প্র ণ ব র ঞ্জ ন রা য়
বিস্ময়করভাবে কর্মঠ ছিলেন সোমনাথ। সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত অক্লান্ত কর্মী ছিলেন তিনি। অথচ শক্ত-সমর্থ পুরুষ বলতে যে শরীরের কল্পনা আমরা করি তা কোনোদিনই তাঁর ছিল না। বরাবরই ছিলেন নির্মেদ, প্রায় পেশিহীন, শক্ত হাড়ের মানুষ। তাঁর অনেক ছবি আর মূর্তির চরিত্রের মতনই। তবে আপাত মিল সত্ত্বেও তাঁর চরিত্রগুলোকে আত্মপ্রতিকৃতিমূলক মনে করলে বোধহয় ভুল করা হবে। কারণ তাঁর চরিত্ররা যে পারিপার্শ্বিক অবস্থার শিকার, তিনি নিজে ঠিক কখনো সে অবস্থায় পড়েননি। তবে কৈশোরে পিতৃহীন, প্রথম যৌবনে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী সোমনাথের যৌবন যে সুখে কাটেনি, স্বাস্থ্যের দিকে তিনি যে নজর দেবার সময় পাননি সে-সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে বার্ধক্যে পৌঁছে তাঁর শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে আসতে থাকে। সত্তর বছর বয়সের পর থেকে তিনি প্রায়শই শরীরের ভেতরে, চিকিৎসা সত্ত্বেও, বেড়ে চলা রোগের আক্রমণে অসুস্থ হতে থাকেন।
আশির দশকের শেষেই ধরা পড়েছিল তাঁর মারক রোগ। অকুপেশনাল হ্যাজার্ড। বহুকাল ধরে এচিং আর ডিফারেন্সিয়াল ভিসকসিটি মাল্টিকালার প্রিন্টমেকিংয়ে, কিয়ৎ পরিমাণে লিথোগ্রাফে আর ভাস্কর্য-বস্তুকে মসৃণতা দিতে, নাইট্রিক আর সালফিউরিক এসিডের ব্যবহার করেছিলেন কোনো ধরনের প্রতিষেধক ছাড়াই। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে এসিডের বাষ্প প্রবেশ করেছে তাঁর শ্বাসনালিতে, ফুসফুসে। সেই এসিড বহুদিন ধরে শ্বাসনালিতে ঘা সৃষ্টি করেছে। এচিং প্লেটের, পাল্প-প্রিন্টের ক্ষতের মতনই সেই ঘা। সেই ঘা মাঝে মাঝে বিষিয়ে উঠেছে। তার থেকে রক্তক্ষরণ হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সাময়িক রক্তক্ষরণের চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু ব্রঙ্কোস্ট্যাসিস সারবার নয়। ক্রমশ আক্রমণের কাল-ব্যবধান ছোট হয়ে এসেছে। আক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে চলৎশক্তি হারিয়েছেন, গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন। আস্তে আস্তে চলশক্তিরহিত হতে হতে ২০০০-এর পর থেকে ভাস্কর্য-কর্ম করার শক্তি হারান। তারপর থেকে ২০০৬-এ মৃত্যু পর্যন্ত ড্রইং ছাড়া আর কিছু করার মতন শারীরিক শক্তি সোমনাথের ছিল না। একদা কর্মঠ সৃজন-কর্মীর এই শারীরিক অবস্থা যখন তাঁর শুভানুধ্যায়ী বন্ধুজনের এতটাই অসহ্য হয়ে উঠেছে, যখন তাঁরা তাঁদের শ্রদ্ধেয় আর প্রিয় শিল্পীর যন্ত্রণা-মুক্তির কামনা শুরু করেছেন, তখনই ২০০৬-এর ৬ অক্টোবর ঘটলো সোমনাথ হোরের কাক্সিক্ষত রোগবন্দিদশামুক্তি, যন্ত্রণামুক্তি। রেখে গেলেন স্ত্রী রেবা, একমাত্র সন্তান চন্দনা আর অসংখ্য গুণমুগ্ধকে।
শান্তিনিকেতন কলাভবন, বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সোমনাথের মানসিক যোগ ছিল তিন ধরনের। প্রাথমিক যোগাযোগ হয় ব্যক্তি-শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়। ১৯৫১-তে আত্মগোপন পর্ব থেকে বেরিয়ে আবার শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করছেন যখন, তারই পরে সোমনাথের সঙ্গে বিনোদবিহারীর যোগাযোগ হয়। তাঁরই মধ্যস্থতায় সম্ভবত নন্দলাল বসুর সঙ্গেও একটা যোগাযোগ ঘটে থাকতে পারে। কারণ ১৯৫২-তে ছাত্রপ্রতিম সোমনাথকে লেখা একটা চিঠিতে দেখি – নন্দলালের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য চিত্তপ্রসাদ সোমনাথকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। তবে মনে হয়, ব্যক্তিগত স্তরের এই যোগাযোগ তখন স্থান ও প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়নি। দিল্লি আর্ট কলেজে থাকার সময়ে দিনকর কৌশিকের সঙ্গে যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে আমরণ স্থায়ী হয়, তারও সূত্র কিন্তু নন্দলাল-বিনোদবিহারী সম্পর্কে দুজনের ধারণার সমতা।
