logo

ইরানি সিনেমার পর্দাকাহিনি

ইমরান ফিরদাউস
সিনেমার শুরু : ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের হাতে এবং সিনেমার সমাপ্তি আববাস কিয়োরাসত্মামির করকমলে – জঁ লুক গদার

১৯৭৯ সালে ইরান বিপস্নব এবং পারস্য অঞ্চলে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের উদ্বোধনের পর অনেকেই ভেবেছিলেন নতুন নিয়মশৃঙ্খলার নিগড়ের জাঁতাকলে মারা পড়তে পারে ইরানের সিনেমা। কিন্তু না, ইরানের সিনেমা সময় ও রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইয়ে ঠিক টিকে গেছে এবং সেন্সরশিপের সংস্কৃতির সমামত্মরালে নিজের অসিত্মত্বই শুধু জাহির করেনি বরং ইরানি সমাজ ও সংস্কৃতিতে যোগ করেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আজকের দুনিয়ায় ইরানি সিনেমা পরিচিতি পেয়েছে অন্যতম সৃজনশীল এবং চিমত্মা-জাগানিয়া ধারা হিসেবে। ইরানের সিনেমাকরিয়েরাও দাপটের সঙ্গে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন, নিচ্ছেন আমত্মর্জাতিক সিনেমা পার্বণগুলোতে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরানের জমিনে প্রগতিশীল সিনেমাকরিয়েদের উত্থান বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈকি! জাতিসংঘে যেখানে ইরান পরিচিত অবদমনমূলক রাষ্ট্ররূপে, সেখানে সিনেমার এমন পুনর্জাগরণমূলক বাসত্মবতা আপাতদৃষ্টিতে যেন এক কুহেলিপনা।

তবে কীরূপে এই কল্পতরম্ন সাধিত হলো তা বুঝতে হলে আমাদের নজর ফেরাতে হবে ইসলামি বিপস্নবোত্তর ইরানের জায়মান বাসত্মবতায় শিল্পকলা, সমাজ ও রাষ্ট্রের ত্রিভুজ সম্পর্কের পানে।

বিপস্নবের জনপ্রিয় প্রকৃতি এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অভ্যমত্মরীণ দলবাজি, সর্বসাধারণ এবং শিল্পীসমাজকে সুযোগ করে দিয়েছে আপস-আলোচনা, প্রতিবাদ, সহযোগিতা ও প্রকাশ্য অবাধ্যতার এক সম্প্রসারিত কার্যক্রমে রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণকে। তাই বলে বিষয়টা এমন নয় যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের তাহজিব ও তমদ্দুনের ঝা-া সমুন্নত রাখার প্রশ্নে জনতা-শিল্পীসমাজ আর রাষ্ট্র পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বরং দেখা যায় যে, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ কর্মসূচি জারি রাখার প্রশ্নে – অধিকাংশ সিনেমাকরিয়েই সরকারযন্ত্রে থাকা উদারনৈতিক কর্মচারীদের সহায়তা ও সহানুভূতি পেয়েছেন এবং সুযোগের শতভাগ কাজে লাগিয়েছেন। যার সুবাদে তাঁরা প্রশ্নের চাবুক ছুড়ে মেরেছেন সরকার ও রাষ্ট্রের নিবর্তনমূলক নিয়মকানুনের প্রতি এবং সেন্সর বাসত্মবতার অর্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে বারংবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছেন।

এই দ্বান্দ্বিক বাসত্মবতার ভরকেন্দ্ররূপে উদ্ভাসিত হয় ‘নারী ও প্রেম’ – যা ইরানি সাহিত্য, সিনেমা ও জনজীবনের এক সময়োত্তীর্ণ বিষয়বস্ত্ত। কেননা বিপস্নবোত্তর ইরানে প্রথম যে প্রবহণকে গায়ের জোরে রক্ষণশীলতার চাদরে মুড়িয়ে দেওয়া হয় তা ছিল নারী ও প্রেমের মতো জীবনযাপনের জলজ, সতেজ দিকটি। আর এটি করা হয় ‘ফিকাহ’ বা ইসলামি আইন শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে, যার দরম্নন একজন নারী ও পুরম্নষের সহজাত আকর্ষণ ও সম্পর্কের মতো চর্যাপদটি নিমেষেই যেন হয়ে দাঁড়ায় ট্যাবু। নারীশরীরে হিজাবের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের আদেশ দিয়ে রাষ্ট্র সামাজিক পরিসরে ‘মানুষ’ হিসেবে নারীর উপস্থিতি আরো সংকীর্ণ করে তোলে, এমন লৈঙ্গিক পৃথকীকরণের রাজনীতি ‘নারী’র সামাজিক মতামতকে করে তোলে বাতুল… সর্বোপরি, ‘প্রেম-ভালোবাসার’ স্বাভাবিক-সামাজিক বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে চরমভাবে বিধিবদ্ধ ও অত্যমত্ম সীমিত। পরবর্তী এক দশক ইরানি সিনেমাপিয়াসীদের রম্নপালি পর্দায় নারী ও ভালোবাসার চিত্রণ ঈক্ষণ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

ফলত, ইরানি সমাজে বিপস্নবোত্তরকালে ইরানি সিনেমার সমামত্মরালে আরো অন্য সব সামাজিক আন্দোলনের টানাপড়েন ঘটতে থাকে, সেখানে নিয়মিত গল্প হিসেবে উঠে দাঁড়ায় – আরোপিত ‘ফিকাহ’ভিত্তিক আদর্শবাদমূলক বিধানের সম্প্রসারণ।

