চা রু বা ক খা লে দ
অনেক উন্নতি হলো পৃথিবীর। প্রযুক্তির কৃপায় বিশ্ব আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। আপন করতল মেলে দিয়ে জন্মরেখা পাঠের মতো পৃথিবীকে মানুষ পড়ে ফেলতে পারে। তবু পথ পাড়ি দিতে দিতে মনে হয় আসলে গন্তব্য খুঁজে পাওয়া যাবে না আর; অথবা পথ শেষ হয়ে আসছে কিংবা গোলকধাঁধার মতো পথ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো বুদ্ধি মাথায় আসছে না। প্যালেস্টাইনের শিল্পী বাশার আল রউফ এসব কথা বলছিলেন শিল্পকলার প্রদর্শনী হলে দাঁড়িয়ে। এই শিল্পীর একটি কাজ এবার ‘এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশে’ গ্রান্ড প্রাইজ জিতেছে। কাজটিতে বারোটি ফটোগ্রাফিক ইমেজ আছে। তবে তা স্বচ্ছ কাগজে তোলা। ইমেজগুলো কাগজের ভেতরের পিঠে রয়েছে। সেগুলো মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কোনোটাতে মুখ, কোনোটাতে পা, কোনোটাতে আবার বুক। অবরুদ্ধতার বেষ্টন ভেঙে একটা মানুষ বাঁচতে চাচ্ছে। তাকে নিরন্ধ্র কোনো বায়ুরোধী বিবরে ভরে মেরে ফেলা হচ্ছে। এ তার জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত। হাত, পা, নাক, মুখ সেই বায়ুরোধী আধারে দেয়ালে চেপে ধরে সে তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। প্যালেস্টাইনের বাস্তবতাকে এমন কতকগুলো অনুচ্চ ফটোগ্রাফিক ইমেজে তুলে ধরেছেন বাশার।
শহরে বাস মানে নরকে বাস। এ-কথা গ্রামলগ্ন বাংলাদেশের মানুষের সবসময় মনে হয়েছে। অন্য প্রাণীর মতো মানুষও স্বস্তিময় পরিবেশ চায়। ঢাকা মহানগরের মানুষেরা প্রতিদিন যে শব্দটি উচ্চারণ করে তা হলো ট্রাফিক জ্যাম। আর যে বিষয়টি মানুষের চৈতন্যকে ঝালাপালার মধ্যেই সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে তা হলো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একসময় মানুষ কোথায় কী ঘটছে তা জানতে পারত না সহজে। আর এখন তাকে এত বেশি জানানো হচ্ছে যে, তার পক্ষে বোঝাই সম্ভব হচ্ছে না আসলে কোনটা সত্য। তথ্য সত্যকে উন্মোচন করে, কিন্তু তথ্যজালে আটকে পড়ে আমরা আর সত্যকে খুঁজে পাই না। সত্যের অনেক তল আছে। কিন্তু কোনো তলই অস্বচ্ছ নয়। কাজী সালাহউদ্দিন আহমেদ যানজট ও তথ্যজটের বন্দিত্বের জাল এঁকেছেন। তাঁর কাজটি সিটিস্কেপ বা নগরদৃশ্য। ইমারত, অরণ্য আর দৈনিক পত্রিকার কাগজ অ্যাক্রিলিকে সেঁটেছেন তিনি। দালানদূষণ ও শব্দদূষণ পরস্পরিত করে পরিণামে তিনি দৃষ্টিনন্দন ছবিই এঁকেছেন। কিন্তু কোলাহলের যে একটা কাঠামো আছে, সেটাই সালাহউদ্দিন স্থাপত্যের মতো নকশায় মেলে দিয়েছেন। তাঁর কাগজটি দেখে মনে হয় ঢাকা শহরকে ওপর থেকে আড়াআড়িভাবে কেটে ফেলা হয়েছে; আমরা সেই ব্যবচ্ছেদিত রূপটা দেখছি। পর্যবেক্ষণ ও তা চিত্রার্পিত করার দক্ষতার কারণে সালাহউদ্দিন গ্রান্ড প্রাইজ পেয়েছেন।
