সু শী ল সা হা
হ্যাঁ, এই নামেই তাঁর বিশ্বখ্যাতি। কলকাতার এক বনেদিপাড়া – ১০সি রজনী ভট্টাচার্য লেন, কলকাতা-২৬; কালীঘাটের এই বাড়িতেই তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালের ৪ আগস্ট। বাবার নাম প্রভাসচন্দ্র দাস, মা – নন্দরানি দাস। এই খ্যাতিমান শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছিলাম গত বছর দুর্গাপুজোর মুখে, রবিবারের এক সন্ধ্যায়। কথার পিঠে কথা, তার পিঠে আবার কথার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠল এক বড়মাপের শিল্পীর হয়ে ওঠা, একজন সৎ মানুষের চড়াই-উতরাইয়ের যাপন-বৃত্তান্ত। তিনি সুনীল দাস। অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় সেই মানুষটাই মূর্ত হয়ে উঠলেন।
‘আমার ছবি অাঁকা কবে থেকে শুরু হলো – এই প্রশ্নের উত্তর একটাই, মাতৃগর্ভেই আমি ছবি আঁকা শুরু করেছিলাম। হ্যাঁ, তাই। আমার মা বলেছেন, আমি নাকি তাঁর গর্ভের ভেতরেই হাত বুলিয়ে ছবি আঁকতাম। ওইভাবেই শুরু আমার ছবি অাঁকা। যখন পৃথিবীর আলো দেখলাম, একটু একটু করে বড় হতে শুরু করলাম, আমাকে তাড়া করে ফিরল আঁকিবুঁকির ওই নানা শিক্ষা।
একটু যখন বড় হলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিনেমার ব্যানার পোস্টার ছবি আঁকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। সেইসব শিল্পীর দ্রুতগতিতে আঁকা, দু-চারটি স্ট্রোকের মধ্য দিয়ে চেনা মুখের আদল মূর্ত করা আমাকে অবাক করত। এভাবেই কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কালীঘাটের মানুষ আমি। দুনিয়াজুড়ে এখানকার পটচিত্রের খ্যাতি। তাই অনেক কৌতূহল নিয়ে এখানকার পটুয়াদের বাড়িতে একসময় নিয়মিত যেতাম। মন দিয়ে ওদের আঁকা দেখতাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম পটচিত্র আমাকে টানছে না। কেমন যেন গতিহীন রক্তশূন্য মনে হতো ওইসব ছবি। পটচিত্রে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। মনে হলো হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। রোমাঞ্চ, শক্তি আর প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করার আনন্দ আমার চাই।’
এই মানুষটার ছেলেবেলাটা ছিল দুরন্তপনায় ভরা। চুরি করাটাকে সেসময় একটা বড় শিল্প বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর সেই দুষ্টুমির কথা তাঁর নিজের ভাষাতেই একটু শুনি।
‘ছোটবেলায় শখের চোর বলে আমার বেশ সুনাম ছিল। এর গাছের পেয়ারা, ওর বাড়ির ছাদ থেকে আচার ইত্যাদি হাতিয়ে নেবার নানারকম কৃৎকৌশল তখন আমার দখলে। সবসময় যে ধরা পড়িনি, তা নয়।
তখন আমি কৈশোর পেরিয়েছি। বছর চোদ্দ-পনেরো বয়স হবে। সবাই মিলে পিকনিক করব ঠিক করলাম। ঠিক হলো, এজন্য যে মাংস লাগবে সেই মুরগিগুলো আমি চুরি করে আনব। সে এক রোমাঞ্চকর গল্প। সারারাত ধরে চুরির ছক কষলাম। গভীর রাতে আমার নেতৃত্বে মুরগি চুরি শুরু হলো। প্রত্যেকের হাতে ভিজে গামছা।
এই রকম গামছা দিয়ে মুরগি ধরলে তারা চেঁচায় না – এটা অনেক আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলাম। যা হোক, মুরগি চুরি সম্পন্ন হলো কিন্তু কীভাবে যেন আমাদের দেখে ফেলেছিল কারা। তারা বাড়িতে আমার নাম বলে দেওয়ায় পরদিন পিকনিক শেষে বাড়ি ফিরে সেকি প্রচন্ড ধমক বাবার। দিব্যি দিয়ে নাকখত দিতে হলো।
এমনই দস্যি ছিলাম আমি। একবার তো বাজি ধরে লেকের মধ্যে যে ছোট্ট আইল্যান্ড আছে সেখানে রাত্রিবেলা সাঁতার দিয়ে পৌঁছে ফার্স্ট হলাম। পেলাম এক হাঁড়ি রসগোল্লা।
এই দস্যিপনা, এই দুরন্ত গতিময়তা পরবর্তীকালে আমার ছবিতে এসেছে। একসময় আমি ভালো খেলোয়াড় ছিলাম। খেলার মধ্যে যে বেগ ও আবেগ থাকে তাও একধরনের শিল্প। এই জন্য আমার ছবিতেও এসেছে এক ধরনের গতিবেগ। একটা দুরন্ত শক্তি আমার ছবি অাঁকার প্রেরণা। আমার ছবিও তাই স্থবির নয়, গতিময়।’
আপনি কী করে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আর্ট কলেজে পা রাখলেন? বাড়ির সায় ছিল এতে?
‘না, বাড়ির সায় ছিল না। প্রথমেই বাবা বেঁকে বসলেন। মূলত পাড়া-প্রতিবেশীদের উৎসাহেই আমার মধ্যে ছবি অাঁকার জেদ তৈরি হয়েছিল। তাই ঠিক করেছিলাম, আর্ট কলেজে ভর্তি হব। তাই বাবার আশঙ্কা – না খেয়ে মরতে হবে – একে ভুল প্রতিপন্ন করার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। আমার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তখন থেকেই মনের মধ্যে বাসা বুনেছে। কেননা আমি জানতাম, ছবি অাঁকাই আমার একমাত্র কাজ। এর বাইরে আমি আর কিছু ভাবতে পারি না। আমার জীবন দিয়ে আমি সেটা প্রমাণ করেছি।’
আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন কবে? কেমন ছিল সেসময়কার জীবন? কীভাবে ছাত্রাবস্থাতেই ঘোড়ার ছবি অাঁকতে উদ্বুদ্ধ হলেন? পুরনো সেই দিনের কথা একটু বলবেন?