দ্ব্যর্থবোধকতার নন্দনতত্ত্ব

১৯৭৯ সালের বিপস্নবের আগেই ইরানের ধর্মীয় নেতারা সিনেমাকে বাতিল বলে গণ্য করেন অথবা বলা যায় সর্বোচ্চ মাত্রায় উপেক্ষা করেন। তাঁদের বিবেচনায় সিনেমা একটি ‘হারাম’ শিল্পকলা এবং সমাজের অনেক ধার্মিক পরিবার মনে করত – সিনেমাঘরে গিয়ে সিনেমা দেখা ভয়াবহ পাপ। এরকম বুজরম্নকিমূলক ধারণার প্রতিবেশ হিসেবে ভূমিকা রাখে নারী ও প্রেম-পিরিতি ইস্যুতে ইরানি সংস্কৃতির আদবকায়দাদুরসত্ম দ্বৈতবাদ, যার ঐতিহ্য হাজার বছরের।

ভালোবাসা/প্রেম/মিলন ফার্সি কাব্যে বরাবরই প্রধান চাষাবাদক্ষক্ষত্র। কিন্তু কাব্যে কদাচিৎ স্পষ্ট করে উলেস্নখ করা হতো কবি/লেখক কোন প্রজাতির ভালোবাসার আলাপ করছেন অর্থাৎ আধ্যাত্মিক নাকি জাগতিক প্রেম। প্রকাশ থাকুক, ফার্সি ভাষায় ব্যাকরণিক সংবর্গে ‘লিঙ্গ’ ধারণার অনুপস্থিতিহেতু লেখকের/কবির ভাববাচ্যে ঠাহর করা দায় যে, উৎকলিত ভালোবাসার গল্পটিতে ভালোবাসার মানুষটি পুরম্নষ না নারী! ফার্সি ভাষা ও কাব্যশৈলীভাবনা উভয়ই কবিদের সুযোগ করে দিয়েছে এমন হেঁয়ালিকে সম্বল করে সৃজনশীল চর্চা জারি রাখার বিন্দুতে। অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থবোধকতার এই শৈলীকে ফার্সি জবানে বলা হয় ‘ইহাম’। ফার্সি চিরায়ত সাহিত্যে ‘ইহাম’ ধারণা ব্যবহারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ রেখেছেন কবি হাফিজ, এর জের সাম্প্রতিককালের কাব্যচর্চায়ও লক্ষ করা যায়। তথাপি এই অস্পষ্টতার নন্দনতত্ত্ব মুখ থুবড়ে পড়ে যখন এ ধারণাকে পুসত্মকের পাতা  থেকে রং-তুলি দিয়ে গাঁথা ক্যানভাসের জমিনে বা আলো দিয়ে লেখা, অন্ধকার দিয়ে অাঁকা সিনেমার পর্দায় প্রক্ষেপনের বিন্দুতে প্রশ্নটি উদিত হয় আরো স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার দাবি নিয়ে। অনস্বীকার্য যে, মাধ্যমগত ভিন্নতাহেতু এসব ঐচ্ছিক মাধ্যমে নারী ও প্রেম এবং অন্যান্য বিষয়কে স্পষ্ট করে হাজির করতে পারতে হয়। অনিশ্চিত দৃশ্যের মধ্য দিয়ে এখানে ঘটনার যবনিকা পতন সম্ভব নয়। এ সম্পাদ্যের অন্যতম প্রচলিত সমাধান হলো, পর্দায়/ক্যানভাসে/সামাজিক পরিসরে ‘নারী’র অপনয়ন বা বর্জন।

যেমন ধরা যাক, ইসলামের ইতিহাসে শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় আলেখ্য ‘তাজিয়া’, যা একটি গভীর আবেগ আক্রামত্ম বিষাদ পালা, পরন্তু এই পালায় পুরম্নষ অভিনয়কারীদের দ্বারা ‘নারী’র অংশটুকু বাসত্মবায়িত হয় বা বিধৃত করা হয়।

ইরানি শিল্পকলার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন কাজার যুগে ‘নিউটার’ বা নপুংসকদের অবয়ব দিয়ে ‘নারী’র অংশটুকুন চিত্রিত হতে। যা থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, ফার্সি চিরায়ত সাহিত্যে (লিঙ্গ উহ্য রেখে) ‘প্রিয়তম’ – ধারণার মূর্তায়নের দৃষ্টামত্ম।

উনিশ শতকের অমেত্ম, ক্যামেরা ও আলোকচিত্রের উদ্ভাবন-পরবর্তী জমানায় নারীর মূর্তায়ন আরো স্পষ্ট ও বাসত্মবিক হয়ে ওঠে। রেজা শাহের শাসনামলে ‘আধুনিকায়ন’-এর উদ্যোগ এবং জন প্রমোদের উপকরণ হিসেবে ইরানে সিনেমার উত্থান, নারীর মূর্তায়নের ধারাকে আরো অর্থবহ ও গতিশীল করে তোলে। এতদ্বারা জনপরিসরে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদার শুধু পুনঃসজ্ঞায়ন ঘটে না বরং ইরানি সিনে-ইন্ডাস্ট্রির শৈশব থেকেই পর্দাকাহিনির অন্যতম টপিক হিসেবে সমাদৃত হয় নারী ও প্রেমের গল্প।

এইক্ষণে, জায়মান ইসলামি প্রজাতন্ত্র সম্মুখীন হয় উভয়সংকটের। ‘সিনেমা’র শক্তি সম্বন্ধে সচেতন ইসলামি কর্তৃপক্ষ তাই শিল্প ও বাণিজ্যের এই মাধ্যমকে খারিজ করতে পারছিল না, এমনকি পূর্বের ধর্মীয় নেতাদের মতো উপেক্ষাও করা সম্ভব হচ্ছিল না। অন্যদিকে ফিকাহ বা ইসলামি শাসনবিধিতে পর্দায় কী কী দেখানো হারাম আর কী দেখানো হালাল – এ ব্যতিরেকে ‘সিনেমা’ সম্পর্কে সরাসরি কোনো কানুন বলবৎ ছিল না। খোমেনির শাসনামলে ইরানে পয়লাবারের মতো ‘সিনেমা’কে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শে আধিপত্যের বেড়াজালে বন্দি করা হয় এবং ইসলামায়নের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এটিকে গণ্য করার প্রবণতা শুরম্ন হয়। কিন্তু ইসলামায়ন-প্রক্রিয়া অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কারণ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের আর্টিস্টদের মতো সিনেমাকরিয়েরাও ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের মতাদর্শিক নিগড় ও ইসলামি অনুশাসনের বৃত্ত থেকে সিনেমাকে নিয়ে এসেছেন মুক্তাঞ্চলের ফসলবিলাসী হাওয়ায়।

