছেন শহরের অভিজাত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এলাকা এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত পাবলিক প্লেস, সাংস্কৃতিক বা শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স, ঢাকার শিশু একাডেমী, মিরপুর সড়কের ধানমন্ডি এলাকায় মৃৎশিল্পের এই নতুন পসরা নিয়ে বসেছেন শিল্পী বা মৃৎশিল্প ব্যবসায়ীরা। এ থেকে এ জিনিসটা বোঝা যাচ্ছে যে, নব্য আধুনিক উচ্চ ও মধ্যবিত্তরাও এখন জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য অন্বেষা থেকে এ ধরনের উপাদানের পৃষ্ঠপোষক। এ বিষয়টি লোকশিল্পকলার রূপান্তরের প্রবল শক্তি ও জাতীয় আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার ঝোঁক ও ক্ষমতাকেই তুলে ধরে।
তবে মাঠপর্যায়ে দেখা যায়, এ পেশাজীবী সম্প্রদায় তাদের পেশা নিয়ে খুব একটা সুখ বা স্বস্তিতে নেই। কুশলী ওস্তাদ শিল্পী (Master artist) নবউদ্ভাবনার মাধ্যমে তাঁদের ঐতিহ্যপ্রীতি ও পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি অনুযায়ী কাজ করছেন। ঐতিহ্যপ্রেমিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নতুন চাহিদা মেটাতে যেয়ে তাদের পুরনো কাজ, বিশেষ করে মূর্তিকলা নির্মাণে যে গভীরতর অন্বেষার সুযোগ ছিল তা কমে আসছে। পেশার সম্ভাবনা সম্পর্কে আস্থায় ফাটল ধরায় নতুন প্রজন্মকে ভিন্ন পেশায় ঠেলে দিচ্ছেন। হাঁড়িকুড়ির যে বিপুল বাজার ছিল শিল্পিত পণ্যের বাজার তত বিরাট নয়। বেশি পুঁজি, পৃষ্ঠপোষণা ও মধ্যস্বত্ব লোপ করে এদের জন্য কোনো সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া হলে মৃৎশিল্প নতুনভাবে হয়তো বিন্যস্ত হতে পারে। শহর ঢাকার রায়েরবাজার এবং সাভার ও ধামরাইয়ের কিছু অঞ্চল যেমন কাকরান, কাগজিপাড়া, শিমুলিয়া প্রভৃতি গ্রামে এ পেশা সংকুচিত অবস্থায় বিদ্যমান। দেশের অন্য অঞ্চলের চিত্র ভিন্ন নয়। ক্ষুদ্র ঋণ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা পেলে শিল্পের অবস্থা ও অবস্থানকে তাঁরা সুবিন্যস্ত করতে পারেন।
পাঁচ
মৃৎশিল্পের সঙ্গেই পুতুলের কথা আসে। আর পুতুল যে-কোনো জাতির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও বোধহয় কথাটা বলেছেন বলে মনে পড়ে। তাঁর বক্তব্যের সারকথা ছিল একটা জাতিকে বুঝতে হলে সে-জাতির পুতুল-অধ্যয়ন দিক-নির্দেশক হতে পারে।
শিল্পবোদ্ধা এবং সমাজ ও নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা পুতুল প্রাক-আর্য যুগের আদিবাসী মানুষের হাতে তৈরি। গুরুসদয় দত্ত মনে করেন বাংলার কোনো পুতুলের সঙ্গে আনুমানিক ৪৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব মহেনজোদারো ও হরপ্পার পুতুলের মিল রয়েছে। পুতুল তৈরির পেছনে জাদুবিশ্বাস, ইচ্ছা পূরণ ও শত্র“ নিধনের সম্পর্ক আছে। জাদুবিশ্বাসের একটা ধারায় দেখা যাচ্ছে, ফসল ধ্বংসকারী জন্তুকে হত্যা করার অভিনয় করছে মানুষ। বিশ্বাস, এতে শত্র“র বিনষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এ-বিশ্বাস বর্তমানকালেও ভিন্ন প্রতীকী মর্যাদায় চালু রয়েছে রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি আধুনিক ক্ষেত্রে। আমরা ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের জন্য গঠিত গণ-আদালতের বিচার উপলক্ষে দাহ করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা। প্রাচীনকালের সে-লোকবিশ্বাসের প্রতীকী ধারণাকে নতুন তাৎপর্যে ব্যবহার। লোকশিল্পকলার এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান।
