logo

আমিনুল কখনো হারিয়ে যাবেন না

বো র হা ন উ দ্দি ন  খা ন  জা হা ঙ্গী র

যেদিন সকালে, খুব ভোরে, আমি টরন্টো থেকে ঢাকা পৌঁছোই, সেদিনই খবর পাই আমিনুল অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন। অনন্তের পথে সার সার গাছপালা আছে, সরলরেখার মতো গাছপালার ফাঁক দিয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে, ট্রেন অদৃশ্য লাইটহাউসের বাতির দিকে চলে যাচ্ছে। ট্রেন কোথায় যাচ্ছে, ট্রেন কি কোনো সীমারেখার সংজ্ঞা তুলে ধরছে। আকাশ, শেষহীন আকাশের দিকে আমিনুল চলে যাচ্ছেন। আমি তাকিয়ে আছি শেষহীনতার দিকে।

জয়নুল আবেদিন থেকে আমিনুল ইসলামের দূরত্ব, আমিনুল দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাড়িয়েছেন। এই দূরত্বের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের ইতিহাস। এই ইতিহাস সমকালীন ইউরোপিয়ান শিল্পের হাত ধরে বেড়েছে। কলকাতা আর্ট স্কুলের অ্যাকাডেমিক তত্ত্ব এবং পরবর্তীতে ঢাকা আর্ট স্কুলের অ্যাকাডেমিক তত্ত্বের মধ্যে কাজ করেছে এক ধরনের শিল্পতত্ত্বের অটোক্রেটিক কেন্দ্রিকতা। অবনীন্দ্রনাথের এক ধরনের বাদশাহি মেজাজ এবং জয়নুল আবেদিনের কৃষক ঔদ্ধত্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রথমে ভাঙা হয়েছে, রাজনীতিতে ভাঙার আগেই। এই পরিবর্তনটাই র‌্যাডিক্যাল, আমিনুলের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে। আমিনুলরা, আবেদিনদের বিপরীতে, বাংলাদেশের ভিস্যুয়াল আর্টসের ক্ষেত্রে, একটা বিশাল-ব্যাপক আন্দোলন তৈরি করেছেন, যে-আন্দোলন সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে, আস্থার দিক থেকে, জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ের দিক থেকে, বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের দিক থেকে অনন্য হয়ে আছে। আমিনুলরা এমন কিছু কাজ করেছেন, এমন কিছু আইডিয়া তৈরি করেছেন, ১৯৪৭-এর পর থেকে, যা শিল্পকলার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই সময়কালে, একদিকে জয়নুল আবেদিনরা, অন্যদিকে আমিনুলরা দুই ভিন্ন দিক থেকে, তাঁদের দেশের রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভাবিত হয়ে ওঠেন। আমিনুল এবং তাঁর বন্ধুরা, এই ভবিষ্যৎকে সমাজতান্ত্রিক হিসাবে কল্পনা করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী এবং শিল্পী হিসেবে তাঁরা, প্রধানত আমিনুল এবং বশীর, ভেবেছেন প্রথম শত্রু অটোক্রেসি এবং কেউই পশ্চিমের নির্মম ধনতন্ত্র অনুসরণ করতে চাননি। ধনতান্ত্রিক অটোক্রেসি এবং কলোনিয়াল অটোক্রেসি ভেঙে ফেলতে হবে, তাহলেই বাংলাদেশ জেগে উঠবে। কেউ কেউ, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং সুলতানের মতো, বাংলাদেশের কৃষক এবং লোকশিল্পের ওপর আস্থা রেখেছেন; কেউ কেউ, আমিনুল, বশীর, হামিদ, রশিদ এবং নিতুনের মতো স্থায়ী বিপ্লবে আস্থা রেখেছেন, কিন্তু সবাই বাংলাদেশ পরিস্থিতির অদ্ভুত, আশ্চর্য ডায়নামিক সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন : দেশটির সমাজটির পশ্চাৎপদতা হচ্ছে ভবিষ্যৎ দখলের পূর্বশর্ত, কলোনিকাল থেকে ধনতন্ত্র থেকে অগ্রবর্তী এই ভবিষ্যৎ। শিল্পীরাই, আবেদিনরা এবং আমিনুলরা, পাকিস্তানের কলোনিয়াল বর্তমান অতিক্রম করতে সক্ষম, অ-মানুষ বুর্জোয়াদের বর্তমান পিছনে ছুড়ে ফেলতে সক্ষম। শিল্পীদের কাছে বর্তমান নেই, একপক্ষে আবেদিনদের এবং অন্যপক্ষে আমিনুলদের কাছে মানবিক অতীত এবং মানবিক ভবিষ্যৎ আছে। আপস নয়, কোথাও আপস নয়।