‘সেটা ১৯৫৬ সাল। আর্ট কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসলাম। আমার আঁকা দেখে কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে আমাকে সরাসরি দ্বিতীয়বর্ষে ভর্তি করে নিলেন। আমিও রীতিমতো অবাক। সেই শুরু। আমি কখনো শ্রমবিমুখ ছিলাম না। সেই সময় দিনরাত ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করে থাকতাম। একটাই লক্ষ্য – আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ক্লাসে শীর্ষ হতে হবে। বৃত্তি আমাকে পেতেই হবে। সে এক মহা ব্যস্ততার সময়। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে বেরোই। তখন প্রতিদিন বাবা দিতেন চারআনা হাত খরচ। সেই সময় আমি প্রধানত আঁকতাম গরু-ছাগল। পশুদের ছবি অাঁকায় সিলেবাসে নম্বর ছিল। কলেজ ছুটির পর শিয়ালদহ স্টেশনে চলে যেতাম। তখন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্ত্তদের ঢল নেমেছে চতুর্দিকে। অনবরত তাঁদের ছবি আঁকি কিন্তু তৃপ্তি পাই না। আমি যেন তখন কী খুঁজে বেড়াচ্ছি। জানি না। হঠাৎ একদিন এস এন ব্যানার্জি রোডে দেখতে পেলাম মাউন্ট পুলিশের একটা তেজি ঘোড়া। চকচকে দেহ। অদ্ভুত উদ্ধত ভঙ্গি। হঠাৎ মনে হলো এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কালগুণে। – এর জন্যই।’
আপনি সেই শিল্পী, যিনি সেই সময় দিনের পর দিন আস্তাবলে বহুক্ষণ কাটিয়েছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন ঘোড়াদের চালচলন। ওই দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে দিনের পর দিন ছবি এঁকেছেন। আপনার সেই মেধাসম্পন্ন মনোনিবেশ আপনাকে একদিন কীভাবে সাফল্যের মুখ দেখাল সেই আখ্যানটি শুনব। শুনব সেই আস্তাবলের দিনগুলোর কথা।
‘সেই যে মাউন্ট পুলিশের তেজি ঘোড়া দেখে থমকে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, আমি পেয়ে গেছি আমার ছবি আঁকার বিষয়। ঘোড়া তখন আমায় রীতিমতো ভর করেছিল। ঘোড়ার তেজি ভঙ্গি, দেহসুষমা, চাহনি ও উদ্ধত স্বভাবের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেয়েছিলাম যেন।
একদিন সাহস করে ওই ঘোড়াদের আস্তাবলে চলে গেলাম। মাউন্ট পুলিশের সেই আস্তাবলে অনুমতি না নিয়ে ঢোকার জন্য প্রথমেই বাধা পেলাম বিশালকায় দারোয়ানের কাছ থেকে। তার সঙ্গে যখন আমার বাদানুবাদ চলছে তখন একজন অল্পবয়েসি অফিসার এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন আমার অভিপ্রায়। তাঁর সুন্দর সপ্রতিভ মুখভঙ্গিমা দেখে আমার প্রাণে জল এলো। তাঁকে বললাম, আর্ট কলেজে এনিম্যাল স্টাডির জন্য আমি ঘোড়ার ছবি আঁকব। খুব কাছ থেকে দেখব ঘোড়াদের চালচলন। সেই অফিসারটি আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। সেই তরুণ অফিসার ডিসুজার সৌজন্যেই ঘোড়ার সঙ্গে আমার মুখোমুখি আলাপ শুরু হলো। সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। ঘোড়ার স্বভাবের মধ্যে যে ভয়শূন্যতা ছিল, তার উদ্ধত ভঙ্গির মধ্যে যে তেজ আমি লক্ষ করেছি তাই-ই ছবি হয়ে উঠল আমার ক্যানভাসে। আমার ছবি অাঁকিয়ে জীবনের শুরুতেই ঘোড়া এমনভাবে আমাকে প্রাণিত করল যে অচিরেই আমি ঘোড়া দাস নামে পরিচিত হয়ে গেলাম।
সে এক সময় গেছে। তখন আমিও বয়সে তরুণ। স্বভাবের কথা তো আগেই বলেছি। কলেজের ক্লাস শেষে ওই এস এন ব্যানার্জি রোডের ঘোড়ার আস্তাবলে ঢুকে পড়ি। কখনো কখনো সারারাত ঘোড়াদের সঙ্গে কথা বলি, ওদের চালচলন নিরীক্ষণ করি। ঘোড়ারাও যেন আমাকে চিনতে পারে। সে এক অদ্ভুত সময়। আমাদের ভাষাবিনিময় হয় না। চোখে চোখে কথা হয়। আমি ওদের দেখি আর বিহবল হয়ে ছবি আঁকি একটার পর একটা। শুরু হয় এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এটা কিন্তু সেইভাবে বোঝানো যাবে না। ঘোড়ারা ঘাড় নাড়ে, শরীরে ঝাঁকুনি তোলে, মাছি তাড়ায় লেজ দিয়ে। কখনোবা ঊর্ধ্বমুখে দুটো পা তোলে। আবার কখনোবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। আমি ওদের শরীরের খাঁজে খাঁজে অন্য এক শরীরের উদ্ভাস লক্ষ করি। ক্রমাগত আবিষ্কার করে চলি ওদের বিচিত্র রূপময় শরীর।
তখন তো প্রতিদিন ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে যেতাম, আবার কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে নিয়েই ফিরতাম। অবশেষে একদিন সেই তরুণ অফিসার ডিসুজার সৌজন্যেই আমার আঁকার সরঞ্জামগুলো ওখানেই রেখে আসার অনুমতি পেলাম। সেই ডিসুজার কথা আমি তাই কোনোদিনও ভুলতে পারি না। তিনি অনুমতি না দিলে কী হতো জানি না।
এইভাবে বছরখানেকের মধ্যে আমি কয়েক হাজার ঘোড়ার ছবি এঁকে ফেললাম। নানা ভঙ্গির সেই ঘোড়ার ছবি। ছবির পর ছবি অাঁকছি কেবল। সে এক অদ্ভুত সৃজনকাল। সব শিল্পীরই হয়তো এরকম এক সৃজনকাল আসে। আমার তখন এক আচ্ছন্ন দশা। আমার সেই অাঁকার বহর দেখে খুশি হলেন আর্ট কলেজের মাস্টারমশাইয়েরা। অজস্র ছবির মধ্য থেকে তিনটে ছবি বাছাই করে বাঁধিয়ে আনার জন্যে বললেন। ভালো বাঁধাইয়ের পয়সা কোথায় পাব? তাই কালীঘাট থেকে এক টাকায় কাচবিহীন ফ্রেমে বাঁধাই করে পাঠালাম দিল্লির ললিতকলায়। দুমাস পরে চিঠি এলো সুসংবাদ নিয়ে। আমি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। সে কী উত্তেজনা তখন! কলেজজুড়ে রীতিমতো হইচই। আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচ শুরু হয়ে গেল। কলেজময় রটে গেল আমার সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা। ছাত্রাবস্থায় আমার আগে কেউ ওই পুরস্কার পেয়েছে বলে শুনিনি। ওই একই বছরে দেশের আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে আরো দশটি পুরস্কার পেলাম। এই সাফল্য আমাকে রীতিমতো উৎসাহী করে তুলল। এইভাবে কলেজজীবন শেষ হলো। ইতোমধ্যে আমার বেশ কিছু ছবি বিক্রি হয়েছে। দাম ছবিপ্রতি একশ টাকা। সেটাই তখন অনেক। আমার তখন পালে লেগেছে হাওয়া।’
আপনার প্রথম প্রদর্শনীর কথা কিছু বলুন। কোথায় হয়েছিল সেই প্রদর্শনী? কবে? কেমন সেই অভিজ্ঞতা! আর এই একশ টাকা ছবির দামই বা কী করে হলো?
