logo

আলোকচিত্র ও চিত্রকলা অন্তর্গত সম্পর্ক

মৃ ণা ল  ঘো ষ
ত্র ও আলোকচিত্র, ইংরেজিতে যাকে বলে পেইন্টিং ও ফটোগ্রাফ, দুটোকেই সাধারণ কথাবার্তায় অনেকে অনেক সময় ‘ছবি’ বলে থাকেন। যা থেকে বোঝা যায়, এ দুইয়ের মধ্যে কোথাও একটা ঐক্য বা মিল আছে। আলোকচিত্রকে কেউ কেউ আবার ফটো বলতে অভ্যস্ত। সেই সূত্রে চিত্রকেও ‘ফটো’ বলছেন কোনো দর্শক, এরকমও হয়তো অনেকে শুনে থাকবেন। ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় ঘরের দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে একটি আলোকচিত্র, অনেক সময়ই সেটা হয়তো কারোর মুখাবয়বের ছবি, তাকে ফটো বলার একটা সাধারণ প্রবণতা অনেকেরই থাকে। এতে কোনো ভুল নেই। সেই সূত্রে ফ্রেমে বাঁধানো দেয়ালে ঝোলানো চিত্রকেও ফটো বলছেন কেউ, এরকমও কখনো কখনো শোনা যায়। এ থেকে দেখার একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য উঠে আসে। আমাদের দেশে, তত সংস্কৃতিমনস্ক নন, এরকম সাধারণ মানুষ ফটো বা আলোকচিত্র দেখতে যত অভ্যস্ত, চিত্রকলা দেখতে ততটা নন। তাই ফ্রেমে বাঁধানো দেয়ালে ঝোলানো সব ছবিকেই তাঁরা ফটো গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই তথ্যটি একটি সত্যের দিকে আমাদের নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ আলোকচিত্রের সঙ্গে যতটা পরিচিত, চিত্রের সঙ্গে ততটা নয়। আলোকচিত্র যদিও চিত্রের তুলনায় অনেক নবীন বা অর্বাচীন একটি মাধ্যম, তবু আলোকচিত্রের জনপ্রিয়তা, সাধারণের জীবনে প্রবেশের ক্ষমতা অনেক বেশি।
চিত্র ও আলোকচিত্রের এই যে প্রাথমিক ঐক্য – এর নান্দনিক উৎস কোথায়? দুইয়েরই অবস্থান একটি সীমাবদ্ধ দ্বিমাত্রিক জ্যামিতিক পরিসরে। সেই পরিসরটিকে যদি চিত্রপট বলা হয়, তাহলে তাকে নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তোলা এই দুই মাধ্যমেরই প্রাথমিক কাজ বা দায়। চিত্রে সেকাজটি একজন শিল্পী রং-তুলিতে এঁকে করেন। আলোকচিত্রে এজন্য ব্যবহৃত হয় একটি যন্ত্র, যার নাম ক্যামেরা। এখানেই দুটি মাধ্যমের বিভেদ বা ব্যতিক্রমের শুরু। আলোকচিত্র একটি যন্ত্রভিত্তিক মাধ্যম। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’। এই মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন আধুনিক যন্ত্রনির্ভর প্রযুক্তির একটি অবদান।
প্রখ্যাত জার্মান মার্কসবাদী সমাজ ও সংস্কৃতিতাত্ত্বিক ওয়ালটার বেঞ্জামিন ১৯৩৬ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ইংরেজি ভাষায় যার শিরোনাম ‘দ্য ওয়র্ক অব আর্ট ইন দ্য এজ অব মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’। প্রবন্ধটি সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পকলার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত ভাবনায় গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এই লেখায় বেঞ্জামিন বলেছেন, চিত্র-ভাস্কর্যের অনুকরণ বা প্রতিলিপি তৈরি হতো আগেও, বলা যেতে পারে প্রাচীন যুগ থেকেই। গ্রিকরা কাস্টিং বা এমবসিং প্রকরণের সাহায্যে ভাস্কর্য বা মুদ্রার একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করত। মধ্যযুগ থেকে প্রচলিত হয়েছে কাঠখোদাই বা উড এনগ্রেভিং, কপারপ্লেট এনগ্রেভিং বা এচিং। লিথোগ্রাফির প্রকরণ শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকে। কিন্তু এর কোনোটিরই অভিঘাত আলোকচিত্রের মতো নয়। আলোকচিত্রের মাধ্যমে দৃশ্যবস্তুর এই যে ‘মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ শুরু হলো বা মুদ্রণব্যবস্থার উন্নতির ফলে যা আরো প্রসারিত হয়েছে, তা চিত্রকলার যে স্বাতন্ত্র্যের গৌরব, যে সহনীয়তা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অরা’ (aura), তাকেই প্রবলভাবে আঘাত করেছে। আলোকচিত্র আবিষ্কারের পরে চিত্র সম্বন্ধে মানুষের যে শ্রদ্ধা ও বিস্ময়বোধ সেটা আর আগের মতো রইল না। চিত্র ও আলোকচিত্রের মধ্যে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হলো। আলোকচিত্র চাইল চিত্রের নান্দনিকতা আয়ত্ত করতে। চিত্র ক্রমাগত গবেষণা শুরু করল আলোকচিত্রের স্বাভাবিকতার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে এসে অনন্য বা অভিনব কোনো দৃশ্যতায় স্বতন্ত্র এক শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠতে। এই দ্বান্দ্বিকতার প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত আছে।