চারম্ন ও কারম্নকলা ইসলামায়ন করার প্রয়াস

ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে সিনেমা ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের মাত্রা তিনটি বিভিন্ন দশায় পরিবর্তিত হয় এবং এর প্রভাব সরাসরি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইশারা জোগান দেয়।

প্রথম দশাটিকে বলা হয়ে থাকে ‘পয়লা প্রজাতন্ত্র’, এ ধাপ দশ বছর স্থায়ী হয় এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয় এই সময়ে। এই পর্যায়ে ‘লিবারেল’ বা উদারবাদী এবং ‘মডারেট’ বা মধ্যপন্থীরা, ‘র‌্যাডিক্যাল’ বা আমূলবাদী এবং ‘মিলিট্যান্ট’ বা জঙ্গিদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ দফায় জয়ী হয় মিলিট্যান্টরা। শেষোক্ত অংশটি আয়াতুলস্নাহ খোমেনির সমর্থন পায়, যার বদৌলতে পূর্বোক্তদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে সরিয়ে বিপস্নব-পরবর্তী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ‘পয়লা প্রজাতন্ত্রের’ আয়ুষ্কালের বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ১৯৮০-এর দশকে প্রায় আট বছর স্থায়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং সমাজে ‘ফিকাহ’ভিত্তিক ইসলামের আধিপত্য ও এর অবিতর্কিত ক্ষমতা। যার ফলে চাপা পড়ে যায় ইসলামের সংস্কারবাদী ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। শিল্প ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষক্ষ্য সরকার গঠন করে ‘কমিটি ফর কালচারাল রেভলিউশন’। সংস্কৃতি ও শিল্পকলা মন্ত্রণালয়কে পরিবর্তন করে গড়ে তোলা হয় ‘মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যান্ড ইসলামিক গাইডেন্স’, যার আদেশপত্রে স্পষ্ট করে উলেস্নখ ছিল যে, এই মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে সব ধরনের শিল্প ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে ইসলামায়নের আওতায় আনা।

আশির দশকের গোড়া থেকে প্রজাতন্ত্রের বিবিধ সংস্থার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা উদ্যোগী হয় ইসলামি সিনেমা নির্মাণ, প্রচার ও প্রসারের তরে। ওই বছরগুলোতে গুণসম্পন্ন কোনো সিনেমা নির্মিত হতে দেখা যায়নি। এবং সেলুলয়েড থেকে ‘নারী ও প্রেম’ বিষয়টি পুরোপুরি ত্যাজ্য করা হয়; যদিও ক্যামেরার পেছনে নারীরা সক্রিয় ছিলেন পরিচালক বা কলাকুশলীর ভূমিকায়। পর্দায় নারী, ভালোবাসা আর আবেগের গরহাজিরার সুযোগে মানবিক আবেগের চোরাচালানের নতুন উপায় হয়ে ওঠে শিশুরা। শিশু চরিত্রভিত্তিক এসব সিনেমা আশির দশকের পর্দায় নিজস্ব জায়গা করে নেয়। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ফিকাহভিত্তিক আদর্শবাদের বজ্র অাঁটুনির গেরো ফস্কা হতে থাকে। এ সময় থেকেই গুণসম্পন্ন সিনেমা আবার নির্মিত হতে থাকে। ইরানি সিনেমা আবারো আমত্মর্জাতিক পর্যায়ে মনোযোগ আকর্ষণের বিষয়ে পরিণত হয়।

‘পয়লা প্রজাতন্ত্র’-এর অমিত্মমকালে ইসলামি বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পী যেমন, আবদুল কারিম সোরউস এবং মোহসেন মাখমালবাফদের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের কর্মপন্থা থেকে মোহমুক্তি ঘটে এবং ফিকাহভিত্তিক শাসনপ্রণালির বিরম্নদ্ধে তাঁরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ শুরম্ন করেন।

এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে সমামত্মরালভাবে দ্বিবিধ চিমত্মার ধারা গঠিত হয় – যার একদিকে সোরউসের ‘নব্য ধর্মীয় চিমত্মা’, আরেকদিকে আওয়াজ তোলে মাখমালবাফের ‘নতুন সিনেমা’ আন্দোলন। সোরউসের সেস্নাগান ছিল, ধর্ম ‘মতাদর্শের চেয়েও বড়’ আর মাখমালবাফ মনে করতেন, ‘শিল্প পারে শিল্পীর মুক্তি ঘটাতে এবং শিল্পের গায়ে মতাদর্শের উর্দি চাপিয়ে সমাজের বিকাশ সম্ভব নয়।’

