logo

একটি উদ্ভ্রান্ত প্রেমের গল্প

হা সা ন  ফে র দৌ স

Marie Therese The Dream

Marie Therese The Dream

এবছর বসন্তের শুরুতে নিউইয়র্কে একই সময়ে পিকাসোকে নিয়ে দুটি বড় ধরনের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো। প্রথমটি মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে ‘পিকাসো ও গিটার’ (১৯১২-১৯১৪), দ্বিতীয়টি গ্যাগসিয়ান গ্যালারিতে ‘পিকাসো ও মারি-তেরেস : লা’মুর ফু’। মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম বা মোমা শহরের মাঝখানে, সাবওয়ের ঠিক গা-ঘেঁষে। অন্যদিকে গ্যাগসিয়ান গ্যালারি শহরের শেষ প্রান্তে, চেলসিতে। সাবওয়ে করে গেলে হাঁটাপথে আরো আধমাইল বা তার চেয়েও বেশি। মোমাতে পিকাসো দেখে আশ মিটল। বিশ্ববিখ্যাত এই মিউজিয়ামের নিজস্ব সংগ্রহই বিপুল, তার ওপর এই প্রদর্শনীর জন্য সারা পৃথিবী চষে সংগ্রহ করা হয়েছে শখানেক ছবি। ঘণ্টাতিনেক মোমায় কাটানোর পর চেলসি যাবার কোনো তীব্র মনোবাসনা আমার ছিল না। কিন্তু সঙ্গে রয়েছেন মতিউর রহমান, প্রথম আলোর সম্পাদক। আমি বললাম, স্ট্রান্ডে যাওয়া যাক। শহরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান। বলা হয়, পাশাপাশি দাঁড় করালে সেখানে নাকি বই আট মাইলেরও বেশি জায়গা নেবে। তাঁকে প্রলোভিত করতে আমি যোগ করলাম, ‘সস্তায় পুরনো বই কিনতে এর চেয়ে উত্তম স্থান ত্রি-ভুবনে আর আছে কি না আমার জানা নেই।’ মতি ভাই বললেন, কেন, মারি-তেরেস দেখব না?
অগত্যা সেই চেলসি। সাবওয়ে থেকে নামতেই দেখি ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। হাতে কোনো ছাতা নেই। মনে মনে ভাবছি, বরং ফিরে যাই। কিন্তু মতি ভাই নাছোড়বান্দা। এদ্দুর এসে ফিরে যাব? এ আর এমন কী বৃষ্টি! তাঁর কথা শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলাম। অতএব, সেই বৃষ্টি ঠেলে দশ ব্লক দূরে গ্যাগসিয়ান গ্যালারি। দূর থেকে মনে হয় বুঝি কোনো ওয়্যারহাউস। সামনে কোনো বড় সাইনবোর্ড নেই, কোনো বাহারি বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ল না। কিন্তু ভেতরে পা দিতেই মনটা ভরে গেল। ভাগ্যিস এসেছিলাম, তা নাহলে একটি অসাধারণ সংগ্রহ দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম। তার চেয়েও বড় কথা, একটা আশ্চর্য উদ্ভ্রান্ত প্রেমের গল্প পর পর ফ্রেমে সাজিয়ে এইভাবে দেখা হতো না।
ছবি নয়, সেই প্রেমের গল্পটাই আমি করতে চাই।
লা’মুর ফু, মানে উদ্ভ্রান্ত প্রেম – ইংরেজিতে ম্যাড লাভ। এই নামে সুররিয়ালিস্টদের কবিতা ও ছবির বই আছে, গোটা দুই ফিল্মও হয়েছে। পিকাসোর যখন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স, তখন তাঁর পরিচয় সতেরো বছরের কিশোরী মারি-তেরেসের সঙ্গে। নারী তাঁর জীবনে কম আসেনি। তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে পিকাসোর জীবন ও তাঁর চিত্রকর্মকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু মারি-তেরেসের ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ আলাদা। এর ভেতর রয়েছে এক নিষিদ্ধ মাদকতা, মাঝবয়সী এক লোকের কিশোরীকে বশে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। লক্ষ্য তার মন নয়, শরীর। অন্যদিকে মধ্যবয়সী সে-শিল্পীর জন্য মেয়েটির রয়েছে অপার বিস্ময়, নিষ্পাপ মুগ্ধতা ও নিঃশর্ত বশ্যতা।
পিকাসো ও নারী – এই নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। অধিকাংশ জীবনীকারই পিকাসোকে একজন দানব বলে চিহ্নিত করেছেন, বলেছেন তাঁর বন্য যৌনক্ষুধা  মেটানোর  বাইরে  মেয়েদের আর কোনো ভূমিকা আছে, পিকাসোকে দেখে তা মনে হয় না। একজন মার্কিন লেখক মন্তব্য করেছেন, মেয়েদের পেছনে যে পরিমাণ সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন পিকাসো, তারপর ছবি আঁকার সময় কোত্থেকে হলো, সেটাই এক বড় বিস্ময়। ফ্রাঁসোয়া জিলো, পিকাসোর পরিণত বয়সের তরুণী প্রেমিকা, পিকাসোরই কথা উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘তাঁর কাছে মেয়েরা হয় দেবী নয়তো পাপোশ।’ বস্তুত পরিচয়ের প্রথম পর্বে সব মেয়েকেই পিকাসো দেবীর মর্যাদায় আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু যেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে, অথবা নতুন শিকার হাতের নাগালে এসেছে, সেই দেবীকেই পাপোশ ভেবে ছুড়ে ফেলেছেন। আমরা অন্ততপক্ষে সাতজন নারীর কথা জানি, যাঁরা পিকাসোর শিল্পীজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিস্ময়কর হচ্ছে, এক ফ্রাঁসোয়া জিলো ছাড়া পিকাসোর প্রায় সকল প্রেমিকার ভাগ্যেই কমবেশি একই পরিণতি ঘটেছে। এঁদের মধ্যে দুজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, দুজন উন্মাদ হয়ে যান। বাকিদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় বটে, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই গভীরভাবে অসুখী ছিলেন। এক ফ্রাঁসোয়া জিলো-ই পিকাসোর অক্টোপাস-বাহু ছেড়ে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হন, যদিও সেজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। পাপোশ অথবা দেবী যাই হোক না কেন, এই রমণীকুল প্রত্যেকে পিকাসোর জীবনে যাঁর যাঁর মতো প্রভাব রেখে গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে পিকাসোর শিল্পীসত্তা প্রকাশিত হয়েছে। ফলত তিরিশের দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই শিল্পীর চিত্রকলার বিবর্তন এই নারীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপড়েনের ভেতর দিয়েও আবিষ্কার সম্ভব।