চিত্রকলা মানুষের সভ্যতার মতোই প্রাচীন। আদিম মানুষ পাহাড়ের গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেছে। তখন সেই ছবি ছিল তার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত। তার আত্মরক্ষার একটা উপায়। একটা জাদুচেতনা সম্পৃক্ত ছিল তার মধ্যে। অর্থাৎ তার সাধারণ জীবনচেতনা থেকে চিত্রচেতনা ছিল অনেক বড়, অনেক সহনীয়। পরবর্তীকালে অরণ্যচারী, শিকারজীবী গুহবাসী মানুষ যখন কৃষিজীবী ও গৃহবাসী হয়েছে, তখন এই জাদুসম্পৃক্ততাকে অতিক্রম করে চিত্র বা শিল্প হয়ে উঠেছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তখনো চিত্র জীবনের থেকে একটা বড় অবস্থানে থেকেছে। ‘মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ শুরু হওয়ার পর বা আলোকচিত্র উদ্ভাবনের পর সেই সহনীয়তা বা আধ্যাত্মিকতা থেকে বিযুক্ত হয়েছে চিত্রকলা। যুক্ত হয়েছে অন্য এক অবস্থানের সঙ্গে, যাকে বলে রাজনীতি। বেঞ্জামিনের ভাষায় :
‘Rather than underpinned by ritual, it came to be underpinned by a different practice : politics.’ আজকে ‘রিচুয়াল’ থেকে বিযুক্ত হলেও চিত্রকলার সাধনা করেন যে-শিল্পী, তাঁর মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত ধ্যান হয়তো কাজ করে। কিন্তু সেটাও নিয়ন্ত্রিত হয় সমাজের সঙ্গে তাঁর সংযোগের রাজনীতি দ্বারা। তিনি হয়তো কোনো সামাজিক প্রক্রিয়ার বা নৈতিকতার প্রতিবাদে ছবি আঁকেন। পিকাসো বা আমাদের অবনীন্দ্রনাথ যেমন। অথবা নতুন কোনো নৈতিকতা বা রূপগত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চান। মাতিস, যামিনী রায় বা রবীন্দ্রনাথ যেমন। ছবিকে জীবনের কাছাকাছি আনার জন্য, ছবি নিয়ে ‘aura’ বা সহনীয়তার বোধ, এটাকেও তাঁরা ভেঙে দিতে চান। যেমন পিকাসো তাঁর কিউবিজম পর্যায়ের ছবিতে তথাকথিত অনেক অনান্দনিক বস্তু চিত্রপটে সেঁটেছেন। মার্সেল দ্যুসা ১৯১৭ সালে একটি মূত্রাধারকে ভাস্কর্যের বিকল্প হিসেবে প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছেন। ‘ডাডা’বাদের অন্তর্গত শিল্পীদের একটি ‘অ্যাজেন্ডা’ বা কার্যক্রমই ছিল এই ‘aura’ র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
আলোকচিত্র ক্যামেরার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রকৃতিকে বা বাস্তবকে খুব সহজেই অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতায় রূপবদ্ধ করতে পারে। চিত্রকলা বা ভাস্কর্য কখনো এই উদ্দেশ্যে কাজ করেনি। আদিম বা প্রাচীন যুগ থেকেই তার লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে, গভীরে গিয়ে সত্যের কোনো অনন্য উপলব্ধিতে পৌঁছনো। প্রাচীন গ্রিক বা রোমক শিল্প স্বাভাবিকতার ধ্যান করেছে। আমাদের অজন্তার ছবি বা গুপ্ত যুগের ভাস্কর্যও প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপকে ধরতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ সবগুলিই ছিল আদর্শায়িত স্বাভাবিকতা। অর্থাৎ স্বাভাবিকতার আদর্শায়িত ‘ডিভাইন’ বা স্বর্গীয় রূপ। পাশ্চাত্যে চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকে নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের সময় থেকে জীবন ও প্রকৃতির অনুধ্যান জেগে উঠতে থাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দর্শন ও বিজ্ঞান মিলে যেতে থাকে। প্রকৃতিকে নিবিড় স্বাভাবিকতায় রূপায়িত করতে চান শিল্পী। এই নিয়ে নিমগ্ন গবেষণা শুরু হয়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন একাধারে বৈজ্ঞানিক ও শিল্পী। লিওনার্দো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, টিশিয়ান প্রমুখ শিল্পীর ছবি ও ভাস্কর্যে স্বাভাবিকতাকে রূপবদ্ধ করার অদম্য প্রয়াস আমরা দেখেছি। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতাও চোখে দেখা বাস্তবতা থেকে অন্যরকম ছিল। আদর্শায়িত রূপায়ণের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁদেরও। পার্সপেকটিভের গাণিতিক বা জ্যামিতিক নিয়ম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে চিত্রকলাকে তাঁরা যেমন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিতে চেষ্টা করেছেন, তেমনি বাস্তবতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার প্রয়াসও ছিল তাঁদের। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ বা টিশিয়ানের ‘দানে’ পার্থিব স্তরের বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বাস্তবকে অনুধাবন করার এই যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল রেনসাঁসের সময় থেকে, পাশ্চাত্য চিত্রকলায় সে-ধারার জয়যাত্রা চলেছে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত। নিও-ক্লাসিসিজমে তার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেছে। আমাদের দেশেও ১৮৫০-এর দশক থেকে ব্রিটিশ শিল্পশিক্ষানীতির অঙ্গ হিসেবে সেই ধারাটা এসে পৌঁছেছে। পঞ্চদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত পাশ্চাত্যের চিত্রকলায় স্বাভাবিকতার চর্চার যে জয়যাত্রা, সেটা প্রথম প্রতিহত হলো ১৮৩৭ থেকে ১৮৪০-এর মধ্যে আলোকচিত্র উদ্ভাবনের পর।
আলোকচিত্রের প্রথম উদ্ভাবক একজন ফরাসি শিল্পী লুইস জ্যাকস মান্ডে ডাগুয়ের (১৭৮৯-১৮৫১) (Louis Jacques Mande Daguerre)| ১৮৩৭ সালে তিনি স্টিললাইফ ধরনের কিছু বস্তুর যে আলোকচিত্রীয় প্রতিরূপ তোলেন, তাকে তখন বলা হতো ডাগুয়েরোটাইপ (Daguerreotype)। এই আলোকচিত্রীয় পদ্ধতি ধীরে ধীরে পরিশীলিত হয়েছে। এই পরিশীলনের পথে ইংলন্ডের প্রথম আলোকচিত্রী উইলিয়াম হেনরি ফক্স ট্যালবটেরও (১৮০০-১৮৭৭) (William Henry fox Talbot) উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। ১৮৩৭ থেকে ১৮৫০-এর মধ্যে যখন আলোকচিত্রের প্রকরণ অনেকটাই পরিশীলিত হলো, তখন চিত্রশিল্পীদের সামনে একটা নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হলো। তাঁরা যে-কাজটা এত যতেœ, পরিশ্রমে, এত সময় নিয়ে করে আসছেন, ক্যামেরা সেটা এক লহমায় করে ফেলতে পারে। তাঁদের এই দক্ষতার আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা রইল না।
এখানে একবার আমরা আলোকচিত্রের বিকাশের প্রাক-ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকাতে পারি। ফটোগ্রাফি (Photography) কথাটির আক্ষরিক অর্থবিন্যাসের দিকে যদি যাই – তাহলে দেখা যায়, এই শব্দটির অর্থ হলো আলো দিয়ে লেখা। ‘ফটো’ মানে আলো। ‘গ্রাফি’ কথাটি এসেছে গ্রাফিক বা লিখন থেকে। চিত্র যেমন রং-তুলি বা কালি-কলমের সাহায্যে আঁকা হয়, আলোকচিত্র তেমনি গড়ে ওঠে আলোর সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে। আলোকচিত্রের কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলে থাকেন, আলোর একটি বিশেষ ধর্ম, যা থেকে আলোকচিত্রের উদ্ভব, সেটা লক্ষ করে যাকে সভ্যতা-পূর্ববর্তী আদিম গুহাবাসী মানুষও। একটি বন্ধ ঘরে, পরিপূর্ণ অন্ধকার রয়েছে যেখানে, সেখানে যদি একটি অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে, যাকে ‘পিনহোল’ বলা যেতে পারে, সেই পথে আলোর প্রবেশ ঘটে, তাহলে দেখা যাবে, বিপরীত দেয়ালে নিপতিত সেই আলোয় ফুটে উঠবে বাইরের প্রকৃতির ছবি। যেমন কোনো গাছ বা মানুষ। কিন্তু সেই ছবি দেয়ালে প্রতিফলিত হবে উল্টোভাবে।
আদিম গুহাবাসী মানুষ গুহাপ্রাচীরের কোনো কোনো অতিক্ষুদ্র ছিদ্রপথে প্রবিষ্ট আলোয় বাইরের প্রকৃতির উল্টোনো প্রতিফলন দেখে হয়তো বিস্ময়াভিভূত হয়েছে। আলোক প্রতিফলনের এই ধর্মটি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে লক্ষ করেছিলেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। এই ধর্মের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল Camera obscura, যে ইতালীয় শব্দের অর্থ ‘a dark room’ বা একটি অন্ধকার ঘর। আলোকচিত্রের ইতিহাসের প্রথম পদক্ষেপ হলো এই Camera obscura-র বাস্তব বা হাতে-কলমে প্রয়োগ। ইতালির রেনেসাঁস শিল্পীরা এর ব্যবহার করেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৪৯০ খ্রিষ্টাব্দে এই পদ্ধতিটির ব্যবহার অনুমোদন করেন, যাতে ‘পার্সপেকটিভ’ নিয়ন্ত্রণের সহজ সমাধান খুঁজে পেতে পারেন শিল্পী। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে লেন্স ব্যবহার করে এই পদ্ধতিকে আরো পরিশীলিত করা হয়। কাজেই এরকম বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে, আলোকচিত্র ও চিত্রের নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে আসছিল সেই রেনেসাঁসের সময় থেকে। Daguerreotype উদ্ভাবিত হওয়ার পর সেই সম্পর্ক পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পর্যায়ে চলে যায়। Daguerreotype-এর ছবি দেখে Paul Delaroche নামে এক শিল্পী বলেছিলেন, ‘From today painting is dead!