আ বু সা ঈ দ তু লু
বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। দীর্ঘ ঐতিহ্যম–ত ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী বাংলাদেশি বাঙালি। বাংলার প্রাচীন পর্বের শিল্প-সাহিত্য প্রধানত উপস্থাপনকেন্দ্রিক ব্যাপ্ত ছিল। তা ছিল স্মৃতিনির্ভর কিংবা হস্তলিখিত। বাংলা পরিবেশনা শিল্পকৌশলের প্রায় সমস্তটাই মুসলিম-হিন্দু, সুফি-বৈষ্ণবীয় ঘরানায় সুগঠিত হয়েছিল। বাংলা নাট্যের জীয়ন্তকাল মধ্যযুগে মুসলিম পর্বেই। সেলিম আল দীন ভরত নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত ‘ওড্রমাগধী’ আঞ্চলিক রীতি হিসেবে বৃহত্তর বাংলা ভূখ–র নাট্য প্রবৃত্তির পরিচয় শনাক্ত করেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ-এর ১৭ সংখ্যক চর্যায় ‘নাচন্তি বাজিল গান্ধি দেবী বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই’ উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে এ সময়ে বৃহত্তর বাংলায় নাট্য অস্তিত্বের সমূহ প্রবহমানতা ছিল বলে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। বাংলার প্রাচীন যুগের নানা সাহিত্য নিদর্শনে নানাভাবে নাটক ও অভিনয়ের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সেখ শুভোদয়া, শূন্যপুরাণ, গীতগোবিন্দম প্রভৃতিও ছিল পরিবেশনা। চর্যায় ‘এক সো পদুমা চউসট্ঠী পাখুড়ী, তঁহি চড়ি নাচই ডোম্বী বাপুড়ি’ ইত্যাদির মধ্যদিয়ে সমকালীন বৃহত্তর বঙ্গ সংস্কৃতির মধ্যে নাট্য পরিবেশনা শিল্পের নানা উপাদান ও উপকরণ বিধৃত হয়। পাল শাসন অধিভুক্ততায় বিভিন্ন ভাস্কর্য, পুঁথিচিত্র প্রভৃতিতে বাংলা অঞ্চলের নৃত্য সংবলিত নাট্যের অস্তিত্বের প্রামাণ্য তৈরি করে। বাংলা সংস্কৃতির ইসলামী শাসনাধ্যায়ে সমস্ত সাহিত্য ও শিল্প সমস্তটাই ছিল পরিবেশনা। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগে আসর-দর্শক-গায়েন-দোহার অধ্যুষিত আখ্যান মাত্রই নাট্যরূপে বিবেচ্য। বাংলা নাট্য মূলত বর্ণনাত্মক আখ্যানের পরিবেশনা।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুলতানি-মোগল শাসনযুগের অন্যতম নাট্যাঙ্গিক ছিল পাঁচালি। রামায়ণ-মহাভারত প্রভৃতি পাঁচালির আঙ্গিকে পরিবেশিত। ওই সময় ‘নেটো’ নামে জনপ্রিয় নাট্যরীতির পরিচয়ও পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণমঙ্গল, শ্রীচৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতিও নাট্যমূলক পরিবেশনা। মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যধারা ছাড়াও প্রণয়মূলক ও পীরমাহাত্ম্য পাঁচালি নাট্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। যেমন – ইউসুফ জোলেখা, বিদ্যাসুন্দর, লাইলী মজনু, পদ্মাবতী, খোয়াজখিজিরের জারি, মাদারপীরের জারি উল্লেখযোগ্য। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এগুলো ছাড়াও সমস্ত বৃহৎ বঙ্গে নানা ধরনের নাট্য পরিবেশনা আঙ্গিক ও রীতি বিদ্যমান ছিল। যেমন – মহুয়া, মলুয়া, কাঞ্চন কন্যা, দেওয়ানা মদিনা প্রভৃতি সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমস্ত বঙ্গে ‘যাত্রা’ নাট্যাঙ্গিকের অসম্ভব জনপ্রিয়তা বিদ্যমান ছিল। বাংলা নন্দনতত্ত্বের ভিত্তিমূল হিসেবে সেলিম আল দীন বৈষ্ণবীয় ঘরানার উজ্জ্বলনীলমণিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। বাংলা সাহিত্য-শিল্প অদ্বৈতের চেতনায় একাকার বলে উল্লেখ করেন। যদিও নবদ্বীপকেন্দ্রিক সাহিত্য-শিল্পচর্চা ঘরানার প্রাধান্য ব্রিটিশ ইতিহাসকরণে সৃষ্ট।
বাংলা সংস্কৃতির মধ্যযুগে সাহিত্য-শিল্পের উপস্থাপনের মধ্যে পাঁচালি, কীর্তন, কথা, কথকতা, লীলা, হাস্তর প্রভৃতি রীতি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। পাঁচজন গায়েন-দোহার মিলে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে পরিবেশিত কাহিনি বা আখ্যানকেই পাঁচালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ পাঁচ ধরনের পরিবেশনের সন্নিবেশিত উপস্থাপন বলে পাঁচালি বলতে অধিকতর যুক্তি দেখান। তা হচ্ছে – পা-চালী, ভাবকালি, নাচাড়ি, বৈঠকী, দাঁড়া কবি ইত্যাদি। পাঁচালি পরিবেশনের পাঁচটি পারিভাষিক শব্দও উল্লেখ্য – কথা, বোলাম, দিশা, পদ ও নাচাড়ি। মধ্যযুগের উল্লেখযোগ্য পাঁচালি হচ্ছে – জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল, মানিক দত্তের চ-ীম-ল। পাঁচালি সাধারণত দু-ধরনের হয়ে থাকে – কৃত্য পাঁচালি ও প্রণয় পাঁচালি। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যসমূহ কৃত্য পাঁচালির আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। মানবিক প্রেম-আখ্যান বর্ণিত হতো প্রণয় পাঁচালিতে। মধ্যযুগের অমত্ম্য পর্যায়ে খ- পালা কাহিনি অবলম্বন করে পাঁচালি গড়ে উঠত। এ ধরনের পাঁচালিতে তিনটি পরিবেশনামূলক শব্দ পাওয়া যায়। তা হচ্ছে – ধুয়া, পয়ার, ত্রিপদী বা নাচাড়ি, কখনো বা শিকলি। পাঁচালিকে সম্পূর্ণই নাট্য বিবেচিত। এতে নাট্য বৈশিষ্ট্যের সমস্তটাই দেখা যায়। বর্ণনা, নৃত্য, গীত, অভিনয়ের হাবভাব, কাহিনি, সংলাপ সমস্তটাই ফুটে উঠত। মধ্যযুগের এ শিল্পকর্মেই যথার্থভাবে দ্বৈতাদ্বৈত শিল্পগুণ ফুটে
উঠত বলে সেলিম আল দীন অভিমত পোষণ করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা বৈঠকিরীতির নাট্য হিসেবে কথকতারীতি দেখা যায়। অভিব্যক্তি-ভঙ্গিমা, গীত-সুরে আখ্যায়িত হতো এ রীতিটি। অনেকে মনে করেন, পাঁচালির পদ ও পয়ারের ওপর ভিত্তি করেই উত্তর সময়ে এ কথকতা রীতির সৃষ্টি হয়েছে। সেলিম আল দীন এ কথকতা বা পাঠ অভিনয় ধারায় সমকালীন কথানাট্যের উদ্ভাবন ঘটান।
মধ্যযুগের শিল্প-সাহিত্যের আরেকটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে ছিল কীর্তন ও লীলা। কীর্তন মূলত এক ধরনের বন্দনাগীতি। কীর্তনের সঙ্গে লীলা যুক্ত হয়ে নাট্য বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে। এ লীলাকীর্তনে গীত, সংলাপ, বর্ণনা প্রভৃতি নাট্যগুণে উজ্জ্বল। কীর্তন পরিবেশনে পাঁচটি অংশ থাকে – কথা, তুক, ছুট, ঝুমুর ও আখর। এর সঙ্গে মধ্যযুগের পরিবেশনা নাট্যশিল্পে আরেকটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে লীলানাট্য। অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা বা দেবতা-দেবতাকল্প মানুষের কাহিনিভিত্তিক নাট্য। যেমন – কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, চৈতন্যলীলা প্রভৃতি। লীলানাট্য এক চরিত্রবিশিষ্ট বা একাধিক চরিত্রবিশিষ্ট হয়ে থাকে। লীলানাট্যের পরিবেশন কখনো মঞ্চকেন্দ্রিক বা কখনো পরিবেশকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। অমত্ম্যবিভাজনের নির্ভরতায় নামকরণও হয়। যেমন – ডঙ্ক নাট্য, কালিয়দমন নাট্য – এগুলো এক চরিত্রবিশিষ্ট। অনুরূপ গীতগোবিন্দ মঞ্চকেন্দ্রিক লীলানাট্য। এ লীলানাট্যের উদ্ভব বাংলায় এবং মধ্যযুগে অত্যন্ত জনপ্রিয় পরিবেশনা শিল্প। উত্তরকালে লীলানাট্য শিথিল অর্থে যাত্রা নামেও উপস্থাপিত হয়। যেমন – কৃষ্ণযাত্রা, রামযাত্রা প্রভৃতি। বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের মধ্যযুগ খ্যাত অধ্যায়ে নানা আঙ্গিক, নানা বৈচিত্র্যের নাট্যক্রিয়াদির পরিচয় বিধৃত হয়।
বাংলা নাট্য একটি আঙ্গিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন রূপ ও আঙ্গিকের মধ্য দিয়েই বাংলা নাট্য বহমান। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা নাট্য বলতে কোনো একটি আঙ্গিককেই নির্দিষ্ট করে না। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশনা শিল্পের অন্যান্য বিষয় থেকে নাট্যকে আলাদা করা হয়ে থাকে। বিশ্বনাট্য ধারায় বাংলা বৈশিষ্ট্য আলাদা নাট্য ও হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বাংলা নাট্য বর্ণনাত্মক। বাঙালি জাতির উপস্থাপনীয় নাট্য শিল্পস্বরূপ প্রধানত বর্ণনাকেই ভিত্তি করে প্রদর্শনরীতি বাঙালি জীবনের মধ্যযুগ অধ্যায়ে সর্বত্রই দেখা যায়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে মঞ্চ ছিল আসরকেন্দ্রিক। চারদিকে দর্শক বসত এবং মাঝখানে সংঘটিত হতো নাট্যক্রিয়া। কৃত্যনাট্যে কখনো কখনো মঞ্চ বানিয়ে নাট্য উপস্থাপন করা হতো। সেলিম আল দীন মধ্যযুগের পরিবেশনায় – ভূমি সমতল বৃত্তমঞ্চ, চৌকোণ খোলা মঞ্চ বা চৌপথ খোলা মঞ্চ, গৃহাঙ্গন প্রভৃতি স্থায়ী বা অস্থায়ী মঞ্চ ব্যবহৃত হতো বলে তুলে ধরেন। উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও বর্ণনাত্মক সর্বত্রই প্রচলন ছিল। হাজার বছরের এ বর্ণনাত্মক নাট্যধারায় গায়েনরীতি, কথানাট্যরীতি ইত্যাদি নানা রীতিতে উপস্থাপিত হতো। অভিনয়রীতির ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী বাংলা অভিনয়রীতিও ছিল বর্ণনাধর্মী। এটা আবার কথকতারীতি হিসেবেও উল্লেখ্য। গায়েন বা কথক ঘটনার বর্ণনা করেন এবং একই সঙ্গে চরিত্ররূপ অভিনয় করতেন। পাশ্চাত্যের চরিত্রাভিনয়ের মতো একই চরিত্রমোহে আবদ্ধ না থেকে আসরে উপস্থিত দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করেন। পাশ্চাত্যের অভিনয় থেকে বাংলার ঐতিহ্যের ধারায় অভিনয়রীতি ভিন্ন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা অভিনয়রীতি জীবনের ব্যাখ্যা করে। সেলিম আল দীন বর্ণনাত্মক অভিনয়ের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচলিত তিনটি প্রধান দিক তুলে ধরেন। এক. গায়েন বিশুদ্ধ বর্ণনাত্মক রীতির আশ্রয় নেন। যা জারি, হাস্তর গান প্রভৃতি নাট্যের উপস্থাপনায় দেখা যায়। দুই. কখনো অভিনয়ে গায়েন কাহিনির অন্তর্গত চরিত্রগুলোকে নানা ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন এবং তিন. চরিত্রাভিনয়ের মতো অভিনয়। লীলাযাত্রায় দোহার সহযোগে চরিত্রাভিনয় সম্পন্ন হয়। বাংলা নাট্যরীতিতে একজন অভিনেতা একই সময়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন। পাশ্চাত্যের সংলাপের মতো ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যে সংলাপনির্ভরতা নেই। এখানে কাহিনি বা ঘটনা বর্ণনার উক্তি-প্রত্যুক্তিই প্রধান। গায়েন বা বর্ণনাকারী কখনো সরাসরি চরিত্রের সঙ্গে
উক্তি-প্রত্যুক্তি করেন, আবার কখনো দোহার বা সহযোগীর সঙ্গেও উক্তি-প্রত্যুক্তি করেন। কাহিনিবিন্যাস বা বৃত্তরীতিতে নানা রকমের বৃত্ত ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যে দেখা যায়। এতে প্রথমে বন্দনা থাকে, পরে নৃত্য-গীত সহযোগে কাহিনি উপস্থাপিত হয়। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের
শিল্প-নন্দনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প বৈশিষ্ট্যের বলে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে বর্ণনা, গান, নৃত্য, অভিনয়, কথা সবকিছুই এ নাট্যে একীভূত বা অদ্বৈত। সে প্রেক্ষিতে ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যকে সেলিম আল দীন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প বলে উল্লেখ করেছেন। প্রচলিত বাংলা নাট্যের বিভিন্ন আঙ্গিক ও বিষয়বৈচিত্র্যের যেমন সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি বৈচিত্র্য রয়েছে নাট্য উপস্থাপনার সহযোগ বিধানমূলক কর্ম তৎপরতায়।
উপনিবেশিত বাংলার নাট্যাতিহাসে বলা হয়ে থাকে – ১৭৫৩ সালে কলকাতায় প্রসেনিয়াম মঞ্চ স্থাপন এবং ১৭৯৫ সালে লেবেদেফের ডিসগাইজ বা কাল্পনিক সংবদল ও লাভ ইস দ্য বেস্ট ডক্টর নাটক অনুবাদ ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েই বাংলা নাটকের শুরু। সেলিম আল দীন গবেষণায় তুলে ধরেন – এ ধারণাটি ভুল। ডিসগাইজ দিয়ে বাংলা নাটকের শুরু নয়; বরং পাশ্চাত্য প্রভাবিত ‘থিয়েটার’ নামক ধারণার শিল্পাঙ্গিকের শুরু হয়। আমাদের ভাষায় ‘থিয়েটার’ শব্দটি ইতোপূর্বে ছিল না। ‘থিয়েটার’ শব্দটি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমাদের শব্দভা-ারে যোগ হয়েছে। পারিভাষিক অর্থে থিয়েটার বলতে যা বোঝায় তা আমাদের বাঙালি জীবনে দীর্ঘদিন ধরেই বহমান ছিল। সেলিম আল দীন মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য গ্রন্থে বলেন – ‘নাটকের মতো একটি জননন্দিত শিল্পমাধ্যম শুদ্ধ উনিশ শতকের আকস্মিক উদ্ভাবনা নয়। নানা রূপে ও রীতিতে, আমাদের এই জনপদে সহস্র বছর ধরে এর ধারা বহমান ছিল।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাঙলা নাটকের প্রাচীন ও মধ্যযুগে ‘নাটক’ কথাটি প্রায় দুর্লভ।… আমাদের নাটক পাশ্চাত্যের মতো ‘ন্যারেটিভ’ ও ‘রিচুয়্যাল’ থেকে পৃথকীকৃত সুনির্দিষ্ট চরিত্রাভিনয় রীতির সীমায় আবদ্ধ নয়। তা গান, পাঁচালি, লীলা, গীত, গীতনাট, পালা, পাট, যাত্রা, গম্ভীরা, আলকাপ, ঘাটু, হাস্তর, মঙ্গলনাট, গাজীর গান ইত্যাদি বিষয় ও রীতিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে।’
