আ মি মু ল এ হ সা ন
দক্ষিণ স্টকহোমের বন্দর এলাকা হামারবির নগর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৭ সালে যখন এর নির্মাণকাজ শেষ হবে তখন পঁচিশ হাজার অধিবাসীর আবাসনসহ মোট পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের থাকার ও কাজের সংস্থান হবে হামারবি অঞ্চলে। লেক হামারবি ঘিরে গড়ে ওঠা এই নতুন নগর স্থাপনার উৎসাহবিন্দুতে রয়েছে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক জল। আধুনিক এই লোকালয় ডিজাইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশগত পদ্ধতিকে। বিশ্লেষকরা বলেন, হামারবি-খিউস্তাদ একটি আধুনিক সিটি-ব্লকসমৃদ্ধ, মুক্ত অঞ্চল পরিকল্পনার নিদর্শন, যেখানে সুইডেনের প্রথাগত শহরের অভ্যস্ততার সঙ্গে মিশে আছে সূর্যালোক, জল আর সবুজের বিস্তৃতি। হামারবি-খিউস্তাদ আবাসিক এলাকা ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু উপাদানকে সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তা করা হয়েছিল। যেমন – ব্লকভিত্তিক অ্যাপার্টমেন্ট, গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং পথচারীবান্ধব পরিবেশ, পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ এবং সামাজিক যূথবদ্ধতা। নিশ্চিতভাবে হামারবি-খিউস্তাদ এখন ইউরোপের সবচেয়ে বড় নব্য নির্মিত নগর স্থাপনাশিল্প।
১. সিটি-ব্লক আবাসন : হামারবি-খিউস্তাদের অ্যাপার্টমেন্ট কেমন হতে পারে তা ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রথমে স্থপতিরা সুইডেনের ট্র্যাডিশনাল আবাসন ব্যবস্থার ওপর গবেষণা করেছেন। বৃহত্তর স্টকহোমের বারোটি উল্লেখযোগ্য আবাসনশৈলী তথা অ্যাপার্টমেন্ট প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করার পর তাঁরা হামারবির জন্য ব্লক ডিজাইন করেন। আবদ্ধ ব্লকের পরিবর্তে উন্মুক্ত ব্লককে বেছে নেওয়া হয়, যেন প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের প্রবাহে কোথাও প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয় সারা বছরের সূর্যপথের পরিক্রমা আর আলোর আপাতন কোণের নির্দিষ্ট সীমারেখা। ভবনের উচ্চতা নির্ধারণেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সকল উপাত্ত বিবেচনায় হামারবি-খিউস্তাদের ভবনসমূহের উচ্চতা ছয়তলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ব্লকের আকৃতি ‘ইউ’ শেপ করা হয়েছে। ‘ইউ’ শেপকে খানিক বক্রতায় স্থাপন করার মাধ্যমে এর অভ্যন্তরীণ খোলা উঠানে সারা বছর সূর্যালোক পাওয়া সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে ভবনের সব ফ্ল্যাট থেকে লেকের দৃশ্য অবলোকনেও কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকেনি। সবুজ অভ্যন্তরীণ উঠানে ডিজাইন করা হয়েছে ‘অ্যালটমেন্ট গার্ডেন’। এখানে অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরত প্রতিটি পরিবার তাদের নিজস্ব বাগানে ফুল, ফল ও সবজি চাষ করে। এভাবে পরিবারগুলোর অধিবাসীরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদিন না হলেও প্রতি সপ্তাহে যোগাযোগের সুযোগ পেয়ে থাকেন। প্রবল শীত পর্যায়ের জন্য প্রতি উঠানে একটি করে গ্লাসহাউস রয়েছে, যেখানে গ্রিনহাউসের আবহাওয়ার গাছপালা সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি মাসে একদিন হামারবি-খিউস্তাদের অধিবাসীরা তাঁদের অঞ্চল পরিচ্ছন্নতার কাজে নিজেরা কাজ করেন। নিজের এলাকা পরিচ্ছন্নতার এই প্রথা অবশ্য সুইডেনের সব লোকালয়ে বাধ্যতামূলক। এতে পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি নিজস্ব অঞ্চলের প্রতি ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা আর সামাজিক যোগাযোগের উন্মুক্ত সুযোগ ও পরিস্থিতি তৈরি হয়। বর্তমানে সুইডেন তাদের আবাসনের ধরন ও প্রকারভেদ নির্ধারণে নানা রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক গবেষণাকে গুরুত্ব দেয়। সামাজিক পরিস্থিতি আর জীবনযাপনের সংস্কৃতিকে ভৌত পরিবেশে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিটি আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে একসঙ্গে বসবাসের সুযোগ দেওয়াকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে মানুষের উপার্জনক্ষমতা ও পরিসরের চাহিদার সমন্বয়ের বিভিন্ন আকারের ফ্ল্যাট ডিজাইন করা হয়। কখনো দেখা যায়, অনেক নিঃসঙ্গ দম্পতির ফ্ল্যাটের কিচেনকে একটি কমন স্পেসে রাখা হয় যেন রান্নার আয়োজনের কাজটি একত্রে করার মাধ্যমে তাদের সামাজিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়, যা তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে। এভাবে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আবাসন প্রকল্পকে সাজানো হয়। হামারবি-খিউস্তাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সুইডেনের প্রতিটি আবাসন প্রকল্পে যৌথ ওয়াশিং স্পেস রাখা হয়, যেখানে অনেক পরিবার একসঙ্গে লন্ড্রি সার্ভিস পেতে পারে। হামারবি-খিউস্তাদে কমন লন্ড্রির পাশাপাশি ‘অ্যালটমেন্ট গার্ডেন’ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌথ কিচেন রাখা হয়েছে। ফ্ল্যাটের আকারের তারতম্য বিভিন্ন ধরনের পরিবারকে একসঙ্গে থাকার সুযোগ দিয়েছে। সব অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয়যোগ্য নয়, সুইডেনের হাউজিং প্রকল্পে বাড়ি ভাড়াভিত্তিক বসবাসকে নীতিগতভাবে সমর্থন করা হয়। এতে যেমন স্বল্প আয়ের মানুষরা সুন্দর ফ্ল্যাটে থাকতে পারে, একই সঙ্গে প্রকল্পের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে হাউজিং কোম্পানির দায়দায়িত্ব দীর্ঘ সময়ের জন্য থেকে যায়। আঞ্চলিক পরিবেশ সংরক্ষণে এই নিয়ন্ত্রণ কখনো কখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. গণপরিবহন ব্যবস্থা : পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করে বাস ও ‘লাইট রেল’ ব্যবস্থার মাধ্যমে হামারবির আশি শতাংশ অধিবাসীকে গণপরিবহনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। গণপরিবহনের এই সুলভ ও সহজপ্রাপ্যতা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেছে। রেল ও বাসের পাশাপাশি হামারবি-খিউস্তাদে রয়েছে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ফেরির ব্যবস্থা। এছাড়া যৌথভাবে গাড়ি ব্যবহার করার সুবিধাকে চিন্তা করে ‘কার পুল’ প্রথা প্রচলন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত চারশো পঞ্চাশটি পরিবার প্রয়োজনের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে গাড়ি ব্যবহার করছে। এছাড়া পাঁয়ে হাঁটার পথ ও সাইকেলের পৃথক লেন প্রতিটি রাস্তায় যাতায়াতকে নিরাপদ করেছে।
