সমকালীন শিল্পকলায় হাতেগোনা যে কজন শিল্পী তাঁদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বকীয়তায় বিশিষ্টতা অর্জন করে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের সুনামকে দশ দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন মুর্তজা বশীর তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শিল্প-সমালোচকরা তাঁর কাজকে, তাঁর শিল্পের ভুবনকে অন্য দশজনের চেয়ে ভিন্নমাত্রার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এই শিল্পী বিরাশি বছর বয়সে এসেও অনেক বেশি সৃষ্টিশীল। মুর্তজা বশীরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি কখনো কোনো একটি বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে যাননি। তাঁর শিল্প নির্মাণে তিনি নিরন্তর ভাঙাগড়ার খেলা খেলেছেন, যা সমকালীন শিল্পকলার কেউ করেননি। একই ছাপ তিনি তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেছেন। সম্প্রতি শিল্প ও শিল্পীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর জীবনের নানা কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহবুব রেজা
শিল্প ও শিল্পী : এক জীবনে তো কত কিছুই চাওয়ার ছিল – অনেককে এ-রকম আক্ষেপ করতে শোনা যায়। তো আপনার জীবনেও কি সে-রকম চাওয়ার কিছু ছিল?
মুর্তজা বশীর : আমার আর্থিক সচ্ছলতার দিকে কোনোদিনই লোভ ছিল না। আমি একজন সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রভাবে জীবনযাপন করতে চেয়েছি, যেখানে অর্থের জৌলুস থাকবে না। তাই অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কেননা আমি সরস্বতীকেই চেয়েছিলাম, লক্ষ্মীর দ্বারস্থ হইনি। ফলে বয়সও আমাকে অর্থচিন্তা বা সংসার চালানোর দুশ্চিন্তায় জড়িয়ে রেখেছে। কেননা আমি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নই, যেখান থেকে কিছু অর্থের জোগান আসে। আমি কমার্শিয়াল কাজ অর্থাৎ বইয়ের প্রচ্ছদ কিংবা অলংকরণও করি না; যদিও অনেক বিত্তবান লোক মনে করেন, আমি খ্যাতিমান, তাই আমাকে দিয়ে তাঁদের পরিবারের প্রতিকৃতি অাঁকতে বলেন। কিন্তু আমি সেটাও করি না।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর যে পেনশন পাওয়ার কথা তা আমার এই মণিপুরীপাড়ার ফ্ল্যাট কেনার জন্য পুরোটাই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। টুকটাক কিছু ছবি বিক্রি ছাড়া আর কোথাও অর্থের পথ নেই। তাই এক ধরনের অনিশ্চয়তা আমাকে সবসময়ই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।
আমি জীবনে অনেক কিছু করতে চেয়েছি। যেমন গল্প, কবিতা ও উপন্যাস লিখতে চেয়েছি। চেয়েছি গবেষণা করতে, অর্থাৎ ভারতবর্ষের শিল্পকলার সামাজিক ইতিহাসে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ১২০০ অব্দ পর্যন্ত লিখতে চেয়েছি। এসব লেখার জন্য আমি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ, জাতক ও কাহিনি এবং পুরাণ ছাড়াও প্রচুর বই পড়েছি এবং নোটও নিয়েছি। The Position of Women in Hindu Civilization গ্রন্থের রচয়িতা পন্ডিত এ এস অলটেকারের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে ১৯৯৮ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিতব্য গ্রন্থের জন্য Anthropological Survey of India আমার কাছে লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং প্রবন্ধের টাইটেল পাঠাতে বলে। আমি যথাক্রমে ‘Sensuality in the Buddhist Monastery’ ও ‘Through Artisan Vision : Upper Strata Society in Bengal’ তাদের পাঠাই। কিন্তু মানসিক তৃপ্তি থেকে অন্নচিন্তা প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে, আমার আর লেখা হয়ে ওঠেনি। তা ছাড়া ক. Life of the Europeans in the Teracotta Art of Bengal, খ. Artists From Ancient and Medieval Bengal, গ. Erotic Art of Bengal ছাড়াও ঘ. বৈদিক সংহিতায় রূপক ও প্রতীক, ঙ. পবিত্র কোরআনে রূপক ও প্রতীক, চ. কোরআনে জান্নাত, জাহান্নাম ও কিয়ামত প্রসঙ্গ – এগুলো নিয়ে লেখার পরিকল্পনা ছিল। উপরোক্ত বিষয়গুলো লেখার জন্য বিবিধ গ্রন্থ ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ আমাকে দীর্ঘসময় ধরে পড়তে হয়েছে। ফলে ছবি অাঁকার ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে পারিনি। তাই আমার একমাত্র আয়ের পথ অনিশ্চয়তার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তখন আমার কাছে প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে পেটে ভাত, স্ত্রী-কন্যা-পুত্রের মুখে হাসি। তাই ১৯৯৮-তে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর আবার বাধ্য হয়ে ছবি অাঁকার জগতে ফিরে আসি। আমি বাংলার মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার জন্য ১৯৯৩ সালে মাঠপর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে আটটি জেলার ১২৫টি গ্রাম এবং ১৯৯৬ সালে ৯টি জেলার ১৫০টি গ্রাম পর্যবেক্ষণ করেছি। কিন্তু পরে সেগুলো নিয়েও আমি লিখিনি। আমাকে অনেকেই বলেন এসব লিখতে। কিন্তু আমি তো পন্ডিত হওয়ার জন্য এসব পর্যবেক্ষণ করিনি। আমি করেছি নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য। যেভাবে পাল যুগের চিত্রকলার ওপর আমি বিলেতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। পাল যুগের চিত্রকলার ওপর সরসী কুমার সরস্বতীর যে গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন, আমি তার থেকেও বেশি চিত্র দেখেছি। কেননা যে-সময় তিনি এ-গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তখন সেই চিত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়নি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে এজন্য যে, আমি একজন তৃষ্ণাতুর পথিক, যে জলের অন্বেষায় বিরান প্রান্তরে ছোটাছুটি করে অবশেষে জলের কলকল ধ্বনি শুনতে পেয়েছি কিন্তু দেখিনি। কজনই বা এই শব্দ শুনতে পায়? এটাই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। এজন্য আমার জীবনে কোনো আক্ষেপ নেই। আমি মৃত্যুর সময় ভাবব, বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে আমি অবগাহন করেছি এবং ক্রমে ক্রমে পূর্ণ মানব হয়ে উঠছি।
শিল্প ও শিল্পী : বাবা ভাষাবিদ ও পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিল? তাকে কি ভয়-টয় পেতেন?