সেলিম আল দীনের ইতিহাস চেতনা ও নাট্যরচনা, নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনা-নেতৃত্ব, সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনা সমকালীন ঐতিহ্যবাহী আধুনিক বাংলা নাট্যচর্চার ভিত্তিমূল হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যকে দুটি বিভাজনে দেখা যেতে পারে। একটি শহরে বা কেন্দ্রিক পর্যায়ে, অন্যটি গ্রামীণ বা প্রান্ত পর্যায়ে। যদিও এ কেন্দ্র ও প্রান্ত সৃষ্টিও উপনিবেশ। উপনিবেশের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থেই এই কেন্দ্র ও প্রান্ত তত্ত্বের সৃষ্টি। আবার উপনিবেশের ‘ফোক’ পরিভাষাটি ব্যবহারের মধ্যদিয়েও দেশীয় শিল্পের বিকাশকে অবদমিত রাখার একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৌশল লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা আঙ্গিকের ঐতিহ্যবাহী নাট্য। সেলিম আল দীন বাঙলা নাট্যকোষ গ্রন্থে প্রাচীন ও মধ্যযুগের অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিকের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – পাঁচালি, লীলা, গীত, গীতনাট, পালা, পাট, যাত্রা, গম্ভীরা, আলকাপ, ঘাটু, হাস্তর, মঙ্গলনাট, গাজীর গান ইত্যাদি। সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের পরিবেশনা শিল্পকে ‘ফোকস্টাডিজ’-এ লোকনাট্য ঐতিহ্য হিসেবে জরিপমূলক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। এখনো বাংলাদেশের লোকায়ত পর্যায়ে নানা আঙ্গিক বৈচিত্র্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নাট্যপালা। বর্তমান বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যায়ে বহুল উপস্থাপিত নাট্য ‘পালা’। সাধারণত পরিবেশনযোগ্য কাহিনিই পালা হিসেবে আখ্যায়িত। কাহিনির প্রাধান্য বা নির্ভরতা বিদ্যমান থাকে বলে এ শ্রেণির নাট্যকে পালা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ‘পালা’ নাট্য আঙ্গিকটি বাঙালি জীবনের মধ্যযুগের অন্তিমপর্যায়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। মঙ্গলকাব্য ধারার উপস্থাপন রীতিই ছিল প্রধানত পাঁচালি-পালাকেন্দ্রিক। তাছাড়াও বাঙালি জীবনে নানা বিষয়-বিন্যাসে পালা উপস্থাপিত হয়ে থাকে। বৈশিষ্ট্য ও বিষয় অনুসারে পালা ভিন্ন ভিন্ন নামেও পরিচিত। যেমন – মহুয়া পালা, দস্যু কেনারামের পালা ইত্যাদি। বর্তমান বাংলাদেশে মানবীয় প্রেম-আখ্যান নিয়ে নানা নামকরণে পালা পরিবেশিত হয়ে থাকে। এ নাট্যাঙ্গিকটি চারপাশের খোলা মঞ্চে অভিনীত হয়। কখনো কখনো কৃত্রিম মঞ্চও স্থাপিত হয়। সাধারণত লোকায়ত হিন্দু, মুসলমানদের ধর্মীয় বা বিশ্বাসগত বিষয়বস্ত্ত এবং বাঙালি জীবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর নানা বিষয় ও চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে এসব পালা গড়ে ওঠে। যেমন – মহিষাসুরবধ পালা ইত্যাদি। পালাগানে একজন মূল গায়েন বা বয়াতি থাকেন। পালার সংগীত, কাহিনি ও নাট্যিক উপস্থাপনে দোহারগণ সাহায্য করে থাকেন। পালাগানের কবি সাধারণত পদকর্তা হিসেবে পরিচিতি পান। ঔপনিবেশিক টার্ম পালাকে গীতিকা বা ব্যালেড হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। পালার বৈশিষ্ট্যসমূহে বর্ণনা, ঘটনা, অভিনয়, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি বিদ্যমান থাকে। সংগীতনির্ভর আরেকটি প্রধান নাট্য আঙ্গিক ‘গান’। আপাতভাবে ‘গান’কে শুধুই সংগীত মনে করা হলেও
নৃত্য-সংগীত-কাহিনিনির্ভর নাট্যপরিবেশনা। এতে সংগীতকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে বলে এ শ্রেণির নাট্যের নামকরণ করা হয় ‘গান’। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন লীলা, যাত্রা, হাস্তর, পাঁচালি প্রভৃতি নাট্য আঙ্গিকের সঙ্গে সুর ও ছন্দের প্রাধান্য থাকলে আঙ্গিকগুলোর সঙ্গে ‘গান’ যুক্ত হয়ে থাকে। যেমন – পালাগান, যাত্রাগান, হাস্তরগান, পাঁচালি গান ইত্যাদি। বিষয়ানুসারে বর্তমানে গানের নামকরণও হয়ে থাকে। যেমন – রামায়ণ বিষয়ক বা চরিত্রনির্ভর এ আঙ্গিকের নাম হয় ‘কুশানগান’। পীর মাহাত্ম্যমূলক গানও পরিবেশিত হয়; যেমন – গাজীরগান ইত্যাদি। এ গান নাট্যক্রিয়ায় বর্ণনা, কাহিনি, অভিনয়, নৃত্য ও সংগীতের বৈশিষ্ট্য দৃষ্ট হয়। এগুলো ছাড়াও সংগীতনির্ভর তুলনামূলক তত্ত্ব পরিবেশনকেন্দ্রিক নাট্য ‘কবিগান’ পরিবেশিত হতে দেখা যায়। এতে কাব্যিক চেতনা প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। এ শ্রেণির নাট্যে সাধারণত দুটি দল থাকে। কবিয়ালকে প্রধানত তর্কযুদ্ধে সহযোগিতা করেন তার দলের প্রধান ঢোলবাদক ও দোহারগণ। এছাড়া বিচারগান নামে বাঙালি সমাজে নাট্যাঙ্গিক লক্ষ করা যায়। বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে ‘জারি’। জারি আখ্যানমূলক গাথা বা পাঁচালি, শোকগাথা। জারিগান ইসলাম ধর্মীয় বিয়োগান্ত ঘটনা ভিত্তি করে উদ্ভব ও বিকাশ হলেও বর্তমানে তা বিষয়বিন্যাস, অঙ্গবিন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ছোট আকারে বিশেষ সুরে গাওয়া হলে তাকে মর্সিয়া এবং বয়াতি বা গায়ক আলাদা সুরে কাহিনিবিন্যস্ত-বিসত্মৃতভাবে পরিবেশিত হলে তাকে জারি গান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। জারিগান আবার ধুয়া গান হিসেবেও পরিচিত। পরিবেশনের সময় বয়াতি বেহালা, সারিন্দা, দোতারা বা ডুগডুগি বাজায় এবং যন্ত্রীরা ঢোলক, একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বেহালা, বাঁশি, জুড়ি বা ঘুঙুর, খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, কাঁসা ইত্যাদি বাজায়। বাঙালি জীবনে লোকায়ত জীবন-পীরমাহাত্ম্যসহ নানামুখী বিষয় নিয়ে বর্তমানে জারি নাট্য প্রদর্শিত হয়। এ জারি নাট্যের সঙ্গে গান শব্দটিও যুক্ত থাকে। যেমন – জারিগান ইত্যাদি। অতিপরিচিত নাট্য ‘যাত্রা’। ধর্মীয় চেতনা থেকে এ আঙ্গিকের সৃষ্টি হলেও বর্তমানে নানা বিষয়ের যাত্রাপালা প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এ আঙ্গিকটির সঙ্গে পাশ্চাত্যের থিয়েটার আঙ্গিকের অনেক সাদৃশ্য বিদ্যমান। যাত্রা ঐতিহাসিক, পৌরাণিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সমকালীন ও সাহিত্যনির্ভর নানা বিষয় আশ্রিত। নৃত্য-গীত তারপরে যাত্রাপালা আরম্ভ হয়। যাত্রায় হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোলক, ড্রাম, কঙ্গো, বেহালা, কার্নেট, অর্গান, বাঁশি, ক্লারিওনেট ব্যবহৃত হয়। সে প্রেক্ষিতে কৃষ্ণযাত্রা, নিমাই সন্ন্যাস যাত্রা ইত্যাদি সনাতন ধর্মীয় কৃত্যমূলক যাত্রা প্রদর্শিত হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মের কারবালার বিয়োগান্ত কাহিনি নিয়ে পরিবেশনার নাম ইমামযাত্রা। মহাভারতের দ্রৌপদী আখ্যান ও জীবনমাহাত্ম্য বিশিষ্টতা নিয়ে একটু আঙ্গিকের সংযোজন-বিয়োজনে ধর্মভিত্তিক পরিবেশনা ‘ঢপযাত্রা’। এ শ্রেণির নাট্য পরিবেশন বৈশিষ্ট্যে সাধারণত বর্ণনামূলক হয় না। পাশ্চাত্যের চরিত্রাভিনয়ের মতো উপস্থাপিত হয়। অনেকে মনে করে থাকেন – জনপ্রিয়তার কারণে ব্রিটিশ সংস্কৃতির নানা স্পর্শ লেগেছে এ শিল্প আঙ্গিকটিতে। ফলে এর স্বরূপ অনেকটা ইউরোপীয়দের মতো হয়েছে। হয়তো সে প্রেক্ষিতেই এ নাট্য আঙ্গিকে বিদেশি নানা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এবং বিদেশি কিছু টার্মও ব্যবহার হতে দেখা যায়। উত্তরবঙ্গে নৃত্য, গীত, কথা, ছড়া ইত্যাদির সংমিশ্রণে ‘আলকাপ’ উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। এ আঙ্গিকটি বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে দেখা যায়। এতে দশ-বারোজন শিল্পী নাচ-গানের মাধ্যমে সমাজ বাস্তবতার নানা হাস্য-কৌতুক উপস্থাপন করেন। আলকাপে ছেলেরা মেয়ে সেজে নৃত্য-গীত ও অভিনয় করে থাকে। আলকাপ অনেকটা ভাঁড়ামির মাধ্যমে দর্শকদের হালকা আনন্দ দান করে থাকে। উত্তরবঙ্গের আরেকটি নাট্য আঙ্গিক ‘গম্ভীরা’। সনাতন ধর্মীয় শিবকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির নাট্যমূলক পরিবেশনাই গম্ভীরা নামে পরিচিত। এতে তিনটি পর্ব থাকে – শিবের জাগরণ, নানারূপ কৃত্য ও মুখোশ নৃত্য বা নাট্য। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির দিন এটি পরিবেশিত হয়। বর্তমান কৃষক সমাজ জীবনের হালকা হাস্যাত্মক বিনোদনমূলক পরিবেশন নাট্য হিসেবে বিবেচিত। ধর্মীয় আখ্যানে নির্মিত হলেও পারিবারিক ও সামাজিক জীবন আশ্রিত নাট্য উপাখ্যান। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে জনপ্রিয় একটি নাট্য আঙ্গিক। এতেও বর্ণনা, সংগীত ও উক্তি-প্রত্যুক্তি দেখা যায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি পরিবেশনা ‘সঙযাত্রা।’ সঙযাত্রা সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নানা অসংগতি নিয়ে পরিবেশিত নাট্য। বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলে এ সঙযাত্রা পরিবেশন দেখা যায়। ‘সঙ’ নাট্যরীতিটি মূলত কৌতুক, গান, নাচ ও অভিনয়ের একটি বিশিষ্ট রঙ্গব্যঙ্গাত্মক চিত্র। ‘সঙ’ অত্যন্ত সমসাময়িক বিষয়বস্ত্ত আশ্রিত। এর পরিবেশন শিল্পীরা পারিবারিক, সামাজিক জীবন-বাস্তবতার নানা অসংগতিপূর্ণ ঘটনা বা চরিত্র সর্বোপরি পারিপার্শ্বিক ক্ষমতা-কাঠামোকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও হাস্য-কৌতুকের ছলে সেসব সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে। বিলুপ্তপ্রায় ‘ঘাটু’ নৃত্য-গীতনির্ভর একশ্রেণির নাট্য। হালকা বিনোদন প্রদানই এর লক্ষ্য। এর কাহিনি সহজ-সরল হয়ে থাকে। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে উপস্থাপিত হতো বলে এ নাট্য আঙ্গিকের নাম ঘাটু, ঘাটু গান, ঘেটু গান, ঘাটুর গান ইত্যাদি। এতে কিশোর বালক বালিকা সেজে নৃত্য-গীত ও অভিনয় করে থাকে। এই ঘাটুর গানে স্থূল ইন্দ্রিয় প্রেম উপস্থাপিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক জীবননির্ভরতা অনেকাংশে কমে যাওয়ায় এ ঘাটুর গানের প্রচলনও অনেক কমে গেছে। এ ছাড়াও ‘পুতুল নাট্য’ একটি জনপ্রিয় নাট্য আঙ্গিক। পুতুলকে কেন্দ্র করে সূত্রধার কাহিনি উপস্থাপন করেন এ শ্রেণির নাট্যে। বিভিন্ন মাধ্যমে নির্মিত পুতুল বা পশু-পাখি-মানব মূর্তি দ্বারা সঞ্চালিত নাট্য ক্রিয়াই পুতুল নাট্য হিসেবে পরিচিত। পুতুল নাট্যে জীবন্ত নাট্যশিল্পের মতোই বর্ণনা, কাহিনি, সংলাপ, গীত-নৃত্য থাকে। শুরু নৃত্যমূলক পরিবেশনা হলে পুতুল নাচ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বাংলা নাট্যে পুতুল নাট্যও একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ঐতিহ্যবাহী নাট্যে নানা আঙ্গিকের মধ্যে বৈশিষ্ট্যানুসারে নামকরণ করা হয়ে থাকে। কখনো একটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অন্য বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েও সংযোজিত নাম ব্যবহৃত হয়। ঊনবিংশ শতকে এতে ইউরোপীয়রা তাদের নির্ধারিত প–তবর্গের দ্বারা ঐতিহ্যবাহী ধারাকে ফোকলোর তত্ত্বের মধ্যে ফেলে এ জীবন্ত শিল্পের প্রাণভোমরাকে মেরে ফেলতে চান।
ঐতিহ্যবাহী নাট্য বৈশিষ্ট্যে সমকালীন নাট্য প্রযোজনার আদর্শ বা প্রভাব বাংলাদেশের অধিকাংশ নাট্যদলগুলোর নাট্য প্রযোজনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রাম থিয়েটার আনেদালন বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান নাট্যচর্চায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য-বিকাশী নাট্যচর্চাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। ঐতিহ্যের ধারায় প্রায় শতাধিক নাট্য প্রযোজনা গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশে মঞ্চে সবচেয়ে আলোচিত ও দর্শকপ্রিয়। সেলিম আল দীনের উপনিবেশ বিযুক্তিকরণ কৌশলী তৎপরতা, ইতিহাসের বিভ্রান্তির বিপরীতে হাজার বছরের বাংলা নাট্যের ইতিহাস, সৈয়দ জামিল আহম্মেদের বিষাদসিন্ধু, বেহুলার ভাসান প্রভৃতি পরিবেশনা এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফের বাংলার নিজস্ব নাট্য পরিবেশনা আন্দোলন বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে বেনিয়া তত্ত্বের বিপরীতের ঐতিহ্য-বিকাশী আদর্শে পরিণত করেছে।
ঐতিহ্যের ধারায় শহর পর্যায়ে সমকালীন বাংলা নাট্যগুলোর মধ্যে ঢাকা থিয়েটারের বনপাংশুল, ধাবমান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমলারানীর সাগরদিঘি, বেহুলার ভাসান, শাজাহান; সং ভং চং নাট্যকেন্দ্রের আরজচরিতামৃত; দেশ নাটকের নিত্যপুরাণ, পদাতিকের বিষাদসিন্ধু, মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের নিশিমন বিসর্জন, পালাকারের নারীগণ, বটতলার খনা, স্বপ্নদলের চিত্রাঙ্গদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি, বিষাদসিন্ধু; জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের কীর্ত্তনখোলা, প্রাচ্যনাটের কইন্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্মাবতী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর খনা, লোকনাট্যদলের লীলাবতী আখ্যান, সোনাই মাধব, সুবচন নাট্য সংসদের মহাজনের নাও, আরণ্যকের রাঢাঙ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখরা রমণী বশীকরণ, সাধনার চম্পাবতী, সিএসটির ভেলুয়া, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের আমেনা সুন্দরী, আরশীনগরের সেই রাতে পূর্ণিমা ছিল, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের গহর বাদশা ও বানেছা পরী, মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের নীলাখ্যান, শিবানী সুন্দরী, অন্বেষা থিয়েটারের ভানু সুন্দরীর পালা, বুনন থিয়েটারের নকসী কাঁথার মাঠ, বঙ্গলোকের রূপচান সুন্দরীর পালা, যশোরের বিবর্তনের মাতব্রিং, বোধন থিয়েটারের চন্দ্রাবতী কথা, ভোলা থিয়েটারের গ্রন্থিকগণ কহে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সমকালে ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রযোজনা ধাবমান নাট্য। সেলিম আল দীন ঐতিহ্যবাহী মধ্যযুগের বাংলার পাঁচালি ও কথকতার ধারায় সমকালীন প্রয়াস হিসেবেই রচনা করেছেন তাঁর অনেকগুলো নাটক। ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা বনপাংশুল মধ্যযুগের পাঁচালি ধারায় সমকালীন বৈশিষ্ট্যে রচিত। এ নাটককে বলা হয় নব্যপাঁচালি। নাট্য উপস্থাপনে বাংলার ঐতিহ্য-উৎসারী ধারায় চারদিকের দর্শক পরিবেষ্টিত মধ্যমঞ্চে উপস্থাপন হয়েছে। বন্দনা, বর্ণনা, উক্তি-প্রত্যুক্তি, নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ সমকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে অত্যন্ত শিল্পকুশলতায় ফুটে উঠেছে। ধাবমান নাট্যটি উপস্থাপনেও মঞ্চবিন্যাস ছাড়া ঐতিহ্যের ধারায় বহমান বাংলা নাট্য অন্যান্য সমস্ত বৈশিষ্ট্যই লক্ষ্যণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহুলার ভাসান সমকালীন বাংলা নাট্যের মাইলফলক। একদিকে স্বতঃসিদ্ধ পৌরাণিক বেহুলাকে সাধারণ পারিপার্শ্বিকতার ‘বেহুলা’ নিরীক্ষা এবং অন্যদিকে নৃত্য-গীত-বর্ণনা-উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে চারদিকের দর্শক পরিবেষ্টিত মঞ্চে উপস্থাপন বাংলাদেশের নাট্যাতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। নবদর্শনজাত এ নাট্যটির নির্দেশনায় ছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। বটতলা নাট্যদলের প্রযোজনা খনা। বাঙালি গার্হস্থ্য সমাজের দার্শনিক, সত্যের ভাষ্যকার ‘খনা’র জ্ঞান ও সত্যদর্শনীয় প্রতিহিংসার শিকারে নির্মম পরিণতির কিংবদন্তি নিয়ে নাট্যটি। নাট্যটির রচনা সামিনা লুৎফা নিত্রা, নির্দেশনা-মোহাম্মদ আলী হায়দার। খনা নাট্যটি উপস্থাপনে বন্দনা, বর্ণনা, নৃত্য-গীত-উক্তি-প্রত্যুক্তিসহ চারদিকের দর্শক পরিবেষ্টিত মধ্যমঞ্চে উপস্থাপিত হয়েছে। সুবচন নাট্য সংসদ সংগীত সাধক শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও দর্শন নিয়ে মহাজনের নাও শিরোনামে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী রীতিতে নাট্য প্রযোজনা করেছে। নাট্যটি রচনা করেছেন শাকুর মজিদ এবং নির্দেশনায় সুদীপ চক্রবর্তী। উপস্থাপনায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এরিনা বা চারদিকের খোলা মঞ্চ ব্যবহৃত হয়েছে। বাঙালি জীবন সংস্কৃতির বহমান ‘পালা’ রীতিকে অবলম্বনে নাট্যটি প্রদর্শিত। স্বপ্নদলের প্রযোজনা চিত্রাঙ্গদা নাট্যটি। রচিয়তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মঞ্চের চারপাশে দর্শক; মাঝখানে উপস্থাপিত হচ্ছে নাট্যটি। বন্দনা, বর্ণনা, সংলাপ, অভিনয়-নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে নাটকটি উপস্থাপিত। নিদেশনায় ছিলেন জাহিদ রিপন। পালাকারের প্রযোজনা নারীগণ নাট্যটি। আবহমান বাংলার নিজস্ব পরিবেশনা রীতিতে উপস্থাপিত নারীগণ নাট্যটি। রচনা সৈয়দ শামসুল হক, নির্দেশনা আতাউর রহমান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত দর্শকনন্দিত প্রযোজনা মুখরা রমণী বশীকরণ শেক্সপিয়রের কাহিনি হলেও বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘সং’ আঙ্গিকে উপস্থাপিত নাটকটি। নাট্যটির নির্দেশনা আল জাবির। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের গহর বাদশা ও বানেছা পরী এ সময়ের অত্যন্ত আলোচিত নাটক। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রচলিত গাথাকে সমকালীন বৈশ্বিক প্রযুক্তি সহযোগে অনন্যসাধারণ এক উপস্থাপন তৈরি করেছেন। বোধন থিয়েটারের চন্দ্রাবতী পালা, ভোলা থিয়েটারের গ্রন্থিকগণ কহে, অন্বেষা থিয়েটারের ভানু সুন্দরীর পালা, বঙ্গলোকের রূপচান সুন্দরীর পালা এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। কিছু প্রযোজনায় নির্দেশকের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারার বিকাশমূলক সচেতন প্রচেষ্টা না থাকলেও অবচেতনভাবেই ঐতিহ্যের ধারার বাংলা নাট্যের বৈশিষ্ট্যে প্রত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নাট্য।