যাঁকে নিয়ে আমাদের আজকের গল্প, সেই মারি-তেরেস ওয়ালটার, সম্ভবত সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় পিকাসোর নিকটবর্তী হতে পেরেছিলেন। ১৯৫০ সালের মধ্যেই অর্থাৎ পিকাসোর মৃত্যুর ২৩ বছর আগে – তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রেমে যতি পড়লেও পিকাসো মারি-তেরেসের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি চুকিয়ে দেননি। যতদিন বেঁচে ছিলেন নিয়মমাফিক চেক পাঠিয়েছেন, যদিও অর্থের পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেননি বটে, কিন্তু তাঁদের কন্যা মায়াকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর পিকাসোর সমাধিতে মারি-তেরেসের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়, পিকাসোরই নির্দেশে, তা ছিল এই নারীর প্রতি তাঁর প্রেমের শেষ স্বীকৃতি। পিকাসোর দ্বিতীয় স্ত্রী জ্যাকুলিন অবশ্য সে-মূর্তি সেখানে স্থায়ীভাবে রাখতে অনুমতি দেননি।
এই দুজনের প্রবল, উদ্দাম, প্রায় বন্য প্রেমের শুরু এমন এক সময়ে যখন পিকাসো শিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে মারি-তেরেস নিষ্পাপ এক কিশোরী। চিত্রকর পিকাসোর সম্ভবত সবচেয়ে আলোকময়, আশাবাদী ও কোমল পর্বের শুরু সেই প্রেম থেকে। এই প্রেমের গল্প কিছুটা মারি-তেরেস নিজে করেছেন পিকাসোর মৃত্যুর পর। মারি-তেরেসের কন্যা মায়া ও মায়ার কন্যা ডায়ানাও সে গল্প করেছেন। পিকাসোর দুই জীবনীকার, জন রিচার্ডসন ও আরিয়ানা হাফিংটন, তাঁরাও যথাসম্ভব নথিপত্র ঘেঁটে সে সম্পর্কের গোপন ও জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। এঁদের সবার কাছে শোনা সে গল্পই মারি-তেরেসের বয়ানিতে আমি এখানে নিজের মতো সাজিয়ে দিলাম। সঙ্গে মেশানো থাকল কিছুটা মনের মাধুরী। তবে এই গল্প উপলক্ষ মাত্র, আসল চেষ্টা হবে পিকাসোর ছবির সঙ্গে পরিচিত হওয়া।
১৯২৭ সালের কথা। তখন আমার বয়স সতেরো, তবে দেখতে আমায় আরো বয়সী মনে হতো। সে-সময়ে প্যারিসের কাছে মাইসন-আলফোর কাছে মা ও আমার দুই বোনের সঙ্গে থাকতাম। সাজ-পোশাক পরতে আমি বরাবরই ভালোবাসতাম। হাই হিল জুতো আর লাল রঙের একটা আঁটসাঁট স্কার্ট পরে রাস্তায় নামলে, আমাকে দেখার জন্য পাড়ার ছেলেদের মধ্যে হুটোপুটি লেগে যেত। আমার লাল চুল যখন বাতাসে নেচে বেড়াত, রাস্তার এমন লোক থাকত না যে একবারের জন্য হলেও মুখ ফিরিয়ে না দেখত। স্কুল আমার কখনই ভালো লাগত না। গরমে ক্লাসে বদ্ধ হয়ে থাকার চাইতে বাইরে খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াতেই আমার ভালো লাগত বেশি। তারিখটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ৮ জানুয়ারি, সময় সন্ধ্যা ছটার মতো হবে। ঠাণ্ডা পড়েছিল, তবে সেদিন আকাশ ছিল একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। বিকালের দিকে আমি হাউসম্যান বুলেভারে গ্যালারি লাফায়েতে যাচ্ছি আমার টুকিটাকি কিছু জিনিস কেনার জন্য। মেট্রো থেকে নামার পথে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। ছোটখাটো, গাট্টাগোট্টা মানুষ, তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, শুধু চোখ দুটো ছাড়া। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ, কী তার চেয়ে বেশিও হতে পারে।
মেট্রো থেকে সিঁড়ি ধরে একসঙ্গে বেরিয়েছি। তিনি আমাকে বোধহয় আগে থেকেই দেখছিলেন, কিন্তু আমি পাত্তা দেবার প্রয়োজন দেখিনি। প্যারিসে রাস্তায় আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায় এমন লোকের অভাব নেই। মেট্রোর বাইরে রাস্তায় নামতেই নিজেই গায়ে পড়ে কথা বলতে এলেন। আমার হাত নিজ হাতে নিয়ে, কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললেন, ‘বাহ, খুব সুন্দর তো মুখখানা তোমার।’ আমি জবাব দেবার আগেই বললেন, ‘শোনো, আমি তোমার একটা পোর্ট্রটে করতে চাই। আমার নাম পিকাসো।’
পিকাসো নামটা আমার কাছে একদম অপরিচিত। এ আবার কেমন নাম, মনে মনে ভাবলাম। ‘শোনো, আমরা দুজনে মিলে খুব মজার কিছু কাজ করব।’ আমি তাঁকে চিনি না, তাঁর নামের কোনো অর্থও আমার কাছে নেই সে-কথা তিনি বুঝে বললেন, ‘দাঁড়াও, তোমাকে আমার ছবির বই দেখাচ্ছি।’ একটা দোকানের ভেতর হন হন করে ঢুকে এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি বেরিয়ে এলেন। হাতে মস্ত একটি ছবির বই, তাতে সত্যি পিকাসোর আঁকা ছবি।
আমি তো হাঁ।