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পট পুতুলের বাঙলা (কলকাতা, ১৯৭৯) বইয়ে বলেছেন, ‘বাঙলার মাটির পুতুলকে লক্ষণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দিক দিয়ে বিচার করে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতীকধর্মী বা সিম্বলিক, আর বাস্তবধর্মী বা ন্যাচারালিস্টিক। প্রত্নবস্তুর মধ্যে পাওয়া পুতুলগুলোর প্রায় সবই প্রতীকধর্মী। এই পুতুলে কোনো ছাঁচ লাগে না। হাত টেপা পুতুল হিসেবে এর পরিচিতি। বাংলাদেশের ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা, মাদারীপুর, জামালপুর, রাজবাড়ীর রামদিয়া ও ময়মনসিংহ শহরসংলগ্ন বলাশপুরে পুতুল তৈরি হয়। ইচ্ছা পূরণ বা মানতের জন্যও মাটির পুতুল উপযোগী উপকরণ। সাভারে ঘোড়াপীরের মাজারে মানতের ঘোড়ার পুতুলের স্তূপ লক্ষণীয়।
মাটির পুতুল ছাড়া কাঠের চিত্রিত মনোলোভা পুতুল তৈরি হতো সোনারগাঁয়ে। মাটির পুতুলে হিউম্যান ফিগারের প্রাধান্য, মানুষের পরেই আসে ঘোড়া, অন্য জীবজন্তুও তৈরি হয়। সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুলে হাতি-ঘোড়াই শুধু আঁকা হয়। এ পুতুল ছিল অতি বিখ্যাত। বিসিক কাপড়ের পুতুলের ব্যাপক প্রচলনকে নান্দনিক শোভনতায় নতুন রূপ দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করেছে। এককালে যা ছিল শিশুতোষ খেলনা, এখন তা গৃহসজ্জার চমৎকার উপকরণ। আমাদের জাতীয় জাদুঘরে সাকিনা খাতুনের পুতুলের মাধ্যমে নজরুলের বাল্য ও যৌবনকালের চিত্রণ শুধু অনিন্দ্যসুন্দর নয়, প্রাচীন শিল্পের নব আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশের এক চমৎকার নিদর্শনও বটে।
ছয়
পটচিত্র বাঙালির লৌকিক শিল্পকলার এক চমৎকার নিদর্শন। প্রাচীন এই শিল্পকলা একসময়ে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল সারা বঙ্গদেশে। শুধু বঙ্গদেশ কেন ভারত, চীন, তিব্বত এই বিশাল ভূভাগে পটচিত্রের প্রচলন ছিল বলে জানা যাচ্ছে। আমাদের উপজাতীয় সমাজ, বৌদ্ধ আর জৈন সম্প্রদায় সবার মধ্যেই পটচিত্রের ব্যবহার ছিল। শিল্পগুরু নন্দলাল বসু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন সফরে যেয়ে বাংলার পটচিত্রের মতোই বৌদ্ধ চিত্র দেখতে পান।
পটচিত্র অনার্যদের উদ্ভাবনা। এই শিল্প বহু ধর্মে অন্তঃপ্রবিষ্ট। বাংলার বৌদ্ধ-হিন্দুর পটচিত্রের প্রাচীনতার কথা বলেছি। হষবর্ধন, চন্দ্রগুপ্তর রাজত্বকালে পটচিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরো বহু আগে থেকে এ পটচিত্রের শুরু। কার্পাস বস্ত্রে ছবি এঁকে গল্পের বা আখ্যানের আকারে তা পড়ে শোনানো হতো, কখনো কখনো বাড়ি বাড়ি গিয়ে, কখনো গ্রামের সাধারণ লোক জমায়েতের স্থলে, কখনো বা হাটে। লম্বা, গুটানো কাপড়ে হাতে আঁকা ছবিই পট। এতে থাকত দেবদেবীর কাহিনি, পৌরাণিক আখ্যান, ধর্ম ও নীতি প্রচারমূলক চিত্র। পটচিত্র লোকের ধর্মপিপাসা যেমন মেটাত তেমনি লোকশিক্ষারও উপায় হয়ে উঠেছিল। পটচিত্রকলার ধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রভাব যেমন পড়েছিল তেমনি শেষদিকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রখর সমাজ-সমালোচনা। বাংলার মুসলমানেরাও এ চিত্রকলার বাইরে থাকতে পারেনি। গাজীর পট তার প্রমাণ। আসলে বাংলার মুসলমানেরা বহু ক্ষেত্রেই হিন্দুদের অনুষ্ঠান পর্বের প্যারালাল তৈরি করেছে। গাজীর পট এর উদাহরণ। পটচিত্রকলা একসময়ে শহর দখল করেছিল, তার প্রমাণ ঢাকা শহরের পটুয়াটুলি সড়ক। আর ইংরেজ আমলে কলকাতার কালীঘাটের পট তো বাস্তবতার অসামান্য দক্ষতা ও সামাজিক অনাচারের সমালোচনায় বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিল। বাঙালির চিত্রকলায়ও এর প্রভাব পড়েছে। স্ক্রলচিত্র নির্মাণের ধারাও পটচিত্রের প্রভাবজাত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ‘মনপুরা’ শীর্ষক বিশাল স্ক্রলচিত্রটি পটচিত্রের আঙ্গিকে করা। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের শিল্পী রুহুল আমিন কাজল ডেনমার্কে দীর্ঘতম পথচিত্র এঁকে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলতে সমর্থ হয়েছেন। এ চিত্রের ধরনও তো পটচিত্রের মতোই দীর্ঘ, তবে তার মৌলিক পার্থক্য হলো পটচিত্র গুটানো আর ওই চিত্র প্রসারিত। একটায় থাকে চিত্রের সঙ্গে কথা ও গান, অন্যটায় বাক্সময় নকশা (Expressive designs)। কাজল ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরে এই চিত্র আঁকেন। দেয়ালচিত্রের রীতি ও বিন্যাসও পটচিত্রের মতো। এ চিত্রের ব্যবহার বাইরের দেয়ালে। দেয়ালচিত্রে এসেছে নতুন আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু। প্রতীকধর্মী বিদ্রƒপ ও ঐতিহ্য অন্বেষার তাগিদে সংগঠিত বাংলা নববর্ষের লোক মিছিল ও সঙের নাগরিক উত্থানের। অনুষঙ্গী চারুকলা ইনস্টিটিউটের দেয়ালচিত্রণ অনিন্দ্যসুন্দর এবং নব-অর্থবোধক। মুখোশ, বিশাল হাতি, বাঘ, সাপ লোকগল্পের শিল্পরূপ সব মিলিয়ে বাংলা নববর্ষের দিনে লোকশিল্পের বিশাল ভোজেরও যেমন এক হৃদয়গ্রাহী আয়োজন।
সাত
নকশি কাঁথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। এরও নানা আধুনিক ও তাৎপর্যময় ব্যবহার আছে। বঙ্গবন্ধু ও শিল্পাচার্য ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য আমাদের সংবিধানে এর ব্যবহার করেছেন। বিস্তারে যাবার সুযোগ নেই। এর নবায়ন নতুন নাগরিক রুচির চাহিদা মেটাচ্ছে। তবে পুরনো নকশি কাঁথার সিম্বল, মোটিফ ও গভীরতর ভাব-ব্যঞ্জনা নতুন কাঁথাশিল্পে তেমন করে নেই। এর ব্যবহারে শৌখিনতাটুকু বেড়েছে, ঝরে পড়েছে sacredness। প্রাচীন নকশি কাঁথায় পুরাণের পৃথিবীর বহু অনুষঙ্গ আছে, ধ্বংস ও সৃষ্টিচক্রে বিশ্বজগতের চলমানতার প্রতীকী চিত্র ও রূপকল্প সূর্য পদ্ম জীবনবৃক্ষ ইত্যাদি পুরনো, ব্যবহৃত জিনিসের মাধ্যমে নবসৃষ্টির প্রেরণা আছে, পারিবারিক বন্ধনকে সংযুক্ত করে রাখার অভীপ্সা আছে – দূরের যাত্রী আত্মীয়কে স্মৃতিময়তায় ধরে রাখার বাসনা আছে – এবং সর্বোপরি দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের কাছে মঙ্গল কল্যাণের কামনা আছে। বাঙালির দর্শন, অধ্যাত্মসাধনা, জাদুবিশ্বাস, ইচ্ছা পূরণের সাধনা ও বিশ্ববীক্ষার নানা উপাদানে কাঁথা অনন্য বহু অর্থ প্রতীক ও গূঢ় অর্থ ব্যঞ্জনাঋদ্ধ এ গভীরতর লোকশিল্পটি নিরক্ষর গ্রামীণ মহিলাদের এক বিস্ময়কর শিল্পকুশলতার ফসল।
বাংলার লোকশিল্পের এক শক্তিশালী বিষয় আলপনা চিত্র। নকশি কাঁথার মতোই এ শিল্পটি আমাদের কৃষিজীবী সমাজের মেয়েলি হাতের সৃষ্টি। আচার-অনুষ্ঠান ও ব্রতের সঙ্গে এ লোককলারীতিটির গভীর সংযোগ। মূলত জাদুবিশ্বাস ও ইচ্ছা পূরণের শিল্পটিকে এখন একটি সুখদ সেক্যুলার রূপ দেওয়া হয়েছে। এ লোকশিল্পরীতিটির নাগরিক উজ্জীবন ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। বিয়ের আসর – বাসর তো বটেই, মহান একুশের আগের দিন রাতে শহীদ মিনার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে বিপুল আলপনা চিত্র করা হয় তা শহীদ দিবসকে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ারই এক চমৎকার নিদর্শন। আসলে ঐতিহ্য যে নতুন ঐতিহ্য নির্মাণ করে এ তারও এক উদাহরণ।
ফুটনোট
১. Folk Arts And Crafts of Bengal : The Collected Papers : Gurusaday Dutt-Calcutta, 1990.
২. Folk Arts of Bengal : Ajit Mukherjee University of Calcutta, 1964, New and Revised edition.