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে অঙ্গীকারবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমি। ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলায় কেন্দ্রীয় দপ্তরে নাটকের জন্য অনেকগুলো অডিটরিয়াম থাকলেও ঐতিহ্যবাহী নাট্যের কোনো স্থায়ী মঞ্চ নেই। অথচ আজকের দিনেও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বা গ্রামেগঞ্জে শত শত পালা-জারি-যাত্রা প্রভৃতি নিয়ত মঞ্চস্থ হচ্ছে। সেগুলো চারদিকের দর্শকবেষ্টিত অস্থায়ী মধ্যমঞ্চে পরিবেশিত হয়। গ্রামেগঞ্জে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে ঐতিহ্যবাহী নাট্যগুলো সাধারণত পরিবেশিত হতে দেখা যায় বলে অনেকে বাংলা নাট্যকে খোলা জায়গায় প্রদর্শনের গুরুত্ব দেওয়ার অজুহাতে কিংবা বিভ্রান্তিতে এ জাতীয় মঞ্চস্থাপত্য তৈরিতে সাধারণত বিরোধিতা করে থাকেন বলে মনে হয়। যদি খোলা জায়গায় উপস্থাপন করাটাই মূল হতো তাহলে বিভিন্ন উপস্থাপনে প্যান্ডেল বা অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করতে দেখা যেত না। প্রকৃত অর্থে বাস্তব সত্যটা ভিন্ন। এ জাতীয় মঞ্চস্থাপত্য নেই বলেই খোলা জায়গায় পরিবেশন হয় বলে সহজেই অনুমেয়। স্থায়ী মঞ্চ থাকলে হয়তো খোলা জায়গায় পরিবেশন হতো না। প্রতিনিয়তই গ্রামেগঞ্জে আবহাওয়া প্রতিকূলতা; দর্শন-উপভোগ্যতা কিংবা পেশাদারিত্বের প্রেক্ষিতে পালা-জারি-যাত্রার জন্য অস্থায়ী প্যান্ডেল অর্থাৎ ক্ষণকালীন মঞ্চস্থাপত্য তৈরি হতে দেখা যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে; বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ঐতিহ্যের ধারার ‘বাংলা নাট্যমঞ্চ’ স্থাপিত হওয়া উচিত। হাজার বছরের বাংলাদেশের পরিবেশনা বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে এবং প্রযুক্তির প্রয়োগে আসর বা চারদিকের দর্শকবেষ্টিত বিশ্বমানোপযোগী মঞ্চ স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। ঐতিহ্যের বিকাশী অনুপ্রেষণ সৃষ্টির ফলে বিজাতীয় দাসত্বের অনুশৃঙ্খলের বিপরীতে বাংলার নিজস্ব শিল্পের বিকাশ ঘটবে বলে সহজেই অনুমেয়।
বাংলার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্য; রয়েছে সমৃদ্ধ নাট্য সংস্কৃতি। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় – বাংলাদেশের নাট্যসংস্কৃতি পাশ্চাত্য কিংবা সংস্কৃত থেকে পৃথকী বৈশিষ্ট্যম–ত। ঐতিহ্যের ব্যবহারমূলক নব্য উপনিবেশ কৌশল উপেক্ষায় ঐতিহ্য বিকাশ জরুরি। সমকালীন পাশ্চাত্য বৈরিতা কিংবা অশ্রদ্ধা নয়; বরং উপনিবেশ সৃষ্ট ইতিহাস ও জ্ঞানতত্ত্বকে উপেক্ষা করে বাঙালির নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিশ্বজনীন বিকাশ জরুরি। মোটকথা ঐতিহ্যের বিশ্বজনীন বিকাশমূলক চর্চা অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যধারা যেভাবে বিকাশে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-রাজনীতি তথা অন্য ক্ষেত্রগুলোতে সেভাবে বিকাশ হওয়া প্রয়োজন। ঐতিহ্যের বিকাশী ধারায় বাংলাদেশ নিজস্ব সুসমৃদ্ধ পরিচয়ে বিশ্বসভ্যে গৌরবান্বিত হোক – এ আমাদের সবারই প্রত্যাশা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। মধ্যযুগের বাংলা নাট্য – সেলিম আল দীন, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৬
২। সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র, খ–১, ৪, ৫। মাওলা ব্রাদার্স।
৩। ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যরীতি ও সেলিম আল দীন’, কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল, শিল্পকলায় পঠিত প্রবন্ধ।
৪। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা ‘পরিবেশনা শিল্পকলা’ খণ্ড, সম্পাদনা ড. ইসরাফিল শাহিন এবং বাংলাপিডিয়া-এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
৫। বাংলার লোকনাটক : বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য, সাইমন জাকারিয়া, বাংলা একাডেমি।
৬। বাংলার লোকসাহিত্য, আশুতোষ ভট্টাচার্য, কলকাতা, এবং লোকসাহিত্য আশরাফ সিদ্দিকী, ঢাকা।
৭। বাংলার লোকসংস্কৃতি, ওয়াকিল আহম্মেদ, গতিধারা, ২০০১
৮। হাজার বছর : বাংলাদেশের বাংলা নাটক ও নাট্যকলা, সৈয়দ জামিল আহমেদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
৯। সাহিত্যের বাংলাদেশ : উপন্যাস, কবিতা, নাটক, অরুণ সেন এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০১৩
১০। Acinpakhi Infinity : Indigenous Theatre of Bangladesh by Syed Jamil Ahmed, The University Press Limited, Dhaka, 2000