‘সেটা ১৯৫৭ সাল। আসামের গৌহাটিতে হয়েছিল সেই প্রদর্শনী। তখনো সরাইঘাট ব্রিজ হয়নি। হাওড়া থেকে বাটিহার হয়ে পান্ডুতে গেলাম। ওখান থেকে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ লঞ্চে পার হয়েছিলাম। লঞ্চের ভেতরেই খেয়েছিলাম মাংস-ভাত। সেই অসাধারণ খাবারের স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে আছে। দেশে-বিদেশে কত পাঁচতারা হোটেলে খেয়েছি। কিন্তু ওই স্বাদের সঙ্গে কারো যেন তুলনা হয় না। গৌহাটি চমৎকার শহর। কলকাতার মতো ভিড় নেই। চারদিকে সবুজঘেরা পাহাড়। অনেক গুণীজন আমার ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। আমি রীতিমতো অনুপ্রাণিত। আমার সেই প্রথম প্রদর্শনীর সেই সাফল্যের কথা কোনোদিন ভুলিনি।
আর একশ টাকায় ছবি বিক্রির ব্যাপারটা বলি। গৌহাটির প্রদর্শনীর বছরতিনেক বাদে (১৯৬০) কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে আমার এক প্রদর্শনী হয়েছিল। অনেকে এসেছিলেন আমার ছবি দেখতে। বন্ধুবান্ধব, শিল্পানুরাগী, শিল্পবোদ্ধা, প্রবীণ শিল্পী, সহপাঠী বন্ধুরা আর আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। প্রদর্শনী সফল হলো। আর ওদিকে কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনী নিয়ে আমরা তখন ব্যস্ত। সেই সময় কলেজ চত্বরেই একজন বিদেশি ভদ্রলোক আমার কাছে এলেন। অ্যাকাডেমিতে আমার ছবি দেখেছেন। ভাবেননি, আমার বয়স এত অল্প। তিনি তখন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। তিনি আমার ছবি কিনতে চান। প্রবল উৎসাহে বাড়ি থেকে অনেকগুলো ছবি এনে তাঁকে দিলাম। তিনি তা থেকে একটা নয়, দুটো নয় – একসঙ্গে দশটা ছবি বেছে নিলেন। দাম জানতে চাইলে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। একজন প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের পরামর্শে ছবিপ্রতি একশ টাকা চাইলাম। বিদেশি ভদ্রলোক মনে হলো রীতিমতো অবাক হয়ে গেছেন। হয়তো আরো বেশি দাম চাইব ভেবেছিলেন। যাহোক একসঙ্গে হাতে পেলাম দশটা ছবির দাম। এক হাজার টাকা। তখন ওই টাকাই আমার কাছে অনেক।’
সেই ১৯৬০-এই তো আপনি ফ্রান্সে গেলেন। ছবি আঁকিয়েদের স্বর্গরাজ্য প্যারিসে যাওয়ার সেই অভিজ্ঞতার কথা বলুন। তখন তো আপনার মাত্র একুশ বছর বয়স। কীভাবে একেবারে ভিন্ন দেশের ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিলেন? প্যারিসের সেই দিনগুলোর কথা জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।
‘হ্যাঁ, ওই ১৯৬০ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি পেয়ে রওনা হবার উদ্যোগ নিলাম। চোখের সামনে অন্তহীন স্বপ্নের এক বিশাল জগৎ। আমাকে ডাকছে বহির্বিশ্ব। আমি রীতিমতো উঠেপড়ে লাগলাম বিদেশযাত্রার তোড়জোড়ে। কোনো নিয়মকানুন জানা ছিল না। তবু ঐকান্তিক আগ্রহে, সবার সহায়তায় পাসপোর্ট-ভিসা হাতে এলো। তখন পাঁচশো ডলার নিয়ে যাবার অনুমতি থাকলেও পুরস্কার আর ছবি বিক্রির টাকা নিয়ে আমার সংগ্রহ হলো মাত্র আড়াইশো ডলার। দমদম বিমানবন্দর থেকে রওনা হলাম একদিন। মনে সে কী উত্তেজনা! তার সঙ্গে আনন্দের মিশেলে আমি তখন রীতিমতো দিশেহারা। আমি যাচ্ছি ফ্রান্সে! শিল্পীদের স্বর্গরাজ্য।
ফ্রান্সের ভারতীয় দূতাবাসকে আগেই জানানো ছিল। তবু প্যারিসের বিমানবন্দরে কেউ আমাকে রিসিভ করতে এলো না। অচেনা দেশ, অচেনা পরিবেশ। ভাষা জানি না। কেউ ইংরেজি বোঝে না। এতটা পথ পেরিয়ে আসার ধকল, উদ্বেগে উদ্বেগে তখন আমার প্রাণান্তকর অবস্থা। আস্তে আস্তে গোটা এয়ারপোর্টটা জনমানবশূন্য হয়ে গেল। যে যার গন্তব্যে চলে গেল। আমি কেমন একা আর বোকার মতো বসে আছি। এয়ারপোর্টের বাইরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে। চরাচর নিস্তব্ধ। কোথায় সেই ফরাসিদের প্রাণচাঞ্চল্য? তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না সব বড় শহরের এয়ারপোর্ট হয় অনেক দূরে। যাহোক, আমার অল্প বয়সের স্বপ্ন দেখা মনে তখন বাসা বুনেছে হতাশা। অপ্রত্যাশিত এক স্বপ্নভঙ্গের আঘাতে আঘাতে আমি যেন কেমন জর্জরিত তখন।