মুর্তজা বশীর : তিনি রাশভারী মানুষ ছিলেন। আমার জ্ঞান হওয়ার পর যা দেখেছি তা ছিল কিছুটা দূরত্বের। একমাত্র সকালে ও সন্ধ্যায় নামাজ পড়া ছাড়া তাঁর সঙ্গে দেখা হতো না। তিনি সে নামাজের ইমামতি করতেন এবং সে নামাজে সন্তানদের উপস্থিত থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক। আমার মাকে কেন্দ্র করেই ছিল আমাদের জীবন। তবে ছেলেবেলায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসের প্রথম দিন বেতন পেয়ে তিনি টেবিলে সমস্ত টাকা বিছিয়ে দিতেন এবং সন্তানদের বলতেন, যার যা খুশি তুলে নিতে। আমার মা তখন সেখানে থাকতেন না। মা থাকতেন ঘরের বাইরে দরজার আড়ালে। আমরা ভাইরা যখন একেকজন বেরিয়েছি মা তখন হাত থেকে সেই টাকা তুলে নিতেন এবং তা তাঁর কাছে রেখে দিতেন। একেকটি ছেলের নামে ছোট কাঠের বাক্স, যেখানে সেই টাকা জমা রাখতেন। সেই টাকাগুলো দিয়ে মা পরবর্তীকালে চবিবশ পরগনায় আমাদের দেশের বাড়ি পেয়ারায় একটি ফলের বাগান কিনেছিলেন, যেখানে নানারকম ফলের গাছ ছিল। গরমের বন্ধে কিংবা অন্য কোনো সময় মার সঙ্গে দেশের বাড়িতে যেতাম, সেই বাগান থেকে আমরা ইচ্ছামতো ফল পাড়তাম, নষ্ট করতাম – এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হতো না। কেননা যৌথ পরিবারে অনেক সময় হতো কাঁচা আমটা পেড়েছি, সেজন্য বকুনি খেতে হয়েছে অথবা ডাব খেতে চেয়েছি, সেটা পাইনি। মার আভিজাত্যে এটা লাগত – তিনি ব্যথাতুর হতেন কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না। আমি মাস তিনেকের জন্য বগুড়ায় ১৯৪৪ সালে পিতার সান্নিধ্যে ছিলাম। একই বিছানায় ঘুমাতাম – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর বগুড়ায় তিনি আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। আমাকে তিনি সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বগুড়ার একটি নামকরা হোটেলে আমাকে নিয়ে গিয়ে তার ক্যাশিয়ারকে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন – যখন যা খেতে চায় দেবেন, মাস শেষে আমি টাকা দিয়ে দেব।
ঘোড়ার মুখের রাস ছেড়ে দিলে সে যেমন দুরন্ত হয়ে ওঠে আমিও বগুড়ায় ঠিক তেমনি হয়ে গিয়েছিলাম। বন্ধু-বান্ধব জুটে গেল। সিনেমা দেখা, সন্ধ্যায় আড্ডা মারা প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল।
আমি তখন বগুড়া জিলা স্কুলে ক্লাস সেভেনে, তিনি আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। আমি আবার ঢাকার খাঁচায় বন্দি হলাম। এই ধরাবাঁধা জীবন আমার কখনো ভালো লাগত না। তাই আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন (১৯৪৭ সালে) বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তখন সবেমাত্র দেশভাগ হয়েছে। লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির জন্য মন কেমন ছটফট করায় আমি আবার ফিরে আসি। আমি যখন ঘরে ফিরে এলাম, পিতা রাগান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো বকাঝকা করেননি। যখন শুনলেন লক্ষ্ণৌ পর্যন্ত গিয়েছিলাম, তখন তিনি আক্ষেপ করলেন যে আমি কেন আগ্রায় গিয়ে তাজমহল দেখে এলাম না।
বাবার কথা শুনে তখন আমার মনে হয়েছিল, যে টাকাগুলো আমি অপচয় করেছি, তাজমহল দেখলে সেটা যথার্থ হতো।
আমার পিতা আমাকে ছাপান্ন সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে পড়তে পাঠিয়েছিলেন দুই বছরের জন্য। কিন্তু ইতালি যাওয়ার কথাটি আমি আমার পিতাকে সরাসরি বলার সাহস পাইনি, তাই মাকে বলেছিলাম। বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা জানালে তিনি আমাকে ডাকলেন এবং জানতে চাইলেন। আমি তখন অস্বীকার করি। ছেলেবেলায় পিতার সঙ্গে আমার স্মৃতি বলতে যা বোঝায়, তা হলো একজন মানুষ যে সবসময় শুধু পড়াশোনা করছে। তবে ঈদের দিন একসঙ্গে নামাজ পড়তে যেতাম। তিনি নিজ হাতে আমাদের আতর লাগিয়ে দিতেন।
শিল্প ও শিল্পী : ছোটবেলায় আপনি বেশ দুর্বিনীত ছিলেন। আপনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছেলে, এ-ব্যাপারেও ছিল আপনার মধ্যে এক ধরনের অহংকার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় এ-ব্যাপারটা আপনার বাবা ধরতে পারলেন। তিনি তখন আপনাকে বললেন, ইউ আর মাই সান। ডোন্ট বি মিডিওকার, আইদার নটোরিয়াস অর ফেমাস – আপনি আপনার বাবার এই কথাগুলোকে আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলেছেন। কেন?
