সেই সে গুহাযুগ থেকেই নাকি একেক সংঘগোষ্ঠীতে ছিলেন একেক নেতা, নায়ক – বীরাঙ্গনা কি বীর। এ হয়তো মানবসমাজের আদি এক লক্ষণ। জনগোষ্ঠীর সর্বদা লাগে বুঝি নায়ক কোনো। যাকে নির্ভর করে বাঁচে মানুষ। এভাবে কল্পনায় তার দেবতাও হয়ে ওঠে বাঁচবারই ভরকেন্দ্র। সেই নায়ক তবে বুঝি একজন কোনো ব্যক্তিমাত্রই নয়, সম্মিলিত মানবগোষ্ঠীর যৌথ শক্তিমত্তা বরং – সমাজের প্রয়োজনে যার সৃজন, নির্মাণ, আবির্ভাব।
বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসেও এমত নায়ক, মহানায়ক, নেতা হয়েছেন কত কত জন! জনসমাজ রূপ দিয়েছে এবং রূপ নিয়েছে যৌথ সে মিথস্ক্রিয়ায়। বাংলা অঞ্চলে মহানায়ক বলতে প্রথমেই মনে আসে শ্রীচৈতন্যের নাম, যদিও তাঁর আগে অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বাঙালির প্রথম বিশ্বমানব। উপমহাদেশের সেরা সব বিহারের অধ্যক্ষ; জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিদ্যায় পারদর্শী তাঁকে তিববতে, বিশেষ উপদেশক হিসেবে যেতে হয় – সেতু নির্মাণ, যুদ্ধবিদ্যায় পরামর্শ দান করতে; সেখানে তাঁর প্রয়াণ ঘটে, তবে বাংলা জনমন তাঁর বিষয়ে কতটা জ্ঞাত ছিল বলা মুশকিল। অথচ বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে তাঁর বাস্ত্তভিটা আজো রয়েছে। জন্মতিথিতে মেলাও নাকি বসে। ‘নাট্যধারা’ তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে মঞ্চস্থ করেছে অতীশ দীপঙ্কর সপর্যা – রচনা ও নির্দেশনা : অলোক বসু।
ইতিহাসের এক ভাঙন-গড়ন নবরূপায়ণ পর্বে চৈতন্যের আবির্ভাব। জাতপাত-বর্ণ-ধর্মের ভেদাভেদের প্রবল তা-বকাল তখন। ক্রম-ক্ষীয়মাণ, ভঙ্গুর সে-কালে বহিরাগত নবীন জোয়ার আছড়ে পড়ছে সমাজজীবনে, জনমানসে। সুফি-সাধকদের মুখে সাম্য-মৈত্রীর অভেদ বাণী আর নতুন শাসকের আগমন। ভক্তি-প্রেমের এক জাগরণ তখন ঘটে, শ্রীচৈতন্য হয়ে ওঠেন তার নায়ক, মহানায়ক। জীবন্ত কিংবদমিত্ম যেনবা। জীবৎকালেই তিনি হয়ে ওঠেন অবতার এক। নানা আখ্যানরীতিতে তাঁর জীবনকাহিনি রচিত হতে থাকে। কীর্তনের সুরে, অভিনয়ে তার পরিবেশনায় উদ্বেল হয় জনসমাজ, ধর্ম-বর্ণের ভেদ ঘুচিয়ে। তিনি নিজেই নাচে গানে অভিনয়ের নতুন রীতির নায়ক হয়ে ওঠেন। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি পরিবেশনায় রাধাভাবের বিভোর কীর্তনিয়া; পরম একের সঙ্গে মিলনের অধীর আকুল বিহবলতায়। ‘নিমাই দাঁড়া রে’ বলে শচীমাতার আর্তহাহাকার গানে-যাত্রায়-পালায় মুখে মুখে আজো আকুল করে বাংলামন।
অভেদ এক প্রেম-ভক্তি বুঝি বাংলামনের আদি স্বভাব। তাতেই তার সৃজনমুক্তি ঘটে – ‘বাঁচার বিস্ময়, বিষাদ আর সম্ভ্রমে।’ আনন্দরসে বিহবল টইটম্বুর হয় সে। অথচ তাকে চিরকাল পাড়ি দিতে হয়েছে লাগাতার এক মারের সাগর। তার আদি স্বভাব যাতে ঘুলিয়ে ওঠে, থেঁতলে, পিষে যায় সত্তাস্বরূপ। তবু বারে বারে সে ফিরে দাঁড়ায়, শেষ সীমায় গিয়ে ঘুরে না দাঁড়িয়ে পারে না। স্বভাবধর্ম তার নতুন করে ফিরে পায় আবার। এভাবে তার নবজন্ম ঘটে, ঘটতে থাকে।