তাঁদের এই নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতের সময়ে পিকাসোর বয়স পঁয়তাল্লিশ। বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা। বলাই বাহুল্য, ততদিনে তিনি খ্যাতনামা শিল্পী, রীতিমতো ধনাঢ্য ব্যক্তি। প্যারিসে তাঁর একাধিক বাড়ি, স্টুডিও। ব্যক্তিগত জীবনেও এক ধরনের বাহ্যিক স্থিতি এসেছে। খ্যাতনামা রুশ ব্যালেরিনা ওলগা খোকলভা তাঁর স্ত্রী, যদিও পিকাসোর কাছে সে বিবাহে আনন্দের চেয়ে বিরাগই ছিল বেশি। ১৯১৮ সালে তাঁদের যখন বিয়ে হয়, ওলগা তখন দাগিলিয়েফের বিখ্যাত রুশ ব্যালে কোম্পানির নামজাদা ব্যালেরিনা। এর আগের বছর দাগিলিয়েফ ও পিকাসোর বন্ধু ককতো-র অনুরোধে রুশ ব্যালে কোম্পানির নতুন প্রযোজনা প্যারেড ইন রোমের সেট ডিজাইনের জন্য পিকাসো এসেছিলেন রোমে। সেখানেই ওলগার সঙ্গে পরিচয়, যা দ্রুত প্রণয়ে পরিণত হয়।
পিকাসো যে ওলগার প্রেমে ঠিক হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তা নয়, তবে ওলগাকে বিয়ে করলে তিনি জাতে উঠবেন, এমন একটি অঙ্ক তাঁর মাথায় ছিল। প্যারিসের খ্যাতিমান ও ধনাঢ্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার ইচ্ছা পিকাসোর অনেক আগে থেকেই। বুর্জোয়াবিরোধী দাদা ও সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকলেও পিকাসো বুর্জোয়া জীবনধারার সকল অনান্দনিক স্বাচ্ছন্দ্যে গভীরভাবে আকৃষ্ট বোধ করতেন। চিত্রকর হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা থেকে নিস্তার পাননি। দামি গাড়ি, বাড়ি, গ্রীষ্মের ছুটিতে অবকাশ নিবাসে দিনযাপন, এসব বুর্জোয়া জীবনযাত্রা তাঁর জাতে ওঠার চেষ্টা। ওলগার বাবা রুশ জারের সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন, রাজকীয় পরিবারের সঙ্গে  তাঁদের  সম্পর্ক  নিয়ে  বানানো  গল্পও  শোনা গেছে। ব্যালে শিল্পী হিসেবে ওলগা মোটেই আহামরি কিছু ছিলেন না, সুন্দরী হিসেবেও ডাকাবুকো নন কিছু। পিকাসোর ছবি অথবা বুদ্ধিবৃত্তিগত ব্যাপারে তাঁর বড়জোর লোক-দেখানো আগ্রহ ছিল। শুধু অভিজাত বংশীয় হওয়ায় দাগিলিয়েফ তাঁকে নাচের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ওলগার সঙ্গে বিয়ে পিকাসোকে প্যারিসের ওপরতলায় স্থান করে দেয়, কিন্তু রোগা-ঢ্যাঙ্গা, প্রায় স্তনবিহীন ও খনখনে গলার ওলগার প্রতি তিনি গভীর কোনো আকর্ষণ কোনোদিনই বোধ করেননি।
বিয়ে মানে এই নয়, বিবাহবহির্ভূত নারী সংসর্গ ত্যাগের কোনো ভাবনা পিকাসোর মাথায় ছিল। নারীদেহের প্রতি এক অদম্য আগ্রহ তিনি আবাল্য বোধ করেছেন। এমনকি প্রায়-কিশোর বয়সে বারসেলোনায় বেশ্যালয়ে যাবার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। নিকট-দূর আত্মীয়াদের সঙ্গেও তাঁর দৈহিক সম্পর্কের কথা অজ্ঞাত নয়। প্যারিসে শিল্পী হিসেবে কমবেশি পরিচিত হতে না হতেই তিনি একের পর এক হ্রস-দীর্ঘ প্রেম ও কাম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-পতœীদেরও তিনি ছেড়ে দেননি (যেমন পল এলুয়ারের স্ত্রী নুশ)। ওলগার সঙ্গে বিয়ের পরেও – তখন তো তিনি রীতিমতো নামজাদা শিল্পী – সেসব সম্পর্কের কোনো কমতি ঘটেনি। এসব সম্পর্কের কোনোটা গোপন, কোনোটা খোলামেলা। গার্টুড স্টাইন তাঁর ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এলিস বি তোকলাসে’ সেসবের কিছু কিছু আমাদের শুনিয়েছেন।
মারি-তেরেসের সঙ্গে তাঁর আকস্মিক প্রণয় পিকাসো যতটা সম্ভব লুকিয়েই রেখেছিলেন। এই গোপনীয়তায় এক ধরনের নিষিদ্ধের মাদকতা ছিল, পিকাসো যা প্রবলভাবে উপভোগ করতেন। তবে তার চেয়েও বড় কারণ ছিল, এ নিয়ে ওলগার সঙ্গে বড় ধরনের ঝুট-ঝামেলায় না জড়িয়ে পড়া। সন্দেহপরায়ণ ও কিছুটা বাতিকগ্রস্ত ওলগার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ছবি আঁকার স্টুডিও করেছিলেন প্যারিসে তাঁর কেতাদুরস্ত বাসভবন থেকে দূরে। মারি-তেরেসের জন্য যে অ্যাপার্টমেন্ট নেওয়া হয়, তাও ছিল বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে। তবে গোপনীয়তার এই ব্যাপারটা ছিল পুরোপুরি একটা খেলা। ওলগা জানুক, তাতে কোনো আপত্তি পিকাসোর ছিল না, কারণ তাঁকে শাস্তি দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। কিন্তু নিজে থেকে ডেকে তাঁকে এ নিয়ে কিছু বলবেন না – সেটি তাঁর সম্ভ্রমের জন্য গ্লানিকর হতো। গোপনীয়তার অন্য কারণ,
মারি-তেরেস ছিলেন তাঁর নিজের একটা পুতুল, তাঁকে নিয়ে যেমন খুশি তিনি খেলবেন, কারো এ নিয়ে কিছু বলার থাকবে না। এমনকি মারি-তেরেসেরও না।
সেই প্রথম পরিচয়ের পর আমাদের দেখা হয় দুদিন পর। পিকাসো আমার কাছে কী চান, তা বুঝতে আমার বিলম্ব হয়নি। পুরুষ মানুষ – তা সদ্য যুবক বা পিকাসোর মতো পরিণত – তাদের চোখ বরাবর আমার দেহের ওপর, সে-কথা আমি ভালোই জানতাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও চট করে তাঁর শয্যাশায়িনী হতে আমি তৈরি ছিলাম না। আমাদের দুজনের মধ্যে যেন এক রকম বেড়াল ও ইঁদুরের সম্পর্ক চলছিল। শেষ পর্যন্ত আমি ধরা দিলাম – তাও প্রথম সাক্ষাতের ছয় মাস পর। তারিখটা আমার ঠিক মনে আছে – ১৩ জুলাই ১৯২৭।
প্রথম প্রথম আমি পিকাসোর ব্যাপারটা মা ও আমার সৎবোনদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। বিকালে বেড়াতে যাবার আগে মাকে বলে যেতাম, এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। কিন্তু কাঁহাতক আর এই কথা লুকিয়ে রাখা যায়। আমি মাকে পিকাসোর কথা বলেছিলাম – তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি শিল্প-সাহিত্যে আগ্রহী। একসময় এক চিত্রকের সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল, এমন গল্প আমাদের জানা ছিল। পিকাসো নাম কেবল তিনি জানতেন না, তাঁর ছবি সম্বন্ধেও কমবেশি জ্ঞান ছিল। তার চেয়েও বড় কথা, পিকাসো মস্তবড় শিল্পী এবং অত্যন্ত ধনী, এ-কথা তিনি ভালোই জানতেন। বয়সে আমার দ্বিগুণ এই লোকটির সঙ্গে আমার চেনা-পরিচয় হোক, তা ঠেকাতে মা কোনো চেষ্টাই করেননি। প্রথম প্রথম আমাকে তাঁর গালমন্দ শুনতে হয়েছে, কিন্তু যেই মা টের পেলেন আমার ব্যাপারে পিকাসোর আগ্রহ গভীর, তখন থেকে তিনি এক ধরনের নীরব সমর্থন দিয়ে গেছেন। মা ও আমি দুজনেই পিকাসোকে ডাকতাম ‘পিক’ বলে। প্যারিসের অদূরে আমাদের পারিবারিক বাড়ির পেছনে একটি ছোট ঘর ছিল। সে-ঘরে পিকাসো অনেকদিন এসেছেন, ছবিও এঁকেছেন। হ্যাঁ, সে-ঘরে যে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছি, সে-কথা মা ও আমার বোনেরা সবাই জানত।
সে এক দুরন্ত প্রেমের সময়। আমার কথা বলতে গেলে কেউই জানত না। ওলগা তো নয়ই, এমনকি তাঁর সে-সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যেমন পল এলুয়ার বা তাঁর এজেন্ট দানিয়েল কাহনভেইলার, ঘুণাক্ষরেও জানতেন না আমার কথা। আমার ছবি আঁকছেন, ছবিতে গোপন সংকেতের মতো আমার নাম (এম টি) লুকিয়ে রাখছেন, তাঁর ছবি আকার নিয়মকানুনও বদলে যাচ্ছে, এসব যে কারো নজরে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু আমাদের প্রণয়কাহিনি পিকাসো যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। সে-সময়টা আমরা সত্যি দারুণ সুখী ছিলাম। কোনো নিয়মকানুন নেই, কোনো বাধা-বন্ধন নেই, কোনো বুর্জোয়া সামাজিকতা রক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। একদম বাউণ্ডুলে এক প্রেম।
এই বাউণ্ডুলে প্রেমের সাক্ষী গ্যাগসিয়ান গ্যালারির প্রদর্শনীটি। এতে রয়েছে আশিটির মতো ছবি, কিছু স্কেচ ও ড্রয়িং, কিছু ছাপচিত্র এবং অনেকগুলি স্কাল্পচার। সবকিছুই মারি-তেরেসের প্রতি নিবেদিত। প্রদর্শনীটি প্রস্তুত করেছেন পিকাসো ও মারি-তেরেসের দ্রৌহিত্রী ডায়ানা ভিডমায়ার পিকাসো ও পিকাসোর জীবনীকার জন রিচার্ডসন। মিসেস ভিডমায়ার মারি-তেরেস ও পিকাসোর একমাত্র কন্যা মায়ার সন্তান। চিত্রকলায় পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি সুপরিচিত। তার ওপর পিকাসো   পরিবারভুক্ত হওয়ায় তাঁর প্রস্তুত এই প্রদর্শনীটির গুরুত্বই আলাদা।
গ্যালারিতে ঢোকার মুখে নজরে পড়ল মূল প্রদর্শনীটি আড়াল করে রাখা একটি ছবি, চারকোলে আঁকা মারি-তেরেসের একটি কোমল সুন্দর পোর্ট্রেট। ২৪ ী ১৮ ইঞ্চির এই ছবিটি সম্ভবত মারি-তেরেসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাজ। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম কয়েক সপ্তাহ পিকাসো একটি নোট বুকে মারি-তেরেসের অনেকগুলি স্কেচ করেছিলেন, সে-কথা আমরা জানি, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ছবি সম্ভবত এটিই প্রথম। মারি-তেরেসের বন্য ও উদ্দাম যৌবন, যা পিকাসোকে আকর্ষিত করেছিল, এই ছবিতে তার চিহ্নমাত্র নেই। এখানে যাকে দেখি সে বড়জোর এক নিষ্পাপ কিশোরী, এখনো পূর্ণ যৌবন যাকে স্পর্শ করেনি, অথবা কামুক পুরুষের হাতে যে দলিত-মথিত হয়নি। সে অনাঘ্রাতা, নিষ্পাপ। কিন্তু সদর দরোজার সে আহ্বান পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই সব বদলে গেল। পর পর সাজানো একের পর এক ছবি – সবই এক রমণীর, কিন্তু ক্রমশ তার রূপান্তর ঘটছে। ক্রম অনাবৃতা এই রমণী পুরুষের ভোগের ও কামনার আধার, এই পরিচয় ছাড়া তার আর কোনো পরিচয় থাকে না। একদম সম্পূর্ণ নিওক্লাসিক্যাল থেকে কিউবিস্ট, এমনকি সুররিয়ালিস্ট এই সব ছবিতে একদিকে যেমন রমণী হিসেবে মারি-তেরেসের রূপান্তর দেখি, তেমনই দেখি শিল্পী হিসেবে পিকাসোর পরিবর্তন।
দক্ষিণের একটি দেয়ালজুড়ে ঝোলানো ‘ন্যুড ওম্যান ইন এ রেড আর্মচেয়ার’ ছবিটি। শিল্পবোদ্ধারা যাকে পিকাসোর মারি-তেরেস পিরিয়ড বলে চিহ্নিত করেছেন (১৯২৭-১৯৪০), তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি। ক্যানভাসের ওপর তেলরং,  মুখাবয়ব ও শরীর প্রায় পূর্ণাঙ্গ ধরা পড়েছে। সবচেয়ে যা স্পষ্ট চোখে পড়ে তা উদ্ভিন্ন-যৌবনা নগ্ন রমণীটির পুষ্ট স্তন, স্তনের বোঁটা, সাপের মতো শরীরের ভাঁজ, কামুক প্রেমিকের চুম্বনের জন্য অপেক্ষারত যোনিদ্বার। হাতলওয়ালা চেয়ারে যে দুটি হাত ধরা পড়েছে, তা আলিঙ্গন-উন্মুখ। রমণীর সুখী ও পরিতৃপ্ত মুখখানি আবৃত করে রেখেছে আরেকটি মুখ, যেন কী আহ্লাদে, কী গভীর তৃপ্তিতে কোনো প্রেমিক তার পূর্ণ ও সিক্ত ওষ্ঠযুগলে চুম্বনরত। হলের মাঝ বরাবর, প্রায় পুরো দেয়ালে যে ছবি তার নাম ‘রিডিং অ্যাট এ টেবিল’। এটিও একটি তৈলচিত্র, ১৯৩৪-এ আঁকা মারি-তেরেসের একটি অন্তরঙ্গ ছবি। এই ছবি এমন একসময়ের যখন মারি-তেরেসের বয়স চব্বিশ। পূর্ণ যৌবনা রমণী, অথচ তাঁর বাঁ-হাতটি যেভাবে রাখা, মাথার চুল ফুলের মালা দিয়ে যেভাবে সাজানো, তাতে মনে হয় কোনো এক কিশোরী। পিকাসো তাঁর প্রেমিকার এই কিশোরী মেজাজটিই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। সে পুরুষের কর্ষণের জন্য অপেক্ষারত, আর সে পুরুষ পিকাসো নিজে, অন্য কেউ নয়। বেঢপ সাইজের টেবিলটি আঁকা হয়েছে বালিকার পুরুষ্টু স্তনযুগলের প্রতি দর্শকের তাৎক্ষণিক দৃষ্টির জন্য। তারপরও রয়েছে এক বিচিত্র সুন্দর কোমলতা – সম্ভবত মেয়েটির বেণিতে গোঁজা ফুল ও টেবিলে সাজানো মোম রং বাতিটির জন্যই।
পিকাসোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গোড়া থেকেই নির্ধারিত ছিল – তিনি প্রভু, আমি সেবিকা। আমি এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করিনি, তার একটা বড় কারণ পিকাসো আমার প্রতি বলতে গেলে সবসময়েই সদয় ব্যবহার করেছেন। ভালোও বেসেছেন। তবে এ-কথায় কোনো ভুল নেই যে দীর্ঘদিন আমি কার্যত অদৃশ্যই ছিলাম। প্যারিসে আমার জন্য আলাদা বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। পরে, তিরিশ সালের দিকে, নর্মান্ডিতে তাঁর বিখ্যাত স্টুডিও বোয়াগিলুপে আমাদের তুলেছিলেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি মেয়ে মায়াকে নিয়ে সেখানেই থাকতাম। আমাকে নিয়ে যে ভাস্কর্যগুলো রয়েছে, তার অধিকাংশ এই বোয়াগিলুপেই করা। ততদিনে অবশ্য অনেকেই আমাদের কথা জেনে গেছে। তাঁর স্ত্রী ওলগার সঙ্গে আমার কখনো মুখোমুখি দেখা হয়নি, যদিও সে নির্ঘাৎ ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। এ নিয়ে পিকাসোর সঙ্গে তার মস্ত বাদ-বিবাদও হয়েছিল। আমি তাতে নাক গলাইনি, তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন, ওলগার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দিয়ে আমাকে নিয়মমাফিক বিয়ে করবেন। কিন্তু সে কথা তিনি রাখেননি। ওলগাকে তিনি একদমই সহ্য করতে পারতেন না, যদিও বিয়ে চুকেবুকে যাবার কয়েক বছর আগেও তাঁরা পূর্ণ দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন। ছুটিতে ওলগা ও পুত্র পাওলোকে নিয়ে সমুদ্রবিহারেও গেছেন।
একটা সময় ছিল যখন আমি প্রতিদিন তাঁকে চিঠি লিখতাম। আমাকেও অসংখ্য চিঠি লিখেছেন তিনি। প্রতিটি চিঠিতে গভীর ভালোবাসার আন্তরিক অঙ্গীকার, বারবার সে-কথা বলেছেন। পিকাসো আমাকে একবার বলেছিলেন, আমি তাঁকে বাঁচিয়েছি। এ-কথার অর্থ সম্ভবত এই যে, শিল্পী হিসেবে তাঁকে আমি নতুন পথচলায় সাহায্য করেছি, শিল্পী হিসেবে নিজেকে তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। আমি তাঁর কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখিনি। তাছাড়া পিকাসোর ছবিই তো সে-কথার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পরে অবশ্য বুঝেছি, বাঁচা বলতে তিনি ওলগার হাত থেকে বাঁচার কথা বুঝিয়েছেন।
১৯৩৫ সালে আমাদের একমাত্র সন্তান মায়ার জন্ম। পিকাসো সে সন্তানের আগমনকে গভীর আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বরণ করেছিলেন। জন্ম সনদে তার নাম রাখা হয়েছিল মারিয়া দে লা কনসেপসিয়ন, পিকাসোর অকালমৃত ছোট বোনের নামানুসারে। পরে সে নাম হয়ে যায় মায়া। মায়া গর্ভে আসার পর থেকে দেখেছি একধরনের গ্লানি ও অপরাধবোধ তাঁকে তাড়া করে ফিরছিল। মায়ার জন্মের আগে থেকেই তিনি আমাকে বিয়ের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। মাকেও সে-কথা বলেছেন বারকয়েক। কিন্তু ওলগার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হোক, তাও তিনি চাইছিলেন না, কারণ তাহলে তাঁর তাবৎ সম্পত্তি – বিশেষ করে তাঁর শিল্পকর্ম – সমান দুভাগে ভাগ করতে হবে।
পিকাসো শুধু আমার নয়, মায়ারও বিস্তর ছবি এঁকেছিলেন। মায়া বুকের দুধ খাচ্ছে, খেলছে, সমুদ্রের ধারে মায়া, বল হাতে মায়া। ছবির পর ছবি। বড় সুখের সময় সেটি। ১৯৩৫ সালের ২৩ মার্চ আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। তিনি লিখলেন, ‘আজ এই সন্ধ্যায় তোমাকে গতকালের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, আগামীকালের চেয়ে কম। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।’ কেউ যাতে সে চিঠি দেখে কে লিখেছে তা টের না পায়, সেজন্য পিকাসো নাম না লিখে তাঁর আসল নাম রুইজ লিখতেন। ২৮ জুলাই আরেকটা নোট পাঠালেন আমাকে, তাতে লেখা, ‘দুপুরে খেতে আসছি, যত দ্রুত সম্ভব। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমার এই কুকুরের মতো জীবনে সবচেয়ে প্রিয় কাজ। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত আমি তোমাকে আগের চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসি।’ এই সময় নানা ভঙ্গিতে আমার একাধিক পোর্ট্রটে এঁকেছিলেন তিনি, তার কোনোটায় আমি ঘুমিয়ে, আমি বই পড়ছি, একটা ছবি আছে যেখানে আমার চোখে জল।
১৯৩৬-এর মাঝামাঝি পিকাসো আমার ও মায়ার জন্য প্যারিসের অদূরে লে ত্রেমলে-সুর-মলদ্রেতে একটি চমৎকার বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর বন্ধু ভোলার এই বাসাটি তাঁকে দিয়েছিলেন ছবি আঁকার স্টুডিও হিসেবে। পরবর্তী তিন বছর এটি হয়ে উঠল আমাদের গোপন আস্তানা। এখানে প্রতি সপ্তাহে শনি-রবিবার তিনি আসতেন, আমাদের সঙ্গে থাকতেন। ছবি আঁকতেন বিস্তর। সোমবার হলে ঠিক প্যারিস ফিরে যেতেন।