ভিড়ের মধ্যেই মানুষ বেশি একা ও বিচ্ছিন্ন। পাশাপাশি বসে থাকলেও একজন মানুষ অন্যজনের সঙ্গে নেই। তারা সুখ-দুঃখে পরস্পর নির্বিকার। এ ভাবনাটা পাশাপাশি উপস্থাপিত দুটি ভিডিও স্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন জাপানের শিল্পী মেইরো কোইজুমি। মেট্রো ট্রেনের ভিডিও ধারণ করেছেন শিল্পী। ট্রেনের কামরায় কেউ চুপচাপ বসে আছে, কেউ বই পড়ছে। কারো মুখে ক্লান্তি, কারো বা মুখে বিরক্তি। এরই মধ্যে কারো সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জন্য একটি লোকের বিলাপ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবাই নির্বিকার। পাঠরত যাত্রী বইটা বন্ধ করে বিশ্রাম নেয় মাত্র। লোকটির বিলাপ, ট্রেনের শব্দ, স্টেশনে আগমন, স্টেশন ছেড়ে যাওয়া, কিছু নিশ্চুপ যাত্রীর ওঠা ও নামা Ñ সব মিলিয়ে বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েনেশন কীভাবে স্তব্ধ করে রেখেছে মানবতা তা-ই জানান দিয়ে এই জাপানি শিল্পী গ্রান্ড প্রাইজে ভূষিত হলেন।
জিহান করিম নামে যে তরুণ সম্মান পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরও বিষয় মৃত্যু। সভ্যতা যত অগ্রসর হয় মৃত্যু তত করুণ ও নিষ্ঠুর রূপ পায়। সিঁড়িতে ভর দিয়ে নিচে তাকালে সিঁড়িতলের যেটুকু জায়গা দেখা যায় সেটুকুতে একটি ভিডিও ইমেজ নিক্ষেপ করেছেন জিহান। ইমেজটি মানুষের। জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তে একটু বাঁচার চেষ্টা করে একটি মানুষ মরে গেল। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত দেখে চলেছি।
সম্মান পুরস্কার পাওয়া সিরিয়ার শিল্পী নাসরিন বুখারিও যুদ্ধ, মৃত্যু, মাতৃভূমির রক্তাক্ত পরিস্থিতিতে বিচলিত হয়ে শিল্প রচনা করেছেন। তাঁর ছবি এক স্লাইস রুটির বিরাট আকারের ফটোগ্রাফ। রুটির গায়ে লেখা ‘বালাদি’। শব্দটির অর্থ রুটি Ñ ঘরে তৈরি রুটি, কিন্তু তা আবার সিরিয়ার নয়। শব্দটির অক্ষর ভেঙে বিচ্ছিন্ন করে লিখেছেন শিল্পী। কোনো ক্যালিগ্রাফির আশ্রয় নেননি। অর্ধবৃত্তাকার রুটির প্রান্তসীমা লাল রক্তের মতো ছড়িয়ে গেছে। রুটিটির ঝাঁঝরা-ফোঁপরা বুক যেন সিরিয়ারই যুদ্ধবিধ্বস্ততার প্রতিচ্ছবি Ñ একই সঙ্গে তা গুলিবিদ্ধতা ও হৃদয়শূন্যতার স্বাক্ষর। সামান্যের মধ্যে এমন অসামান্য ভাবনায়োজন বিরল শিল্পিত পরিমার্জনার দৃষ্টান্ত।
শান্তিপ্রিয় নেপাল এখন পণ্যভারে দিশেহারা। শুধু নেপাল কেন, পৃথিবীর অনেক দেশই পণ্যের বৈচিত্র্যে বুঝে উঠতে পারছে না কোনটা তার প্রয়োজন, কোনটা প্রয়োজন নয়। মানুষ কি একদিন আবিষ্কার করবে এই উপলব্ধি যে, যা তার দরকার ছিল তার চেয়েও বেশি পণ্য সে উৎপাদন করে চলেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ঊনপঞ্চাশ বায়ুতে ঘুরপাক খাচ্ছে পণ্যবিলাসী বিশ্ব। নেপালের রঞ্জন কালফে কতকগুলো মশা-মাছির পায়ের কাঠামো বানিয়েছেন তার দিয়ে। আর এসব কাঠামোর ওপর বসিয়েছেন নানা পণ্যের মোড়ক, বোতল, শিশি, বাক্স। পণ্যের ইঁদুরদৌড়টা দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। পণ্যের প্রতিযোগিতাই বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সত্য।
চিন্তাহীন কোনো শিল্প পৃথিবীর কোনো দ্বিবার্ষিক বা ত্রিবার্ষিক চারুকলার প্রদর্শনীতে স্থান পায় না। প্রতি দুবছর পর আয়োজন করার অর্থই অতি সাম্প্রতিককালের স্বরূপ উন্মোচন করে দেওয়া। প্রথাবদ্ধতা দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর আদর্শ নয়। নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য অনেক সময় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। সে অর্থ ব্যয় না করেও কিন্তু চিন্তাগর্ভ বিষয় সামান্য অর্থ ব্যয়ে তুলে ধরা যায়। প্যালেস্টাইনের বাশার, সিরিয়ার নাসরিন, নেপালের রঞ্জন যে কাজের জন্য পুরস্কৃত হলেন তা করতে তাঁদের একটি ক্যানভাস পেইন্টিংয়ের অর্থও ব্যয় হয়নি। বাংলাদেশ ও অন্য কোনো কোনো দেশের শিল্পীরা এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। বিষয়কে জাঁকাল করে প্রকাশ করার কোনো শৈল্পিক শর্ত নেই। বাংলাদেশের শিল্পীরাই এবার সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ে নানা ধরনের স্থাপনা উপস্থাপন করেছেন। সাদেগ তিরাফকান ইরানের শিল্পী। তাঁর ছবির নাম ‘হিউম্যান ট্যাপেস্ট্রি’। দূর থেকে ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বুনটের বাহারি পারসি কার্পেট দেখছি। কাছে গেলে দেখা যায়, সেখানে রঙিন ফুল-লতা-পাতা নেই; শুধু মানুষের মুখ; রাশি রাশি পাসপোর্ট সাইজ ছবি। মানুষের মুখ দিয়ে নতুনকালের নতুন কার্পেট বুনে সম্মান পুরস্কার পেয়েছেন সাদেগ। এখানেও মৃত্যু বাসা বেঁধেছে। বিস্তৃত যে ট্যাপেস্ট্রি, যাকে ইরানি কার্পেট বলেই মনে হয় Ñ তা লাখো মানুষের মুখে আকীর্ণ। এ মানুষগুলো কারা? তারা নেই। তারা স্মৃতি। তারা হারিয়ে গেছে Ñ গুম হয়েছে Ñ যুদ্ধেও মরেছে। আমার মনে হয়েছে, ইরানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে এক সত্যনিষ্ঠ দলিল তৈরি করেছেন শিল্পী সাদেগ।
দুই
এশিয়ার চৌত্রিশটি দেশ পঞ্চদশ এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী ২০১২-তে অংশ নিয়েছে। আমাদের দেশ থেকে যারা পশ্চিমে, বিশেষ করে আরব বিশ্ব ও পূর্বদিকে নিকট-প্রাচ্য থেকে দূরপ্রাচ্য, মাথার ওপর নেপাল, ভুটান, চীন, মঙ্গোলিয়া, নিচের দিকে মালদ্বীপ ও আরো দূর সাগরের সদ্য স্বাধীন দেশ পূর্ব তিমুর এবং ওশেনীয় অঞ্চলের দেশ বলে অস্ট্রেলিয়াও অংশ নিয়েছে। এতগুলো দেশের অংশগ্রহণে প্রদর্শনীতে বৈচিত্র্য আসবে Ñ এটা স্বাভাবিক। কিন্তু শিল্পের সাম্প্রতিক চর্চার সব শেষ নিরীক্ষার ফলগুলো তুলে ধরে যে দ্বিবার্ষিক বা বিয়েনাল করার কথা তা আমরা করতে পারিনি। বাংলাদেশের শিল্পীদের এত বেশি অংশগ্রহণ হাস্যকর। বিদেশ থেকে আগত ধরতাই এসব জল, তেল, অ্যাক্রিলিকে আঁকা ক্যানভাসও প্রদর্শনীকে খেলো করে দেয়। তবে আশার কথা, অনেক সাধারণ ও নিুমানের কাজের পাশাপাশি আমরা শিল্পের গভীর সংবেদনাপ্রযুক্ত মানসম্পন্ন কাজও পেয়ে যাই। এটাই এ প্রদর্শনীর ইতিহাসকে একটা তাৎপর্য দিয়েছে। সেই ১৯৮১ থেকে ২০১২, তিরিশ বছর কেটে গেছে। সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হলো না বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক। বরাবরই দো-আঁশলা। খুব নিরীক্ষাদীপ্র কাজ আছে, আবার তার পাশেই অপটু হাতে আঁকা তেলরঙের মানুষ ও প্রকৃতি। আমাদের অনেক পরে শুরু করেও সিঙ্গাপুর জাতে উঠে গেছে। আর যে আরব বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব ইতিবাচক নয়, অন্তত সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সেই এলাকার দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে যে শারজাহ বিয়েনাল হয় তার আয়োজন দেখলেও আমরা আমাদের দ্বিবার্ষিকের পশ্চাৎপদতায় লজ্জিত না হয়ে পারি না।