১৯৬৬-৬৭-তে কলাভবনে যোগ দেবার পর সোমনাথ কলাভবনের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নের প্রতিটি কাজে অধ্যক্ষ বন্ধু দিনকর কৌশিককে সাহায্য করে গেছেন। কিন্তু কৌশিকের অবসরের পরে অধ্যক্ষর দায়িত্ব নিতে চাননি। সম্ভবত তাঁর সৃজনশীল কাজ তাতে ব্যাহত হবে, এই ভেবেই। কিন্তু কলাভবনের উন্নয়নের জন্য নেওয়া প্রতিটি নতুন প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিপদগ্রস্ত ছাত্রদের আপৎকালীন সাহায্যের জন্য তহবিল গড়ে তোলার জন্য বার্ষিক নন্দনমেলার পরিকল্পনা আর আয়োজনে সোমনাথ তাঁর সহকর্মী অজিত চক্রবর্তীকে প্রয়োজনাতিরিক্ত সাহায্য জুগিয়েছিলেন। আজকে, কলাভবনের বার্ষিক নন্দনমেলা (নন্দলাল বসুর জন্মদিন উপলক্ষে পয়লা আর দোসরা ডিসেম্বর কলাভবনের চৌহদ্দিতে বসে) বিশ্বভারতীর বর্ষপঞ্জির অন্যতম উৎসব। কর্মজীবনের শেষ পর্বে এসে সোমনাথ কিছুকালের জন্য কলাভবনের অধ্যক্ষর দায়িত্বভারও সামলান। ১৯৮৩-তে অবসরগ্রহণের পর, এক বছরের জন্য তাঁকে অধ্যাপক পদে বহাল রাখা হয়। কিন্তু ওই এক বছরের জন্যই। বিশ্বভারতীর তদানীন্তন কর্তৃপক্ষ এই ভারতবিখ্যাত শিল্পী ও সার্থক শিক্ষককে এমেরিটাস অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করার কথা চিন্তাই করেননি বলে তাঁর মনে একটা চাপা ক্ষোভও ছিল। কিন্তু সেই ক্ষোভ কলাভবনকে তাঁর প্রথম বাসগৃহদানের অন্তরায় হয়নি। কলাভবনের ছাপাইছবি বিভাগ নিজের কাজে সেই গৃহ ব্যবহার করবে এই মাত্র শর্তে সোমনাথ তাঁর লালবাঁধের পুরনো গৃহদান করে, অবনপল্লীর নতুন বাড়িতে যান। নতুন বাড়িতে যখন যান তখন সোমনাথ বেশ অসুস্থ। তার কিছুদিন আগেই বেশ দীর্ঘ চিকিৎসার পরে কলকাতার পিজি হাসপাতাল থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে গেছেন। চিকিৎসার জন্য তাঁর কলকাতায় থাকাই ভালো হতো। পারলে চেষ্টাচরিত্র করে কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্যও ততদিনে তাঁর হয়েছে। কিন্তু সেসব কিছু না করেই, শান্তিনিকেতনেই অপেক্ষাকৃত ভালো আরেকটি গৃহ নির্মাণ করেন। শান্তিনিকেতনে চিকিৎসার অভাব তাঁর সেখানে থাকার ইচ্ছাকে টলাতে পারেনি। কলাভবন, বিশ্বভারতী এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জীবনের শেষ কুড়ি বছর তাঁর বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। অনমনীয়, জেদি, একগুঁয়ে সোমনাথের সঙ্গে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক এবং পুরনো সহকর্মীদের (যাঁরা অনেকেই সোমনাথ দ্বারা উপকৃত ছিলেন। এমনকি কারো কারো চাকরি তো সোমনাথের ইচ্ছাতেই হয়েছিল) সম্পর্ক শেষ দিকে আর সহজ ছিল না। শান্তিনিকেতন-পর্বে সোমনাথের সঙ্গে যে তিনজন পারস্পরিক গুণগ্রাহীর সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছিল তাঁদের মধ্যে দিনকর কৌশিকের কথা আগে কয়েকবারই বলা হয়েছে। দ্বিতীয়জন – কল্পাতি গণপতি সুব্রাহ্মণ্যনের সঙ্গে সোমনাথের প্রথম পরিচয়, দিল্লি থেকে বরোদায় কয়েকবার যাতায়াতের সময়ে। সে আলাপেও পরোক্ষ সেতু বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। মানি সুব্রাহ্মণ্যন প্রথমে যখন বরোদা থেকে কলাভবনে এক বছরের জন্য সাম্মানিক অধ্যাপক হিসেবে এলেন তখন পরিচয় গাঢ় হলো। তারপর সুব্রাহ্মণ্যন যখন পাকাপাকিভাবে শান্তিনিকেতনে বাস করতে এলেন তখন তা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হলো। যশস্বী নকশাশিল্পী (ডিজাইনার) ঋতেন মজুমদার শান্তিনিকেতনে বাস করতে এলেন সোমনাথের অবসরগ্রহণের বেশ কিছুকাল পরে। দিল্লিতে থাকাকালে ওঁরা পরস্পরকে চিনতেন মাত্র। সেই পরিচয় শান্তিনিকেতনে সহজ বন্ধুত্বে পরিণত হয়।
শান্তিনিকেতনে – বিশ্বভারতীর আওতার বাইরে, অন্য কয়েক ধরনের সম্পর্ক থেকে সোমনাথ সহজ আনন্দের উপকরণ সংগ্রহ করে নিতে পারতেন। সোমনাথ যখন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক-আবাস ছেড়ে, মধ্যবিত্তের শান্তিনিকেতন ছেড়ে, লালবাঁধ গ্রামে বাসগৃহ আর কাজের জায়গা বানালেন, তখন ওই গ্রামে সেটাই হলো প্রথম পাকা বাড়ি। ওর প্রতিবেশী হলেন কিছু বিহার থেকে আসা জবরদখলকারী শ্রমজীবী, অল্প কয়েকঘর আদি বাসিন্দা শ্রমজীবী সাঁওতাল আর কয়েক ঘর অন্ত্যজ-বর্গীয় পরিবার। কয়েকটি গ্রীষ্মে শুকিয়ে যাওয়া অগভীর কুয়ো ছাড়া জলের জন্য ছিল পচা-জলের লালবাঁধ। যাতে গ্রীষ্মকালে জল থাকতো না বললেই হয়। ১৯৭৭-এ সোমনাথ এলএন গুপ্তা মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পেয়ে, সে পুরস্কারলব্ধ অর্থের অর্ধেক দিয়ে, গ্রামের সাধারণের যাতায়াতের রাস্তার ধারে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য একটি টিউবওয়েল বসান। দুবছর পরে টিউবওয়েলটি যখন অচল হয়ে পড়ে, তখন গ্রামের লোক নির্বিকার থেকে বলেন, জলের কল বসিয়ে সোমনাথবাবু পুণ্য অর্জন করেছেন। অতএব, সেটাকে সচল করে রাখার দায়িত্বও তাঁরই। লালবাঁধ বিশ্বভারতীর জমিতে। তার রক্ষণাবেক্ষণ আর সংস্কারের দায়িত্বও মূলত বিশ্বভারতীর। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত বিভাগ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করে। আশপাশের গ্রামের আর বস্তির লোকেরা যথেচ্ছ ব্যবহার করে, আগাছা জমতে দিয়ে এই গভীর বাঁধকে পচা-দিঘিতে পরিণত করে। সোমনাথ আর তাঁর নতুন প্রতিবেশী ভাস্কর ও লোকশিল্পবেত্তা প্রভাস সেন (সোমনাথের কিছু পরেই লালবাঁধ গ্রামে একটা মাটির দোতলা বাড়ি করে বাস করতে থাকেন) নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে বাঁধের সংস্কার করান। তাঁর নিজের ধাতু-ঢালাই ভাস্কর্যের কাজে সহায়তা করার জন্য আশপাশের গ্রামের কারিগর পরিবারের কয়েকটি ছেলেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাতে তাদের রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছিল। আজকে তাদের কয়েকজনই মোম-নিষ্কাশনী পদ্ধতিতে ধাতু-ঢালাই করার সুদক্ষ কারিগর। তাদের দু’একজনকে দিয়ে অসাধু ব্যবসাদাররা নকল সোমনাথ, নকল রামকিঙ্কর ভাস্কর্যও বানিয়ে নেন বলে শোনা যায়।
সোমনাথ জীবিত থাকলে হয়তো তাঁর অন্য আরেকটি গুণের উল্লেখ তাঁকে বিব্রত, এমনকি বিরক্তও করতে পারতো। কিন্তু এখন তিনি যখন আর নেই, তখন তাঁর মহত্বের এই দিকটির অনুল্লেখ অনুচিত হবে। তিনি অর্থসংকটে বিপর্যস্ত তাঁর প্রিয়জনদের সাধ্যমতো অর্থসাহায্য অকাতরে করে গেছেন। বোম্বাইতে চিত্তপ্রসাদ প্রায়শই অর্থকষ্টে পড়তেন, আর অসুস্থ হয়ে তিনি যখন কলকাতায় ফিরে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছেন, তখন সোমনাথ নিয়মিতভাবে সাহায্য জুগিয়ে গিয়েছেন। সোমনাথের এমন একজন অশিল্পী গুণমুগ্ধ প্রিয়জনকে বোধহয় পাওয়া যাবে না যিনি তাঁর কাছ থেকে প্রীতি-উপহার হিসেবে তাঁর একটি শিল্পকর্মও পাননি।
কিন্তু না। শুধু এই সব ব্যক্তিগত গুণের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন না। সেটা তাঁর কাম্যও ছিল না। কী কারণে সোমনাথ হোর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার জন্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর শিল্পকর্মের তাৎপর্য বিশ্লেষণ দরকার।
কেন সোমনাথ হোর
সোমনাথ হোরের শিল্পকর্ম কী গুণে আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলায় বিশিষ্ট স্থান দাবি করে? কী গুণে জনমানসে (অবশ্যই, রসিকমানসে) তাঁর কলাকাজ স্থায়িত্ব পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে! অর্থাৎ ভারতের আধুনিককালের দৃশ্যকলা সংস্কৃতিতে সোমনাথ হোরের সর্জন-কর্মের তাৎপর্য কী? সে প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে শিল্পী হিসাবে কী গুরুত্ব তাঁকে দিতে হয়। এর সঙ্গে এটাও বিবেচ্য, জগৎ-জীবন সম্পর্কে নিজের ধ্যান-ধারণায় অবিচল নিষ্ঠা নিয়ে, সুযোগ হওয়া সত্ত্বেও, জাগতিক সব রকম প্রলোভনকে উপেক্ষা করে, শিল্পসর্জনে তন্ময় থাকতে পেরেছেন কেমন করে!
সোমনাথের সারা জীবনের কাজ যদি গোনা যায় তবে দেখা যাবে ড্রইং আর স্কেচই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। সেটা এমন কিছু ব্যতিক্রম নয়। অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই কথাটা খাটে। তবে সোমনাথের ড্রইংয়ের যেটা বিশেষত্ব, তা হলো সোমনাথের অনেক ড্রইং-ই ঠিক দৈনিক রেওয়াজের মতন অভ্যাসের ফসল নয়, মামুলি নয়। শুধু চাক্ষুষভাবেই তাঁর অনেক ড্রইং আর স্কেচই প্রায় তাঁর উড-এনগ্রেভিং, উডকাট, এচিং, আর এনগ্রেভিং প্রিন্টের মতন। অনেক ড্রইং আবার যেন তাঁর ব্রোঞ্জের মূর্তির দ্বিতলমাত্রিক সংস্করণ। সোমনাথের ড্রইং অনুসরণের আদর্শ হতে পারে না – এ-কারণেই যে সেসব ড্রইং ভাবনাদ্বারা, কল্পনাদ্বারা,
চিন্তাদ্বারা রূপান্তরিত জীববিম্ব, যেসব বিম্বে বস্তু আর ধারণার আদলটিমাত্র যুগপৎ ধরার ইচ্ছাই অভিব্যক্ত হচ্ছে। আধুনিক ভারতীয় দৃশ্যকলায় ড্রইং সম্পর্কে এবম্বিধ ধারণার প্রকাশ যে শুধু সোমনাথের ড্রইংয়েই দেখি তা নয়, তবে যাঁদের কাজে দেখা যায় সোমনাথ তাঁদের অন্যতম প্রধান। অনেকে হয়তো বলবেন, রেখায় শারীর সংস্থান, অনুপাত, বিশেষ করে সচল শরীরের অঙ্গ-সংস্থান দক্ষতার সঙ্গে চাক্ষুষ করার ক্ষমতা তাঁর ড্রইংকে এই অনন্যতা দেয়। কিন্তু তা তো ধারণারই কৌশলী প্রকাশ মাত্র।
সংখ্যা গোনায় ড্রইং আর স্কেচের পর সোমনাথের সবচেয়ে বেশি কাজ ছাপাইছবিতে। তাঁর শিল্পীজীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম পর্বে ছাপাইছবির কাজই ছিল তাঁর প্রধান কলাকর্ম, যাতে তিনি তাঁর কাজের দিনের বেশির ভাগ সময় দিয়েছেন। সোমনাথ ছাপাইছবির প্রায়
সর্বমাধ্যম পারঙ্গম শিল্পী। কাঠখোদাই (উডকাট) আর কাষ্ঠ তক্ষণ (উড-এনগ্রেভিং) করে রিলিফ পদ্ধতিতে ছবি ছাপাই করে তাঁর শিল্পীজীবন শুরু। তার পরও আরেকবার কাঠের ব্লকের ছাপে ফিরে গিয়েছিলেন। প্রথম পর্বের কাষ্ঠ তক্ষণ আর কাঠখোদাই-ছাপাই উপাদানের ব্যবহারে আর প্রকরণের দিক থেকে নিয়মনিষ্ঠ মাধ্যম-অনুগত নির্মাণ। পরে যখন আবার কাঠের ব্লকের ছাপে ফিরলেন, তখন প্লাই-প্ল্যাঙ্কে কাজের উপযোগী প্রকরণ তৈরি করে নিলেন। সঙ্গে স্টেনসিলও ব্যবহার করলেন। ফলে ছাপাইটা হলো রিলিফ পদ্ধতির সঙ্গে স্টেনসিল পদ্ধতির মিশ্ররীতি। এই উদ্ভাবনী চিন্তাই ছাপাইছবির চিত্রকর হিসেবে সোমনাথকে বিশিষ্ট করে তোলে।