মুর্তজা বশীর : তখনকার দিনে মানে বিভাগোত্তর মফস্বল শহরে তিন ধরনের লোক অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন – ১. ডিএম (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট), ২. সিভিল সার্জন ও ৩. কলেজের অধ্যক্ষ। আমার পিতা ১৯৪৩ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর বগুড়ায় আযিযুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। বগুড়া তখন ছোট একটি ছিমছাম শহর। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাদের বেশি। ফলে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে তারা ছিল অনেক উন্নত। বগুড়ায় যখন যাই আমি ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে অষ্টম শ্রেণি পড়া শেষ করেছি। ছেচল্লিশ সালে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম আমি। পিতা খ্যাতিমান, ফলে স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে আমার একটি স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি হয়েছিল।
পিতার পরিচয়ে ছিল আত্মগরিমা, ফলে সে ছাত্রই হোক কিংবা শিক্ষকই হোক আমি কাউকে তোয়াক্কা করতাম না। ফলে নিজের ইচ্ছামতো চলাফেরা করতাম, একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব ছিল। যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন বন্ধুদের সঙ্গে একটা বাজি হয়েছিল যে মুকুল ফৌজের মেয়েরা যে লাইন করে যাচ্ছে তার ভেতর দিয়ে আমি সাইকেল চালিয়ে চলে যেতে পারব কি না। তখন আমার একটা র্যালে সাইকেল ছিল। আমি সেই মেয়েদের লাইনের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে দিয়েছিলাম। একটি মেয়ে সাইকেলের আঘাতে পড়ে গেল। পরে সে উঠে আমাকে ভীষণভাবে গালাগাল করে বলল, এটা কি তোমার বাবার রাস্তা? উত্তরে আমি বললাম, না, তবে প্রয়োজন হলে তা করে নেব। স্কুলের কাছেই ছিল একজন সাব-রেজিস্ট্রারের বাড়ি। তিনি ঘটনাটি দেখেছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, খোকা, তুমি আজকে যা করলে অন্য কেউ করলে তাকে মারধর করা হতো। কিন্তু তুমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবের পুত্র বলে কেউ কিছু বলল না। তবে মনে রেখো, তোমার পিতা চিরদিন বেঁচে থাকবেন না। তখন তোমাকে কেউ রেহাই দেবে না।
গৌতম বুদ্ধ মহানিষ্ক্রমণে যাওয়ার আগে যে তিনটি ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করেছিল ঠিক তেমনি এই ঘটনাটা আমার ভেতর এক ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখনই আমি উপলব্ধি করলাম – নিজেকে খোঁজার অন্বেষণ করলাম। একটি বড় গাছের নিচে যেমন ছোট গাছ জন্মাতে পারে না, তেমনি আমার মনে হলো, সিন্দাবাদের ঘাড়ে চেপে থাকা সেই বৃদ্ধকে (পিতা) আমি যদি আমার ওপর থেকে না নামিয়ে ফেলতে পারি আমার মুক্তি নেই।
একই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে আমার এই দুরন্তপনার নালিশ গেল। আমার নানারকম দুরন্তপনার কথা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু নরেন্দ্র মোহন চৌধুরীর কানে যায়। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। প্রধান শিক্ষকের ঘরে চেয়ারে বসেছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক ও আমাদের অঙ্কের মাস্টার বাবু নরেন্দ্র মোহন ঢোল। অঙ্কের মাস্টার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি প্রধান শিক্ষকের সামনের টেবিলে দুহাতে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। হেডমাস্টার রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন এবং বললেন, ঠিক হয়ে দাঁড়াও।
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমার অন্যায়টা কী। তখন কিন্তু বুঝতে পারিনি হেডমাস্টারের টেবিলে দুহাত রেখে দাঁড়ানোটা বেয়াদবি। নরেন্দ্র মোহন ঢোল আমাকে বললেন, বশীর, টেবিল থেকে হাত দুটো নামাও। তখনই আমি বুঝতে পারলাম আমার অন্যায়টা কী!
রাগত স্বরে হেডমাস্টার বললেন, আমি তোমার সম্পর্কে তোমার পিতার কাছে নালিশ করব। আমি তখন আমার অহংবোধ থেকে উত্তর দিলাম, আপনি হেডমাস্টার আমার পিতা অধ্যক্ষ, তাঁর সামনে যাবার যোগ্যতা আপনার নেই।
তিনি বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, আমার বাবার কানে এসব নালিশ আসত। তিনি আমাকে বললেন, তোমার ক্লাসের ইংরেজি গ্রামার বইয়ে তুমি পড়েছো না, প্রিন্সিপাল (চৎরহপরঢ়ধষ)-প্রিনসিপল (চৎরহপরঢ়ষব), এমিনেন্ট (ঊসরহবহঃ)-ইমিনেন্ট (রসসরহবহঃ), নটোরিয়াস (Notorious) অ্যান্ড ফেমাস (Famous)। তারপর তিনি ইংরেজিতে বললেন, ইউ আর মাই সান, আইদার নটোরিয়াস অর ফেমাস, ডোন্ট বি মিডিওকার।