দলবাজির নববৃত্তায়ন

১৯৮৮ সালে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং ১৯৮৯ সালে আয়াতুলস্নাহ খোমেনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর ইমেত্মকালের পর ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তন সূচিত হয়। এই পর্যায়ে আয়াতুলস্নাহ আলি খোমেনি সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং আলি আকবর হাশেমি রাফসানজানি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। একটি নতুন দশার শুরম্ন হয়। এই দশাকে ‘পুনর্গঠন’রূপে চিহ্নিত করা হয়। এ পরিস্থিতিতে সমাজে বিরাজিত পৃথক পৃথক ইসলাম দর্শনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে দলাদলি বিকট রূপ নেয়। যার কেন্দ্রে ছিল তথাকথিত ‘ডানপন্থী’ ও ‘বামপন্থী’রা। দুদলের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রীতে থাকা র‌্যাডিক্যাল ও মিলিট্যান্টদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। খোমেনির শাসনামলে আধিপত্যশীল বামপন্থীরা মন্ত্রণালয়, পার্লামেন্ট, আইনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পদ থেকে চ্যুত হতে থাকে একের পর এক। এই পর্যায়ে ক্ষমতার চেতনাবিন্দুতে উঠে আসে শিল্পকলা ও সংস্কৃতি। ‘সাংস্কৃতিক বিপস্নবের’ ধারণাটি প্রতিস্থাপিত হয় ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ দ্বারা। নতুন ধারণাটি ডানপন্থী মহলে ব্যাপক আদৃত হয়। কেননা একে ব্যবহার করে তাঁরা শাসনব্যবস্থার ভেতরে থাকা ‘শত্রম্ন’ বা বামপন্থীদের শায়েসত্মা করার সুযোগ করে নেন।

ডানপন্থীরা ‘মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যান্ড ইসলামিক গাইডেন্সে’র কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত হয়। কারণ ১৯৮২ সাল থেকে এই সংস্থা দেশীয় সিনেমার ক্রমবৃদ্ধি ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে কাজ করছিল, যা ছিল ‘উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক নীতি’র এজেন্ডা। এর আওতায় ফারাবি সিনেমা ফাউন্ডেশন নামক আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি সিনেমার আমদানি নিষিদ্ধ করে এবং স্থানীয় সিনেমাকরিয়েদের জন্য আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করে। রাফসানজানি সরকার প্রথমে এই কর্মসূচির বিরোধিতা না করলেও পরবর্তী সময়ে সরকার তার কোমল ছায়া সরিয়ে নেয়। অতঃপর ডানপন্থীরা এই সংগঠনকে কব্জা করে এবং রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের সমর্থনে তাদের ফিকাহভিত্তিক দর্শন সংস্কৃতি ও শৈল্পিক উৎপাদনের ক্ষক্ষত্রে পুনরায় আরোপ করে।

সিনেমা : সামাজিক সমালোচনার মাধ্যম

কিন্তু ততদিনে মেলা দেরি হয়ে গেছে। ‘নারী ও ভালোবাসা’র মতো বিষয়টি প্রাচীন ট্যাবু থেকে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে। শাসনতান্ত্রিক জীবন ও মৃত্যু বাসত্মবতায় মোহসেন মাখমালবাফের আ টাইম টু লাভ (১৯৯১) ছিল ট্যাবু ভাঙার প্রথম নিশান। এই সিনেমায় তিনি তুলে ধরেন একজন নারীর সঙ্গে দুজন পুরম্নষের ত্রিভুজ প্রেমের ‘নিষিদ্ধ’ গল্প। যার জমিন হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল মানুষের মানসিক অবস্থা ও বিবেকের আপাত সম্পর্কের মতো সহজ সত্যটি। আ টাইম টু লাভ (১৯৯১) যেন রাষ্ট্রের ওপর একটি বোমা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়; তার কারণ শুধু ত্রিভুজ প্রেমের গল্পই নয়, বরং একজন ইসলামের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সিনেমাকরিয়ে বলে পরিচিত মাখমালবাফের নিজেও। টার্কিতে শুট করা এই সিনেমা ইরানে জনসাধারণের জন্য সিনেমাঘরে মুক্তি দেওয়া যায়নি। তেহরানের ফজর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেই একমাত্র প্রদর্শনী হয়। একই সময়ে নারী সিনেমাকরিয়েরাও পুরম্নষতান্ত্রিক দর্শনের বাধা ভেঙে সিনেমায় নিজেদের কথা তুলে ধরেন এবং সমাজে নারী নয় ‘মানুষ’ নামক মানবিক প্রাণরূপে নিজেদের প্রকাশ করেন। এই ধারায় উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে রাখশান বানি-ইতেমাদের নার্গিস (১৯৯২) সিনেমাটি। নার্গিসের গল্পের চাকা গতিশীল রাখে দুজন নারী ও একজন পুরম্নষের মধ্যকার সম্পর্ক।

সমাজে উন্মুক্ত গণমাধ্যমের অনুপস্থিতিতে ইরানে সিনেমা জোগান দেয় সামাজিক সমালোচনার মতো গুরম্নত্বপূর্ণ গতিবিদ্যার। এই সিনেমাগুলো শুধু সমালোচক নয়, সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকেও অনুকূল অভ্যর্থনা পেয়েছে। যার মধ্য দিয়ে বাইরের দুনিয়ায় ইরানের একটি নতুন ইমেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ডানপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ‘মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যান্ড ইসলামিক গাইডেন্স’ পরিণত হয় দলীয় সিনেমাকরিয়েদের দোকানে।

১৯৯৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সিনেমাকরিয়েরা সরাসরি ময়দানে হাজির হন। প্রথমবারের মতো জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা প্রকাশ্যে তাঁদের মতামত স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। প্রায় পুরো সিনেমাকরিয়ে গোষ্ঠী মোহাম্মাদ খাতামির সমর্থনে প্রচারণা চালায়। নির্মাতা সেইফুলস্নাহ দাদ খাতামির নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন।