একেবারে যেন ছাপাইছবির বিবর্তনের ইতিহাস অনুসরণ করেই রিলিফ পদ্ধতিতে ছাপাইয়ের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পরই সোমনাথ ইনতাল্লিও পদ্ধতিতে ছবি ছাপাইয়ে মন দিয়েছিলেন। আর সাদা-কালোয় কাজ করার পরে রঙিন ছবি ছেপেছিলেন। তবে ইনতাল্লিও পদ্ধতিতে কাজ শুরুটা ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে প্রথমে এনগ্রেভিং ও ড্রাই-পয়েন্ট না-করে সরাসরি এচিংয়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর রঙিন এচিং বিষয়ে আলোচনায় আমরা দেখেছি, যে পদ্ধতি-প্রকরণে তিনি এগুলো নির্মাণ করতেন – কী করে বই পড়ে তা আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। তাছাড়া বুনোটের আর বর্ণচ্ছায়ের বৈভবের জন্য তিনি কিছু স্বোদ্ভাবিত কৃৎকৌশল ব্যবহার করতেন; যার বিশদ বিবরণ এখানে অপ্রয়োজনীয়; তবু এটা বলা হলো সোমনাথের প্রকরণিক উদ্ভাবনী শক্তির কথা আরেকবার মনে করার জন্য।
ছাপাইছবির বিশ্বজোড়া ইতিহাসের ক্রম যেন অনুসরণ করেই, সোমনাথ তার পরে প্লেনোগ্রাফিক পদ্ধতিতে লিথোগ্রাফ ছেপেছেন। আগে সাদা-কালো, পরে রঙিন (যদিও সাধারণত দুরঙে)। লিথোগ্রাফের আত্যন্তিক চরিত্রানুসারে পুঞ্জপ্রধান বিম্ব এঁকেছেন। রেখার ব্যবহার থাকলেও সে রেখা হয়েছে পুঞ্জচারিত্র্যের।
কিন্তু ছাপাই পদ্ধতিতে শিল্পকলাবস্তু নির্মাণ করে, উদ্ভাবনী প্রতিভার যে সাক্ষ্য সোমনাথ তাঁর পাল্প-প্রিন্ট বা হোয়াইট অন হোয়াইটস অথবা ছাপাই ভাস্কর্যে রেখে গেছেন তার তুলনা ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলায় পাওয়া দুষ্কর। এই ছাপাই ভাস্কর্য শুধু উপাদান-ব্যবহার, প্রকরণ-কৃৎকৌশলগত অভিনবত্বের কারণেই উল্লেখযোগ্য তা নয়। তাৎপর্যময় এই কারণেই যে উপাদান ব্যবহার, পদ্ধতি-প্রকরণ, কৃৎকৌশলের এই সমাহার সোমনাথ ঘটিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির অনুভবেদ্য অভিব্যক্তির জন্য। বিষয়ভাবনা, অভিব্যক্তির ভাষা আর সেই ভাষা নির্মাণে অভিনব উপাদান ব্যবহার, পদ্ধতি-প্রকরণ আর কৃৎকৌশলের মেলবন্ধন একান্ত ব্যক্তিগত হবার কারণে অননুকরণীয়। অথচ সোমনাথের এ-সিদ্ধি ভারতীয় আধুনিকতার স্বাধিকার প্রমত্ততার অভিজ্ঞান।
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে ভারতে ছাপাইছবি নির্মাণ চলছে। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথম দশকে বিম্ব ও নকশা ছাপাইয়ের জন্য ফটোগ্রাফিক প্রসেস ব্লকের ব্যবহার শুরু হবার আগে পর্যন্ত বিম্ব আর নকশা ছাপাইয়ের জন্যই শুধু হাতে ছাপাই মাধ্যমগুলোর ব্যবহার হতো। লিখিত বয়ান চিত্রিত করা, দৃশ্যায়িত বার্তা প্রচার আর পূজ্যপ্রতিমার বিকল্প নির্মাণের জন্যই হাতে ছাপাইছবির প্রচলন ছিল। অন্নদাপ্রসাদ বাগচীর মতন দক্ষ লিথোগ্রাফারও মাধ্যমের শিল্পগুণ নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম শিল্পী যিনি ছাপাইছবির একটি বিশিষ্ট মাধ্যমের মাধ্যমগত অনুভব আর বার্তাবহনযোগ্যতাকে গুরুত্ব দিয়ে ছাপাইছবি নির্মাণ করে, ছাপাইছবিকে শিল্পকলার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেন – এ দেশে। তারপর অনেক শিল্পীই শিল্পকলাজ্ঞানে বিভিন্ন মাধ্যমে ছাপাইছবি রচনা করেছেন। নন্দলাল বসু লিনোকাটে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। বিনোদবিহারী আর রামকিঙ্কর অনেক মাধ্যমেই কাজ করেছেন। এমনকি অবনীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথও কিছু ছাপাইছবি রচনা করেছিলেন। কিন্তু এঁদের কারো কাজেই ছাপাইছবি আত্মপ্রকাশের মুখ্য মাধ্যম কখনই ছিল না। মুকুল দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সফিউদ্দীন আহমেদ, মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, হরেন দাস প্রমুখ প্রত্যেকেই একটি বা দুটি করে ছাপাই মাধ্যমে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন বলেই সেসব মাধ্যমে ছাপাইছবি তাঁরা সারা জীবন ধরে করেছেন। রমেন্দ্রনাথ ভারতে প্রথম রঙিন উডকাট করেন। কিন্তু প্রচলিত মাধ্যমগত কৃৎকৌশলের সাহায্যে প্রচলিত দৃশ্যভাষাতে বিবরণমূলক বড়জোর কথঞ্চিৎ বর্ণনাত্মক, চিত্র রচনার বেশি কেউই কিছু করেননি। কী দৃশ্যভাষায়, কী বিষয়ভাবনায় যুগপ্রসঙ্গ তাঁদের শিল্পকর্মে কদাচিৎ মূর্ত হয়ে ওঠে। যে অন্তর্তাগিদ থেকে শিল্পী প্রচলিত শিল্পভাষার রূপান্তর ঘটিয়ে, নিজস্ব