আমাদের এক গভীর অসুখ আছে। মনোজাগতিকভাবে আমাদের চেয়ে বেশি ঔপনিবেশিক জাতি এ বিশ্বে আছে কি না সন্দেহ। আমরা ভেনিস বিয়েনালে পৌঁছুতে চাই, জার্মানির পৃথিবী কাঁপানো শিল্প প্রদর্শনী ডকুমেন্টায় ঠাঁই পাওয়ার স্বপ্ন দেখি। অথচ আমাদের অনতিদূরে এশিয়ার দেশগুলোতে যে প্রদর্শনী হচ্ছে, তাতে অংশ নিয়ে নিজের অবস্থা যাচাই করছি না। আর আমাদের পরে শুরু করেও তারা কীভাবে মেধাদীপ্ত দ্বিবার্ষিক আয়োজন করে তা জানার জন্যও কোনো উদ্যোগ নেই। শিল্পকর্ম উপস্থাপনে, বুদ্ধি ও চিন্তাসমৃদ্ধ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রকাশনায় চীন ও জাপান শুধু নয়, সিঙ্গাপুর ও শারজাহ বিয়েনালও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী।
আমাদের দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অন্য দেশ থেকে এবং দেশের ভেতর থেকেও আশানুরূপ নিরীক্ষাধর্মী সৃজনশীল কাজ আসছে না। কিন্তু কেন? এর উত্তর হলো, সরকারিভাবে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে মানসম্পন্ন কাজ যে পাওয়া যায় না তা আমরা বুঝেও বুঝতে চাই না। এখানে কমিশনার ও কিউরেটর নিয়োগ করার কথা ভাবতে হবে। সরকারি খবরদারি ও নিয়মনীতির বাঁধন শিথিল রাখতে হবে। এশিয়াকে নানা অঞ্চলে ভাগ করে কিউরেটর ও কমিশনারের খোঁজ করতে হবে। তাঁরাই শিল্পী ও শিল্পকর্ম নির্বাচন করবেন। আমাদের সরকার দ্বিবার্ষিকের জন্য যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে তা আরো ফলপ্রসূ হবে যদি এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর জন্য একটা ‘বিয়েনাল সেল’ প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পীরা সাধারণত সরকারি আহ্বানে দ্বিবার্ষিকে কাজ জমা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন না। গবেষক-কিউরেটর শিল্পীদের আবিষ্কার করেন এবং তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীতে উপস্থিত হন। ২০১৪-তে অনুষ্ঠেয় ষোড়শ এশীয় দ্বিবার্ষিকের জন্য আমরা যদি এখনই তৎপর হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কিউরেটরের শরণাপন্ন হই এবং সহজ শর্ত সাপেক্ষে অল্প অর্থ ব্যয়ে তাঁদের নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করতে পারি তাহলে একটি মানসম্পন্ন প্রদর্শনী আগামীতে হতে পারে।