এরপর থেকেই চিত্রকলা ও আলোকচিত্র – উভয় ক্ষেত্রেই একটা দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকল। চিত্রকলা চাইল স্বাভাবিকতাকে পরিহার করে বা রূপান্তরিত বাস্তবকে নতুন মাত্রায় অনুধাবন করতে। আলোকচিত্র তার স্বাভাবিকতার সীমার মধ্যেই কম্পোজিশন বা বিন্যাসের উৎকর্ষ এনে আলোকচিত্রকে চিত্রের নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত করতে চাইল। পরবর্তীকালে আলোকচিত্র স্বাভাবিকতাকেও ভেঙেছে, রূপান্তরিত করেছে। আলোকচিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক যে-ধারণা তা বাস্তবের যথাযথ প্রতিরূপকে রূপবদ্ধ করে, এই ধারণায় স্থিত থেকেও আলোকচিত্র যেমন শৈল্পিক নান্দনিকতার সন্ধান করেছে, এই ধারণাকে ভেঙে বা এ থেকে বেরিয়ে এসেও সেই নান্দনিকতায় সঞ্জীবিত হতে চেষ্টা করেছে।
আমরা প্রথমেই বলতে চেষ্টা করেছিলাম আলোকচিত্র ও চিত্রকলার মধ্যে একটি প্রাথমিক ঐক্যের কথা। দুই মাধ্যমই একটি সীমাবদ্ধ জ্যামিতিক পরিসরকে সাজিয়ে তোলে। এই সাজিয়ে তোলাকে বলে রচনাবন্ধ বা ‘কম্পোজিশন’। চিত্রকলা যেমন এই কম্পোজিশনের বৈভবে নান্দনিকতায় অভিষিক্ত হয়, আলোকচিত্রের পক্ষেও সেটা সম্ভব। সার্থক সৃজনধর্মী আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত এটা ঘটছে। আলোকচিত্রের পক্ষে নান্দনিক হয়ে ওঠার আর একটা সূত্র বা উৎসও আছে। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত অনন্ত দৃশ্যমালা উৎসারিত হয়। তার মধ্যে ক্বচিৎ কখনো এমন একটি দৃশ্যের জন্ম হয়, যার মধ্যে থাকে আকস্মিকতা, অনন্যতা ও বিস্ময়। সেই মুহূর্তটিকে বলা যেতে পারে decisive moment. সেই অরূপ সৌন্দর্যকে, সেই বিরল মুহূর্তটিকে অনেক সন্ধানের মধ্য দিয়ে কেউ কেউ দেখতে পান। সকলে পান না। আলোকচিত্রের শিল্পী সেই বিরল মুহূর্তটিকেই ক্যামেরায় ধরেন। যিনি নিরলস সন্ধানে বাস্তবের এই অরূপ মুহূর্তটিতে পৌঁছতে পারেন, তিনি আলোকচিত্রের শিল্পী হতে পারেন। তাই যেমন সব কবিতাই কবিতা নয়, সব চিত্রই চিত্র নয়, তেমনি সব আলোকচিত্রই শিল্পনন্দিত হয়ে উঠতে পারে না। প্রকৃতির ভেতর, জীবনের ভেতর সবসময়ই গভীর রহস্যের আলোছায়ার খেলা চলে। শিল্পীর কাজ সেই রহস্যের অনির্বচনীয়তাকে অনুভবের সামনে নিয়ে আসা। চিত্রীর মতো আলোকচিত্রীও যখন সেই কাজটি সার্থকভাবে করতে পারেন, তখনই তাঁর আলোকচিত্র নান্দনিক বৈভব পায়। আলোকচিত্রের উদ্ভাবনের পর থেকে এই সন্ধানটি চলে আসছে নানাভাবে।
১৮৪০-এর দশকে পাশ্চাত্যে আলোকচিত্র যখন তার প্রকরণগত নানা সমস্যার সমাধান করে পরিশীলিত হয়ে উঠছে ক্রমশ, তখন থেকেই অনেক শিল্পী এর শৈল্পিক উৎকর্ষ নিয়ে কাজ করে আসছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সের ফেলিক্স নাদার (Felix Nadar, 1820-1910), ইংলন্ডের জুলিয়া মার্গারেট ক্যামেরন (Julia Margaret Cameron 1815-79), আলেকজান্ডার গার্ডনার (Alexander Gardner, 1821-82), ম্যাথু ব্র্যাডি (Mathew Brady, 1823-96)) প্রমুখ। এর মধ্যে ম্যাথু ব্র্যাডির একটি ছবির উল্লেখ করা যায়। ছবিটি ১৮৬২ সালে তোলা। ছবিটির শিরোনাম এরকম – ‘Gathered for Burial at Autietam After the Battle of September 17, 1862’ । দিগন্ত বিস্তৃত একটি শূন্য প্রান্তরে কবর দেওয়ার জন্য অজস্র মৃতদেহ শোয়ানা রয়েছে। প্রকৃতির শূন্যতার বিস্তারের মধ্যে মানবিক হিংসা, নৃশংসতা ও করুণার ব্যতিক্রমী সমন্বয় এই ছবিটিতে। আলোকচিত্রের প্রথম যুগে আলোকচিত্রকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার একটি সার্থক প্রয়াস এই ছবি।
আলোকচিত্রের এই ওঠে আসার সময় চিত্রকলার অবস্থানটা কেমন ছিল? অনেক শিল্পীই তখন স্বাভাবিকতাকে ক্রমশ ভাঙতে শুরু করলেন। ক্যারিকেচারের দিকে গেলেন। এই পথেই বাস্তবকে বিশ্লেষণ করলেন, যা তখনো আলোকচিত্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফরাসি শিল্পী Honore Daumier (1810-79)-এর ছবিতে এই প্রবণতা খুবই লক্ষণীয়। তাঁর একটি ছবির উল্লেখ করা যায়। ছবিটি ১৮৬০-৬২ সালে আঁকা। শিরোনাম ‘দ্য থার্ড ক্লাস ক্যারেজ’। ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির কামরায় যাত্রীরা বসে আছে। এই বাস্তবতাকে ধরতে তিনি অবয়বের স্বাভাবিকতাকে যেভাবে ভেঙেছেন, তার মধ্যে এক্সপ্রেশনিজম বা অভিব্যক্তিবাদের লক্ষণ দেখা দিলো, প্রকৃত অভিব্যক্তিবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগে। Gustav Courbet (1819-1877) ছবিতেও স্বাভাবিকতার এই রূপান্তরণ দেখা দিতে থাকল।