ইডিয়মে, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধির অনুভবেদ্য রূপ দেন, সেই তাগিদ কৃষ্ণ রেড্ডির আগে আর কোনো ভারতীয় ছাপাইছবির নির্মাতার কাজে চাক্ষুষ করা যায়নি। বয়সের ক্রমে কৃষ্ণ রেড্ডির প্রায় সমসাময়িক, কিন্তু শিল্পে সিদ্ধিলাভের কালক্রমে কিঞ্চিৎ পরে আসা, সোমনাথের ছাপাইছবির শিল্পী হিসেবে সিদ্ধি সমধিক। কৃষ্ণ রেড্ডি শুধু নিজের উদ্ভাবিত (স্ট্যানলি উইলিয়ম হেটার এবং কায়কোবাদ মোতিওয়ালার সহযোগিতায়) ডিফারেন্সিয়াল ভিসকসিটি ইনতাল্লিও প্রিন্টিং অফ্ মালটিকালার এচিং পদ্ধতিতে, একই বিষয় নিয়ে, একই ধরনের ইমেজারিকেন্দ্রিক ছবি রচনা করে গেছেন সারা জীবন। দ্বিতীয় কোনো মাধ্যমে যাননি। অন্যদিকে স্টেনসিল মাধ্যম (যে মাধ্যমে সেরিগ্রাফি হয়) বাদ দিয়ে, সোমনাথ ছাপাইছবির সর্বমাধ্যম পারঙ্গম। সোমনাথেরও সারা জীবনের শিল্পকর্মের গভীর বৃহত্তর বিষয়টি (থিম) – চালিকাশক্তির মতন – এক থাকলেও, যেসব কল্পরূপকের বা ইমেজারির মারফত তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে রূপ-বৈচিত্র্যের অভাব ঘটেনি। সবচেয়ে যা তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো সোমনাথের দৃশ্যত প্রতিষ্ঠিত বিষয়-ভাবনা আর ভাষা-ভাবনার দেশ-কাল প্রাসঙ্গিকতা। এই স্বাভাবিক স্বপ্রণোদিত প্রাসঙ্গিকতা সোমনাথকে শিল্পী হিসেবে এমন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেয় যা ভারতে এতাবৎকাল কোনো ছাপাইছবির শিল্পী অর্জন করেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য, দৃশ্যকলার মাধ্যম হিসেবে – বাজার, ছাপাইছবির মাধ্যমগুলোকে ‘মাইনর মিডিয়া’ হিসেবে ধরার ফলে সোমনাথ অনেকাংশে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অবশ্য তাঁর ছাপাই-ভাস্কর্যকে একটা আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়।
যদিও সোমনাথ হোর শুধু একটি মাত্র মাধ্যমেই, মোম-নিষ্কাশনী পদ্ধতিতে ব্রোঞ্জ ঢালাই করে, তাঁর যাবতীয় ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, প্রাসঙ্গিক বিষয়ভাবনা-ঋদ্ধ এমন গভীর অর্থময় নিজস্বতা-নিহিত দৃশ্যভাষায় নির্মিত ভাস্কর্য, রামকিঙ্কর বেজের পর কেজি সুব্রাহ্মণ্যন, মীরা মুখোপাধ্যায় ছাড়া সোমনাথ হোরই করেছেন।
ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারোত্তর ভারতের দুর্ভাগ্য, ভারতীয় ভাস্কর্যের দীর্ঘ ঋদ্ধ উত্তরাধিকার সত্ত্বেও Ñ ঔপনিবেশিক আধুনিক পর্বে যে ভারতীয় ভাস্কর্যের উদ্ভব হলো তা হলো একান্তভাবে পরমুখাপেক্ষী। হ্মাত্রে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক ইলিউশনিস্টিক ন্যাচারালিজমের ভাষায় সনাতন হিন্দু ভারতীয় জীবনকে রূপ দেবার চেষ্টা করলেন, দেবীপ্রসাদ ইউরোপীয় নিওক্লাসিস্টি দৃশ্য-ভাষায় আধুনিক ভারতীয় সমাজ-রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ইলাস্ট্রেশনের একটা রীতি প্রবর্তন করলেন, যা সর্বতোভাবে বিবরণাত্মক। মাঝখানে রামকিঙ্কর বেজ এক প্রচণ্ড ব্যতিক্রম। তাঁরই সময়কাল থেকে, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিকতা-উত্তর আধুনিকতা বিকাশের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের ভারতীয় ভাস্কর্য ন্যক্কারজনকভাবে পশ্চিমি আধুনিকতাবাদী ভাস্কর্য অনুকারী। ভারতের মতন আর্থিক অনুন্নত দেশের, গোষ্ঠীসমাজভুক্ত শিল্পীর পক্ষে পশ্চিমি শিল্পীর মতন বিচ্ছিন্ন-অনিকেত ব্যক্তি না-হবার কারণে আধুনিকতাবাদী ভারতীয় ভাস্করের পক্ষে সংসার-সম্পর্কশূন্য বিম্ব নির্মাণ, সম্ভব না হলেও, বিম্ব নির্মাণ, এমনকি মানুষী-বিম্বনির্ভর ভাস্কর্য-বস্তু নির্মাণেও বিম্বকে পরিণত করা হলো সমস্ত জাগতিক অনুষঙ্গরহিত আকার-আকৃতিতে। আবয়বিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ হলো পারস্পরিক সংস্থাপনের বস্তু। রামকিঙ্করের পরে, প্রায় সমসময়ে কল্পাতি গণপতি সুব্রাহ্মণ্যন আর মীরা মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় লৌকিক ভাস্কর্যের চলমান ধারা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁদের নির্মিত বিম্বে জগৎ-সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিলেন। তাঁরা তাঁদের কাজে তাঁদের জাগতিক (যার মধ্যে কলা-জাগতিকও ওতপ্রোত হয়ে আছে) অভিজ্ঞতালব্ধ ভাবনাচিন্তার জগৎকেন্দ্রিক বর্ণনাত্মক রূপ দিলেন। এরা কাজ শুরু করার স্বল্পকালের মধ্যে ভাস্কর সোমনাথ হোরের আবির্ভাব। মানুষী-বিম্ব তাঁর ভাস্কর্যে আরেকবার তাঁর দেশ-কালকেন্দ্রিক জগৎ প্রসঙ্গে ফিরল। দেশ-কালে অবস্থিত মানুষের দশার অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভব, আর তার জারিত ভাবনাই সোমনাথের ভাস্কর্যের বিষয়-গৌরবের উৎস। নির্মাণের উপাদানের করণকৌশলে শিল্পী তাঁর নির্মিত বিম্বকে নিজস্বতা-চিহ্নিত যে ইডিয়মে ঘননিবদ্ধভাবে অর্থবোধক করে তুলেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য ও অতি প্রাসঙ্গিক। ভাস্কর হিসেবে আধুনিক ভারতে এ-সিদ্ধি রামকিঙ্কর ছাড়া অতি অল্প শিল্পীই অর্জন করতে পেরেছেন। ভাস্কর সোমনাথ না, ছাপাইছবির চিত্রকর সোমনাথ, কে বড় শিল্পী এ তর্কের মীমাংসা বোধহয় হবার নয়। তবে দুজনের স্থানই যে আধুনিক ভারত-শিল্পের ইতিহাসে তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।