তখন এতই বিধ্বস্ত অবস্থা আমার যে, আমি লাগেজটাও সংগ্রহ করিনি। যাহোক, ওটা এক এয়ারহোস্টেসের সহায়তায় খুঁজে পেলাম। সবাই যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলাম। এই সময় তিন-চারজনকে একটা মিনিবাসে উঠতে দেখে আমি তাতে উঠে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। ফরাসি ভাষায় টিকিট চাইলে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আমার কাছে তো কোনো ফ্রাঁ নেই। যা আছে, সব ডলার। যাহোক, আমার এই অসহায় অবস্থা দেখে একজন আফ্রিকান আমার টিকিটটা কেটে দিলেন। বাস এয়ারলাইনসের সিটি অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সবাইকে নামতে দেখে আমিও নামলাম। সবাই যে যার জায়গায় চলে গেল। আমি একা বসে আছি। তখন বিকেল হয়ে গেছে। অজানা দেশ, অচেনা পরিবেশ, দুর্বোধ্য ভাষা – কী যে এক দুঃসহ পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম সেদিন। ফরেন এক্সচেঞ্জ কাউন্টার থেকে একশ ডলার ভাঙালাম। পাশেই একটা বার দেখে কী জানি কী ভেবে একটা বিয়ার কিনে আনলাম। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছি। যাহোক, বোতল খুলে মুখে দিতেই গা গুলিয়ে উঠল। কী তেতো! খেতে পারলাম না। জীবনে সেই প্রথম আমার বিয়ার চেখে দেখা।
একটা এসটিভি বুথ দেখে ভাবলাম, ভারতীয় দূতাবাসে একটা ফোন করি। ফোন করতে গিয়ে অবাক। বাটনে কোনো নম্বর নেই, ওয়ান টুর বদলে এবিসিডি। ওদেশে ফোন করার রীতিও আলাদা। কান্নায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা আমার। এমন সময় এক ভদ্রলোক এলেন আমার কাছে। ফরাসি ভাষায় কী সব বললেন। তাঁর কথার মধ্যে কয়েকবার দাস ও একবার সুনীল দাস শুনে বুঝলাম তিনি আমাকে উদ্ধার করতে এসেছেন। কোনোরকমে বুঝলাম ‘ইপক’ নামে এক হোটেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ট্যাক্সি ডেকে চললাম সেই হোটেলের দিকে। ট্যাক্সিকে যে ওদেশে ট্যাক্সিই বলা হয় সেটা বুঝলাম তখনই।
যাহোক হোটেলে এলাম। রুম নম্বর ১৬-তে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ঘরে ঢুকে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চমৎকার ঘর। চমৎকার বিছানা পর্দা চেয়ার ইত্যাদি। এত সুন্দর ঘর এই প্রথম দেখলাম। তখনো প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। হোটেলের লোকজনের কথাবার্তায়, ইশারায় বুঝলাম ওখানে খাবার ব্যবস্থা নেই। খেতে হবে বাইরে গিয়ে। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সন্দেশ খেয়ে রাত কাটাব ঠিক করলাম। কলকাতা থেকে নিয়ে আসা খামে বাড়ির ঠিকানা লিখে লম্বা এক চিঠি লিখতে বসলাম। কী যে লিখেছিলাম সব মনে নেই। তবে আমি যে হেরে যাচ্ছি, আমি অচিরে ফিরে আসব এসব কথাই লিখেছিলাম ঘুরেফিরে। জানালা খুলে দেখি একটি দোকান। TABAC। তাবাকে স্ট্যাম্প পাওয়া যায় জানতাম। যাহোক সেখানেই নানাভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভারতে পাঠাবার স্ট্যাম্প কিনে চিঠি পোস্ট করলাম।’
এরপর কি ফিরে এলেন?
‘তা কি হয়? একবার যখন গেছি তখন কি শেষ দেখা না দেখে বেপরোয়া সুনীল দাস ফিরে আসতে পারে? যাহোক, সন্দেশ খেয়ে কি আর পেট ভরে? তাই খাবারের সন্ধান করতে লাগলাম। একটা কফিশপ দেখলাম। কফি চাইলাম। টেবিলে পৌঁছে গেল। দেখলাম অনেকে শিংয়ের মতো বাঁকা পাউরুটি যাকে ওরা ‘কোয়াসো’ বলে তাই খাচ্ছে। কোনোরকমে ইশারা করে ওই পাউরুটি আনিয়ে কফির সঙ্গে একনাগাড়ে বারোখানা খেয়ে ফেললাম। পেট ভরল। হোটেলে ফিরে সটান বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এক ঘুমে রাত কাবার।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে শহর চেনার চেষ্টা করলাম। নতুন দেশ, অচেনা শহর, অজানা মানুষজন। আমার যে কী অবস্থা তখন! দোকানের হোর্ডিং দেখে দেখে হোটেলে ফেরার পথ মনে রাখছি আর খুঁজছি খাবারের দোকান। একটা বাজার এলাকা পেলাম। দেখলাম নানারকম ফল পাওয়া যাচ্ছে। কী আর করব! সাতদিন কাটালাম ফল খেয়ে। ধৈর্যের বাঁধ যখন প্রায় ভেঙে যাচ্ছে তখন এক নিগ্রো যুবকের সঙ্গে দেখা হলো আমার। দেখলাম, সে ইংরেজি জানে। তাঁকে আমার এই সাতদিনের ফলাহারের বৃত্তান্ত জানালাম। সে আমাকে একটা খাবারের দোকানে নিয়ে গেল। আমি কী খাব, জানতে চাইল সে। তখন সামনের টেবিলে দেখি এক ভদ্রলোক এক ফরাসি ডিশ খাচ্ছেন। আমিও ওটা অর্ডার দিলাম। চমৎকার স্বাদ সেই খাবারের, যার নাম ‘রোজ’ মিট স্ট্যাগ। অতুলনীয় সেই স্বাদ। একসময় এটাই হয়ে উঠল আমার প্রিয় ফরাসি খাবার।’
কিন্তু যেজন্য ফরাসিদের দেশে আসা তার কী হলো?