কিন্তু যে কথাটা মারি-তেরেস তখনো জানেন না তা হলো পিকাসো ততদিনে পরবর্তী প্রেমিকা, তাঁর নতুন দেবী পেয়ে গেছেন। তাঁর নাম ডোরা মার। ১৯৩৬ সালে প্যারিসের এক কাফেতে ডোরার সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, ফটোগ্রাফার ও চিত্রকর ডোরা সব দিক দিয়েই মারি-তেরেসের বিপরীত। প্রথম দর্শনেই ডোরার প্রতি আকৃষ্ট হন পিকাসো, একটানা দশ বছর তাঁদের সে সম্পর্ক টিকে থাকে। মিউজ হিসেবে মারি-তেরেসের স্থান করে নেন ডোরা। মারি-তেরেসকে পিকাসো যেভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন, ডোরার বেলায় তেমন কোনো চেষ্টা ছিল না। তাঁর কবি ও চিত্রকর বন্ধুরা প্রায় সবাই তাঁকে চিনতেন। পিকাসোর ছবিতে ডোরা মারের প্রবেশ তাই কারো কাছেই আকস্মিক বা বিভ্রান্তিকর মনে হয়নি। ঠিক মারি-তেরেসের বিপরীত।
বলাই বাহুল্য, মারি-তেরেস ব্যাপারটা খুশি মনে গ্রহণ করেননি। কিন্তু মারি-তেরেসের চেয়েও ডোরার উপস্থিতি যিনি একদমই সহ্য করতে পারতেন না তিনি হলেন ওলগা। এ নিয়ে তাঁদের প্রকাশ্য বিবাদ লেগেই থাকত। একবার ওলগা ও ডোরার মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। ওলগার সঙ্গে বাদ-বিবাদ ও কোন্দল ক্রমশ এতটা অসহ্য হয়ে ওঠে যে, শেষ পর্যন্ত আইনগতভাবে বিচ্ছেদের পথ নিতে বাধ্য হন পিকাসো। তাঁদের দুজনের তালাক হয়নি – অর্থনৈতিকভাবে সেটা পিকাসোর জন্য ভয়াবহ হতো। কিন্তু পারস্পরিক সম্মতিতে আলাদা থাকার চুক্তি হলো, কিছু কিছু সম্পত্তি ভাগাভাগিও হলো। পিকাসো কথা দিয়েছিলেন ওলগার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে মারি-তেরেসকে আইনসম্মতভাবে বিয়ে করবেন। কিন্তু ডোরার আগমনের ফলে সে-ব্যবস্থাও বাতিল হলো। ডোরা হয়ে উঠলেন পিকাসোর এক নম্বর প্রেমিকা। ১৯৩৭-এ পিকাসো যখন তাঁর বিখ্যাত গুয়ের্নিকা ছবি আঁকছেন, তার পাশে ছায়ার মতো আগলে থাকলেন ডোরা। মারি-তেরেস সেই আগের মতোই রয়ে গেলেন পশ্চাতে।
পিকাসোর প্রথম স্ত্রী ওলগাকে মারি-তেরেস মেনেই নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগেই তাঁদের পরিণয়, ফলে এ নিয়ে ক্রোধ বা উষ্মার কোনো সুযোগ তাঁর ছিল না। কিন্তু ডোরা মারের আবির্ভাব হাসিমুখে মেনে নেওয়া তাঁর জন্য কঠিন ছিল। এ নিয়ে পিকাসোর সঙ্গে তাঁর বাদ-বিবাদ হয়েছে। পিকাসোর স্টুডিওতে তাঁদের দুজনের প্রায় চুলোচুলির এক গল্প শোনা গেছে। পিকাসোর পরবর্তী প্রেমিকা ফ্রাঁসোয়া জিলো তাঁর স্মৃতিকথায় তাঁদের সে চুলোচুলির সরস বর্ণনা দিয়েছেন। মারি-তেরেস ও ডোরা দুজনের মুখোমুখি হয়ে সব হিসাব-নিকাশের দাবি তুললেন। সে-সময়ে পিকাসো গুয়ের্নিকা আঁকায় ব্যস্ত। মারি-তেরেস দাবি করলেন, ‘আমাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। বলো, কাকে চাও?’ শান্ত ও সমাহিত পিকাসো, যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির দর্শক, জবাবে বললেন, ‘অবস্থা এখন যেমন আছে, সেটাই আমার পছন্দ। তবে সিদ্ধান্ত যদি নিতে হয়, তার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।’ এরপর ডোরা ও মারি-তেরেস রীতিমতো হাতাহাতি শুরু করলেন। পিকাসো নাকি পরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আহ, এমন মজার দৃশ্য তিনি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি।’
মারি-তেরেসকে নিয়ে তো বটেই, ডোরাকে নিয়েও নিষ্ঠুর খেলা খেলতে ভালোবাসতেন পিকাসো। প্রতি সপ্তাহান্তে মারি-তেরেস ও মায়ার সঙ্গে যখন সময় কাটাতে তাঁদের লে ত্রেমলে-সুর-মলদ্রের বাড়িতে আসতেন, পিকাসো ডোরাকে উসকে দিতেন সে যেন মারি-তেরেসের বাসায় তাঁর খোঁজে ফোন করে। যথারীতি ফোন আসত, কে ফোন করেছে জানতে চাইলে কিছু সময়ের নাটকীয় যতি দিয়ে পিকাসো বলতেন, ‘আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত’। উল্লেখ্য, ডোরা একসময় আর্জেন্টিনায় কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন ও চমৎকার স্প্যানিশ বলতে পারতেন। হাফিংটন লিখেছেন, মারি-তেরেস ও ডোরা উভয়কে  কষ্ট  দেবার জন্যই  পিকাসো কখনো কখনো তাঁদের দুজনকে একই পোশাক কিনে উপহার দিতেন। একবার ডোরার জন্য কেনা পোশাক তিনি মারি-তেরেসের বাসায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ক্রুদ্ধ মারি-তেরেস প্রথমে ডোরার বাসায় এসে সে পোশাক ছুড়ে ফেলে দিলেন। এরপর তিনি হন হন করে ছুটে এলেন রু দে সাভোয় পিকাসোর স্টুডিওতে। সে স্টুডিওতে মারি-তেরেসের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো সাহসী হতে চেষ্টা করলেন মারি-তেরেস। প্রথমে ডোরা ও পিকাসোর ওপর তাঁর রাগ ঝেড়ে দিলেন তিনি। অপ্রস্তুত পিকাসো তাঁকে নয়ছয় করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পিকাসোর উত্তরে অসন্তুষ্ট হয়ে সরাসরি দাবি তুললেন, আমাকে বিয়ের প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলে তুমি। তার কী হলো? বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে পিকাসো জবাব দিলেন, ‘দেখো, আমার এই বয়সে বিয়ে একটু হাস্যকর। তাছাড়া এখন যুদ্ধ চলছে।’ খানিক পরে সে স্টুডিওতে এসে হাজির ডোরা মার। মারি-তেরেসকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ডোরা সোহাগভরা কণ্ঠে পিকাসোকে বললেন, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো, কি বাসো না।’ সে-কথার জবাব না দিয়ে পিকাসো ডোরা মারের দিকে তাকিয়ে মারি-তেরেসকে দেখিয়ে বললেন, ‘ডোরা, তুমি তো জানো, একমাত্র যে মেয়েকে আমি ভালোবাসি সে হলো মারি-তেরেস। আর এই হলো সেই মারি-তেরেস।’