দেখাই তো গেল জীবনের পাঠশালায় পাঠ আর তার পরে জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও ভাবাদর্শের পাঠ নিতে শুরু করার অনেকটা পরেই তাঁর কাক্সিক্ষত জীবনাদর্শকে ভাষা দেবার তাগিদেই শিল্পকলার পাঠশালাতে পাঠ নিতে যান সোমনাথ। ফলত শুধু শিল্পকলার দর্শন-অভিজ্ঞতা তার চেতনায় আর শিল্পে কদাচিৎ অগ্রাধিকার পেয়েছে। অথচ সারা জীবন ধরে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধির অনুভবেদ্য বার্তাবহতার জন্য উত্তরোত্তর বেশি করে দৃশ্যভাষার চর্চা করে গেছেন। ক্রমশ সে ভাষা বাহুল্যহীন হয়েছে, নির্মেদ হয়েছে, ঘনত্ব লাভ করেছে। আবার সংকেত-চিহ্নে পরিণত হবার ফলে অর্থ-ব্যাপ্তি পেয়েছে। সোমনাথের কোনো সার্থক শিল্পসৃষ্টিই অর্থ-নির্দিষ্ট করে না, একটা অর্থময়তার আবহ সৃষ্টি করে, অনেক সম্ভাব্য অর্থের ইঙ্গিত দিতে থাকে।
দেরি করে হলেও, শিল্পকলার পাঠ নিতে নিতে সোমনাথ উত্তরোত্তর যতই শিল্পকলার অন্দরমহলে ঢুকেছেন, দৃশ্যকলার ভাষার বাঁধনে নিজেকে জড়িয়েছেন, ভাষাকে নিজ ক্ষমতায় বাঁধার জন্য করণকৌশল প্রয়োগ করেছেন, ততই নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সচেতন হয়েছেন। এর ফলে নিঃশব্দে আরেকটা পরিবর্তন Ñ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনও ঘটে গিয়েছে। আত্মপ্রকাশের সচেতন কর্মে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে গিয়েছেন। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ থেকে হয়তো নয়। ব্যাপারটা আরো একটু বিশদে বলা দরকার। সোমনাথ শিল্পকর্মের জগতে এসেছিলেন কোনো গোষ্ঠী বা পরম্পরা কিংবা পারিবারিক উত্তরাধিকারের রেশ ছাড়াই। শিল্পকলার রাজ্যে প্রবেশ করেছিলেন তাঁর স্বেচ্ছানির্বাচিত দুঃখত্রাণের পথের দিশারী কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়োজনে। কমিউনিস্ট আন্দোলন সর্বতোভাবে ততদিনে নতুন জীবন গড়তে সক্ষমতার দাবি নিয়ে সাংস্কৃতিক-উৎপাদন বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি করে ফেলেছে। সেই ধারণায়, সলিল চৌধুরীর পঞ্চাশের দশকে রচিত একটি গানের কথায়, দলবদ্ধ ‘প্রতিবাদের ভাষা’র নিবদ্ধ ঘোষণা শোনা যায়, ‘প্রতিরোধের আগুন’ জ্বলে। তেভাগার ডায়েরির কিছু ড্রইং আর স্কেচে ওই দলবদ্ধ প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, উদ্দীপনার কিছু দৃশ্য বিবরণ পাওয়া যায়। এর পরও আরেকবার, ১৯৬৯-৭২-এর লাল-কালো লিথোগ্রাফে উদ্দীপ্ত প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের একটা চেহারা দেখা যায়। কিন্তু এটা আগের চেয়ে অন্যতর। প্রতিবাদী আর প্রতিরোধী এসব ছবিতে অনেকের প্রতিনিধিত্ব করলেও, একক মানুষই (হয়তো একাকী ব্যক্তিত্ব নয়) ছবির চরিত্র। কিন্তু বিম্বিত মানুষ কী সম্পূর্ণ জাগতিক মানুষই? এই লিথোগ্রাফগুলো যখন আঁকছেন, তখন সোমনাথ পরিণত চিত্রশিল্পী। তিনি যখন বহির্জাগতিক কোনো ঘটনা বা অবস্থাকে আত্মস্থ করেন, তখন তাঁর শিল্পীসত্তা দিয়েই তা করেন। ফলে এই গ্রহণ প্রক্রিয়াতে অবান্তর বিশদ বর্জনেরও একটা ভাগ থাকে। থাকে অভিজ্ঞতার উপলব্ধি ভাষায় প্রকাশের অভিপ্রায়। চাঁচাছোলা তীব্রতায় ভিয়েতনামের আর বাংলাদেশের সংগ্রামীদের সচল সকর্মক প্রতিবাদকে দৃশ্যভাষায় ধরতে, নির্মমভাবে বিশদহীন এমন সব ভঙ্গিমাময় চিহ্ন-নির্মিত মানুষী-বিম্ব তিনি আবিষ্কার করলেন যারা মানুষী চরিত্র না-হয়ে, হলো দুর্বার বেগে ধেয়ে চলা প্রতিবাদী আর প্রতিরোধী। তাদের অধিষ্ঠান শুধু সোমনাথের ছবিতে। জগতে নয়। জীবন ছবি হয়ে উঠলো। ছবিই। সংগ্রামী মানুষগুলো খানিকটা গৌণ হয়ে গেল। আসলে বোধহয়, টিপিক্যাল কমিউনিস্ট-সুলভ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ইত্যাদি দলবদ্ধ আন্দোলনে সোমনাথ অন্তর থেকে আর সাড়া দিতে পারেননি। ওঁর ছাপাই ভাস্কর্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিমূর্ত হলেও সেগুলো তো ভয়ঙ্কর বাস্তব, মারক বাস্তবেরই প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট।