‘হ্যাঁ, এবার সেটাই বলি। ওই ছেলেটি আমাকে ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে দিলো ঠিকই; কিন্তু ওখান থেকে কোনো সাহায্যের আশ্বাস পেলাম না। দেশ থেকে নিয়ে আসা সামান্য ওই কটি ডলার তখন প্রায় শেষ। ওদের এসবই বললাম। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কোনো সহানুভূতিও পেলাম না। জনবহুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে হতাশায় ক্লান্তিতে আমার তখন রীতিমতো ভেঙে পড়বার মতো অবস্থা। সন্ধে নেমে আসছে ধীরে ধীরে। বিমূঢ় হতবুদ্ধি আমি দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় পিঠে এক কোমল স্পর্শ পেলাম। দেখলাম একজন সুদর্শন পাদ্রি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি ভারতীয় কি না জিজ্ঞেস করায় ঘাড় নাড়লাম। তিনি ভারতীয়দের ভালোবাসেন – একথাই বললেন ইংরেজিতে। মনে হলো, আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন মূর্তিমান মুক্তিদূত। তাঁর একটি কথাতেই এটা আমি বুঝলাম। তিনি বলেন, ‘আই লাভ ইন্ডিয়ান্স’। আমার কি অসুবিধে হচ্ছে – একথা জিজ্ঞেস করতেই আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একরাশ কথা। এই প্রথম বিদেশে এসে মন খুলে কাউকে কিছু বললাম। তিনি আমাকে পরম যত্নে একটা দোকানে নিয়ে গেলেন, সেখানে আমাকে পেটপুরে খাওয়ালেন। আমাকে নিয়ে এলেন হোটেলে। এরপর থেকে প্রায়ই তিনি আমার জন্য পাউরুটি, মাখন, ফল ইত্যাদি নানারকম খাবার নিয়ে আসতেন। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে শহরের নানা জায়গায় ঘুরতে যেতেন। ওঁর সঙ্গ পেয়ে আমি যেন বর্তে গেলাম। আজ আর বলতে দ্বিধা নেই, ওই সময়ে যদি ওঁর সান্নিধ্য না পেতাম তাহলে হয়তো আমি দেশেই ফিরে আসতাম। একদিন তিনি আমাকে ফরাসি সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে নিয়ে গেলেন। আমার ছবি তোলা হলো কয়েকটি। আমাকে পাঁচ-ছটা কার্ড করে দেওয়া হলো – যাতে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়া এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে ঢোকার সুযোগ পেলাম।’
কিন্তু কী করে আপনি ভাষার ব্যবধান ঘোচালেন? ফরাসি ভাষা না জানলে তো ওদেশে চলাফেরা করা মুশকিল। ভাষাটা শিখলেন?
‘হ্যাঁ, ভাষাটা শিখতে হলো অবশেষে। সে এক প্রাণান্তকর চেষ্টা। অনেক চেষ্টা করেও আড়ষ্টভাব কাটল না। শেষে গেলাম দক্ষিণ ফ্রান্সের একটা জায়গায় ভাষা শিখতে। পাদ্রি ভদ্রলোক আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেলেন। শুরু হলো এক নতুন অভিযান। উৎকণ্ঠায় ভালো করে ঘুমোতে পারলাম না রাতে। ভোরবেলা পৌঁছালাম সেখানে। ওখানে কিন্তু ট্রেন থেকে নামতেই একজন সুদর্শন মানুষ আমাকে রিসিভ করলেন। ফরাসি সরকারের সৌজন্যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পাহাড়ের নিচে আমার থাকার ঘর। সকাল ছটা থেকে সন্ধে ছটা পর্যন্ত ক্লাস, রাতে একজন মাদামের সঙ্গে পড়তে যাই। সারাদিন ফরাসি ভাষাতেই কথা বলতে হতো। পারি বা না পারি! কেউ ইংরেজি বললেই সাসপেন্ড। এইভাবে এক মাসের মধ্যেই বেশ কিছুটা ফরাসি ভাষা রপ্ত করে ফেললাম। তখন এমন হলো যে, সবসময় ফরাসি ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করতাম। এমনকি কুকুরের গায়ে পা লেগে গেলেও বলে উঠি – ‘পা তো’ (ক্ষমা করো)। একসময় সত্যি সত্যি ফরাসিতে অনর্গল কথা বলতে শিখে গেলাম। তারপর ফিরে এলাম প্যারিসে। শুরু হলো আবার ছবি অাঁকা, প্রদর্শনী। অর্থ ও যশ দুই-ই হচ্ছে। ম্যুরাল করছি, ছবি এঁকে দিচ্ছি, লিথোগ্রাফিতে প্রিন্ট তৈরি করছি। রীতিমতো ব্যস্তসমস্ত জীবন।’
ভাষা তো শিখলেন। কত বন্ধুবান্ধব হলো। বান্ধবীও হলো। কারো সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ হলেন কি? তখন তো আপনার প্রেম করার বয়েস।
‘বেশ মজার প্রশ্ন করেছেন। এসব ব্যাপারে আমি অকপট হতে চাই। যে অভিজাত এলাকায় আমি থাকতাম, যে মহিলার পেয়িং গেস্ট হয়ে, তাঁর নাম মাদাম রস। ভারি সুন্দর মুখ। ওঁর বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডের একখানি ঘর আমাকে দিয়েছিলেন স্টুডিওর জন্য। তখন প্রায়শই সারারাত ধরে কাজ করতাম। মাঝে মাঝে মাদাম কফি বা দুধ খেতে দিতেন। তখন একসময় লক্ষ করতাম, আমার কোনো বন্ধু এলে মাদাম তাঁকে খুব খাতির করেন আর বান্ধবী এলে বলেন : আমি বাড়ি নেই। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। একদিন সারারাত আড্ডা দিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফিরে দেখি মাদাম কাঁদছেন। কাজের লোকের কাছে জানলাম, আমি রাতে ফিরিনি বলে মাদাম কিছু খাননি। দিন দিন মাদামের পাগলামি বেড়ে চলল – যা একসময় অন্যদের চোখেও পড়ল। একসময় তো প্যারিসের বন্ধুমহলে রটে গেল যে, আমি মাদামকে বিয়ে করছি।
ওখানে থাকাকালীন অনেক তরুণী বন্ধু জুটেছিল। অনেকের সঙ্গেই প্রেম হতে হতে হয়নি। এর মধ্যে একজনের নাম রমা, নেপালের রাষ্ট্রদূতের মেয়ে। সেটাও বেশিদূর এগোয়নি। প্রসঙ্গক্রমে বলি – দেশে এক বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধারের মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বেশিদূর এগোয়নি। বড়লোকের মেয়ে বড়মাপের মানুষকেই বিয়ে করেছিল। পিতৃবন্ধু অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীকে সে বিয়ে করেছিল। সেই অর্থে ওটা প্রেম ছিল না। প্রেম করেছিলাম যার সঙ্গে তার নাম গীতা। সেটা আমার বাল্যপ্রেম। কালক্রমে গীতাই হয়ে উঠল আমার প্রকৃত জীবনসঙ্গী, সেই অর্থে সহধর্মিণী।’
আপনি যেমন অসংখ্য ঘোড়ার ছবি এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন ষাঁড়ের ছবি। শুনেছি আপনি স্পেনে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছেন ষাঁড়ের লড়াই। সেইসব শৌর্যবীর্যময় তেজ ও যুদ্ধের অভিব্যক্তি কীভাবে আপনার ছবিতে এলো?