তখনই আমার খুব ইচ্ছে হলো, আমি খ্যাতিমান হব। বাবার কাছে রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি চিঠি ছিল আর ছিল দীনেশ চন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কায়কোবাদ প্রমুখের চিঠি। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এঁরা আমার বাবাকে চেনেন! আমি আমার বাবার মতো হব। সেই বাসনা থেকেই আমি খ্যাতিমান ব্যক্তিদের কাছে চিঠি লিখতাম, তাঁদের অটোগ্রাফ চাইতাম। তাঁরা আমার চিঠির প্রত্যুত্তরে অটোগ্রাফ পাঠাতেন। যেমন তখনকার বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহ, প্রথম বাঙালি ভূপর্যটক যিনি সাইকেলে ভ্রমণ করেছেন, সেই রামনাথ বিশ্বাস, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতা অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং এবং স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যাঁদের কবিতা পড়েছি সেই কবি শেখর কালিদাস রায় ও কুমুদরঞ্জন মল্লিক। এমনকি বাবার টেবিলে রাখা রেমিংটন প্যাডের কাগজে পরীক্ষার খাতা কাটার লাল-নীল পেনসিল দিয়ে রং করতাম। জওহরলাল নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর একটি প্রতিকৃতি এঁকে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলাম এবং সেই সঙ্গে তাঁর অটোগ্রাফসহ একটি ছবি পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তিনি নাম সই করা ছবিতে সেপ্টেম্বর ’৪৮ লিখে আমাকে পাঠিয়েছিলেনও।
শিল্প ও শিল্পী : জীবনে শিল্পী হবেন – এ রকম ধ্যান-ধারণা বা বিশ্বাস কখন থেকে আপনার ভেতর প্রোথিত হতে শুরু করল? মানে বলতে চাচ্ছি এর পেছনে কি কোনো ঘটনা, কোনো স্মৃতি –
মুর্তজা বশীর : ছেলেবেলা থেকেই আমি আমার বাবার লাইব্রেরিতে ঘুরঘুর করতাম। আলমারির মোটা মোটা বই নামাতাম। সেগুলো ছিল ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতি, বিচিত্রা, মডার্ন রিভিউ ও এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। ছবিগুলো দেখতে ভালো লাগত আমার। কিন্তু জীবনে কখনো শিল্পী হব, এটা আমি কখনোই কল্পনা করিনি।
ক্লাস সেভেন-এইটে বইয়ের পাতায় যেসব অলংকরণ থাকত সেগুলো পিতার নীল-সবুজ কিংবা পরীক্ষার খাতা কাটার জন্য লাল-নীল পেনসিল দিয়ে রং করতাম। আমার ভালো লাগত। ছবি অাঁকার প্রতি আকর্ষণ হলো বগুড়াতে যখন পড়ি। তখন কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হই, সেই সুবাদে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিনের নাম শুনতাম এবং আমার ইচ্ছা হতো নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বোস কিংবা সিনেমাজগতের আমার প্রিয় অভিনেতা অশোক কুমার ও খলনায়ক ইয়াকুবের প্রতিকৃতি, এমনকি আমি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও পোর্ট্রেট এঁকেছিলাম। আমি রাস্তায় সাইনবোর্ড পেইন্টাররা যেভাবে ছোট ছোট গ্রাফ করে বড় করে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতাম এবং বাড়িতে অনুশীলন করতাম।
আমি মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিনের ২৪ বাই ৩৬ সাইজের প্রতিকৃতি এঁকেছিলাম এবং তা বগুড়ার কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে বাঁধিয়ে টাঙানো হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছুদিন পর ১ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিক ভবানী সেন (যিনি মার্কসবাদী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং রবীন্দ্রগুপ্ত ছদ্মনামে লিখতেন) বগুড়ায় এলেন। তিনি আমার অাঁকা ছবি দেখে আমাকে দেখতে চাইলেন। আমার সে-সময় অটোগ্রাফ জমাবার শখ ছিল। ভবানী সেন আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখলেন, ‘আর্টিস্টের কাজ হলো শোষিত জনগণের ভাব ও দুঃখ-দুর্দশাকে চিত্রের ভেতর দিয়ে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা, যাতে সমাজে সে আর্ট নবজীবন সৃষ্টি করতে পারে। তারিখ (১.৯.৪৭)।’
১৯৪৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার পর আমরা সবাই ঢাকায় ফিরে আসি এবং কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আমি আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই।
একটা বিষয় আমার মনে এখনো জাগ্রত সেটা হলো, বইয়ে পড়তাম, মানুষ মরণশীল। কিন্তু একটি ঘটনায় আমার আত্মা চিৎকার করে বলে উঠল, আমি মৃত্যু চাই না। মানুষ অবিনশ্বর – মানুষ মরণশীল নয়।
ঘটনাটি এই, আমি যখন বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউটে ক্লাস টেনে পড়ি, স্কুলের উল্টো দিকেই ছিল আমার এক সহপাঠীর বাসা। একদিন সকাল ১০টার দিকে আমি তার সঙ্গে গালগল্প করতে গিয়েছিলাম; কিন্তু আমি তার বাসায় ঢুকেই দেখলাম খালি গায়ে ঘাড়ে গামছা নিয়ে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাকে আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছিস? সে বলল, আমি করতোয়ায় চান করতে যাচ্ছি। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। তুই এদিক-ওদিক ঘুরে কিছুক্ষণ পর আয়। আমি যখন পরে তার বাসায় গেলাম এবং দেখলাম বাড়ির বাইরের উঠানে অনেক মানুষের ভিড়। সেখানে গিয়ে দেখলাম, সে মাটিতে শুয়ে। জানলাম, সে পানিতে ডুবে মারা গেছে।
আমার তখন ভীষণ ভয় করেছিল। পৃথিবী এত সুন্দর! অথচ এই পৃথিবী থেকে আমাকেও চলে যেতে হবে, তখনই আমার প্রাণে ভীষণভাবে ইচ্ছা হলো আমি বেঁচে থাকব। আমি বেঁচে থাকতে চাই। মৃত্যুর পরও বাঁচতে চাই। সেভাবেই আমার শিল্পী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
শিল্প ও শিল্পী : আপনি যে বয়সে (৮২) এসেছেন তাতে করে অনায়াসেই আপনি বলতে পারেন, এক জীবনে অনেক কিছুই তো দেখলাম – তো কী কী দেখলেন?