৩. সামাজিক সুযোগ-সুবিধা : ষাটের দশকের বিপুল জনপ্রিয় ‘আধুনিক স্থাপত্য ও পরিকল্পনা’র একটি প্রধান উপকরণ ছিল ‘জোন’ভিত্তিক নগরায়ণ। এই ধারণায় আবাসিক এলাকা, অফিস এলাকা, বিপণিবিতান, খেলাধুলার অঞ্চল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিবিধ পৃথক স্থাপনাকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় স্থাপন করা হতো। এর ফলে মানুষকে বিভিন্ন প্রয়োজনের জন্য অনেক বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হতো। আবার নির্দিষ্ট সময় পর বিভিন্ন স্থান একেবারে ফাঁকা হয়ে যেত। এতে অপরাধ সংঘটনের আশঙ্কা বেড়ে যেত। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের মতো সুইডেনও ‘আধুনিক পরিকল্পনা’র ‘জোনিং’ বিধিকে পরিত্যক্ত মনে করে। এর বিপরীতে ‘মিশ্র ব্যবহার’ভিত্তিক পরিকল্পনা অনেক বেশি কার্যকর এবং মানবিক বলে বিবেচিত হয়েছে। হামারবি-খিউস্তাদের অধিকাংশ ভবনই মিশ্র ব্যবহারের আওতাভুক্ত। ভবনের নিচের ফ্লোর ডে-কেয়ার, ফার্মেসি, মনিহারী দোকান, খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, ব্যাংক বা বাণিজ্যিক অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবাসিক প্রকল্পের সঙ্গে এসব সার্ভিস স্পেস থাকার কারণে অধিবাসীদের সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। সেই সঙ্গে অফিস সময়ের পর এই স্থানসমূহ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে না – ভবনের অধিবাসীদের অবস্থানই এর নিরাপত্তা বিধান করছে। বিপরীতভাবে সারাদিন এই সকল প্রতিষ্ঠানে, রেস্তোরাঁয় মানুষের যাতায়াতের কারণে এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে। হামারবির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকেও বিভিন্ন প্রয়োজনে অধিবাসীরা আসা-যাওয়া করছে, যা অঞ্চলভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের স্থান হিসেবে কাজ করছে। সাধারণত প্রতিটি এলাকার শিক্ষার্থীরা ডে-কেয়ার, প্রি-স্কুল এবং আমাদের মাধ্যমিক মান পর্যন্ত স্কুলের সুবিধা নিজস্ব এলাকায় পেয়ে থাকে। সব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ও পদ্ধতি সমান, তাই এক এলাকার শিক্ষার্থীরা অন্য এলাকায় যায় না। হামারবি-খিউস্তাদে এই স্কুল সুবিধার পাশাপাশি নানাবিধ অফিস, ব্যাংক ও রিটেইল শপ রয়েছে, যেখানে এই অঞ্চলের অধিবাসীরাই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা তাদের দূর-দূরান্তে যাতায়াতের প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে, যা পুরো স্টকহোমের ট্রাফিক ব্যবস্থায় কার্যকর অবদান রেখেছে। কাজের জায়গার পাশাপাশি এখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্থান, খেলার মাঠ, শীতকালে শীতভিত্তিক খেলাধুলার সুবিধা। হামারবির সিকলা এলাকায় নির্মিত হয়েছে একটি লাইব্রেরি। লুগনেট অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ভবন ও থিয়েটার হল। হামারবির কেন্দ্রস্থলে একটি আধুনিক চার্চ ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। এর পাশেই রয়েছে ‘গ্লাসহুসেট’, যেখানে এই অঞ্চলের নির্মাণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর নানা রকম তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তা এই অঞ্চলের তথ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি ভবন, পথ ও গণপরিবহন ব্যবস্থায় শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে।
