সৈ য় দা ফা র হা না
বিকেল ৩টা, ৪ এপ্রিল ২০১৩, আমানুল হকের দেহটি রাখা হলো তাঁর প্রিয় জায়গা শহীদ মিনারে। বায়ান্নতে আমতলায় শুরু, এরপর অর্ধশত বছর ধরে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তের শহীদ মিনারের রক্তাক্ত ও বর্ণিল চিত্রমালা গাঁথা আছে তাঁর নেগেটিভে।
এরপর ভাষাসৈনিককে নিয়ে যাওয়া হলো বনানী বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। ‘নদী নিয়ে আমার এই বিচিত্র জীবন। আমাকে কবর দিও নদীর পাড়ে, যেন আমার দেহ মিশে যেতে পারে নদীর জলে।’ কথাগুলো বলেছিলেন মতি মিয়া (আমানুলের ডাক নাম) ছোট ভাই আসাদুল হককে।
যদি তাঁর শরীর সত্যি মিশে যেত নদীর জলে, তবে কী দেখতেন এই প্রাজ্ঞ চিত্রকর। মৃদু হেসে স্মৃতিচারণ করতেন হয়তো। নদীর তীরে অনাথ মাঝি বজরা নৌকা নিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। ডাল, ভাত রান্না হয়ে গেছে। এবার খেয়ে যাত্রা শুরুর পালা। নৌকাবোঝাই সোনার ফসলে। সারি সারি বিভিন্ন আকারের নেগেটিভ ও সাইড ফিল্ম, পোলারয়েড প্রিন্ট, সাদা-কালো আর রঙিন ছবির সম্ভার।
জল হয়েও তিনি দেখতেন সেই একই চিত্র, যা দেখেছেন ও খুঁজেছেন সারাজীবন। আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, পাখি, পালতোলা নৌকায় ঢেউয়ের ঝাপটা, গুণটানা, দাঁড়টানা মাঝি, কলস কাঁখে জল আনতে আসা গাঁয়ের বধূ, পাড় ও পাড় ভাঙার শব্দ, বন্যা ও নতুন চরের হাতছানি, নদী ও নদীকে ঘিরে বাংলার বিচিত্র জীবনচক্র। সবকিছু তোলা আছে সযতনে ‘আমার দেশ’ চিত্রমালায়।
‘আমার দেশ’ চিত্রমালার শুরু কোথায়? যদি বলি ‘বেবি ব্রাউনি’ ক্যামেরার গর্ভে! অতিকথন হবে কি? ১৮৫০ শতকে ঢাকায় আলোকচিত্রচর্চা শুরু হলেও প্রায় একশ বছর লেগে গেল মফস্বলের মুসলমান মধ্যবিত্তের হাতে পৌঁছতে।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বড় ভাই আজমল হক ও আমানুল ডাক পাঠালেন ক্যামেরার জন্য। ক্যামেরা এসে হাজির হলো তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। মাসুল দিয়ে ক্যামেরা ছাড়ানোর অর্থ জোগাড় করতে পারলেন না চার ভাই। অবশেষে মায়ের সাহায্যে অতিরিক্ত মাসুল দিয়ে দ্বিতীয় ডাকে কেনা হলো বেবি ব্রাউনি ১২০ কোডাক ক্যামেরা। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।
ছোট ভাই আহাসানুল হকের কাছ থেকে জানা গেল, উল্লাপাড়ার গ্রামে দুজন ছাত্র কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তেন। আমানুলরা চার ভাই মিলে তাঁদের কাছে যেতেন ছবি দেখার জন্য। আমানুল ছবি অাঁকতেন, দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ করতেন। যতক্ষণ না নিখুঁত হবে ততক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। পরবর্তীকালে কলকাতা ও ঢাকা আর্ট কলেজে অনিয়মিত শিক্ষার্থী হন। অর্থাভাবে কোনো কোর্সই শেষ করতে পারেননি। তবে আলোকচিত্রের জন্য যতটুকু নন্দনতত্ত্বের ব্যাকরণ জানা দরকার তা তিনি শিখে ফেললেন। সমসাময়িক প্রথিতযশা আলোকচিত্রী নাইবুদ্দিন আহম্মেদ এক প্রামাণ্যচিত্রে বলেছেন, তিনি ও তাঁর অনুজ নওয়াজেশ আহমেদ আলোকচিত্রের নন্দনতত্ত্ব শিখেছেন আমানুলের কাছে। ‘আমার দেশ’ চিত্রমালার সজ্জিত চিত্রগুলো (অ্যারেঞ্জড ফটো) এই বিবৃতির উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে আছে।