এই রূপান্তরণের মধ্য দিয়েই পাশ্চাত্যের চিত্রকলা এসে পৌঁছল প্রতিচ্ছায়াবাদ বা ইম্প্রেশনিজমে। ইম্প্রেশনিজমের শিল্পীরা Edouard Manet (1823-83), Claude Monet (1840-1926), Edgar Degas (1834-1917) প্রমুখ শিল্পী স্বাভাবিকতা থেকে যেভাবে দূরে সরে আসছিলেন তার পেছনে অপটিকসের বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেমন কাজ করেছে, তেমনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে জাপানি কাঠখোদাই ছবির বৈশিষ্ট্য। এসব ছাড়াও রয়ে গেছে পরোক্ষ একটা তাগিদ। আলোকচিত্রের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। নৈর্ব্যক্তিক দেখার যুগ ফুরিয়েছে। এখন ছবিতে রূপ দিতে হবে শিল্পীর আত্মগত অন্তর্লীন দেখা। ইম্প্রেশনিজম সেই কাজটি শুরু করেছিল।
আমাদের দেশের দিকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক এবার। পাশ্চাত্যে আলোকচিত্র উদ্ভাবিত হওয়ার পর খুব বেশি সময় লাগেনি এদেশে আসতে। ১৮৪০ সালে কলকাতায় শুরু হয়েছিল Bourne & Shephard studio নামে একটি ফটোগ্রাফি স্টুডিও। ‘Encyclopedia of photography : Indian Chapter’ থেকে এই তথ্য উল্লেখ করেছেন বেনু সেন তাঁর Art of Photography বইতে। ১৮৪৪ সালের ৬ জুলাই ইংলিশম্যান পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল এই মর্মে যে, ৭ নম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ারের Maas P.M. Montario নামে এক ব্যক্তি ‘begs to inform the public that he is prepared to take likeness by Daguerreotype process’ এই তথ্যের ভিত্তিতেই অনেকেই Montario-কে বলে থাকেন কলকাতার তথা ভারতের প্রথম ফটোগ্রাফার।
এরপর থেকেই প্রকৃতির যথাযথ প্রতিরূপ গড়ে তুলতে আলোকচিত্রের চর্চা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিশেষত সরকারি কাজকর্মেও তথ্যপঞ্জীকরণে ব্যবহৃত হতে থাকে আলোকচিত্র। আলোকচিত্র চর্চার অনেকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। ‘দ্য বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। ১৮৫৬-তে গড়ে উঠেছিল ‘দ্য বেঙ্গল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’ ও ‘দ্য মাড্রাস ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’। ১৮৮০-র মধ্যে বম্বে ও কলকাতায় গড়ে উঠেছিল বড় বড় ফটোগ্রাফিক ফার্ম। ১৮৭৭ সালে জেমস ফার্গুসন প্যারিস প্রদর্শনীতে দেখিয়েছিলেন ভারতীয় স্থাপত্যের প্রায় পাঁচশো আলোকচিত্র। খুবই জনসমর্থন পেয়েছিল তা। এর কিছু আগে ১৮৫৪ সালেই কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের সন্নিকটে পটলডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম আর্ট স্কুল ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’। এটিই পরে চৌরঙ্গি রোডে স্থানান্তরিত হয় ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট’ নামে। এই ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টে’ ড্রয়িং, মডেলিং, এনগ্রেভিং, মোল্ডিং ইত্যাদি প্রকরণের সঙ্গে ফটোগ্রাফিও শেখানো হতো। শেখাতেন Mailette Oscar নামে একজন শিক্ষক মাসিক এক টাকা আট আনা দক্ষিণার বিনিময়ে।
কাজেই বলা যেতে পারে, কলকাতায় চিত্রকলা ও আলোকচিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রায় একই সময়ে শুরু হয়েছিল, যদিও এই চর্চা চলছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে। দুইয়ের মধ্যে কোনো সংযোগ স্থাপিত হয়নি। বরং চিত্রকলা আলোকচিত্রীয় নিপুণতায় প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে চিত্রপটে রূপায়ণের চেষ্টা করছিল পাশ্চাত্যের রেনেসাঁস-উত্তর চিত্রকলার ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে। শিল্পীরা কখনো আলোকচিত্রের সহায়তা নিতেন কি না তা বলা যায় না। আলোকচিত্রে তখনো রঙের ব্যবহার আসেনি। তাই চিত্রশিল্পীর যে-সুযোগ ছিল স্বাভাবিকতাকে বর্ণিল করে তোলার, আলোকচিত্রীর তা ছিল না। তবু আলোকচিত্রের একটি নিজস্ব পরিসর ছিল, যেখানে চিত্রকলার প্রবেশ খুব সহজ ছিল না। সেটা হচ্ছে সত্যকে যথাযথভাবে রূপায়িত করা। ক্যামেরা কখনো মিথ্যা কথা বলে না, এই ছিল আলোকচিত্রের প্রথম পর্যায়ের ধারণা। কিন্তু চিত্রকলা সবসময়ই সত্যকে রূপান্তরিত করে বা আদর্শায়িত করে। এখন অবশ্য আর তা নেই। সত্যকে রূপান্তরিত করাও এখন ক্যামেরার একটা কাজ। কম্পিউটারের ফটোশপ এদিক থেকে যুগান্তর এনেছে। চিত্র ও আলোকচিত্রের ব্যবধান অনেকটাই ঘুচে গেছে।