মুর্তজা বশীর : ব্রিটিশ আমলে আমার দেশ পরাধীন ছিল কিন্তু রাস্তায় চলাফেরায় আমি কখনো আতঙ্কিত হইনি। তারপর দেশভাগ হলো। নতুন রাষ্ট্র হলো। তখনো সেই আতঙ্ক ছিল না। ১৯৭১ সালে দেশ অভ্যুদয়ের পর যে স্বপ্ন দেখেছিলাম আজকে তা ভূলুণ্ঠিত। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে, রাস্তায় বেরোলে মনে একটা ভয় ছিল – কখন কী জানি কী ঘটে যায়। সে-সময় আমরা সবাই একটি দমবন্ধ অবস্থায় দিন কাটিয়েছি। সকালের সূর্যোদয় দেখে সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখব কি না জানতাম না। এই প্রথম সে-সময় প্রকৃতিতে দেখলাম আকাশে সুন্দর মেঘের আনাগোনা, গাছের পাতায় সূর্যের লুকোচুরি। জীবন যে এত সুন্দর এর আগে কখনো উপলব্ধি করিনি। এখন ওই সময় রাস্তায় বেরোতে ভয় লাগে। সবসময় সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত – এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, অচিরেই মানুষ আবার সুন্দরভাবে চলাফেরা করবে। হাসিমুখে হাঁটবে।
শিল্প ও শিল্পী : আপনি তো পঞ্চাশের দশকে পড়াশোনার জন্য বেশ কিছু বছর ইতালিতে ছিলেন। তখনকার দিনের ইতালির জীবনব্যবস্থা, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিল্প-সাহিত্য কি আপনাকে কিংবা আপনার কাজে প্রভাব ফেলেছিল?
মুর্তজা বশীর : আমি পিতার অর্থায়নে ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইতালির ফ্লোরেন্সে গিয়েছিলাম। পিতা অবশ্য চেয়েছিলেন আমি প্যারিসে যাই। কেননা তিনি প্যারিসে পড়াশোনা করেছেন। সেখানে বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম তিনি দেখেছেন। শিল্পীদের জীবনযাত্রা দেখেছেন। কিন্তু ফ্লোরেন্সে যাবার পেছনে আমার অন্য কারণ ছিল। ইতালির ব্যাপারে আমি খুব অনড় ছিলাম। আমার বন্ধু আমিনুল ইসলাম ১৯৫৩ সালের মাঝামাঝি থেকে ইতালি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ফ্লোরেন্সের Academia de belle arti-তে পড়াশোনা করছিল এবং আমাকে সেই প্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে ভর্তির কাগজপত্রও পাঠিয়েছিল। তাই বন্ধুর সান্নিধ্যে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্যারিসের বদলে ফ্লোরেন্সে যাই। সেখানকার জীবনব্যবস্থা যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, তারা দরিদ্র তবে আত্মবিশ্বাসী। ইতালির সাহিত্য আমার ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। কেননা ইতালির ভাষায় লেখা সে সাহিত্য পড়ার মতো বিদ্যা আমার ছিল না। তবে পরবর্তীকালে ইংরেজি অনূদিত আলবের্তো মোরাভিয়ার সমস্ত বই আমি পড়েছি। আমার সংগ্রহে আছে কিন্তু তাঁর লেখা দ্বারা আমি কখনো প্রভাবিত হইনি। তবে যেহেতু ইতালিতে ছিলাম তার ফলে তাঁর লেখায় এক ধরনের নস্টালজিয়া ছিল। তবে শিল্পকলায় আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে আধুনিক শিল্পী Gentellini, Morrandi, Campigli, তবে মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েল, টিশিয়ান প্রমুখ রেনেসাঁ-শিল্পীর কাজ আমাকে তেমনভাবে অনুপ্রাণিত করেনি। এককথায় বলা চলে, তাঁদের কাজ আমি দেখার জন্য দেখেছি, কিন্তু শেখার জন্য দেখিনি। তবে রেনেসাঁ-পূর্ব যেসব শিল্পী যেমন জোত্তো, সিমাবু, ফ্রা এঞ্জেলিকো, দুচ্চো আমাকে সবসময় আকর্ষণ করেছেন। আমি তাঁদের কাজ ঘুরেফিরে দেখি, যেভাবে আমি বাইজাইন্টাইন শিল্পীদের কাজ দেখি ও একালের পিকাসোর কাজ দেখি। এঁদের কাজের সীমিত রং, ফর্মের সরলীকরণ আমার কাজে প্রভাব রেখেছে।
শিল্প ও শিল্পী : অনেকের লেখায় পাওয়া যায়, ইতালির মেয়েরা আমাদের এই অঞ্চলের মেয়েদের মতোই সামাজিক জীবনে বিশ্বাসী। সর্বোপরি আবেগী। জনশ্রুতি আছে, ইতালিয়ান মেয়েরা খুব দ্রুত প্রেমেও পড়ে যায় – তো আপনি কি ইতালিয়ান কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন?
মুর্তজা বশীর : ইতালিয়ান মেয়েরা খুব দ্রুত প্রেমে পড়ে কি না আমার জানা নেই, তবে ইতালিয়ান একটি মেয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের আদান-প্রদান ঘটেছিল। সে ছিল একাডেমির সবচেয়ে সুন্দরী এবং ‘মিস্ একাডেমি’ও হয়েছিল। আমরা দুজন বিয়ে করব ভেবেছিলাম, সেজন্য মেয়েটি বাংলাও শিখেছিল। আমরা যখন বাংলায় কথা বলতাম, অন্যরা অবাক হয়ে আমাদের দেখত। কেননা সে ছিল স্বর্ণকেশী, নীল চোখ, গায়ের রং ফর্সা। আমার গায়ের রং সে-রকম ফর্সা নয় – চুল কালো। তাই ফ্লোরেন্সের অনেকেই আমাদের দেখে রসিকতা করে বলত, কাফে লাততে মানে কফি আর দুধ। আরো পরিষ্কার করে বললে কাফে মানে আমি, আমি মানে কালো, আর লাততে (ইতালিয়ান ভাষায় লাততে মানে দুধ) মানে ও। তাকে কেউ তার দেশ কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে সময় নষ্ট না করে ঝটপট উত্তর দিত, বাংলাদেশ। বাঙালি সম্পর্কে তখন ইতালিয়ানদের তেমন কোনো জ্ঞান ছিল না। শুধু জানত বাংলার বাঘের কথা। ইতালিয়ান অনেকে আমাকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করত এ বাঘের কথা। আমি তখন রসিকতা করে ওদের জবাব দিতাম, তোমরা যেমন ঘরে বিড়াল পালো, আমরাও তেমনি ঘরে বাঘ পালি। তারা হয়তো তাকে বাঙালি মনে করত এজন্য যে, ইতালির উত্তরের মানুষরা ছিল বেশিরভাগ স্বর্ণকেশী আর দক্ষিণে ছিল কালো বর্ণের চুল। এই মেয়েটির অনেক ছবি এখনো আমার কাছে সযত্নে রয়েছে। এমনকি আমি যখন ’৬২ সালে বিয়ে করি, বাসররাতে আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে তার ছবি দেখিয়ে বলেছিলাম – এ আমার অতীত, তুমি বর্তমান। আমার স্ত্রী সে রাতে কিছু বলেনি। তবে বহু বছর পর বলেছিল, বাসররাতে কেউ ব্যক্তিগত এসব ছবি দেখায়!