থার্ড রিপাবলিক

নির্বাচনে খাতামির অনাকাঙিক্ষত জয়ের মধ্য দিয়ে রক্ষণশীল ডানপন্থীদের দখলে থাকা ‘মিনিস্ট্রি অব কালচার অ্যান্ড ইসলামিক গাইডেন্সে’ পুনরায় প্রগতিশীলদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্যায়ে আরো সহনশীল সাংস্কৃতিক নীতিমালা গৃহীত হয়। এই পর্যায়কে বলা হয়ে থাকে ‘থার্ড রিপাবলিক’। বিপস্নবোত্তরকালে এই দশায় নারী ও প্রেম-সম্পর্কের মতো বিষয়কে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা হয়। এক্ষক্ষত্রে তাহমিনা মিলানির টু ওমেন (১৯৯৮) এবং রাখশান বানি-ইতেমাদের লেডি অফ মে (১৯৯৮) সিনেমাটি গুরম্নত্বের স্বাক্ষর রেখেছে।

এই পর্যায়ের আরেকটি উলেস্নখযোগ্য দিক হলো, সমাজে তরম্নণদের কণ্ঠে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার দাবি এবং ফিকাহর আলোকে লৈঙ্গিক রাজনীতির অসারতা নিয়ে খোলাখুলি বক্তব্য। এই আওয়াজগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেসব সিনেমায়, যেখানে খোলামেলাভাবে এবং ক্রামিত্মক অর্থে আরোপিত লৈঙ্গিক ভূমিকার সমালোচনা করা হয়েছে এবং সিনেমার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ভালোবাসা। এর মধ্যে আমত্মর্জাতিক পরিসরে ইরানি সিনেমার জয়রোল একটি নতুন মাত্রাগত সম্পর্ক তৈরি করে প্রবাসী ইরানিদের সঙ্গে, যা তাদের সুযোগ করে দেয় পরিত্যক্ত ভূমির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার। ভিনদেশে বসবাসকারী অনেক ইরানির কাছে ইরানি সিনেমাই একমাত্র উপলক্ষ, যা নিয়ে তাঁরা ইরানের নাগরিক হিসেবে লজ্জিত নন।

ইরানি মূলধারার সিনেমা

ইরানের সিনেমা ইতিহাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেখা যায়, স্থানীয় সিনেমা মানেই বাজে চিত্রনাট্য, সংগতিহীন অভিনয় এবং নিমণ প্রযোজনা মান। এখানে উলেস্নখ্য, বিবিধ আমত্মর্জাতিক সিনেমা পার্বণের সুবাদে যে ‘ইরানি সিনেমা’কে আমরা চিনেছি, তা সম্পূর্ণ চিত্র নয়; বরং বলা যায় আংশিক বাসত্মবতা। ইরানের স্থানীয় সিনেমার অনেকটা জুড়ে আছে সরকারি নীতি অনুসারী বিপস্নবোত্তর ইরান বা ইরান-ইরাক কোন্দল অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মূলধারার চলচ্চিত্রমালা। আর এখানেই আরেক গল্পের শুরম্ন – আঙ্গিক ও বিষয়ের পরিপ্রেক্ষক্ষত থেকে রক্ষণশীলতায় টইটম্বুর এসব সিনেমা আদতে রদ্দি বলে বাতিল করতে গিয়েও একটু থমকে যেতে হয়।

শুরম্ন থেকে আজতক প্রায় স্পষ্টভাবেই ইরানি সিনেমা তার যে বৈশিষ্ট্য বাজারে সহজপাঠ্যরূপে বিধৃত করেছে তা হলো – পলায়নী প্রবৃত্তি। অর্থাৎ সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিক ইস্যুগুলোকে এড়িয়ে মূলধারার চলচ্চিত্র যে বিষয়গুলোকে অাঁকড়ে ধরে তা যেন স্বপ্নে পাওয়া এক ইরান। যদিও ১৯৯০ সালের পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এর আগের সময়ে নির্মিত সিনেমাগুলো যতটা না সিনেমা হয়ে উঠেছিল, তার চেয়েও বেশি করে প্রকাশিত হয় এর শিক্ষকসুলভ ভঙ্গি। এ-ধরনের সিনেমার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র দর্শকবৃন্দকে শেখাতে চাইত – কীভাবে একজন জনপরিসরে আচরণ করবে; বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কীভাবে আচরণ করতে হবে; অসততাকে কীভাবে দেখতে হবে; প্রতিবাদের ভাষা কী হবে ও কোথায়/কখন আপস করতে হবে; কীভাবে ভালোবাসতে হয় ও কীভাবে ঘৃণা ছুড়তে হয়; কীভাবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে হয় ও কীভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়; ধনীদেরকে কেমন নজরে দেখতে হবে ও গরিবদের সম্পর্কে কী ভাবতে হবে; পশ্চিমাদের বিরম্নদ্ধে কী ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে। এ সিনেমাগুলো তরম্নণদের দিয়েছে ক্যারিয়ার শিক্ষা, তরম্নণীদের শিখিয়েছে কীভাবে ইজ্জত-আব্রম্ন ঢাকতে হয়; সিনেমাগুলো ভালোমন্দ নির্ধারণের নোটবই; কখনো-সখনো তাঁরা সামাজিক সমস্যাগুলোকে পর্দায় তুলে ধরেন বটে, তবে সেগুলোর কোনো স্থায়ী সমাধান নিয়ে আলাপ থাকে না, থাকে শুধু সরল প্রসত্মাবনা। এমনটি এখনো ঘটছে।

এই মূলধারার সিনেমাগুলো আদতে রদ্দি বা প্রপাগান্ডামূলক মনে হলেও স্মরণে রাখা জরম্নরি যে, এমন নির্মিতির পেছনে প্রবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সিনেমা শেষে এসব দেখে দর্শকরা হয়তো খুশিমনেই বাড়ি ফিরে গেছেন। এক বা একাধিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে গভীর তলে রেখে এই সিনেমাগুলো তৈরি করে গেছে এক পৌনঃপুনিক বাসত্মবতা। রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধগুলোকে তর্জমা করেছে সাধারণ দৃশ্যমালায়। অাঁক কেটে গেছে অনেক প্রজন্মের শৈশব স্মৃতির খেরোখাতায়।