চৈতন্য-পরবর্তীকাল ধরে চলে এই ক্রম-রূপরূপান্তর পালা। আর্য ব্রাহ্মণ্য কি জৈন-বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান একের পর এক তারে ক্ষমতার কি শাসকের ধর্ম-মত-পথে বদলে দিতে চেয়েছে; তবু কোন এক অন্তর্গত সত্তাস্বভাব সে খুঁজেছে। ফিরে পেয়েছে নিজেকে তন্ত্র-যোগশক্তি-বৈষ্ণব-সুফি ঘরানার সহজিয়া অভেদ এক প্রেম-ভক্তিময়তায়। কিছুতেই হার-না-মানা, ‘দাবায় রাখতে পারবা না’ বাঙাল রোখ তার বুঝি।
বাংলার এই স্বভাব স্বধর্মের আরেক মহানায়ক লালন ফকির। ইতিহাসের দীর্ঘকালব্যাপী বাঙালিমনের অপার, অকূল মর্ম-ধর্ম-সাধক গুরুদেব তিনি যেন। উচ্চতর তার এই ভাবসাধন সাধারণের করায়ত্ত যদিও নয়; তবু বাংলা মনেরই সে অমৃতফসল – মানবজমিন আবাদের স্বর্ণ শস্যসার। এহেন পয়মন্ত ক্ষেত্র বিনা যার এমত সম্ভার ফলে না। ন্যায়নীতি, সত্যসন্ধিৎসার, অপার এক প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার মানস উৎস সমাজে দীর্ঘ চর্চা-চাষ বিনা সম্ভব না। কোনো শাস্ত্র-ধর্ম-মতে বিনা তর্ক-মীমাংসায় সায় দিতে সে নারাজ চিরকাল। চির এক মানস-দ্রোহ তার আদি স্বভাব বুঝি; অনন্ত এক বাহাস-বিতর্ক, তর্কপ্রিয়তা সাধারণ্যে তাকে থ্যাটা বাঙালের অভিধায় ভূষিত করেছে। লালন ফকির সেই সত্তার ভাবজিজ্ঞাসায় নান্দনিক উত্তুঙ্গ শিখর বুঝি বা। তার ইয়ত্তা সহজসাধ্য নয় – প্রায় অসাধ্য বাংলা সে বাচনের ভাষা-হারা শিক্ষিত নগরজনের বেলা। সেই তো উপনিবেশি মনের আদি পাপ-ঘোর। যার উৎসাদন দিনে দিনে অসাধ্য, অসম্ভবপরতার চূড়ামেত্ম পৌঁছেছে। যদিও জনসমাজে, মনে চারিয়ে গেছে লালনের সে ভক্তি-প্রেম – মানবের সত্তা-জিজ্ঞাসার সারাৎসার। সেটাই জিয়নকাঠি বাংলামনের আজিও। যদিও নাগরিক বাউল-বিলাসে তার নাগাল মেলে না। যতই কেন মঞ্চ-মিডিয়া-চলচ্চিত্রে তার উচ্চ- নিনাদ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হোক – বাজারের উন্মাদন মাতম হিক্কায়।
পান্থ শাহরিয়ার রচিত, ত্রপা মজুমদার নির্দেশিত, ‘থিয়েটারে’র বারামখানায় তার নাগাল খুঁজেছে।
উপমহাদেশে উপনিবেশকালীন প্রথম নাগরিক মহানায়ক হলেন রাজা রামমোহন রায়। উপনিবেশ বাস্তবতায় কী করে দাঁড়াতে পারে ক্ষীয়মাণ দেশ-সমাজ-সভ্যতা – তারই সুলুকসন্ধান করেছেন তিনি। তাই তো ইংল্যান্ডে প্রশাসনিক যোগাযোগ করে চলেন; দেশীয়দের রাজনৈতিক-সামাজিক অধিকার রক্ষায় শাসকদের হাউস অব কমন্সে চিঠিপত্র চালাচালি করেন। এহেন বাস্তব মর্যাদাসম্পন্ন কা-জ্ঞান একালে বসে কল্পনা করা অসম্ভব-প্রায়। তারই পথ ধরে আমাদের নাগরিক নায়ক-মহানায়কেরা নানা পথে অগ্রসর হয়েছেন। খ্রিষ্টান ও মুসলমান একেশ্বরবাদের আদর্শে সন্ধান করেন তিনি ভারতীয় এক উপনিষদীয় নিরাকার ব্রহ্ম। নিছক কোনো ধর্মসম্প্রদায় করতে চাননি তিনি – যুক্তিবুদ্ধিতর্কে পরস্পর সহনশীল ঔদার্যে, ন্যায়নীতি মীমাংসার একটা ক্ষেত্র গঠন করতে চেয়েছিলেন – যদিও শেষ পর্যন্ত তা একটি সংস্কারপন্থী সম্প্রদায় হয়ে দাঁড়ায়, সমাজজীবনে যার অভিঘাত যদিও বিচিত্র ব্যাপক হয়েছে – অন্তত নাগরিক সীমিত পরিসরে। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব জিজ্ঞাসায় তিনি বাংলা-ইংরেজি-ফার্সি ভাষায় পত্র-পত্রিকা-পুস্তক প্রণয়ন করেন। সতীদাহ প্রথা নিবারণে তাঁর সংশপ্তক প্রণোদনা আজো প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছে জনসমাজ মনে। যা কিছু নবজাগরণ বা আধুনিক বলে জানি – তার প্রথম উদ্গাতা ঋত্বিক ছিলেন তিনি।
মাইকেল মধুসূদন নব মহাকাব্য রচনা করেন বলেই যে ছিলেন মহানায়কপ্রবর তা নয়। ইউরোপের সঙ্গে নান্দনিক মোলাকাত তিনিই প্রথম বিচিত্র বীর্যবত্তায় সূচনা করেন। প্রথাগত, পুনরাবৃত্ত কাব্যছন্দ পয়ার বাকস্পন্দের নবীন বাচনে বাঁধেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তনা তাঁর পদ্য-গদ্যের এক নাগরিক গড়ন দেয়। সামাজিক শ্রম্নতির পরম্পরা থেকে ব্যক্তির পাঠ-উচ্চারণ সম্ভব হয় তাতে; স্বদেশীয়-বিদেশীয় পুরাণের নবভাষ্য রূপায়ণ, বাংলা ট্র্যাজেডি রচনা, নাগরিক ও লোকবাচনের ধ্রম্নপদী প্রহসনদ্বয় এবং শাসকের সমকক্ষতা অর্জন কি অতিক্রম, বিচিত্র, ভাষাজ্ঞান ও তাঁর কাব্যপ্রয়োগ তাকে বাঙালি মহাপুরুষের এক পৌরাণিক চরিত্র দিয়েছে। বনফুল রচিত তাঁর জীবননাট্য শ্রী মধুসূদন পরিবেশন করেছে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’; অমলেন্দু বিশ্বাস যাত্রারীতিতে তাঁর মহানায়কোচিত বাচন-অভিব্যক্তি দৃশ্যকাব্যে বাঙ্ময় করেছেন। ‘প্রাঙ্গণেমোর’ তাঁর অমিত্মম জীবননাট্য ‘দাঁড়াও…জন্ম যদি তব বঙ্গে’ মঞ্চস্থ করেছে, রচনা : অপূর্ব কু-ু, নির্দেশনা : অনন্ত হীরা গত শতকে উৎপল দত্ত করেছিলেন ‘দাঁড়াও পথিকবর’। বাঙালিমনে তিনি প্রবল প্রতিস্পর্ধার আর্কেটাইপ-তুল্য গরিমায় মহিম্ময়।
বিদ্যাসাগর, মাইকেলের স্বভাব বৈপরীত্যে, পরিপূরক বাঙালি দার্ঢ্যের আর এক পৌরাণিক পুরুষপ্রবর। বিধবা বিবাহ প্রচলন, বর্ণপরিচয় প্রচার-প্রসার, ইয়োরোপীয় আধুনিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তন এবং নাগরিক-গ্রামসমাজ জোড়া তাঁর বিচিত্র ক্রিয়াকর্মের বিসত্মার ও অভিঘাত জনসমাজে নানা মিথতুল্য গল্পগাথায় রূপায়িত। ধুতির পাড়ে তাঁতিসমাজ প্রণতি জানায় তাঁকে; তাঁর মাতৃভক্তি কি ইংরেজের মুখোমুখি চারিত্র্য মাহাত্ম্যের অফুরান আখ্যান, জীবন্ত আজো জনমনে। এবং বিদ্যাসাগর আরণ্যকের একালীন নাট্যভাষ্য আরেক, রচনা মান্নান হীরা।