৪. পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : হামারবি-খিউস্তাদের প্রতিটি ভবন পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করে। এ অঞ্চলে মূলত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও জলস্রোতকে ব্যবহার করে উৎপন্ন বিদ্যুতের ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রতিটি ভবনের রান্নাঘরের বর্জ্য বা জৈব বর্জ্য একটি স্থানে জমা করে তা জৈবসার এবং জৈব তেলে রূপান্তরিত করা হয়, যা কৃষিক্ষেত্র এবং ‘হিটিং অ্যান্ড পাওয়ার প্লান্টে’ ব্যবহৃত হয়। কাগজ, কাচ ও টিন পুনর্নবায়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে নতুন দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। টয়লেট ও কিচেনের সাধারণ পানি, বৃষ্টির পানিকে পর্যায়ক্রমে ইকুইজারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে এবং সেডিমেন্টেশনের মাধ্যমে পরিশ্রুত করে পার্শ্ববর্তী লেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। লেক ম্যালারেনের এই পানিই আবার প্রতিটি বাড়িতে ‘ড্রিংকিং ওয়াটার প্লাটে’র মাধ্যমে ফিরে আসে। টয়লেট-বর্জ্য ‘ট্রিটমেন্ট প্লান্টে’র মাধ্যমে বায়োগ্যাস ও বায়োসলিডে রূপান্তরিত করা হয়। বায়োগ্যাস গণপরিবহনের শক্তি হিসেবে কাজ করে আর বায়োসলিড জৈবসার হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে চলে যায়। এছাড়া দহনযোগ্য সব উপাদান ‘হিট অ্যান্ড পাওয়ার প্লান্টে’ দাহ্য করা হয়, যা জ্বালানি শক্তি হিসেবে প্রতিটি ঘরে সরবরাহ করা হয়। বৈদ্যুতিক উপকরণ চালানো ছাড়াও এই শক্তি ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে ‘ডিস্ট্রিক্ট হিটিং’ ও ‘ডিস্ট্রিক্ট কুলিং’য়ের মাধ্যমে হামারবি-খিউস্তাদের ভবনসমূহের তাপমাত্রা সহনীয় মাত্রায় রাখা হয়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিপুণ এই পদ্ধতির জন্য প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে কিছু ‘গার্বেজ শুট’ রাখা হয়েছে। এসব শুট যথাক্রমে সাদা, নীল ও সবুজ রঙের, যা নবায়নযোগ্য বর্জ্য, জৈববর্জ্য ও নবায়ন-অযোগ্য বর্জ্যকে প্রথমেই পৃথক করে। অধিবাসীরা নির্দিষ্ট ধরনের বর্জ্যকে নির্দিষ্ট ‘শুটে’ রেখে দেন। পরবর্তী কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং নগর মিউনিসিপ্যালিটি দ্বারা পরিচালিত হয়।
৫. জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ : স্টকহোম ২০১০ সালে ‘ইউরোপের সবুজতম শহর’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা ‘পৃথিবীর সবুজতম শহর’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী। এই স্বপ্ন সামনে রেখে স্টকহোমের প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটি কাজ করে চলেছে। নগর পরিকল্পনার একটি আবশ্যকীয় শর্ত হলো, প্রতিটি কমিউনিটি বা লোকালয়ের অধিবাসীরা যেন দশ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে একটি মাঝারি আয়তনের সবুজ অঞ্চলের দেখা পায়, আর ত্রিশ মিনিটের দূরত্বে একটি বড় সবুজ বনভূমিসদৃশ অঞ্চলের সংস্পর্শে আসতে পারে। হামারবি-খিউস্তাদ এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে খানিক দূরত্ব পর পর সবুজ বনবীথি রাখা হয়েছে। সংরক্ষণ করা হয়েছে অত্যন্ত দুর্লভ ও শতবর্ষীয় গাছ। গাছের গায়ে বিভিন্ন রঙের চিহ্ন দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা কী মাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। সমগ্র অঞ্চলের সবুজ আবার বিভিন্ন প্রস্থের করিডর দ্বারা সম্পর্কিত। হামারবি অঞ্চলের সামগ্রিক সবুজ আবার বৃহত্তর স্টকহোমের সবুজের সঙ্গে সংযুক্ত। এই ‘বায়োডাইভারসিটি করিডরে’র মধ্য দিয়ে সবুজের সংযুক্তির ব্যাপারটি ঘটে, যার ফলে বিভিন্ন ছোট প্রাণী, কাঠবিড়ালি, খরগোশ, এমনকি হরিণও লোকালয়ের কাছাকাছি চলে আসতে পারে এবং নিজস্ব চলাচলের ও বসবাসের নিরাপদ স্থান খুঁজে পায়। এইসব সবুজের বিস্তারে নানারকম