যাই হোক, ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্বে ভারতীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটেছিল বিশিষ্ট একজন আলোকচিত্রীর। তাঁর নাম রাজা দীন দয়াল (১৮৪৪-১৯০৫)। দীন দয়াল ডকুমেন্টেশন ফটোগ্রাফিতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিলেন। তাঁর খ্যাতি প্রায় আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছেছিল। তখনো আমাদের দেশে অন্তত আলোকচিত্র পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদায় পৌঁছেনি। একই সময়ে দীন দয়ালের প্রায় সমসাময়িক একজন শিল্পী ভারতবর্ষে চিত্রকলার ক্ষেত্রে প্রবল আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি রাজা রবি বর্মা (১৮৪৮-১৯০৬)। ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক চিত্ররীতির রূপায়ণকে তিনি উৎকর্ষের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পী হিসেবে রবি বর্মার যে-মর্যাদা দীন দয়ালের তা নেই।
ইন্দোরের রাজা দীন দয়াল ছাড়া আরো যাঁরা প্রথম পর্বে আলোকচিত্রের পরিশীলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিবান্দ্রামের রাজা, বম্বের ড. নারায়ণ গাজি, মাদ্রাজের সি. আয়েরস্বামী, লক্ষেèৗর আলি খান, জয়পুরের স্বামী রাম সিং প্রমুখ। বাংলার যেসব ব্যক্তিত্ব আলোকচিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পি.সি. মুখার্জি, হীরালাল সেন, সিনেমাটোগ্রাফিতেও যাঁর বিশিষ্ট অবদান আছে, মহারাজ বাহাদুর প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর, সুকুমার রায় প্রমুখ। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুও আলোকচিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন।
এই সমস্ত উদ্যোগ সত্ত্বেও আলোকচিত্র ও চিত্রকলার মধ্যে বিনিময় ঘটতে এখানে অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেক দিন, প্রায় ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত। বাংলার আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে অন্তত সুনীল জানার নামটি স্মরণীয়। ১৯৪০-এর দশকে যে সামাজিক আলোড়ন ঘটেছে, বিশেষত ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের আলোকচিত্রীয় ডকুমেন্টেশনে সুনীল জানার অবদান অবিস্মরণীয়। জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর প্রমুখ শিল্পী ছবিতে যখন দুর্ভিক্ষকে রূপবদ্ধ করছিলেন, সুনীল জানা তখন তাকে ধরছিলেন আলোকচিত্রের মাধ্যমে। আলোকচিত্র হয়ে উঠেছে চিত্রের পরিপূরক।
১৯৪০-এর দশকের আরেকজন আলোকচিত্রীর কাজের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি, আলোকচিত্র স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবেই কেমন করে নিজের পরিসর তৈরি করে নেয়। শম্ভু সাহা (১৯০৫-৮৮) রবীন্দ্রসান্নিধ্যের ও শান্তিনিকেতনের আলোকচিত্রের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, যদিও তিনি সারাজীবন নানা বিষয়ের ছবি তুলেছেন। তাঁর তোলা খোয়াইয়ের ছবি বা ‘পুনশ্চ’ বাড়ির স্থাপত্যের মধ্যে বসে থাকা রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখলে আমরা বুঝতে পারি, স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্রের অবস্থান কী রকম হতে পারে। এটা সবসময়ই মনে রাখতে হয়, আলোকচিত্র আর চিত্রকলা এক নয়। আলোকচিত্রের নান্দনিকতায় রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যার মধ্য দিয়ে এই মাধ্যমটি ভিন্ন এক দৃশ্যতাকে অভিব্যক্ত করে, যেটা আবার চিত্রকলার পক্ষে সম্ভব নয়। শম্ভু সাহা তাঁর শান্তিনিকেতন আলোকচিত্রমালায় সেটিই দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন তথ্যকে আত্মস্থ করে এবং তাকে অতিক্রম করে আলোকচিত্র কেমন করে নান্দনিকতায় অভিষিক্ত হয়।