হাফিংটন মন্তব্য করেছেন, মস্ত পরাবাস্তববাদী বুদ্ধিজীবী ডোরা মার এইভাবে দেবী থেকে পাপোশে পরিণত হলেন।
পিকাসোর যখন ৬১ বছর বয়স, তখন তাঁর জীবনে একুশ বছরের ফ্রাঁসোয়া জিলোর প্রবেশ। ততদিনে ডোরা মারের মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। অধিকাংশের ধারণা, সে বিকৃতির কারণ পিকাসো। মারি-তেরেসের সঙ্গে সব সম্পর্ক তখনো চুকেবুকে যায়নি। প্রতি মাসে তাঁকে নিয়মিত অর্থ পাঠিয়েছেন, মায়ার লেখাপড়ার খোঁজখবর নিয়েছেন। বস্তুত মারি-তেরেসের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও মায়ার সঙ্গে তাঁর একটি নিকট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে এই মায়ার কারণেই পিকাসোর প্রথম সন্তান পাওলো ও ফ্রাঁসোয়ার গর্ভজাত অপর দুই সন্তান – পালোমা ও ক্লদের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের জন্ম হয়।
ডোরা মঞ্চ থেকে অন্তর্হিত হওয়ার পর মারি-তেরেস হয়তো আশা করেছিলেন, এবার পিকাসো তাঁর দিকে নজর ফেরাবেন। কিন্তু তেমন সুযোগই আসেনি, কারণ ফ্রাঁসোয়ার আবির্ভাব। সুন্দরী, বিদুষী ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জেতা মারি-তেরেসের পক্ষে অসম্ভব ছিল। ফ্রাঁসোয়া পিকাসোর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর নিজে যে স্মৃতিকথা লেখেন তাতে জানিয়েছেন, মারি-তেরেসের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলতে – নিদেনপক্ষে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি চেষ্টা করেছিলেন। বাদ সাধেন পিকাসো। ফ্রাঁসোয়া জিলো লিখেছেন, পিকাসো বারবার তাঁর বন্ধু-বান্ধব, ব্যবসায়ী সহকর্মী, এমনকি প্রেমিকাদেরও একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। মায়ার উদ্ধৃতি দিয়ে হাফিংটন জানিয়েছেন, ১৯৪৯-এর গ্রীষ্মে প্রথমবারের মতো মারি-তেরেস ও ফ্রাঁসোয়া জিলোর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু ততদিনে মারি-তেরেসের পক্ষে বিবাদ মিটিয়ে ফেলা আর সম্ভব ছিল না। বিশ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি অপেক্ষায় থেকেছেন পিকাসোর। স্বেচ্ছায় নিজের স্থান ছেড়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ফ্রাঁসোয়াকে সে-সময়ে মারি-তেরেস বলেছিলেন, ‘আমার জায়গা দখল করবে যদি ভেবে থাকো তো মস্ত ভুল করবে।’
জবাবে ফ্রাঁসোয়া বলেছিলেন, ‘আমি তোমার স্থান দখল করিনি। জায়গাটা খালি ছিল। আমি সেখানেই স্থান নিয়েছি।’
এরপর আরো দশ বছর পিকাসো মারি-তেরেসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের দুজনের শেষ দেখা ১৯৫৮ সালে। সে-সময়ে অবশ্য তাঁর জীবন থেকে একে একে ঝরে গেছে ওলগা, মারি-তেরেস, ডোরা মার ও ফ্রাঁসোয়া জিলো। তাঁর জীবনে ও ছবিতে প্রবেশ করেছেন নতুন বান্ধবী – পরে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী – জ্যাকুলিন।
শেষ কথা
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পিকাসোর প্রথম কিউবিস্ট পিরিয়ড এবং পরবর্তী সুররিয়াল পিরিয়ডে অধিকাংশ ছবির সুর ছিল ভয়াল ও ঋণাত্মক। কখনো কখনো এক গভীর বেদনাবোধের অনুরণনও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি যা ধরা পড়ে তা হলো ছবির ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। কোনো একটি বিশেষ অনুভূতিকে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের দৃষ্টিগোচরে আনার জন্যই এই বিকৃতি। দুচারটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবসময়েই এই বিকৃতির ভেতর আমরা শিল্পীর ক্রোধ, তাঁর হিংসা, এমনকি গভীর আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হই। কিন্তু মারি-তেরেসের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাঁর ছবিতে একটি কাব্যিক মেজাজের সূত্রপাত হয়। যেন কোমল, আন্তরিক ও লাবণ্যময় এক চেহারা। মারি-তেরেসের প্রতি তাঁর অনুরাগ নির্ভেজাল না হলে এমন কাব্যিক ছবি পিকাসোর কাছ থেকে পেতাম কি না সন্দেহ। সে রকম অনুরাগ-ভেজা একটি ছবি ‘স্নিপিং বিউটি’। প্রায় রূপকথার ম্যাজিক যেন এই ছবিটির প্রতিটি রেখায় – তাতে উজ্জ্বল, স্নেহময়, আলস্য আলিঙ্গনে ধরা মারি-তেরেস। ক্যানভাসের অধিকাংশ স্থানজুড়ে আছে মেয়েটির শির, ঘুমন্ত সে, কিঞ্চিৎ আলুলায়িত কেশদাম, শিল্পী যেন তাঁকে কাছ থেকে দেখছেন, সে দৃষ্টি লালস্যপূর্ণ হলেও তা মমত্বমাখা।
এই সিরিজের আরেকটি ছবি ‘ন্যুড, গ্রিন লিভস অ্যান্ড বাস্ট’। এটি একটি জাদুবাস্তব তৈলচিত্র : একটি আবক্ষ মূর্তির পটভূমিতে নগ্ন রমণী, আবক্ষ মূর্তিটি যেন আলোকবাতি, যার উজ্জ্বল আলোয় আবৃত রমণীটি, একটি সতেজ ঘন সবুজ পত্রপল্লব তার শিরে। মেয়েটির অবয়ব, তার নগ্নদেহ সবই সযত্ন রেখায় আঁকা। মেয়েটির মুখটি যেন রূপকথার রাজকন্যা।