শিল্প ও শিল্পী : এ কে এম বশীরউল্লাহ থেকে আপনি কখন, কীভাবে হয়ে গেলেন মুর্তজা বশীর? ঘটনাটি কী বলবেন?
মুর্তজা বশীর : ঊনপঞ্চাশ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষে আবার ঢাকায় ফিরে আসি এবং আমরা যখন মাহুতটুলীতে ভাড়া বাসায় উঠি, আমার বাবা তখন আযিযুল হক কলেজ ছেড়ে ১৯৪৮ সালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপার নিউমারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা তখন ঢাকায় এসে ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। তখন আমাদের ৭৯ বেগমবাজারের বাসায় এক ভাড়াটে থাকে। ভাড়াটে চলে যাবার পর আমরা মাহুতটুলীর বাসা ছেড়ে বেগমবাজারের বাসায় উঠি। আমার বাবার লাইব্রেরি ঘরটা ছিল রাস্তার ওপরেই। যদিও ভেতরে আরেকটি বড় ঘরে তাঁর বইপত্র, পড়ার টেবিল ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি এই ঘরে বসতেন। এখানে পড়াশোনা করতেন মাঝেমধ্যে এবং লোকজন এলে এখানেই সাক্ষাৎ করতেন। কোনো কারণে আমি তখন বাবার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় পিয়ন এলো। বেশ কিছু চিঠি দেখার পর তিনি একটি চিঠি দেখে বললেন, এ নামে এখানে কেউ থাকে না।
আমি পিয়নের হাত থেকে চিঠিটা নিলাম। দেখলাম চিঠিটা আমার। বগুড়া থেকে লেখা কোনো এক সহপাঠীর। আমি বাবাকে বললাম, চিঠিটা আমার। বাবা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললেন, মুর্তজা বশীর তুমি? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি আপনার নামে পরিচিত হতে চাই না। আমার পুরো নাম যেভাবে আমার সমস্ত শিক্ষা সনদপত্র-সার্টিফিকেট রয়েছে, তাতে লেখা আবুল খায়ের মুর্তজা বশীরুল্লাহ। ১৯৫২ সাল অবধি আমি মুর্তজা বানানে ম-এর নিচে দীর্ঘ ঊ-কার দিতাম। আমার পিতা আমার হাত থেকে চিঠিটা নিলেন এবং তিনি বললেন মূর্খের দীর্ঘ ঊ-কার হয়। তুমি তো মূর্খ নও। তুমি লিখবে ম’তে হ্রস্য উ-কার দিয়ে।
এভাবে আমি মুর্তজা বশীরে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম।
শিল্প ও শিল্পী : আপনার একটি শিল্পকর্ম ডেড লিজার্ড (Dead lizard) দেখে আপনার পিতা বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারপর অন্যের সামনে আপনার প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আধুনিক চিত্রের মতোই আমার ছেলে দুর্বোধ্য’ – আপনি তাঁর এই মূল্যায়নকে কীভাবে দেখবেন।
মুর্তজা বশীর : প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ আমাকে ১৯৫৯ সালের শেষে লাহোরে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে প্রদর্শনী করার জন্য। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৪৮ সালে লন্ডনে। আমি দুবছর লাহোরে ছিলাম। ১৯৬১-র শেষে ঢাকায় ফিরে আসি। তখন বাংলা একাডেমিতে সমকালীন শিল্পীদের একটি প্রদর্শনীতে Dead Lizard শিরোনামে একটি ছবি ছিল। ছবিটি আমি এঁকেছিলাম সমাজের অবক্ষয়ের রূপক হিসেবে। এ-প্রদর্শনী আমার পিতা দেখেছিলেন। এমনকি ইতালি থেকে ফিরে আসার পর ১৯৫৯ সালের মে মাসে আমি যখন করাচিতে একক প্রদর্শনী করি সে সময় করাচিতে (আমার পিতা তখন অবস্থান করছিলেন) তিনি সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। একটি আমেরিকান সংস্থা এ-প্রদর্শনীর আয়োজক, তাই সেখানে কোমল পানীয়র সঙ্গে ককটেল পরিবেশন করা হচ্ছিল। আমি কিছুটা শঙ্কিত হয়েছিলাম, আমার পিতা এই মদ পরিবেশন কীভাবে গ্রহণ করবেন, কিন্তু দেখলাম এ-ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ছিলেন। পত্রিকায় আমার ছবির প্রদর্শনীর খবরাখবর তিনি পড়তেন এবং আমাকে চিঠি লিখে তা জানাতেন। একবার ১৯৫৭ সালে আমেরিকায় ওয়াশিংটন ডিসিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন শিল্পীর যৌথ চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই সংবাদ পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমার নাম সেখানে ভুলবশত ‘মূর্তজা রশীদ’ ছাপা হয়েছিল। তিনি পত্রিকার সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি লিখে আমার শুদ্ধ নাম এবং আমার পূর্ণ নাম জানিয়েছিলেন, যা পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমিতে এই প্রদর্শনী উপলক্ষে একটি আলোচনা সভা হয় – ‘আধুনিক মানুষ ও আধুনিক চিত্রকলা’। বক্তা ছিলেন এ কে ব্রোহী। তিনি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, শহীদুল্লাহ্ সাহেব, আপনার পুত্র তো একজন আধুনিক শিল্পী। জবাবে আমার পিতা বলেছিলেন, আধুনিক চিত্রের মতোই আমার পুত্র আমার কাছে দুর্বোধ্য। সেই রাতে তিনি আমার ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করলেন, তুমি এমন কিম্ভূতকিমাকার ছবি আঁকো কেন? আমি প্যারিসে ছিলাম, আমি দেখেছি শিল্পকর্ম কত সুন্দর হয়!