পাখি, প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ বসবাস করে, যা সামগ্রিক পরিবেশকে সজীব ও নিরাপদ করে রাখে। হামারবির সংরক্ষিত সবুজ অঞ্চলে কোনো গাছ মরে গেলে তাকে ‘ট্রাংক গ্রেভইয়ার্ড’ নামে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করে রাখা হয়। মৃত গাছের বাকলে বাসা বাঁধে নানা প্রজাতির ছোট ছোট পোকামাকড়। পাখির খাদ্য আর মাটির উর্বরতার জন্য তাদের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন প্রাণী, পাখি আর পতঙ্গের বর্ণনা হামারবির বনাঞ্চলের সামনে বেশ কিছু বোর্ডে ডিসপ্লে করা হয়েছে – যা থেকে অধিবাসীরা এই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে পারে।
এইভাবে পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আর পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে সুইডেনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী নগর স্থাপনা হামারবি-খিউস্তাদকে নির্মাণ করা হয়েছে। কেবল বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের নির্ভরতা নয়, এখানে সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনীতি আর মনস্তাত্ত্বিক প্রকরণকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পথের দুপাশে, পার্কে, খোলা প্রাঙ্গণে শিল্পীরা নানা ধরনের ম্যুরাল, ভাস্কর্য আর স্ট্রিট আর্ট নির্মাণ করেছেন। স্থপতি, শিল্পী, পরিকল্পনাকারী আর রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন সাধারণ অধিবাসীরা। তাদের প্রত্যেকের মত প্রকাশের জন্য পাবলিক মিটিং এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। এই সকল কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্টকহোম মিউনিসিপ্যালিটি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছে।
১৯৯০ থেকে এর কর্মপরিকল্পনা শুরু হয়, যা ২০১৭ সালে সম্পূর্ণভাবে শেষ হবে। এর মাঝে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন হামারবি-খিউস্তাদের ডিজাইনে যে প্রভাব রেখেছে তা এর কর্মকাণ্ডকে কখনই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনকে আত্মস্থ করার সপক্ষে কাজ করেছে। বিশেষজ্ঞরা এই নগরায়ণকে মনে করেছেন ‘হিউম্যান সেন্টারড ডিজাইন’, যেখানে মানুষকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এর সমার্থক রূপে পরিবেশ-বন্ধুতাকে উপজীব্য করা হয়েছে। বিশ্বমানের প্রযুক্তি আর স্থপতি/ পরিকল্পনাকারীদের যৌথ নির্মাণকল্প হামারবি-খিউস্তাদকে মানুষ আর পরিবেশের যূথবদ্ধ আবাসভূমে পরিণত করেছে। দীর্ঘমেয়াদি এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর পেশাজীবীদের কার্যকর পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
একটি বিচ্ছিন্ন স্থাপনা নয়, কিংবা একটি পৃথক আর্ট অবজেক্ট নয়, নগরের সুচারু স্থাপনা মানুষের সম্মিলিত যাপনেরই শিল্পিত উদ্যাপন। এখানে বিচ্ছিন্ন মানুষের ক্ষণিকের রুচিøিগ্ধতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রতিদিনকার জীবনের ছোট ছোট উপলক্ষ আর কার্যপ্রকরণ। দিনের ব্যস্ত যাপন, বাড়ি ফেরা – অবসরকাল, আবার পরদিনের সকাল – জীবনযাপনের এই আটপৌরে বিন্যাসকে সুচারু করে রাখার সহজ প্রত্যয় থেকেই নগর নির্মাণকল্পের সূচনা। হামারবি-খিউস্তাদ এই সহজ প্রকরণ থেকে আরো অনেক দূর অগ্রসরমান। শুধু ইউরোপ নয় – সুইডেনের হামারবি এখন সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আবাসন প্রকল্পের একটি উল্লেখযোগ্য দিকনির্দেশনা।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011