‘সেটা ১৯৬২ সাল। প্রাদো মিউজিয়াম দেখব বলে প্যারিস থেকে স্পেনে গিয়েছিলাম। ওখানকার দারুণ দারুণ ছবি আর ভাস্কর্য দেখে সময় কাটছিল ভালোই। প্রতিদিন রাতে হোটেলে ফিরে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করতাম। আমি যে একজন শিল্পী, আমি যে ঘোড়ার ছবি অাঁকি জেনে ওরা আমাকে বলল ষাঁড়ের লড়াই দেখার জন্য। ওদের কথায় একদিন গেলাম সেই ভয়ংকর লড়াই দেখতে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে বোঝানো মুশকিল। চারদিকে অসংখ্য দর্শক। উল্লাস আর চিৎকারে গ্যালারি ফেটে পড়ছে। বিশাল মাঠে ক্রুদ্ধ উত্তেজিত হিংস্র ষাঁড় দেখে রক্ত হিম হয়ে আসে। আত্মরক্ষা ও আক্রমণের সে এক মহাযুদ্ধ। ষাঁড়ের আক্রোশ, ঔদ্ধত্য, প্রতিপক্ষের কৃৎকৌশলের কাছে ক্লান্ত রক্তাক্ত হয়ে পরাজয়বরণ দেখতে দেখতে আমি নিজের মধ্যে একই সঙ্গে ষাঁড় ও মানুষের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলাম।
ঘোড়ার মতো ষাঁড়ও কালক্রমে আমার আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠল। এঁকে ফেললাম কয়েক হাজার ষাঁড়ের ছবি। তারা কখনো ক্রুদ্ধ, কখনো ক্লান্ত। নিবিড়ভাবে দেখা তাদের নানা ভঙ্গি আমার ছবিতে উঠে এলো। সেইসব ছবি একটিও আমার কাছে নেই।
এক সপ্তাহের জন্য স্পেনে গিয়ে ছিলাম এক মাস। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কীভাবে যেন ঘোড়া আর ষাঁড় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল আমার ছবিতে। শিল্পবোদ্ধারা সেইসব ছবি পরম আদরে গ্রহণ করেছেন – এটাই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি।’
এবার আপনার ফ্রেস্কো তৈরির কথা বলুন। এই কাজে আপনার দোসর ছিলেন রশিদ চৌধুরী। রশিদের কথাও এই সূত্রে কিছু বলুন।
‘প্যারিসেই ফ্রেস্কোর কাজে আমার হাতেখড়ি। একজন অধ্যাপক আমাকে এই শিল্পকর্ম শিখিয়েছিলেন। প্রথম ফ্রেস্কো ২০ ফুট বাই ২০ ফুট এক দেয়ালে। প্রথমে লে আউট, তারপর সিমেন্ট-বালিতে প্লাস্টার করে তার ওপর ব্রাশের স্ট্রোকের পর স্ট্রোক দিয়ে চিত্রময় করে তোলা। প্লাস্টার করা একটা শিল্প। মাটিতে সিমেন্ট বালি পড়ত না। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
ঢাকার রশিদ চৌধুরী আমার সহপাঠী। আমি আর রশিদ ফ্রেস্কো কাজের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠি। রশিদ আজ আর নেই। ওর কথা খুব মনে পড়ে। ওর ফরাসি প্রেমিকা, পরে স্ত্রী এ্যানির কথাও মনে পড়ে। সে এক মর্মছোঁয়া অসামান্য বন্ধুত্বের স্মৃতি। আমরা দুজনেই মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ভঙ্গিতে ফ্রেস্কো করতাম। হঠাৎ দেখে মনে হবে বড় তৈলচিত্র। রশিদ আর আমি ছিলাম অভিন্নহৃদয়। সমগ্র প্যারিস আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি একসঙ্গে। রশিদের বিয়েতে কত না হৈ-হুল্লোড় করেছি সবাই মিলে। বেশ উঁচুদরের শিল্পী ছিল রশিদ। অদ্ভুত এক বর্ণময় চরিত্র তাঁর। স্পেনের মাদ্রিদে সে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করতে যায়। পরে ঢাকায় ফিরে ওখানকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে যোগ দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের চেয়ারম্যানও হয়েছিল। রশিদ ফ্রেস্কোর কাজে আমাকেও ছাড়িয়ে যায়। রশিদের মাধ্যমেই বাংলাদেশের আরেক গুণী শিল্পী কিবরিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। আজ কিবরিয়াও বেঁচে নেই। দেশকে ভাগ করা সহজ – কিন্তু তার ভাষা, সাহিত্য ও চিত্রকলাকে ভাগ করা যায় না। সংস্কৃতির দীপশিখা তাই জ্বলছে অবিরাম। এই চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। বাঙালি জাতিসত্তার আপনভূমি। বাঙালি হিসেবে ওই দেশ নিয়ে আমিও গর্বিত। গত কয়েক বছরে আমি কয়েকবার ঢাকায় গেছি। ওখানকার নানা আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি। চিত্রশিবির তো নয়, শিল্পীদের নিয়ে রীতিমতো উৎসব। কেবল ছবি অাঁকা নয়, সঙ্গে কবিতা পাঠ, আলোচনা আড্ডা। সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। সবার আবদার ঘোড়ার ছবি অাঁকতে হবে। ঘোড়ার ছবি এঁকে এঁকে আমি কারো কাছে ঘোড়া দাস, কারো কাছে ঘোড়া সুনীল। সবার আবদার মেটাই – একটার পর একটা ঘোড়ার ছবি এঁকে। ঘোড়া অাঁকায় আমার কোনো ক্লান্তি নেই।’
সেই মাদাম রসের কথা বলছিলেন, তাঁর কী হলো শেষ পর্যন্ত?
‘ও সেই মাদাম রস? যে তখন আমার কাছে এক মূর্তিমান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। স্পেন থেকে ফিরে ষাঁড় আমাকে পেয়ে বসেছিল। কত যে ষাঁড়ের ছবি এঁকেছিলাম তখন। নানা জায়গায় প্রদর্শনী হচ্ছে তখন। ছবি বিক্রিও হচ্ছে। হিসাব করে খরচ করি। টাকা ব্যাংকে জমাই। ছেলেবেলা থেকেই আমি হিসাবি।
এদিকে বাড়ি ফেরার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ওদিকে মাদাম রসের ভালোবাসার উৎপাতে আমি নাজেহাল হয়ে উঠেছি। পালাবার জন্য সুযোগ খুঁজছিলাম। তিনি প্রতিবছর একবার তাঁর মেয়ের কাছে যেতেন। একবার যখন গেলেন আমি সেই সময় প্যারিস ছেড়ে বাড়ি চলে এলাম। সেটা ১৯৬৪ সাল। এদিকে মাদামের চিঠি আসে নিয়মিত। প্রতিটি চিঠিতে একটি করে গোলাপ ফুল। এবার একটি চিঠিতে জানালাম আমি বিবাহিত, ছেলেপিলে আছে। ব্যস, সেই যে মাদাম রস চুপ করে গেলেন আর কোনো সাড়া পেলাম না।’
কলকাতায় ফিরে কী করলেন। প্রদর্শনী হলো, ছবি বিক্রি হলো কেমন? আর সমাদর?