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সোবর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন শেষে যখন দেশে ফিরবেন তখন প্যারিসে অবস্থিত ভারতীয় ছাত্রদের অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে ল্যুভর মিউজিয়ামের প্রখ্যাত শিল্পীদের চিত্রসংবলিত দুই খন্ড মোটা অ্যালবাম উপহার দেন। এই দুটি গ্রন্থ তিনি আজীবন তাঁর ছোট একটি মেহগনি কাঠের আলমারিতে মূল্যবান বইগুলোর সঙ্গে রেখেছিলেন এবং তাঁর সেই আলমারিটি সবসময় তালাবদ্ধ থাকত। যখন আমি ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তির জেদ করলাম তখন তিনি প্রথমে আপত্তি করলেন। তখন তিনি আপত্তি করে বলেছিলেন, আমি প্যারিসে ছিলাম। শিল্পীদের জীবন দুঃখকষ্টে ভরা। আমি চাই না তুমি আমার সন্তান সে-রকম অর্থকষ্টে, অনাহারে থাকো। তারপর আমার একগুঁয়েমির কাছে তিনি তাঁর তালাবদ্ধ আলমারি খুলে ল্যুভর মিউজিয়ামের সেই দুই খন্ড বই আমার হাতে দিতে দ্বিধাবোধ করলেন না। বইয়ে ছিল বেশ কিছু বিবস্ত্র নারীর চিত্র। সেই রাতে আমার পিতা ডেড লিজার্ড অর্থাৎ এই মৃত টিকটিকির ছবির সম্পর্কে বললেন, আমি জানি না এই ছবিতে কী আছে, তবে ছবিটা আমাকে খুব আলোড়িত করেছে। আমি জবাবে পিতাকে বললাম, আমি আপনি সবাই অশরীরী, প্রেতাত্মা। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হয়তো হবে।
শিল্প ও শিল্পী : আপনার আত্মজৈবনিক উপন্যাস আলট্রামেরিন কীভাবে লিখলেন, মানে অনুপ্রেরণা পেলেন কোত্থেকে?
মুর্তজা বশীর : ১৯৫৪ সালে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে চারুকলা নিয়ে পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করার পর রেজাল্ট বের হতে বেশ কয়েক মাস বাকি। তখন আমার বড় ভাই মুহম্মদ সফিউল্লাহ স্টেটসম্যান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বললেন, তুমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট কোর্সে (Art Appreciation) ভর্তি হও। তাঁর কথামতো পিতা আমাকে জুন মাসে কলকাতা পাঠান। সে সময় আমি আমার এক আত্মীয়র বাসায় উঠি। কিন্তু আমি তাঁকে একটি শর্ত দিয়েছিলাম যে, আমি আপনার এখানে থাকব কিন্তু খাব না। তাঁর বাসা ছিল পার্ক সার্কাসে সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিনিউতে। প্রথম কয়েকদিন আমি ট্রাম ডিপোর সামনে একটি সস্তা রেস্টুরেন্টে খেতাম কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাধারার বন্ধু ও বড় ভাই সোমনাথ হোর আমাকে করেয়া রোডের কমিউনিস্ট পার্টির কমিউনে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। সেখানে কমরেড মুজাফফর আহমেদ থাকতেন। আমার পরিচয় জেনে তিনি আমাকে তুমি করে বললেন। সোমনাথদা বিস্মিত হলেন। কেননা কাকাবাবু (মুজাফফর আহমেদ) ছেলে-বুড়ো সবাইকে আপনি করে সম্বোধন করতেন। আমার ব্যাপারে তাঁর এই পরিবর্তন দেখে সোমনাথ হোরের জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বললেন, ওর বাবা আমার বন্ধু।
সেখানে মাসখানেক দুবেলা করে খাওয়ার পর পথে আমার এক বন্ধু কামাল আহমেদের সঙ্গে দেখা। সে যখন শুনল আমি পার্টি কমিউনে খাওয়া-দাওয়া করি তখন বলল, এই বুড়োদের মধ্যে বসে তুই কী করবি। আমি একটি বাঙালি খ্রিষ্টান পরিবারকে চিনি, সেখানে তোর খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। তারপর একটু হেসে বলল, ওখানে দুটো যুবতী মেয়ে আছে। তুই আর্টিস্ট মানুষ – ইন্সপ্রেশনও পাবি।
সেই পরিবারের ওপর ভিত্তি করেই আমার আলট্রামেরিন উপন্যাস, যেখানে প্রতিটি ঘটনা ও সংলাপ, যা আমি প্রতিদিন রাতে ঘরে ফিরে টুকে রাখতাম। এই উপন্যাসে সেগুলো হুবহু আমি লিখেছি।
শিল্প ও শিল্পী : কবিতার বই এসরেণু, তোমাকেই শুধু, এসো ফিরে অনুসূয়া, আর গল্পের বই কাচের পাখির গান বেরিয়েছে আপনার। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়েছেন। এই বিরতির কারণ কী?