বিদেশের দিকে তাকানো যাক আর একবার। ইম্প্রেশনিজমের সময় থেকেই চিত্রকলার সমান্তরালে আলোকচিত্র নিয়েও চলেছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাতে শুধু বাস্তবকে ধরা নয়, তার মধ্যে কিছু চিত্রীয় বৈশিষ্ট্যও আনা যায়। ক্লদ মোনে (Claude Monet) যখন আঁকছেন প্যারিসের রাস্তার ছবি, ‌’Boulevard des capucinis, Paris’ শিরোনামে ১৮৭৩-৭৪ সালে, তার কিছু আগেই আলোকচিত্রী এডওয়ার্ড অ্যান্থনি ১৮৫৯-এ ওরকমই এক বৃষ্টিভেজা রাস্তার ছবি ‘A Rainy Day on Broadway’ শিরোনামে। ক্যামেরার প্রাকরণিক সীমাবদ্ধতাই সেখানে নিয়ে আসছে ইম্প্রেশনিজমের ছবির অতিস্পষ্টতার অভাবের কিছু বৈশিষ্ট্য। এডওয়ার্ড মুরিব্রিজ (Eadweard Muybridge) ১৮৭৮-এ তুলেছেন একটি ছবি ‘হর্স ইন মোশন’ শিরোনামে। আরোহীসহ ছুটন্ত ঘোড়ার প্রতিমাকল্প সেখানে চারটি করে তিন সারির মোট বারোটি ফ্রেমে। এডগার দেগা (Edgar Degas) ১৮৮৯ সালে এঁকেছেন ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে আরোহীর ছবি ‘দ্য জকি’ শিরোনামে। আলোকচিত্র ও চিত্রের স্বতন্ত্র পরিসর ধরা পড়েছে এই দুটি ছবিতে। অগুস্ত রদাঁ তাঁর ‘মনুমেন্ট টু বালজাক’ ভাস্কর্যটি করেছিলেন ১৮৯৭-৯৮ সালে। ১৯০৯ সালে একজন আলোকচিত্রী এডওয়ার্ড স্টেইচেনকে (Edward Steichen) দিয়ে চাঁদের আলোয় তিনি তুলিয়েছিলেন এই ভাস্কর্যের আলোকচিত্র। আলোছায়ার দ্বৈতে অসামান্য প্রতিচ্ছায়াবাদী অনুষঙ্গ এসেছিল ছবিটিতে। আলোকচিত্র এইভাবে নিজেকে রূপান্তরিত করেছে। শুধু স্বাভাবিকতাকে নথিবদ্ধ করার দায় আলোকচিত্রের, এই ধারণাকে অতিক্রম করে আলোকচিত্র বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদের দিকেও অগ্রসর হয়েছে। রবার্ট কাপা Kvcv (Robert Capa, 1913-1954),মাইনর হোয়াইট (Minor White, 1908-76) প্রমুখ আলোকচিত্রী বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী আলোকচিত্রের ধারায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। রবার্ট কাপার একটি ছবি উল্লেখ করা যায় দৃষ্টান্ত হিসেবে। ১৯৪৪-এর এই ছবিটির শিরোনাম ‘নর্মান্ডি ইনভেশন’। যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি। যুদ্ধরত সৈনিক ও ট্যাঙ্কের প্রতিমাকল্প কেঁপে কেঁপে বিমূর্ততার দিকে চলে গেছে।
এভাবে কিউবিজম, ফিউচারিজম, ডাডাইজম, সুররিয়ালিজম, পপ আর্ট ইত্যাদি দৃশ্যকলার সমস্ত আন্দোলনেরই প্রভাব পড়েছে আলোকচিত্রের ওপর। ডাডা-পপের সমন্বিত প্রভাবের দুটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যায় আমেরিকান ফটোগ্রাফি থেকে। প্রথমটি রবার্ট ফ্র্যাঙ্কের (জন্ম ১৯২৪) একটি ছবি। ১৯৫৬-তে তোলা আলোকচিত্রটির শিরোনাম ‘পলিটিক্যাল র‌্যালি’। পতাকা তুলে বিউগল বাজিয়ে যাচ্ছে তিনজন লোক। তাঁদের কারোরই মুখ দেখা যাচ্ছে না। বিউগলের বৃত্তাকার সম্মুখভাগ ঢেকে দিয়েছে মাঝখানের মূল বাদকের মুখ। বাকি দুজনের শরীরের বেশিরভাগ অংশ ফ্রেমের বাইরে। ডাডা-অনুষঙ্গের এক ধরনের যান্ত্রিকতা ছবিটির মধ্যে। দ্বিতীয় ছবিটি গ্যারি উইনোগ্র্যান্ডের (Garry Winogrand, 1928-1984)| শিরোনাম, ‘পিস ডেমনস্ট্রেশন’। স্বাভাবিকতার মধ্যেও মিলিটারি-সুলভ এক যান্ত্রিকতা ছবিটিতে বিমানবিকতার আবহ এনেছে। এ দুটি ছবিও বলে দেয় আলোকচিত্রের নান্দনিকতার ক্ষেত্রটি চিত্রকলার থেকে একেবারেই আলাদা।
আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদের (Modern and Modernist) যুগে ছিল এই রকম। আলোকচিত্রের বাস্তব বা স্বাভাবিকতাকে পুঞ্জীকৃত করার বিপুল ক্ষমতার অভিঘাতে চিত্রকলা নিজেকে রূপান্তরিত করে গেছে ক্রমশ। বাস্তবতার গভীরে পৌঁছতে দৃশ্যমান বাস্তবতার আবরণকে নিষ্কাশিত করেছে কেবলই। ইম্প্রেশনিজম থেকে মিনিমালিজম পর্যন্ত এই হলো চিত্রকলার বিবর্তনের রূপরেখা। আর আলোকচিত্র চিত্রকলার বিবর্তনের এই ধারাকে অনুসরণ করে গেছে। পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদায় পৌঁছতে যেয়ে স্বাভাবিকতার অভিধা বা দর্শনকে প্রতিহত করেছে।