আবেদিনরা এবং আমিনুলরা, দুপক্ষই ব্যক্তির ওপর ও সমাজ পরিবৃদ্ধির ওপর, শিল্পের গভীরতর প্রভাবে বিশ্বাস করেছেন; দুপক্ষই শিল্পের সামাজিক ভূমিকায় বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অমিল আছে : আবেদিনদের সমাজচেতনা অস্তিবাদী এবং আমিনুলদের সমাজচেতনা ক্রিটিক্যাল। তাঁরা দুপক্ষই ভাবা শুরু করেছেন, মুক্ত ভবিষ্যতের তাঁরা প্রতিনিধি। এই মুক্তির অর্থ শ্রেণি, পেশা, পূবর্তন আমলাতান্ত্রিক ক্যাটেগরি ভেঙে ফেলা। আমিনুল থেকে নিতুন পর্যন্ত (নিতুন ডেডিক্যাটেড পার্টি শিল্পী ছিলেন), সবাই, শিল্পের সঙ্গে ইনজিনিয়ারিংয়ের, সংগীতের সঙ্গে পেইন্টিংয়ের, কবিতার সঙ্গে ডিজাইনের, ফাইন আর্টের সঙ্গে প্রপাগান্ডার, ফটোগ্রাফের সঙ্গে টাইপোগ্রাফির, স্টুডিওর সঙ্গে রাস্তার, মেলবন্ধনে গভীরভাবে বিশ্বাস করেছেন। আর্টিস্ট-ইনজিনিয়ার এবং আর্টিস্ট-ফিলোসফারের মধ্যে দূরত্ব আছে কি এবং তফাৎ আছে কি? আমিনুল কোনো দূরত্ব খুঁজে পাননি ও তফাৎ খুঁজে পাননি। সেজন্য তাঁর মধ্যে একটা প্রফেটিক ভিশন তৈরি হয়েছে। আমিনুল উড়িয়ে দিয়েছেন শিল্পক্ষেত্রের ফর্মাল মাধ্যমগুলো, তিনি বিলীন করেছেন ক্যানভাস ও ভাস্কর্যের মধ্যকার ক্যাটেগরি। তিনি ধ্বংস করেছেন বিভিন্ন মিডিয়ার মধ্যকার নানা ক্যাটেগরি, তেমনি নস্যাৎ করেছেন শিল্পী ও পাবলিকের মধ্যকার দূরত্ব।

জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর বন্ধুরা, কলকাতা আর্ট স্কুলের অ্যাকাডেমিসিজম ভেঙে ঢাকায় রিয়ালিস্টিক চিত্রকলার উদ্বোধন করেছেন। রিয়ালিজম পপুলার এবং নতুন রাষ্ট্রের পাবলিকের ডিমান্ড মেনে বেড়ে চলেছে। কিন্তু মতাদর্শিক আশাবাদ ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে প্রাত্যহিক জীবনধারণের অভিজ্ঞতা, বিশুদ্ধ নিসর্গ দৃশ্য কোনো সান্ত্বনা তৈরি করতে পারেনি। অ্যাকাডেমিক পপুলার আর্ট তাহলে কী? ন্যাচারালিজম এবং রিয়ালিজমের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট করা দরকার। ন্যাচারালিজম সীমাবদ্ধভাবে সিলেকটিভ, বর্তমানের পরপারে তার নির্বাচনের কোনো ভিত্তি নেই। সেক্ষেত্রে রিয়ালিজমও সিলেকটিভ এবং টিপিক্যালের দিকে অগ্রসরমাণ। কোনো পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যা টিপিক্যাল, তার উন্মোচন অন্যান্য পরিবৃদ্ধিশীল পরিস্থিতির পরিসরে বেড়ে উঠতে থাকে। এভাবে রিয়ালিজম সিলেক্ট করে একটি সমগ্র। এই সমগ্রের একটি ক্ষুদ্র অংশের বর্ণনাই রিয়ালিটি। ন্যাচারালিজম এবং রিয়ালিজমের মধ্যকার পার্থক্যের ভিত্তি হচ্ছে অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে দুই মনোভঙ্গি। ভিস্যুয়াল আর্টসের ক্ষেত্রে ন্যাচারালিজম সম্বন্ধে অনেক আলোচনা আছে, কিন্তু রিয়ালিজম এখনো ব্যাখ্যার অতীত। রিয়ালিজমকে ভাবা হয়েছে একটা স্টাইলিস্টিক ক্যাটেগরি হিসাবে, কোনো সাবজেক্টের বর্ণনা হিসাবে, বর্ণনাটি প্রাণবন্ত এবং পপুলার।