‘ওই সময় কলকাতায় একটাই আর্ট গ্যালারি ধর্মতলার ‘প্রিয়দর্শিনী’। ষাঁড় সিরিজের ছবি নিয়েই প্রথম প্রদর্শনী হলো। ভালো সাড়া পেলাম। তবু সংশয় যায় না। কেননা তখন এখানকার ছবির বাজার ভালো ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হতো, দেশে ফিরে কি ভুল করলাম! প্যারিসে থাকলে আরো অর্থোপার্জন করতে পারতাম!
সাল ১৯৬৫। তখন দিল্লিতে ছোটদের অাঁকা শেখাচ্ছি। ওই সময় পালিকাবাজারের বিশাল খোলা মাঠে আমাদের আড্ডা বসত। ঠিক করলাম, ওই খোলা মাঠেই ছবির প্রদর্শনী করব। নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা, শিল্পবোদ্ধা বন্ধুরা পরম উৎসাহ দিলেন। প্রদর্শনী শুরু হলো একসময়। অতি সাধারণ মানুষ থেকে নানা শ্রেণির মানুষ এলেন ছবি দেখতে। ব্যাপক সাড়া পেলাম। সবাই মিলে ঠিক করলাম রোজ রাতে খোলা আকাশের নিচে ছবি অাঁকব। শুরু হলো পালিকাবাজারের ওপেন আর্ট গ্যালারি। শুরু হলো ওইখানে গান-বাজনার আসর। অনেক শিল্পী আসতে লাগলেন। অদ্ভুত এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরি হলো। সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের ছবি অাঁকা দেখতেন। আমরাও রীতিমতো প্রাণিত হতাম। ক্রমশ ওই খোলা জায়গা ঘিরে ফেলা হলো। কত যে লেখক, শিল্পী, চিত্রনির্মাতা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ওখানে এসেছেন। দিল্লিতে আমার বেশিদিন থাকা হয়নি। কিন্তু ওই মুক্ত আর্ট গ্যালারি বহুদিন চলেছিল। ১৯৭৫ সালে হঠাৎ দেশে ইমার্জেন্সি জারি হওয়ায় সব স্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন কে বা কাদের প্ররোচনায় বুলডোজার দিয়ে ওই আর্ট গ্যালারি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। কোনো কাগজে এক লাইনও লেখা হলো না। সারাদেশের কণ্ঠ তখন রুদ্ধ।’
এরপর তো আপনি কলকাতায় ফিরে এলেন। চাকরিও করলেন। সেই সময়কার কথা একটু বলবেন?
‘দিল্লিতে কাজ জুটল না। কলকাতায় ফিরে এসে ইন্টারভিউ দিলাম ইন্ডিয়ান হ্যান্ডলুম্সে। চাকরিটা হলো। কলকাতার অফিসে যোগ দিলাম। শুরু হলো অন্য এক ধরনের ব্যস্ততা। তখন এক অদ্ভুত শাড়ির নকশা করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম লোডশেডিং শাড়ি। জর্জ ফার্নান্ডেজ তখন হ্যান্ডলুম দপ্তর দেখতেন। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মহিলাদের জন্য শাড়ি তৈরি করতে বলেন। তাঁর কথায় আমি মোটা সুতো দিয়ে গ্রামের মহিলাদের জন্য শাড়ি বানাতে শুরু করলাম। তখন নানা ভাবনা আমার মাথার মধ্যে উঁকি মারত। রং নিয়ে বিচিত্র খেলায় মেতে উঠলাম। তখনই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি অদ্ভুত ধরনের শাড়ির নকশা তৈরি করলাম। ওরই নাম লোডশেডিং শাড়ি। গ্রামেগঞ্জে সস্তা এই শাড়ির খুব চাহিদা ছিল।’
ছবি অাঁকা ছাড়াও ভাস্কর্যের কাজও আপনি করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কী রকম?
‘ষাটের দশকে ‘সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট’ নামে শিল্পীদের একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল। তাদের উদ্যোগে অনেক আর্ট ক্যাম্প তখন হয়। একবার ঠিক করা হলো চিত্রকররা ভাস্কর্য তৈরি করবেন। কলেজের পাঠক্রমে ভাস্কর্যের কিছুটা শিক্ষা আমি নিয়েছিলাম। এছাড়া কাটুম-কুটুম জাতীয় কিছু কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার ছিল। তবে ছবি অাঁকায় এত নিমগ্ন ছিলাম ভাস্কর্যের কাজ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এতদিন পরে ওই সুযোগ আসায় ব্যাপারটাকে একরকম চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিলাম। যাহোক, যথাসময়ে ওই ক্যাম্পে ভাস্কর্য তৈরিতে উঠেপড়ে লাগলাম। একে একে তৈরি করলাম ষাঁড়ের মাথায় ক্ষিপ্ত একটা ঘোড়া। বালক বয়সে ঠাকুর গড়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। মূর্তি গড়তে গড়তে আমি আমার নিজের মধ্যে এক অন্য আমিকে আবিষ্কার করে ফেললাম। আমার সেই ভাস্কর্য অনেক বোদ্ধার মন জয় করেছিল। সব মূর্তি বিক্রি হয়ে গেল। শিল্পী পরিতোষ সেনের মৃত্যুর পর তাঁর একটা চিঠিতে জানা গেল, তিনি কুড়িজন নির্বাচিত শিল্পীর নাম নিজেই জানিয়ে বলে গেছেন তাঁরা যেন তাঁর ছবি অাঁকেন বা মূর্তি গড়েন। সেই তালিকায় আমার নামও ছিল। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন কিন্তু শিল্পী হিসেবে আমাকে এই মর্যাদা দিয়ে যাবার জন্য খুব গৌরববোধ করেছিলাম। মনপ্রাণ ঢেলে তাঁর একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছিলাম। ব্যতিক্রমী কাজে আমি বরাবরই আগ্রহবোধ করি। পরিতোষ সেনের ওই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে আমি খুবই তৃপ্ত হয়েছি।’
এছাড়া তো আপনি অনেক আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন। কেমন সেই অভিজ্ঞতা। নিজেই তো একটি গ্যালারি তৈরি করেছেন। কেন গ্যালারি তৈরি করেছেন? এতে আপনি কোনো আনন্দ পান?