এই সিরিজেরই আরেকটি বহুল আলোচিত তৈলচিত্রের নাম ‘দি ড্রিম’। ১৯৩২ সালে আঁকা এই তৈলচিত্রে মারি-তেরেস নিদ্রামগ্ন। একটি লালরঙা চেয়ারে অলস ভঙ্গিতে সে বসে, তার দুই চোখ বোজা, হাত দুটি সযতেœ মোড়ানো তার যোনিপৃষ্ঠে। পিকাসোর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিকৃতি এখানেও আছে, তবে অল্প কয়েকটি রেখায় ও রঙে যে অবয়বটি অঙ্কিত, তার সারল্য আমাদের মুগ্ধ করে। ছবিটি একটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখলে চোখে পড়ে, নিদ্রিত রমণীটির মাথা ও মুখ বরাবর একটি দৃঢ় কালো রেখা। অনেকেই বলেছেন, এই রেখা আসলে একটি শিশ্ন-প্রতীক। ঘুমন্ত রমণীটি স্বপ্ন দেখছে ওই উত্থিত শিশ্নের, আর সে-কারণেই তার হাত দুটি আলগোছে বাঁধা তার যোনিপৃষ্ঠে।
মারি-তেরেস দীর্ঘদিন কার্যত অজ্ঞাত-অপরিচিত থাকলেও পিকাসো তাঁর জীবনে এই রমণীর প্রবেশের ইঙ্গিত রেখে গেছেন। কোনো কোনো ছবি আছে, যেখানে পিকাসো মারি-তেরেসের নামে আদ্যক্ষর – এম টি – কখনো কখনো তার সঙ্গে নিজের নামের আদ্যক্ষরটিও (এম টি পি) ছবির ভাষায় লিখে রেখেছেন। কোথায় যেন পড়েছি, আদ্যক্ষর ব্যবহারের পেছনে লুকানো থাকত এক ধরনের ঐশ্বরিক বার্তা। তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু – গিয়ম আপোলেনিয়র ও ম্যাক্স ইয়াকভ – একইভাবে বর্ণমালার ব্যবহার করেছেন এই বিশ্বাস থেকে যে, প্রতিটি বর্ণের অন্তরালে থাকে ঐন্দ্রজালিক শক্তির ইঙ্গিত। সম্ভবত পিকাসো তাঁদের কাছ থেকে এই ইঙ্গিতময়তার ধারাটি রপ্ত করেছিলেন।
ভাবা হয়, পিকাসো ও মারি-তেরেস কখনো এক গৃহে একটানা বসবাস করেননি। বোয়াগিলুপে একাধিকবার মারি-তেরেস ও কন্যা মায়াকে এনে রেখেছেন বটে, কিন্তু ওলগার রোষ এড়াতে নিজে তাতে বাস করেননি, বড়জোর উইক এন্ড কাটিয়েছেন। তবে এ-প্রদর্শনীর একটি ছবি, বেদার প্লেয়িং উইথ দি বল, বোয়াগিলুপেই আঁকা, সেখানে যে উচ্ছল তরুণীকে দেখি, সে যে মারি-তেরেস, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। ফলে কেউ কেউ ধারণা করেছেন যেমন, পিকাসোর জীবনীকার পিয়ের দেই – পিকাসো নির্ঘাত ওলগার চোখ এড়িয়ে এখানে সময় কাটিয়েছেন।
এই বোয়াগিলুপেই পিকাসো তাঁর বিখ্যাত মাইন্যাটার (মিনোতুর) সিরিজের কাজ শেষ করেন। গ্রিক পুরাণে যে মিনোতুরের কথা আমরা পড়ি, তার আধখানা মানুষ, বাকি আধখান মোষ। পিকাসোর কাছে এই মিনোতুর – তিনি নিজে – একদিকে পৌরুষের প্রতীক, অন্যদিকে নারীর ওপর তার প্রভুত্বের। পুরুষ ও নারীর সকল সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু – যে সম্পর্ক অন্য সকল সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে – তা দৈহিক ও কামজ। এবং এই সমীকরণে নারীর ওপর পুরুষের প্রভুত্ব অনিবার্য, তর্কাতীত। একই সঙ্গে পুরুষের অব্যাহত অপরাধবোধ ও সংশয়েরও প্রতীক সে। মারি-তেরেসের প্রতি পিকাসোর ব্যক্তিগত ব্যবহারে কোনো গ্লানি বা অপরাধবোধের প্রকাশ দেখি না – সে বোধ প্রকাশ তার অহংকারের পরিপন্থী হতো। কিন্তু ছবিতে – যেখানে অনেক কথাই তিনি বলেছেন ইঙ্গিতে – তার প্রকাশ ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। ১৯৩২ সালে পিকাসো তাঁর মিনোতুর সিরিজের তিরিশটির মতো ড্রয়িং শেষ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে মারি-তেরেসকে নিয়ে যে অদম্য যৌন-ক্রীড়ায় তিনি মত্ত ছিলেন, এই স্কেচগুলিতে তাঁর অর্গলখোলা পরিচয় নথিভুক্ত হলো। গ্যাগসিয়ান গ্যালারির প্রদর্শনীতে এ স্কেচগুলো দেখে তাঁর মিনোতুরকে দানব ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তার মনুষ্যত্ব কার্যত অদৃশ্য – লোভী চোখে সে দেখছে তার শিকার ঘুমন্ত নগ্ন যুবতীকে। অথবা শক্ত, কঠিন আলিঙ্গনে তাকে আবদ্ধ করেছে। একটি স্কেচে বোঝা যায়, মিনোতুর রমণীটিকে বলাৎকার করছে। হ্যাঁ, বলাৎকারই, কারণ দানবটির চোখে নগ্ন লালসা, সে-লালসার সম্মুখে অসহায় নগ্নিকা। বিস্ময়কর হলো, এই প্রায়-কুৎসিত ছবিটির পাশে রয়েছে আরেকটি ড্রয়িং – বাতি হাতে মারি-তেরেস। বুল ফাইটিংয়ের নির্দয় রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও মারি-তেরেস সেখানে সাহস ও সৌন্দর্যের প্রতীক। এই ড্রয়িংয়ের কথা উল্লেখ করে পিয়ের দেই লিখেছেন, পিকাসোর এই প্রিয় রমণী যেন চতুর্দিকের সকল ক্লেদ, সকল অন্ধকার দূর করে দিচ্ছে। বস্তুত মারি-তেরেসকে নিয়ে পিকাসো যে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতেন, অবচেতনে যে অপরাধবোধে ক্ষতদষ্ট হতেন, এই মিনোতুর ছিল তারই প্রচ্ছন্ন প্রকাশ। নগ্নিকার দেহের প্রতি তাঁর ক্ষুধা সীমাহীন, কিন্তু সে নারীর শরীর – তার দেহ – আগলাবার দায়িত্বও ছিল তাঁর।
গ্যাগসিয়ান গ্যালারির প্রদর্শনীর আরেকটি ছবি ১৯৩৯ সালে আঁকা ‘লেডি রেস্টিং অন এ কুশন’ – সেখানে যে মারি-তেরেসকে দেখি, তিনি ততদিনে পিকাসোর চোখে আকর্ষণহীনা হয়ে পড়েছেন। এক সন্তানের জননী, তাঁর শরীরও কিঞ্চিৎ ভারী হয়ে এসেছে, যৌবনের সেই মাদকতা যেন আর নেই। কিন্তু তারপরেও এক ধরনের পেলব নিজস্বতা ছবিটিকে ঘিরে। ঘন নীল চোখ জোড়ায় ক্লান্তি ও বিষণœতা। দূরে, অনেক দূরে তার দৃষ্টি বিস্তৃত, সে দৃষ্টি থেকে ক্রমশ অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছেন পিকাসো।
১৯৭৩ সালে মারা যান পিকাসো। এর চার বছর পর, ১৯৭৭ সালে, ৬৮ বছর বয়সে, নিজ বাসভবনে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেন মারি-তেরেস।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১, নিউইয়র্ক

Leave a Reply