মুর্তজা বশীর : আমি বগুড়ায় ক্লাস টেনে পড়ার সময় ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম। স্কুলের ছাত্রদের নাটকের জন্য একটি নাটকও লিখেছিলাম। কিন্তু কবিতা কখনো লিখিনি। ১৯৫০ সালে যখন ঢাকা জেলে বাম রাজনীতির জন্য বিচারাধীন বন্দি ছিলাম তখন সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রভাবে কিছু কবিতা লিখেছিলাম। তারপর আর কবিতা লিখিনি।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘পারবে না বলে’ একটি কবিতা লিখেছিলাম, যা কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় ১৯৫২ সালেই ছাপা হয়। আমার বন্ধু শামসুর রাহমানকে আমি বললাম, আমার মাঝে মাঝে একটি ছোট ক্ষণিকের উত্তেজনা কিংবা স্মৃতি কবিতায় লিখতে ইচ্ছে করে। আমার কথা শুনে শামসুর রাহমান বললেন, ছবি অাঁকেন ছবিই অাঁকেন। কথাটি আমাকে আঘাত করেছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় যখন ঘরে ঘরে তল্লাশি চলছে, তখন আমার স্ত্রী, আট ও দেড় বছরের দুই কন্যাসহ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে প্যারিসে চলে যাই। সেখানে বসে ১৫-২০টি কবিতা লিখি। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে ঢাকায় ফিরে আসার পর শামসুর রাহমানের সঙ্গে হঠাৎ এক অনুষ্ঠানে দেখা। আমি তাঁকে আমার কবিতা লেখার কথা জানালাম। তিনি আমার কবিতাগুলো নিয়ে তাঁর পুরনো ঢাকার আশেক লেনের বাসায় যেতে বললেন। তিনি আমার কবিতা পড়ে কিছু কবিতায় টিক চিহ্ন দিলেন ও বললেন, এগুলো কপি করে তাঁকে দিতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তিনি বললেন, ঢাকায় গণসাহিত্য বলে একটি মাসিক পত্রিকা আছে সেখানে দেবেন। আমি অবাক হয়ে তাঁকে বললাম, তারা ছাপবে?
শামসুর রাহমান হেসে বললেন, আমি নিজ হাতে দিচ্ছি, তারা কেন ছাপবে না?
তারপর তাঁর আলমারি থেকে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার ক্লাস গ্রন্থটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, এই বইটি পড়ুন। আপনার কাজে লাগবে।
আমার প্রথম কবিতার বই এসরেণুতে ফ্রান্সে বসে লেখা কবিতা ছাড়াও রাজশাহীতে যখন ১৯৭৪ সালে শহীদ মিনারের পেছনের দেয়ালে ইট কেটে মোজাইক চিত্র রচনা করছি তখন রাজশাহীতে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলাম। আর বাকি কবিতাগুলো লিখেছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময়। আমার প্রথম কবিতার বই বের হয় ১৯৭৬ সালে ঢাকা থেকে এবং বইয়ের পেছনের মলাটে শামসুর রাহমান স্বনামে লিখেছিলেন। তবে ১৯৬৯ সালে আমার প্রথম গল্পের বই কাচের পাখির গান বের হয়, তখন প্রচ্ছদের পেছনে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন কিন্তু নাম দেননি।
তোমাকেই শুধু এবং এসো ফিরে অনুসূয়া – একই প্রেক্ষাপটে কবিতাগুলো রচনা বলা যেতে পারে, এ দুটি গ্রন্থই সম্পূরক। তোমাকেই শুধু কাব্যগ্রন্থটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর কোনো পৃষ্ঠা চিহ্ন নেই। আমার জানা মতে, ডায়েরির আকারে এর আগে এ-ধরনের কোনো কবিতার বই বের হয়নি। কবিতাগুলোর কোনো শিরোনামও ছিল না। ডায়েরিতে যেমন বাংলা, আরবি ও ইংরেজি সন-তারিখ থাকে তেমনি ওপরে সেভাবে মুদ্রিত হয়েছিল। বলা চলে, তোমাকেই শুধু আমার ব্যক্তিগত ডায়েরি, গদ্যে না লিখে পদ্যে লেখা এইটুকুই তফাৎ। বলা যায়, আলট্রামেরিনের মতোই আত্মজৈবিক।
১৯৮১ সালে আমি যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে অসুস্থ অবস্থায় ছিলাম তখন ১৫-২০টি কবিতা লিখি হাসপাতাল ও অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে। তারপরে বিভিন্ন সময় মাঝেমধ্যে কবিতা লিখেছি, সেগুলো ছাপাও হয়েছে। কলকাতার চতুরঙ্গে, ঢাকার সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও ইদানীংকালের কালি ও কলমে – এগুলো অগ্রন্থিত। আমার ইচ্ছে সাদায় এলিজি শিরোনামে একটি গ্রন্থ করার। যেখানে হাসপাতালের মর্গে অাঁকা শল্য চিকিৎসকের উৎকীর্ণ শবদেহের ড্রইং থাকবে। তবে ২০১০-এ আমার প্রকাশিত গ্রন্থ ও অপ্রকাশিত কবিতাগুলো নিয়ে স্ব-অনূদিত বাংলা থেকে ইংরেজিতে একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে, যার নাম Fresh blood, Faint line (টাটকা রক্তের ক্ষীণ রেখা) এই ইংরেজি তর্জমা সম্পাদনা করেছেন কায়সুল হক ও হাসনাত আবদুল হাই, যাঁদের কাছে আমি ঋণী।
এছাড়া আমার আরো দুটি উল্লেখযোগ্য বই আছে। একটি হলো ইতিহাসভিত্তিক মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ এবং নির্বাচিত ছোটগল্প ও কবিতা, স্মৃতিকথা, নদী ও নারীর চিত্রনাট্য, কিছু সাক্ষাৎকার ও প্রাচীন মুদ্রাবিষয়ক কিছু প্রবন্ধ নিয়ে গ্রন্থ মুর্তজা বশীর মূর্ত ও বিমূর্ত। এই নামকরণের পেছনের কারণ হলো, আমি চিত্রকর এটাই সবাই জানে, এটাই মূর্ত কিন্তু আরো অনেক কিছু করেছি যা অনেকেই জানে না – সেটাই বিমূর্ত। এছাড়া মুর্তজা বশীরের মুর্ত শব্দটির সঙ্গে একটি অনুপ্রাস রাখারও চেষ্টা করেছি।