সেই প্রতিহত করার প্রয়াস সম্পূর্ণ হয়েছে উত্তর-আধুনিক যুগে পৌঁছে। পাশ্চাত্যে ১৯৬০-পরবর্তী সময়ে যখন উত্তর-আধুনিকতার সমাজতত্ত্ব ও দর্শন শিল্পকলার প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়েছে, তখন আলোকচিত্র ও চিত্রের ব্যবধান প্রায় মিলিয়ে যেতে থেকেছে। বিংশ শতকের গোড়া থেকেই পদার্থবিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বের নতুন সন্ধানগুলি বাস্তবের এবং বাস্তবের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের পূর্ববর্তী ধারণাগুলোকে ভেঙে ফেলছিল। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ফ্রয়েড ও ইয়ুংয়ের মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব – এসবের অভিঘাত পড়েছে শিল্পেও। কিউবিজম থেকে মিনিমালিজম পর্যন্ত বিবর্তনে এর প্রভাবও আছে। উত্তর-আধুনিক যুগে এই ভাবনা বা প্রত্যয়গুলোই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। অনেক দিন আগে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলেছিলেন, রূপায়ণ ছাড়া বস্তুকে জানা যায় না, ‘Objects are unknowable apart from their representations.রবীন্দ্রনাথের কথায় Ñ ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’। এই দর্শনের পূর্ণ অভিব্যক্তি দেখা গেল উত্তর-আধুনিকতার দর্শনে। জাঁ বড্রিলার্ড (Jean Baudrillard)বললেন, ভূখণ্ড আগে নয়, তার মানচিত্রই আগে। ‘ÔThe territory no longer precedes the map, nor survives it. Henceforth it is the map that precedes the territory’. এতদিনকার বাস্তবের তত্ত্বটা সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়ে গেল।
বড্রিলার্ড আলোকচিত্রের একজন বিশিষ্ট শিল্পীও। তাঁর আলোকচিত্র থেকে বাস্তবের সব আবরণ দূরীভূত হয়ে গেল। এভাবেই আলোকচিত্রকে স্বতন্ত্র শিল্পসত্তায় উদ্ভাসিত করেছেন উত্তর-আধুনিকতার অনেক শিল্পী – যেমন জের ভ্যান এলক (Ger van Elk), বয়েড ওয়েব (Boyd webb),সিনডি শেরম্যান (Cindy Sherman), শেরি লেভিন ভিক্টর বারজিন (Victor Burgin),সোফি কালে (ঝড়ঢ়যরব ঈধষষব) প্রমুখ। তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থান, নারীবাদ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে চিত্রকলাও বা সাধারণভাবে দৃশ্যকলাও তার নিজের নান্দনিকতার প্রসারণে নানাভাবে ব্যবহার করেছে আলোকচিত্রকে। কখনো ‘রেডিমেড’ হিসেবে, কখনো ফটোমন্তাজ হিসেবে, কখনো বা ভিডিও আর্টে আলোকচিত্রকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করে। আজ এই দুটি মাধ্যম তাদের স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেও পরস্পর পরস্পরের সহযোগী ও পরিপূরক।
আমাদের দেশে উত্তর-আধুনিকতার ঢেউ এসে পৌঁছেছে বিশ্বায়নের পালে ভর করে। ১৯৯০-এর পর থেকে এর পূর্ণ প্রকাশ আমরা দেখছি এখানে। স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্রের প্রদর্শনী অনেক বেড়েছে এই সময় থেকে। অনেক চিত্রশিল্পীও ছবির পাশাপাশি আলোকচিত্রেও প্রকাশ করছেন নিজেদের। আবার আলোকচিত্রীও কম্পিউটারের ফটোশপ বা অন্যান্য প্রকরণে আলোকচিত্রকে রূপান্তরিত করে পূর্ণ চিত্রীয় বৈশিষ্ট্যে অভিষিক্ত করছেন। তবু এখনো আমাদের দেশে আলোকচিত্রের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। ‘মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশন’ বলে একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করা যায় বলে চিত্রের মতো এর অনন্যতা স্বীকৃত হচ্ছে না। ফলে সীমাবদ্ধতা আসছে বিপণনে।যে-সমস্যাটা আমাদের গ্রাফিক আর্টে রয়েছে এখনো। তবু আজ আর কেউ আলোকচিত্রকে শিল্প হিসেবে ব্রাত্য ভাবেন না। একটা নান্দনিক মর্যাদায় তা আজ অভিষিক্ত। তবে এখান থেকেই উঠে আসে আর একটা সমস্যা। অনেক আলোকচিত্রীই ভুলে যান আলোকচিত্রকে চিত্রের মর্যাদায় নিয়ে যেতে গেলে অনেক সাধনার প্রয়োজন। সেরকম সাধনাহীন আলোকচিত্রের প্রকোপও আজ কম নয়। তবু আজ যাকে ‘অলটারনেটিভ আর্ট’ বা ‘কাটিং এজ আর্ট’ (Cutting Edge art) বলা হয়, সেই ক্ষেত্রে আলোকচিত্র ও চিত্রের মধ্যে আর বিশেষ কোনো ব্যবধান নেই।

তথ্যসূত্র ও সহায়ক উৎস
1.    Walter Benjamin, The work of Art in the Age of Mechanical Reproduction, Penguin Book, 1934-2008.
2.    H. H. Arnason, A History of Modern Art, Thames and Hudson, 1977.
3.    Brandon Taylor, Art Today, Laurence King Publishing, 2005.
4.    Art News & Views, May 2011, Journal Published by Aakriti art Gallery.
5.    Shambhu Saha, Faces and places of visva-Bharati, Visva-Bharati 2008.
6.    Benu Sen, Art of Photography, Photographic Association of Dum Dum, Calcutta 700074, 1979/1987.

Leave a Reply