এ প্রসঙ্গে সিনেমাবেত্তা হামিদ রেজা সাদার ইরানিয়ান সিনেমা : আ পলিটিক্যাল হিস্টোরি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভালো বা মন্দ যা-ই হোক না কেন – এই সিনেমাগুলো দর্শকের ভাষায় কথা বলে এবং দর্শকরাও এ থেকে নিজেদের ভাষা শেখে। এটা পরিষ্কার যে, এ ছবিগুলো একটি ‘রাজনীতি’, একটি ‘মতাদর্শ’, একটি ‘কায়দাকানুন’ অথবা নিদেনপক্ষক্ষ একটি ‘বিশ্বাস’-এর প্রচারণার পাঁয়তারা কষে থাকে। এমনকি দুর্বল চিত্রনাট্য, পুনরম্নক্তিমূলক বার্তাবহ, একই গল্পের পুনর্চিত্রায়ণ এবং হাস্যকর ও অদ্ভুত চরিত্রগুলোও রাজনৈতিক অর্থবহতায় ঠাসা। সিনেমার সুখী সমাপ্তি শুধু চরিত্রগুলোর সম্মিলন জ্ঞাপন করে না বরং সেই সমাজের পিঠ চাপড়ে দেয় – যেখানে এতসব অপলাপের ভিড়েও ভালোভাবে বাঁচার সম্ভাবনাকে সম্ভব করে তোলে।

সিনেমার পর্দায় যাঁরা কল্পমূলক অভিব্যক্তি প্রকাশের খোঁজে থাকেন, তাঁদের কাছে এ সিনেমাগুলো মোটেও আগ্রহোদ্দীপক হওয়ার নয়। যা-ই হোক, যাদের আগ্রহ আছে ইরানি সংস্কৃতির কোন কোন দিক কীভাবে শ্রম্নতিচিত্রে রূপামত্মর করা হয় এবং কোনগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়… তাদের কাছে এই সিনেমাগুলো কৌতূহল-উদ্রেক লাগতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষক্ষত্রে হতে পারে শঙ্কার কারণ! এই ছবিগুলোর মতাদর্শ বুঝতে হলে জরম্নরি ভিত্তিতে নজর করতে হবে সিনেমায় কে সুখে-শামিত্মতে বাস করতে থাকে আর কে মারা যায়; কে সংঘর্ষে কাটা পড়ে আর কে উদ্ধারকারীর দেখা পায়; কার কপালে চার চাঁদ লাগে আর কে হয়ে যায় পথের ভিখারি এবং সর্বোপরি ‘কেন’ এমনটি হয়।’

সিনেমাদোসিত্ম

বাংলায় যা চলচ্চিত্রামোদী ফার্সিতে তা-ই সিনেমাদোসিত্ম। ইরানে সিনেমাভক্তদের মনিকার সিনেমাদোসিত্ম। প্রকৃত অর্থে ‘সিনেমাদোসিত্ম’ মানে কী?

পাঠিকা ও পাঠক, এতক্ষণে আপনারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, আধুনিক ইরান বা বিপস্নবোত্তর ইরানের সামাজিক গতিবিদ্যা অথবা ব্যক্তিযাপনের স্থিতিবিদ্যার সঙ্গে সিনেমা দেখার, করার-উপযোগিতার একটি সন্নিহিত সম্পর্ক আছে।

বিপস্নবের কালে চরমপন্থীরা যখন একটার পর একটা সিনেমাঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল তখন শুধু গৃহেই তা লাগেনি, উত্তুঙ্গ অাঁচে গলে বিকলাঙ্গ হয়ে যায় সেলুলয়েডে গেঁথে রাখা অনেক পুরাঘটিত অতীত। ওই সময় পশ্চিমা বিশ্ব সংশিস্নষ্ট যে-কোনো সিনেমাকে দেখা হতো সন্দেহের চোরা চাহনি দিয়ে। ফলাফল, সিনেমাভক্তরা অপার হয়ে বসে থাকলেন একরাশ বঞ্চনা নিয়ে। তবে সিনেমা দৃশ্যত ছাই হয়ে গেলেও তার অশরীরী আত্মা খুঁজে নেয় নতুন দেহ, ভর করে সিনেমাভক্ত বা যা বলছিলাম – ‘সিনেমাদোসিত্ম’দের মসিত্মষ্কের থিয়েটারে। সিনেমাঘর হারিয়ে তাঁরাও হয়ে যান আন্ডারগ্রাউন্ড।

‘সিনেমাদোসিত্ম’ একটি বিরল প্রপঞ্চ। একে গণ্য করা হয় এক প্রকার রাজনৈতিক ও শৈল্পিক প্রতিরোধ হিসেবে। কেননা এ ধারণা ক্রিয়াশীল হয় চলচ্চিত্রিক অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে। সেটা কীভাবে?

যেমন ধরা যাক, স্বল্পকালের জন্য আগে নিষিদ্ধ সোভিয়েত নির্বাক সিনেমা ও অন্য বামপন্থী রাজনৈতিক ঘটনাসংকুল সিনেমাগুলো বিপস্নবের খাতিরে কিছুদিন ইরানে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বিপস্নবোত্তরকালে বিপস্নবী সরকার অচিরেই সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শন বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে সার্থক ইসলামি সিনেমার জন্য। আমরা জ্ঞাত যে,
যেমন-তেমনভাবে নির্মিত এই স্থানীয় সিনেমাগুলো প্রযোজনার প্রশ্নে সরকার ও রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কী ছিল। যে সিনেমাঘরগুলো বিপস্নবের আগুন থেকে বেঁচে গিয়েছিল সেখানেই প্রদর্শিত হতে থাকে এগুলো। এই নিয়ন্ত্রণের খড়গ থেকে মুক্তি পায়নি হোম ভিডিও এবং পরবর্তীকালে ডিজিটাল টিভি ও আকাশ-সংস্কৃতি। কিন্তু বিশ্ব সিনেমা বা অপর বাসত্মবতার স্বাদ যে পেয়েছে, তাকে তো যা খুশি তাই দেখিয়ে ভোলানো যাবে না। বছরের পর বছর ধরে মানুষ তাই গোপনে মিলিত হতো গুপ্ত কামরায় ভিএইচএস টেপে ক্লাসিক সিনেমা বা সাম্প্রতিক সিনেমার বুটলেগ কপি দেখার জন্য।