‘যত মত তত পথ’ প্রবক্তা শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মীয় সাধক-গুরু হলেও জনসমাজে অন্যতর প্রণোদক : ওঠো, জাগো, এগিয়ে চলো। জাতপাত-দারিদ্র্য ভেদ ঘুচিয়ে মানব-দেবতার উদ্বোধক : ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি/কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিয়ে ঈশ্বর।’ বেদান্ত দর্শনের ভিন্ন ব্যাখ্যান প্রয়োগ করেন তিনি জনমনে। এভাবে সশস্ত্র বিপ্লবীদেরও রণগুরু হয়ে ওঠেন। জড়ত্বনাশা যৌবনজলতরঙ্গ তাঁকে সমাজে এক মহানায়কের আসনে বৃত করেছে।
ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগীত-শিক্ষা ও সমাজের বিচিত্র উদ্যোগের প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ। তিনি তো চিরকালের শ্রেষ্ঠ এক মহানায়ক – কেবল বাংলা ও বাঙালি বা উপমহাদেশব্যাপী নয়, তার ব্যাপ্তি-বিসত্মার দেশ-বিদেশ-বিশ্বজুড়ে। বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত তিনি মানবসভ্যতারই তুলনারহিত এক মহাপ্রতিভা।
একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে কোনো একটি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ ইতিহাসে এতখানি প্রণোদনা-প্রবর্তনা-অভিভাব সঞ্চার মানবেতিহাসের মহাবিস্ময়, মহাসম্পদ বিশেষ; আজকের ভাষায় চিরকালের মানব ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এই মহাপ্রতিভাবান বাঙালি মহানায়ক। তাঁকে নিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে একের পর এক ব্যাখ্যান-ভাষ্য, চলচ্চিত্র-উপন্যাস-নাটক-কবিতা। গবেষণার সর্ববৃহৎ আকরখনি তিনি আজ বিশ্বজুড়েই। পালাকার প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হকের বাংলার মাটি বাংলার জল, প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজিত আমি ও রবীন্দ্রনাথ তারই বর্তমান নাট্যভাষ্য। দুটি দেশের জাতীয় সংগীত রচনা, একটি দেশের জাতীয় সংগীতের পুনর্বাচন-সম্পাদনা বিশ্বে বেনজির। গত শতকের ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশ তাঁকে কেন্দ্র করেই এক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন-ব্রত সম্পন্ন করে; মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর গান নিরক্ষর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখেও অপূর্ব ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত-গীত হয়ে চলে; বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এহেন ইতিহাস-প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে ওঠে জনমানসের বাচনযোগে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল কেবল বাংলাদেশ নয়, অখ- বাঙালি জাতির জাতীয় কবির স্বীকৃতি পেয়েছিলেন গত শতকে, আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর ত্রিশ বছরের জন্মবর্ষে। বাঙালির আরেক মহানায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র সে সভায় ঘোষণা করেন – আমরা কারাগারে যাইব তাঁর গান গাইতে গাইতে, যুদ্ধ করব তাঁর গানের তালে তালে। জাতীয় জীবনে নজরুলের মহানায়কত্বের এই হলো চিরস্থায়ী স্মারক এক। মুসলমান জনসমাজে নজরুলের আবির্ভাব অবতার-পয়গম্বর সদৃশ। পশ্চাৎপদ জাতির হীনম্মন্যতা থেকে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালিত্বে আরোহণে তাঁর একক সৃজনমাহাত্ম্য অতুলনীয়। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই একই মানসগরিমায় প্রণোদিত হোক – এই ছিল তাঁর অর্ধজীবনব্যাপী শ্রামিত্মক্লামিত্মহীন অভিযাত্রা। অপ্রকৃতিস্থ পরবর্তীকাল থেকেও যার তেজসঞ্চারণ অনিঃশেষ অফুরান। বাংলা কাব্যের শরীরে-মনে শব্দছন্দভাবের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সঞ্চার করেন তিনি – যা জাতীয় মানসে চিরস্থায়ী অভিভাব প্রবর্তনা ঘটায়। ‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল’ – রবীন্দ্রকথিত এই ভাষ্য প্রাতঃস্মরণীয় জনমনে, চেতনমননে। পাকিসত্মানি ইসলামি কবির অভিধা থেকে এক মুক্তিপ্রক্রিয়া নির্ণয় করাই বাংলাদেশের সমাজমানসে তাঁর যথাভূমিকা গ্রহণ-প্রয়োগের প্রাক-শর্ত। জাতীয় কবির অভিধার আড়াল থেকে এই মহানায়কের উজ্জ্বল আবির্ভাবে সূচিত হবে জাতির ভবিষ্যৎ। চিরবিদ্রোহীর বন্ধনমোচন তাহলেই সম্ভব।
সবশেষে বলা যায়, রাজনৈতিক মহানায়কত্ব অর্জনের দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া-পরম্পরা। চিরকালের বিদ্রোহী, পোষ-না-মানা রোখ তাঁর। সেই অভিযান আলেকজান্ডারের কাল থেকে, গঙ্গারিডিবাসীর সে পরাক্রম গ্রিক কাব্যে কীর্তিত। মোগল আমলে বারোভূঁইয়াদের লাগাতার যুদ্ধংদেহী অভিযান; তার আগে শশাঙ্ক-গোপালের বিজয়-গরিমা! বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজ কূটনীতি ও স্বদেশি বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত হলে সূচিত হয় – দুশো বছরের উপনিবেশ। জনমনে তাঁকে নিয়ে শাসকের কুৎসা রটনা খারিজ করেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। শচীন সেনগুপ্তের নাটকে তাঁকে বীরনায়কের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। নির্মলেন্দু লাহিড়ীর কণ্ঠে যার বীজতলা রচিত হয়েছিল। সাঈদ আহম্মেদ রচনা করেন শেষ নবাব। বাঙালি জাতীয়তাবাদী সে আবেগ মুক্তিযুদ্ধেও প্রণোদিত করে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ-পরবর্তী একশ বছর বাংলা অঞ্চলজুড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটে চলে সাধারণ্যে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে যার কীর্তিগাথা ইতিহাসে, জনমনে। ফকির মজনু শাহ এবং গত শতকের আশির দশকে উদ্ঘাটিত নূরলদীন বীর নায়ক ছিলেন। নাগরিক প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হক নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে একালের সঙ্গে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করেন এক রণধ্বনি – জাগো বাহে কোনঠে সবায়। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসে চিরায়ত ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করেছে। উৎপল দত্তের নাটকও আছে ঐতিহাসিক এই বীর্যগাথা নিয়ে। যাত্রাপালায়ও তার রূপায়ণ হয়ে থাকে। ‘ইতিহাস কথা কও’ গানে গানে রচিত, প্রচারিত সে বারতা।