কাজের সংখ্যা ও মানের বিচারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অনভিপ্রেত। প্রদর্শিত চারশো কাজের মধ্যে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজই রয়েছে প্রায় দেড়শো। শতাধিক শিল্পী এতে অংশ নিয়েছেন। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর আন্তর্জাতিক অঙ্গন। এ অঙ্গন আমি তৈরি করলেও এটা শুধু আমার নয়। এটা এশীয় পরিসরপ্রতিম অঙ্গন। এতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মেধাবী দাবি আছে এমন কাজই শুধু উপস্থাপিত হবে, অন্য কোনো কাজ নয়। অনেক শিল্পীর অনেক কাজ দেখার ও দেখানোর জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী রয়েছে।
এ-প্রদর্শনীতে সর্বসাকল্যে বাংলাদেশের বিশজন শিল্পীর কাজ অংশ নেওয়ার যোগ্যতা রাখে। বেশি পরিমাণে মাঝারি মানের কাজ উপস্থাপিত হওয়ায় চিন্তাগর্ভ কাজে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের এত বেশিসংখ্যক কাজ দ্বিবার্ষিকের
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসে কী করে? কারণ এগুলো কোনো কিউরেটরিয়াল প্রসেস অনুসরণ করে নির্বাচিত নয়। আমাদের শিল্পীরা তাঁদের কাজের ফটোগ্রাফ ও ডিজিটাল ফরম্যাটে সিডি-ডিভিডিতে জমা দেন। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচকমণ্ডলী এগুলো দেখে কাজের গুণাগুণ বিচার করে প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করেন। এই নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরা এদেশেরই বিখ্যাত শিল্পী। চারজন শিল্পীর সঙ্গে একজন শিল্পসমালোচক যুক্ত হয়ে নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, তিনজন শিল্পসমালোচক মিলে একটা বোর্ড গঠন এবং শিল্পীদের সত্যিকার কাজ দেখে (ডিজিটাল প্রিন্ট নয়) শিল্পকর্ম নির্বাচন করতে হবে। আসলে নির্বাচনের কাজটা শিল্পীদের নয়। অবশ্য কোনো শিল্পী যদি শিল্পসমালোচনা ও শিল্পতত্ত্বে বিশেষ অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন তাহলে তিনিও নির্বাচক কমিটির সদস্য হওয়ার দাবি রাখেন। যেহেতু শিল্পসমালোচনা এদেশে আশানুরূপ বিকশিত হয়নি, তাই এই আয়োজনে শিল্পীর প্রয়োজন হবে। তবে নির্বাচকমণ্ডলীর বেশিরভাগ সদস্যই যেন শিল্পী না হন। নিরপেক্ষ বিচারের দায়টা কিউরেটরের কাঁধেই থাকুক Ñ এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম।
বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিকের প্রাপ্তি এই যে, জাপান পূর্বাপর কিউরেটর নিয়োগ করে অংশগ্রহণ করছে আর দীর্ঘদিন আরব বিশ্বের কাজকে দেশের বাইরের প্রদর্শনীতে আহ্বান জানানো হতো না বলে শুরু থেকেই সেই অঞ্চলের শিল্পীরা আমাদের দ্বিবার্ষিক আয়োজন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছেন। ওমানের শিল্পী বুদুর আবদুল্লাহ মরুভূমিতে নামাজরত মানুষের হাঁটু মুড়ে বসে থাকায় যে মগ্নতা যোগ করতে পেরেছেন তা বিশেষ নজরে দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবের মানুষী মুখের ছবি প্রথাগত ইম্প্রেশনিজম, তবে তার বিমূর্ত শৈলীর কাজে মন সাংকেতিক ভাষায় কথা বলছে। বিমূর্তনও যে শেষাবধি দেশনিরপেক্ষ নয়, তার প্রমাণ আবদুল রাজ্জাক আল আবদুল হাইয়ের ‘গন্তব্যের ছন্দ’ শীর্ষক কাজ। এ কাজে কোনো ক্যালিগ্রাফি নেই, উট বা খেজুরবীথিও নেই, তবু তাতে মরুর ঘ্রাণ আছে। রঙের স্পর্শগুণ সংপ্রযুক্ত করতে পেরেছেন এই আরব শিল্পী। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফাতিমা ইব্রাহিম আয়েশা আবদুল্লাহ-আল ধামাস খেজুরপাতার ডগায় যে ইমেজ জুড়েছেন তাতেও আরব-স্বভাবের মৌলিকতা শিল্পিত ভাষ্য পেয়েছে।
বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী যে আয়োজনের দিক থেকে এতটুকু পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়নি দীর্ঘ তিরিশ বছরে, তার বড় প্রমাণ প্রদর্শনীর ক্যাটালগ। এর আকার-প্রকার, ভেতরের অঙ্গসজ্জা ও লেখা পূর্বাপর একই রকম। ক্যাটালগের সাইজটা টেলিফোন ডাইরেক্টরি বা সরকারিভাবে প্রকাশিত গেজেটের মতো। এটা দেখলে বোঝা যায় না, এটি চারুকলা বিষয়ক বিশাল প্রদর্শনীর প্রকাশনা। এতে প্রতিটি দেশের শিল্পচর্চা বিষয়ে একটা লেখা থাকে। লেখাগুলো পড়ে অবশ্য দ্বিবার্ষিকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর কাজ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। এমনই একটি দেশ পরিচিতিমূলক লেখা। শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা, পরিপ্রেক্ষিত, শিল্পীর ভাবনা-দর্শনসংবলিত লেখাই নিয়ম অনুসারে ক্যাটালগে মুদ্রিত হওয়ার কথা আর কাজটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করে থাকেন কিউরেটর বা কোনো শিল্পসমালোচক। এছাড়া অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক শিল্পীর একটি করে কাজ ছাপা হয়। ক্যাটালগ খুলে শুরুতেই পড়তে হয় বাণীচিরন্তনী। এতগুলো বাণী না ছাপলেই কি নয়? কোনো পৃষ্ঠাতেই কোনো চারুতার ছাপ নেই, গ্রাফিক্সের বৈশিষ্ট্য নেই। অনেকে ভাবতে পারেন, এসব কথায় অম্লতার পরিমাণ বেশি হয়ে গেল। কটু কথা বলার জন্য এ লেখা নয়। আগামীতে একটি ভালো দ্বিবার্ষিক আয়োজনের লক্ষ্যেই এই আত্মসমালোচনা। কেননা আমি এবং আমার মতো আরো অনেক শিল্পী ও শিল্পসমালোচকই এ আয়োজনের দায়িত্বে থাকেন। সেমিনার, প্রকাশনা, প্রচার, সাজসজ্জা ইত্যাদি বহু সদস্যধারী নানা উপকমিটির উপদ্রবে কোনো কাজই শেষ অবধি ঠিকমতো এগোয় না। আমার কথা আপত্তিকর মনে হলে শারজাহ, সিঙ্গাপুর, চীন বা জাপানের এরকম শিল্প-আয়োজনের ক্যাটালগ খুলে দেখুন। বাংলাদেশ ও অন্য দেশের কাজের জন্য কিউরেটর নিয়োগ, ক্যাটালগের জন্য যাঁরা বইয়ের অঙ্গসজ্জায় পারঙ্গম তাঁদের দায়িত্ব প্রদান, উপকমিটি সংক্ষিপ্তকরণ, অন্য দেশের বিয়েনালের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি, শিল্পকলা একাডেমীর ও মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের শুধু বিদেশে না পাঠিয়ে বিয়েনালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ শিল্পী, শিল্পসমালোচক ও গবেষকদের বিয়েনাল দেখার সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি মাধ্যমে মান বাড়বে বাংলাদেশের দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর। সবার আগে প্রয়োজন বিয়েনাল সেল বা দ্বিবার্ষিকের জন্য একটি আলাদা দপ্তর। এই দপ্তরকে সহযোগিতা দেবে শিল্পকলা একাডেমী ও সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান। দপ্তরটি অবশ্য কাজ করবে স্বাধীনভাবে।