সোমনাথ হোর তাঁর চিত্রকর্ম শুরু করেছিলেন অলক্ষ্য আততায়ীর বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শরীর মৃতদেহ আর আহত আর্ত মানুষের ছবি এঁকে। দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছেন নিরন্ন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, অভুক্ত, অপুষ্ট, দুর্দশাগ্রস্ত শিশু, নারী, অকালবৃদ্ধ মানুষী-বিম্ব সাজিয়ে। এই সব বিম্ব নির্মাণ, সাজানো ইত্যাদি শিল্পকর্মে অন্তর্লীন নিুস্বর প্রতিবাদ, অলক্ষ্য আততায়ীর আক্রমণ-প্রতিরোধ ইচ্ছাকে ছাপিয়ে সরব হয়ে ওঠে এক গভীর করুণা, এক মরমি মমত্ববোধ। আঘাতপ্রাপ্ত, আহত, আর্ত, অনাথ, আতুরের অবস্থার গভীর উপলব্ধি সোমনাথের ড্রইংয়ে, এনগ্রেভিংয়ে, ছাপাই ভাস্কর্যে আর ব্রোঞ্জ ঢালাই ভাস্কর্যে যে অনুভব সঞ্চার করে তার নাম করুণা। মার্কসীয় ভাবাদর্শই সোমনাথকে অসহায়, আহত, আর্তের প্রতি মমত্ববোধে চিরকাল প্রেরণা জুগিয়ে গেছে, কিন্তু কমিউনিস্ট দলীয় শিল্পাদর্শ যে তাঁকে কখনো তেমন করে উদ্দীপ্ত করেনি, তাঁর কাজের গুণগত ঔৎকর্ষ তার প্রমাণ। সেখানে সোমনাথ অনেকটাই স্বাধীনচেতা ব্যক্তিমানুষ আর ভাষাসচেতন শিল্পী। সোমনাথ যেখানে মানুষের দুর্দশাসচেতন মরমি ব্যক্তিশিল্পী, সেখানে অনেক সময় তাঁকে আদি অর্থে, সদর্থে বৌদ্ধ বলে মনে হয়, গভীর এক করুণাবোধ যাঁর কাজের মূল প্রেরণা। এই বৌদ্ধ প্রেরণা যে এই ভাষ্যকারের কলাবস্তু পাঠসঞ্জাত ধারণা মাত্র নয় তার কিছু প্রমাণ সোমনাথের ষাটের দশকের কিছু রঙিন এচিংয়ে আছে। এ-পর্বের অনেক ছবির দৃষ্টিকেন্দ্রে এক দাঁড়ানো মানুষী-বিম্ব দেখা যায়, যার চারপাশের অনেক ঘটনার মধ্যে সেই মানুষ অবিচল। অনুপাতে চারপাশের সবকিছুর চেয়ে বড়, এই আলখাল্লায় শরীর ঢাকা, সন্তদের মতন মানুষটি নজরে পড়ার মতন অন্য রঙে আঁকা। শারীরিক বিশদহীন, শুধু রেখার টানে চিহ্নিত এই মানুষ। হাতের মুদ্রাভঙ্গি বুদ্ধমূর্তিকে মনে করায়। কিন্তু সরাসরি বুদ্ধমূর্তির অনুরূপ নয়। এ-বিম্ব বুদ্ধমূর্তি নয়। শুধু মৃদুভাবে অনুষঙ্গবহ। যথাযথ কথার সেই অনন্ত ভাণ্ডার রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিধ্বনি করে বলার ইচ্ছা হয়, বেদনা যে ভাষায় ‘মর্মে মর্মরি গুঞ্জরি বাজে’, সোমনাথের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম সে ভাষায় রচিত।
বিশ শতকের গোড়ায় অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুগামীরা ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তববিভ্রমাত্মক দৃশ্যভাষায় পুরাণকথা আর পুরাশৌর্যগাথার বিবরণ দাখিল করাটাকে অনভিপ্রেত মনে করেছিলেন, এই কারণে যে, ওই ভাষায় বর্ণনা কল্পনার শীর্ষ ছুঁতে পারে না আর কল্পনাকে তাৎপর্যময় করে উপস্থাপন করতে পারে না। তার ফলেই অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুসারীরা পুরনো ভারতীয় শিল্পপরম্পরাগুলো থেকে তাঁদের দৃশ্যভাষার উপাদান সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন। অবনীন্দ্রনাথ নিজে অবশ্য সৃষ্টির কাজে ব্যক্তিগত কল্পনাকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে ধার করা দৃশ্যভাষা একটা সময়ের পরে তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাতো। প্রকাশের প্রয়োজনে, তাকে বদলে নিজের করে নিতেন। সারা জীবনই তা করেছেন। কিন্তু ১৯৩০-এর পর থেকে ঘন ঘন তা করতে থাকেন। পুরাণ (তা দেশি হোক বা আরব্য রজনীর মতন বিদেশি কল্পকাহিনিই হোক) আর পুরাকথা ক্রমশ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশতে থাকে। কিন্তু কল্পভ্রমণ শেষ হয় না। এই সব কাল্পনিক কাহিনি আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসৃষ্ট কল্পনার মিশ্রণকে নিজস্ব ইডিয়মে প্রকাশ করতে গিয়ে পরম্পরা থেকে অনেক দূরে সরতে হলো অবনীন্দ্রনাথকে। তার আগেই কিন্তু তাঁর জগৎ থেকে তাঁর সবচেয়ে গুণী শিষ্য নন্দলাল সরে গিয়ে, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি আর প্রাকৃতজনের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জগতে নিজের শেকড় খুঁজে পেয়েছেন। এই পাওয়ার মধ্যে কিন্তু গান্ধীজির গ্রামকেন্দ্রিক জীবনের মুক্তির ভাবনার একটা বড় ভূমিকা ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথই শেখালেন ব্যক্তির সার্বিক মুক্তি মুক্ত-চিন্তার পরিবেশেই সম্ভব আর সেই দেশ-সীমাহীন মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার মানবিক দায় ব্যক্তিকেও নিতে হয়। এমন রাবীন্দ্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশকাল সৃষ্ট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধির অভিব্যক্তি দিতে, দেশি-বিদেশি দৃশ্যভাষা থেকে উপাদান সংগ্রহ করে, নন্দলাল, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় আর রামকিঙ্কর বেজ গত শতকের বিশের দশকের শেষ থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝির মধ্যে যে ব্যক্তিচিহ্নে চিহ্নিত জগৎভাবনা-সমৃদ্ধ দৃশ্যকলার জন্ম দিলেন তাই হলো সদর্থে আধুনিক ভারতীয় দৃশ্যকলা। যাকে ওদেরই উত্তরসূরি কল্পাতি গণপতি সুব্রাহ্মণ্যন আর শিবকুমার ‘প্রাসঙ্গিক আধুনিকতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