বীরসা মু-া সাঁওতাল সমাজে শুধু নয়, মানব পরাক্রমের আর্কেটাইপ বিশেষ। আদিবাসীদের নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর জীবনব্যাপী কাজ তো চিরস্মরণীয় : দেশ নাটক প্রযোজিত মাসুম রেজার নাটক বীরসা মু-া আর মামুনুর রশীদ রচিত আরণ্যকের রাঢ়াঙ-এও রূপায়িত সে বীরগাথা।
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আর প্রীতিলতা-সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন – বাঙালি বিক্রমের দুই মহাকীর্তি। জয়-পরাজয় সেখানে তুচ্ছ, বীর্যবত্তায় অতুল অপার সে মহিমা! তিতুমীরের ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের সঙ্গে জমিদার-জোতদারবিনাশী প্রকল্পও ছিল। বাঙালি মনে এই দুই/তিন বীর নায়ক-নায়িকা চিরকালের পুরাণ-প্রতীকে প্রাতঃস্মরণীয়। যাত্রাপালা নাটকে তার রূপায়ণ হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি রেপার্টরি প্রযোজিত শোভনময় ভট্টাচার্য রচিত সূর্য সেন নাটক মঞ্চস্থ হয়।
‘আজ যা বাংলা ভাবে, কাল তা সারা ভারত ভাববে’ – একথা নিছক পিঠ চাপড়ানো ছিল না একদিন। উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষাদীক্ষায় প্রথম হাতেখড়ি বাঙালির। তা থেকেই শাসকের প্রতি দাস্য-বশ্যতা পার হয়ে স্বদেশানুরাগ, সংস্কার আন্দোলন তাকে নিয়ে যায় জাতীয়তাবাদী প্রাণনায়। উনিশ শতকের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় মেলা’য় তার উদ্বোধন ঘটে। তারপর যদিও অতীতচারিতায় সূচিত হয় সাম্প্রদায়িকতার বীজতলা – হিন্দু-মুসলমান উভয় তরফে। উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধি সাধারণ্যে মিলনের এক আবেগ সঞ্চার করেন। আজ তো বিশ্বজুড়েই তিনি রাজনৈতিক মহাপুরুষের মর্যাদায় আসীন। বাংলাদেশেও তাঁকে নিয়ে প্রযোজিত হয়েছে ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাটক মহাত্মা, রচনা ও নির্দেশনা : মাযহারুল হক পিন্টু। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন এক বাস্তব রাজনৈতিক পন্থা নির্দেশ করেছিলেন – হিন্দু-মুসলমানের বৈষম্য নিরসনে। ঐক্যবদ্ধতার একটা পরিপ্রেক্ষিত তাতে সূচিত হয়। তাঁর অকালপ্রয়াণে যদিও সে সম্ভাবনা যথাবিকশিত হতে পারে না। কংগ্রেসের মধ্যে নরমপন্থী-গরমপন্থী দুদলের অবস্থান ছিল। শ্রী অরবিন্দ-সিস্টার নিবেদিতা সশস্ত্র পন্থার পৃথিকৃৎ। বঙ্গভঙ্গ প্রবর্তন ও রদ নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্য প্রবল হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী উপেক্ষেত হয় রাজনীতিতে। নেতাজি সুভাষের কংগ্রেস সভাপতি