‘‘হ্যাঁ, আরো অনেক আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে নিজেই আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করি। এতে নবীন-প্রবীণ বহু শিল্পী যোগ দেন। প্রকাশ্যে এইভাবে ছবি অাঁকতে বিদেশের বহু শিল্পীকে দেখেছি। এতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একধরনের যোগসূত্র তৈরি হয়। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমি অনেকগুলো আর্ট ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি। ১৯৮৫ সালে মুম্বাইতে ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট এনকাউন্টার’ নামে একটি বিশ্বমানের আর্ট ক্যাম্প হয়েছিল। দেশ-বিদেশের বহু গুণী শিল্পী এতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের পাশে নিজেকেও যুক্ত করতে পেরে আমি কৃতার্থ হয়েছি।
২০০৫ সালে আমার স্বপ্নের গ্যালারির উদ্বোধন হয়েছিল। সূচনা অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীত চোপড়াসহ বহু জ্ঞানীগুণী আসেন। তখন প্রায়শই দেশ-বিদেশের অনেক বোদ্ধা, শিল্পরসিক ও শিল্পী এখানে আসেন। বিশ্বমানের এই গ্যালারি খোলা হয় রাত দশটায়। এটা আমার প্রিয় একটি জায়গা, আমার আনন্দের আশ্রয়। যখনই বিষণ্ণ হই, ক্লান্ত হই – ওখানে চলে যাই। ওখানে যে অনাবিল আনন্দ পাই তার তুলনা আর কোথাও নেই।’
আপনি প্রখ্যাত চিত্রকর মকবুল ফিদা হুসেনের সান্নিধ্যে এসেছেন। তাঁর সম্পর্কে এবার কিছু বলুন।
‘হুসেন একজন ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন। এক অপ্রিয় পরিস্থিতির মধ্যে তিনি তাঁর দেশ ছেড়ে চলে যান। দেশের বাইরেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই অভিমানী ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন শিল্পী বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। ভাবতে খারাপ লাগে দেশে ওঁর প্রদর্শনীতে যখন হামলা হয়েছিল তখন আমরা ওঁর পাশে দাঁড়াইনি। মৃত্যুর পরেও তাঁর দেহ স্বদেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাইনি। তাঁর এই নিঃসঙ্গ মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তিনি যে আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। দিল্লিতে একবার একজনের আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে ছবি অাঁকতে গেয়েছিলাম। বিশাল বড় ক্যানভাসে তিন ঘণ্টায় ছবি শেষ করি। অনেক মানুষ সেই সময় এসেছিলেন। এর মধ্যে হুসেন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর স্বাক্ষরিত একটি ছবি উপহার দিলেন। অনুজের প্রতি এই স্বীকৃতি সত্যিই তুলনাহীন, আজকের দিনেও।
হুসেনও ঘোড়া এঁকেছেন। এছাড়া অনেক শিল্পীই ঘোড়া এঁকেছেন। প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। চিনের বিখ্যাত শিল্পী জো পিও-র ঘোড়া খুবই বিখ্যাত। তবে আমার ঘোড়া সবার থেকে আলাদা। আমি যে ঘোড়াপ্রেমিক! এই প্রীতির জন্যই আমার নাম ঘোড়া সুনীল। একসময় ক্লাসে সেরা হব বলে ঘোড়া অাঁকতে শুরু করি। ঘোড়া নিয়ে এত ছবি এঁকেছি যে ঘোড়া আমার লোগো হয়ে যায়। তাই বলে শুধু ঘোড়াই নয়, অন্য ছবিও আমি এঁকেছি। সেগুলোও নেহাৎ নগণ্য নয়।’
এ পর্যন্ত কত ছবি এঁকেছেন? ছবি অাঁকিয়ে ছাড়া একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে সমাজের দায় ও দায়বদ্ধতা কতখানি অনুভব করেন। আর কয়েক মাস বাদে আপনি ৭৪ পেরিয়ে ৭৫-এ পা দেবেন। জীবন ও জগতের অনেকখানি দেখে, সাফল্যের এমন দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে আজ আপনার অনুভূতি কী – সেটাই আমার আজকের শেষ প্রশ্ন।
‘আমাদের বাড়ি ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানের খুব কাছে। ছেলেবেলায় ভাওয়ালের রাজার শবযাত্রায় দেখেছিলাম রুপোর টাকা ছড়াতে। সেই থেকে আমিও অনেক রুপোর টাকা জমিয়েছি। আমার শবযাত্রার সময় তো আমি থাকব না। তবু আমার ইচ্ছা আমার বাড়ি থেকে এই তিন মিনিটের রাস্তা ত্রিশ মিনিটে সারতে সারতে যাত্রাপথে যেন ওই রুপোর টাকা ছড়ানো হয়। তবে এটা জেনে মনে করবেন না আমি কেবল আমার কথাই ভাবি। আমি আমার চারপাশের মানুষজনের কথাও ভাবি। একদিন টিভির খবরে দেখলাম, একজন বাঘের সঙ্গে লড়াই করে আহত হয়েছেন। টাকার অভাবে তাঁর চিকিৎসা হচ্ছে না। বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ওই মানুষটার জন্য সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম। তাঁর চিকিৎসার খরচ দিলাম। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তৃপ্ত হলাম আমি। সংকীর্ণ স্বার্থপরের মতো জীবনযাপনে আমি বিশ্বাস করি না। আমি চাই সবাই ভালো থাকুন। এখানেই শিল্পী আমি আর মানুষ আমির এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছে। সমস্ত দুরাশার অন্ধকার সরিয়ে সুন্দরের আবাহন করাই আমার কাজ। জীবন ঘষে যে আগুনের উত্তাপ আমি অনুভব করেছি, আমি চাই তার পরশে অন্যের জীবনও আলোকিত হোক।
এখন পর্যন্ত ১৮ হাজারের অধিক ছবি আমি এঁকেছি। সবই বিক্রি হয়ে গেছে। তবু বিত্তবানের অহংকার আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি নিঃস্বও নই, পূর্ণও নই। যা উপার্জন করেছি তা কেবল আমি একা ভোগ করিনি। পরিবার-পরিজনের দাবি মিটিয়ে অন্যদের জন্যেও করেছি। দুস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ট্রাস্ট গড়ে গরিব ছাত্রদের বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এই কাজে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করেছি।
আমি জীবনকে নানাভাবে দেখেছি। জীবন থেকে গ্রহণ করেছি শিক্ষা। অশুভশক্তির বিরুদ্ধে মঙ্গলবোধকে সব সময় বাঁচিয়ে রেখেছি। এইভাবেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।’
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
‘আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।’
দ্রষ্টব্য : বাণীবদ্ধ কথোপকথন ও মুখোমুখি আলাপচারিতার ভিত্তিতে এই সাক্ষাৎকার লিখিত। শিল্পীর অনুমতিক্রমে ‘আরম্ভ’ উৎসব ১৪১৮ সংখ্যায় (সম্পাদক লালন বাহার) প্রকাশিত তাঁর আত্মকথা থেকে কিছু তথ্য গৃহীত।