সোমনাথ পঞ্চাশের দশকে যখন দৃশ্যকলার চর্চা শুরু করলেন, তার অনেক আগে থেকেই বিবরণদায়ী আর বর্ণনাত্মক দুধরনের বাস্তববিভ্রমাত্মক দৃশ্যকলারীতিবর্জিত। এবং ভারতে কোনো সময়ে, কোনো অংশে প্রচলিত কোনো দৃশ্যভাষার আদলে, পুরাণকথা, পুরাকাহিনি অথবা কোনো আদর্শজীবনের কল্পিত বিবরণ দেওয়াটাকে তখন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রকল্প মনে করা হচ্ছে। আর কলকাতায়, বোম্বাইতে শিল্পীরা ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের প্রভাবে বিশুদ্ধ, অন্যনিরপেক্ষ, ‘আন্তর্জাতিক’ দৃশ্যভাষায় দেশকাল পরিচয়হীন পশ্চিমি কালচিহ্নে চিহ্নিত কলারচনার আদর্শকে যখন মনেপ্রাণে আত্মস্থ করছেন, তখন কিন্তু তাঁরা একইসঙ্গে বাজারি প্রচারের ঢক্কানিনাদে গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্বের দেশকালের প্রতি দায়িত্ববান প্রাসঙ্গিক আধুনিকতার বৃহত্তর তাৎপর্য ও গুরুত্ব সম্বন্ধে অনবহিত থেকেই উৎকেন্দ্রিক আধুনিক হচ্ছেন। চলমান আন্তর্জাতিক দুর্ঘটনার আঘাতে দেশের মানুষের দুর্দশা যে সোমনাথকে যুগপৎ রাজনৈতিক এবং শিল্পকর্মে টেনে নিয়েছিল, সে সোমনাথের পক্ষে বিশুদ্ধ, অন্যনিরপেক্ষ, স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পরচনা কোনোদিনও সম্ভব হয়নি। সারা জীবন দৃশ্যভাষা চর্চা করে গেছেন ভাষাকে ঘনবদ্ধভাবে, তীব্রভাবে বার্তাবহ করতে। উপলব্ধির অনুভবেদ্য দৃশ্যরূপ দিতে। শিল্পী হিসেবে তাঁর অভিপ্রায় কী আর সে-অভিপ্রায় পূর্ণ করার জন্য নির্মিতি সম্পর্কে কী ধরনের জ্ঞানার্জন তাঁর প্রয়োজন সে-সম্বন্ধে একটা ধারণা শিল্পীজীবন-অভিলাষী সমাজরাজনৈতিক কর্মী যুবক সোমনাথ তাঁর শিল্পীজীবনের গোড়াতেই করে ফেলতে পেরেছিলেন। ১৯৫২ সালে লেখা তাঁর দীক্ষাগুরু চিত্তপ্রসাদের একটা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, তাঁর আগেই তিনি শান্তিনিকেতনে নন্দলালের (আর বিনোদবিহারীর) সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে নিয়েছিলেন। অথচ পূর্ববঙ্গীয় সোমনাথ শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন না। আর দলীয় কাজের সূত্রেও শান্তিনিকেতনে যাননি। চাকরিসূত্রে শান্তিনিকেতনে স্থিত হওয়ার অন্তত দেড় দশক আগে থেকেই শান্তিনিকেতনে চর্চিত দেশকালের মানব-জমিনে শেকড় গাঁথা, আকাশের বিস্তারে শাখা মেলা আধুনিকতার টানেই সোমনাথ মনেপ্রাণে শান্তিনিকেতনে পুষ্ট হওয়া প্রাসঙ্গিক আধুনিকতার শরিক। এই প্রাসঙ্গিক আধুনিকতার প্রতিজন প্রবক্তার মতন সোমনাথও নিজের বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ একবার কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস সম্বন্ধে এক লেখায় কবিদের দুজাতে ভাগ করেছিলেন : সাহিত্যজগতের ও বিশ্বজগতের কবি। আমাদের প্রাচীন নন্দনতাত্ত্বিক দার্শনিকরা কল্পনা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ সব ধরনের সর্জনশিল্পীদেরই কবি বলতেন। সে অর্থে তো আন্তপ্রেরণাচালিত সব চিত্রকর-ভাস্করই কবি। বিশ্বজগতের কবির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রটা ছোট, কালসীমায় নির্দিষ্ট হতে পারে। কিন্তু সেই ছোট ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা যদি তাঁর চিত্তে বৃহত্তর অনুরণন তুলতে পারে, তিনি যদি তাঁর কল্পনা ও বিশ্বাস (ওই একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যাকে রসধমরহধঃরাব পড়হারপঃরড়হ বলছেন) দিয়ে তাঁর ক্ষেত্রজ অভিজ্ঞতাজাত প্রেরণাকে সম্প্রসারিত করে বৃহত্তর দেশকাল, সমাজ ও মানবজীবনকে স্পর্শ করতে পারেন, তাহলে তো তাঁকে আমাদের বড় কবির, বড় শিল্পীর মর্যাদা দিতেই হয়। শুধু একটা সময়েরই নয়, শুধু সেই সময়ের এ দেশের দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসে দক্ষতাপূর্ণ অভিনব অবদানের জন্যই নয়, এ দেশের ইতিহাসের একটা বিশেষ ক্ষণে মানবমুক্তি বিষয়ক বৃহত্তর চিন্তার সঙ্গে নিজের সর্জনকর্মকে ওতপ্রোত করে নিয়েছিলেন বলেই সোমনাথ স্মরণযোগ্য শিল্পী।