এখন সিনেমা না হয় দুর্লভ হয়ে গেল, তথাপি যাঁরা বিপস্নব-পূর্ব ইরানে সিনেমা-সন্দেশের স্বাদ পেয়েছেন তাঁদের চিত্ত থেকে তো চাইলেই নিমেষে রঙিন, জীবনের থেকেও বৃহৎ ও বাসত্মব প্রতিমা/কল্পমূর্তিগুলো মুছে ফেলা যায় না। আর এখান থেকেই শুরম্ন এক নতুন প্রজাতির গল্প।

বিপস্নবের প্রথম পনেরো বছর যখন ইরানে বাইরের সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল তখন অন্য ছবির স্বাদ বিলিয়েছেন এই সিনেমাদোসত্মরা। ইরানের বিপস্নবোত্তর প্রজন্মের কচিকাঁচা, তরম্নণ-তরম্নণীদের অন্য সিনেমা চেনার সেতু ছিল এরাই। এই গপ্পোবাজরা তাদের শ্রোতাদের শোনাত মারিয়া পুজোর গডফাদার, ফেদ্রিকো ফেলেনির লা স্ত্রাদা বা রাজকাপুরের শ্রী ৪২০ ইত্যাদির দুনিয়াবি খোয়াবের গল্প। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা একজন বলেছেন যে, শৈশবে গল্পে শোনা সিনেমাগুলো যখন দেখেছেন তখন তাঁর কাছে মূল সিনেমাটাই কখনো কখনো পানসে লেগেছে।

সিনেমার দুনিয়া ইরানে উন্মুক্ত হওয়ার আগ পর্যমত্ম সিনেমার গল্প করার এক মৌখিক ঐতিহ্য ছিল ইরানজুড়ে। সিনেমা গবেষক এহসান খোসবাখত গণজীবনে ‘সিনেমাদোসিত্ম’র ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সিনেমা ফ্রান্সে উদ্ভাবিত হয়ে থাকতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক মাত্রায় শিল্পায়িত পণ্য হিসেবে বিকশিত হতে পারে, কিন্তু ইরানে এসে এটি পরিণত হয়েছে ফোকলোর আর্ট বা লোকজ শিল্পে।’ ইরানিদের বোধিতে এসব সিনেমা শুধু সিনেমা নামেই সঞ্চিত হয়নি, এটি স্মৃতি, কথামালা/টেক্সট ও ইমেজ/চিত্রমূর্তির আলপনা নিয়ে হাজির হয়েছে। যেখানে তাদের কল্পনা কখনোবা হয়ে ওঠে সিনেমার চেয়েও বেশি ফিল্মিক।