আমিনুল নিজের কাজের একটা স্টাইল তৈরি করেছেন। স্টাইল ফর্ম ও কন্টেন্টের মধ্যে মেডিয়েট করে। এই মেডিয়েশন হচ্ছে ঐক্যের অন্বেষণ ফর্ম ও কন্টেন্টের মধ্যে। সেজন্য বলা যায়, এ হচ্ছে কাজের ধরন। এই স্টাইল থেকে শুরু হয় নতুন কন্টেন্ট; এই কন্টেন্ট সমাজ পরিবর্তন থেকে উৎসারিত। আমিনুল এভাবেই তাঁর স্টাইল তৈরি করেছেন।

আমিনুলের কাজে আমি এভাবে হস্তক্ষেপ করতে চাই। হস্তক্ষেপ হচ্ছে শিল্পকাজ এবং আমার মধ্যে, শিল্পকাজ এবং পাবলিকের মধ্যে। এই অর্থে হস্তক্ষেপ সৃষ্টিশীলতা, সমালোচনা এই দিক থেকে সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে। আমিনুল সম্বন্ধে লিখতে গেলে এই বোধটা মনে রাখতে হবে। আমিনুল আধুনিকতাকে বাংলাদেশের শিল্পে নিয়ে এসেছেন, একই সঙ্গে ভিস্যুয়াল আর্টিস্টের চরিত্র বাংলাদেশে তুলে ধরেছেন, আবার একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বিপ্লবী শিল্পের অর্থ মেলে ধরেছেন এবং উন্মীলিত করেছেন বিপ্লবী চেতনার ভবিষ্যতের ফলশ্রুতি।

আমিনুলের কাজ দূরস্পর্শী প্রভাব বিস্তার করেছে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে। এই কাজ জটিল এবং বৈপরীত্য আলিঙ্গন করা। এসব বৈপরীত্য তাঁকে এবং তাঁর কাজকে টিকিয়ে রাখবে। এই অর্থে তাঁর কাজ প্রফেটিক।

পাকিস্তানিদের অটোক্রেসি এবং বাঙালি রাজনীতিবিদদের অটোক্রেসির বিরুদ্ধে এখানেই আমিনুলের দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। তাঁর শিল্পের উদ্দেশ্য অস্বচ্ছতা ইস্ত্রি করে মিলিয়ে দেওয়া নয়, বরং তাঁর শিল্পের উদ্দেশ্য সমগ্র মুষ্টিবদ্ধ করা। এভাবে শিল্প হয়ে ওঠে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যম এবং উপায়। সেজন্য তাঁর তেলরঙের কাজ কিংবা ড্রইং কিংবা ম্যুরাল প্রপাগান্ডার হাতিয়ার কখনো হয়ে ওঠেনি।

ফল কী হয়েছে? ফল হয়েছে বাঙালি জনমানুষের ভিস্যুয়াল আর্টস সম্বন্ধে বর্তমান মনোভঙ্গি। এই মনোভঙ্গি সবাই শেয়ার করেছে, পেশা কিংবা অবস্থান যাই হোক না কেন, তরুণরা তাঁর কাজ থেকে পরিণত হয়েছে, তারা খুঁজে পেয়েছে অফিসিয়াল শিল্পের কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পের বিকল্প আছে। ভিস্যুয়াল আর্টস মানুষের জীবনে এভাবে প্রবেশ করতে পেরেছে, তাদের জীবনকে নাড়া দিতে পেরেছে।

আমিনুলের কাজকে এস্টাবলিশমেন্ট হুমকি হিসেবে মনে করেছে। আমিনুল, শেষ পর্যন্ত, একজন

নন-কনফরমিস্ট আর্টিস্ট, যাঁর কাজ স্টাইলিস্ট। তাঁকে হুমকি মনে করা হয়েছে কারণ, অধিকাংশ সময় তিনি প্রাইভেটলি কাজ করেছেন, এমন একটা স্পিরিট নিয়ে কাজ করেছেন মনে হয়েছে প্রতিষ্ঠানবিমুখতা তাঁর চোখ ও কবজিতে ভর করেছে, সেজন্য তাঁর কাজ পাবলিক সবসময় নন্দিত করেছে। বলতেই হবে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন রাজনীতির দিক থেকে, অর্থনীতির দিক থেকে, রাষ্ট্রের আর্ট পলিসি এবং চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে সবসময় বৈপ্লবিকভাবে নতুন করে রেখেছেন। আমিনুলের কাজ অনন্তের দিকে নিজেদের খুলে দেয়, তারা আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ভিস্যুয়াল স্তব্ধতা দিয়ে। অনন্তের পথে আমিনুলকে সালাম। হাজার হাজার সালাম।

Leave a Reply