পদগ্রহণ ও পদত্যাগ ভিন্ন মেরুকরণ গড়ে তোলে। অন্তরীণ অবস্থা থেকে তাঁর দেশত্যাগ ও বিদেশে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন জনমনে তুমুল আবেগ সঞ্চার করে। আইন অমান্য আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠে। তার মধ্যে ‘পাকিসত্মান প্রসত্মাব’ রাজনীতিতে অন্তর্ঘাত ঘটায়। তার ফলে দেশভাগ, বাংলাভাগ অনিবার্য হয়। শেষ সময়ে অখ- বাংলা গঠনের প্রয়াস হিন্দু-মুসলমান উভয়ের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক ভাগ-বাটোয়ারা ক্ষমতা-অর্থনীতির হিসেবে ভেসেত্ম যায়।
যদিও নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযান বিপুল জাগরণ ঘটায় – হিন্দু-মুসলমান উভয় তরফে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তা নিয়ে কংগ্রেস-কম্যুনিস্ট পার্টির যৌথ প্রচারণা বিভ্রামিত্মও সৃষ্টি করে জনমনে। তবু নেতাজি সুভাষচন্দ্র মহানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ জনমনে – যদিও ব্যর্থ হন তিনি বিশ্বরাজনীতির অনিবার্য বাস্তবতায়। আমি সুভাষ বলছি যাত্রাপালায় নেতাজি বীর নায়কের মর্যাদায় আসীন। উৎপল দত্ত কল্লোল নাটকে আজাদ হিন্দ সমর্থক নৌবিদ্রোহের একচক্ষু বাম-বয়ান হাজির করেন। প্রযোজনার সে কৃতিত্ব গান্ধিদূষণে কলুষিত হয়। একালে শাহীন আক্তারের উপন্যাস স্মৃতি ছায়াপাতে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ অনুষঙ্গ উঠে এসেছে।
শেরেবাংলা-মওলানা ভাসানী একদা নায়কের মর্যাদায় আসীন ছিলেন জনমনে; হয়ে উঠেছিলেন মহানায়কোচিত প্রায়।
বাঙালি পতন-বন্ধুর-অভ্যুদয়ের ঐতিহাসিক অভিযান সফল হয় ১৯৭১ সালে – হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শ্রেষ্ঠ সে অর্জন বাঙালির। পলাশীর আম্রকাননে পরাজয়ের গস্নানি তার অদূরে মেহেরপুরের আম্রকাননে মুজিবনগরে জয় সূচিত করে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর পলাশী থেকে ধানমন্ডি নাটক তার জয়গাথা ও অনিবার্য ট্র্যাজেডির নাট্যভাষা। লোকনাট্য দলের লিয়াকত আলী লাকী রচিত ও নির্দেশিত মুজিব মানে মুক্তি নাটকে শুরু হয়েছে মহানায়কের মহাকীর্তির ধারণ-বয়ান। যাত্রারীতিতে অবশ্য দুই বাংলা মিলে অন্তত ১৩টি পালা মঞ্চস্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
সিরাজউদ্দৌলা থেকে নেতাজি হয়ে বঙ্গবন্ধু – বাংলা মহানায়কের এক ক্রমবিকাশ – যদিও ট্র্যাজেডি ঠেকানো যায়নি সে মহাকাব্যপ্রতিম জয়যাত্রায়। আজো তাই কি অপেক্ষায় আছে বাঙালি কবে নূরলদীনের কণ্ঠে ডাক আসে আবার ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’? নায়ক-মহানায়কের ঐতিহাসিক উত্থান বিনা আবার, আরেকবার জয়মুক্তির আস্বাদ মেলে কী করে! জাতীয় অবচেতন মনে তার প্রস্ত্ততি-প্রক্রিয়া কবে সম্পন্ন হবে চিরকালের বাঙালি মহিমায়, যাদের কেউ ‘দাবায় রাখতে পারবা না।’