ইরানি সিনেমা : বিচ্ছিন্ন ভাবনা

সাধারণ বর্তমানের দৃষ্টিতে ইরানি সিনেমার যে প্রতিকৃতি আমরা দেখে থাকি বা জেনে থাকি প্রকৃতার্থে তা একাধিক সত্মরে বিন্যসত্ম। ইরান এমন এক ভূখ- যেখানে মাজিদ মাজেদি সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অনুদানে কয়েক বিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমা নির্মাণের সুযোগ পান, সেই দেশেই জাফর পানাহির ওপর আরোপিত হয় বিশ বছরের নিষেধাজ্ঞা। এবং সাদা চোখে পরখ করা না গেলেও ইরান বিশ্বের ওই রাষ্ট্র, যেখানে সিনেমাকরিয়েরা জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখে থাকেন। নব্য বাসত্মববাদী ঘরানার এই ছবিগুলো এক অর্থে ইরানের বাসত্মবতায় মানবিক সম্পর্ক ও টানাপড়েনের কারনামা হাজির করে; তবে এটি কোনো স্থানিক বাসত্মবতায় সীমাবদ্ধ নয়। যেমন, আসগর ফরহাদির আ সেপারেশন মানবিক সম্পর্কের যে সামাজিক সংকটের মাত্রা বিবৃত করে তার সত্যতা শুধু ইরানেই নয়, বিশ্বের যে-কোনো দেশের বাসত্মবতাতেই সত্য। অথবা অফসাইডে জাফর পানাহি সমাজে নারীর অ(ন)ধিকার ও রাষ্ট্রের আচরণের যে বাসত্মবতা নির্মাণ করেন সেটিরও সমতুল্য পরিস্থিতি অনেক রাষ্ট্রেই বলবৎ আছে। তাহলে ইরানি বাসত্মবতা বলে যে সামাজিক অবস্থার সঙ্গে আমি-আপনি ওয়াকিবহাল আছি, তা আদতে কতখানি অকৃত্রিম ইরানের আর কতখানি সিনেমাকরিয়েদের কাল্পনিক অভিব্যক্তি, তার উত্তর হাতের কাছে সহজলভ্য নয়। প্রকাশ থাকুক যে, ইরানের সিনেমা সংস্কৃতি শতবর্ষী। ‘বিতর্কিত’ ও ‘নিষিদ্ধ’ খেতাবপ্রাপ্ত যে সিনেমাগুলো বিশ্ববাসী গভীর অভিনিবেশসহকারে অবলোকন করে, সেই সিনেমাগুলোই আবার প্রজাতন্ত্রের নিগড়ে থাকা আমজনতা দেখার সুযোগই পায় না। তাহলে জাতীয় মুক্তির তরে নির্মিত এসব জাতীয় সিনেমা যদি জাতির কাছে না পৌঁছাতে পারে তবে কী অর্থ এই নির্মাণ প্রযোজনায়। উৎসব-পার্বণে সমাদৃত ছবিগুলো কী ইরান নামক কোনো ‘মিথ’ পাচার করে থাকে কি না… তা নিশ্চিত করে জানা নেই। কাব্যিক, গীতলধর্মী মেজাজের সিনেমাগুলো যেন মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার মতো একই বাসত্মবতার ওয়াজ করে থাকে। আপনি কখনো লক্ষ করেছেন কি, কেন উৎসব কাঁপানো এই সময়ের ইরানি সিনেমাগুলোতে ইরানের সাম্প্রতিক বাসত্মবতার প্রতিফলন দেখা যায় না! যেমন, বলা যাক ইরানের তরম্নণদের মধ্যে সুফি সংগীত একটি জনপ্রিয় সাব-কালচার এবং মেইনস্ট্রিম সাব-কালচার। এই সংস্কৃতিতে তরম্নণ-তরম্নণীরা ঘরবাড়ি ছেড়ে বোহেমিয়া জীবনের পথে, আধ্যাত্মিক সংগীতকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়ে। তাদের ওই জীবনের রোজনামচা, বহির্বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো ইরানি জাতীয় সিনেমাতে আলেখ্য হিসেবে দেখার সুযোগ কবে হবে ভবিতব্যই জানে। তথাপি আমরা দেখে থাকব বাহমান গোবাদির নো ওয়ান ন্যোওজ অ্যাবাউট পার্সিয়ান ক্যাটে আর্বান তেহরানের একদল তরম্নণ-তরম্নণীকে যারা (নিষিদ্ধে) ‘রক গান’-এর দল করে এবং ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করার আপ্রাণ চেষ্টায় রত থাকে। এ ক্ষক্ষত্রে পাঠিকা ও পাঠক স্ববিরোধিতার মাত্রাটি আশা রাখি আপনাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আপনারা নজর করলেই দেখতে পারবেন যে, ইরানি নির্মাতাদের সিনেমায় সে বিষয়গুলো বারংবার উঠে আসে, যা পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহের বিষয় বা যা দেখতে তারা পথ চেয়ে থাকেন। কারম্নশৈলীতে মারাত্মক উৎকর্ষে থাকা এই সিনেমাগুলোর নির্মাতারা জাতীয় সিনেমার আড়ালে বাজার ধরার একটা কোশেশ করেই থাকেন। এই ধারার সিনেমার পরতে পরতে হাজির থাকে উদ্দিষ্ট বা কাঙিক্ষত দর্শকের বাসনার পাটিগণিত। কোন পরিস্থিতিতে বা আবেগী মুহূর্তে কাঙিক্ষত দর্শক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন তা মেপেই যেন ছবির ভাষার ও ঘটনার ঘনঘটার সমাবেশ-বিন্যাস সাধন করা হয়। এসবই করা হয় পশ্চিমের দিকে মুখ করে।

হাল আমলের উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা ব্যাপকভাবে ঔপনিবেশিকায়ন পরিস্থিতি এবং যে প্রথায় দুদিকের ভারসাম্যহীনতা বা অসামঞ্জস্য পরস্পরের মাঝে মস্নান হতে থাকে অপজাত ও প্রজনন পরিব্যক্তির মাধ্যমে – তার তত্ত্বায়ন করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা দেখিয়েছেন যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক বাসত্মবতায় সাবেক উপনিবেশের সঙ্গে অধুনা স্বাধীন ভূখ- নেহাতই অর্থনৈতিক সম্পর্কে যুক্ত নয়, এর একটি মনসত্মাত্ত্বিক কর্তৃত্বাধীনতার প্রভাববিসত্মারকারী দিকও আছে, যা উত্তর ঔপনিবেশিক ট্রমা বলে পরিচিত। বিশ্ব চলচ্চিত্র-বাজারে ঠাঁই করে নেওয়া ইরানি সিনেমাগুলোর বিষয়বস্ত্ত ও আঙ্গিক এবং আখ্যান বিচার করলে উত্তর-ঔপনিবেশিক ট্রমার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাওয়া যায় তার দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যমালায়। আপাত সত্য, তবে কল্পনাশ্রয়ী দারিদ্র্য ও সংকটাপন্ন মানবিক অধিকার বিকিকিনির হাটে ইরানি সিনেমাকরিয়েরা আজ নমস্যের কাতারে জায়গা করে নিয়েছেন।

ইরানি সিনেমার বিশ্ব দরবারে উত্থানের প্রচলিত মুগ্ধতার আবরণ সরিয়ে আমরা যদি তাকাই তবে দেখব সিনেমা কূটনীতিতে ক্রিয়াশীল ‘ভালো’ সিনেমার ভূরি ভূরি উজ্জ্বল দৃষ্টামত্ম, তবে এর মধ্যে ‘সৎ’ সিনেমা কোনটি তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা রয়ে যায় অবশেষে। n

দোহাই

এই রচনার বয়ান বয়নে লেখক ঋণগ্রসত্ম নিমেণাক্ত রচনাগুলোর প্রতি :

1.  http://www.bfi.org.uk/news-opinion/sight-sound-magazine/features/cinemadoosti-film-folklore-iran

2.  http://www.merip.org/mer/mer219/iranian-cinema

3.  http://www.aljazeera.com/indepth/opinion/2013/06/ 20136674051520796.html

4.  http://www.aljazeera.com/indepth/opinion/2015/02/ iranian-cinema-150218053456234.html

Leave a Reply