অনুজ আহাসানুল হকের মনে পড়ে গেল প্রথম প্রিন্ট/ছবি দেখার উত্তেজনা। একটা রিলে আটটা এক্সপোজার থাকত। ডাকযোগে প্রিন্ট এলো। একটা ছবির কথা এখনো মনে পড়ে – ‘বাবা সাইকেল চালিয়ে গ্রামের পথে যাচ্ছে।’
পরবর্তী সময়ে আমানুল ও আজমল যেতেন সিরাজগঞ্জে প্রিন্ট করতে। প্রিন্টের মান তাঁদের হতাশ করত। একসময় তাঁরা বুঝে ফেললেন, ব্যবহৃত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হয় তাঁদের প্রিন্ট। দুই ভাই মিলে প্রিন্ট শুরু করলেন। তাঁরা ছবি তুলতেন প্রকৃতির, বাড়ির মানুষের। আজমল হকের এখনো মনে পড়ে তিরিশের দশকে নিজেদের বাড়িতে নয়, কিন্তু অনগ্রসর মুসলিম সমাজের প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে শিল্পচর্চা করতে হতো তাঁদের। ‘জান দিতে পার না তো ছবি তোলো কেন?’ – এমন মনোভাবকে উপেক্ষা করে ভাইয়েরা মিলে চলে যেতেন নির্জন মাঝে গ্রামোফোন বাজিয়ে গান শুনতে। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে পাবনায় চাকরির পাশাপাশি আজমল হক স্টুডিও খোলেন। দুই ভাই মিলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তখন।
আমানুল হক ঢাকায় আসেন সাতচল্লিশে। প্রথম চাকরি করেন গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। ১৯৫২ সালে মেডিক্যাল কলেজে আর্টিস্ট ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দেন। জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। জামার ভেতর লুকিয়ে রাখা ক্যামেরায় তোলা হয় ছবি। শহীদ রফিকের গুলিবিদ্ধ মাথার ছবি। আমানুল তখন পলাশী ব্যারাকের কাছে মামার বাড়িতে থাকতেন। বাড়ি ফিরে লেপ-তোশক দিয়ে ডার্করুম বানিয়ে ফিল্ম পরিস্ফুটন করা হলো। লুকিয়ে রাখা হলো বাথরুমে বাঁশের চাটাইয়ের দেয়ালের ফাঁকে। আর ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে ঝুলিয়ে রাখা হলো সামনেই। সেই রাতে পুলিশ এলো। অন্যদিকে ছবি প্রিন্ট করে পাঠানো হলো দৈনিক আজাদীতে। ব্লক হলো। কিন্তু ছাপা হলো না ছবি। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ওই ছবি ব্যবহার করতে লাগল প্রচারণা পত্রে। পুলিশ খবর পেয়ে বাজেয়াপ্ত করেছিল। চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্টের মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণায় এই ছবিটি ব্যবহৃত হয় চট্টগ্রামে।
এ-সময়ে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে আমানুলের জীবনে। চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ এন লাই পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন। দুই প্রেসিডেন্টের করমর্দনের ছবি তোলেন আমানুল। সত্যিকারের গারো পাহাড়ের মাটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ফোরগ্রাউন্ডে হাত দুটো রাখা হয়। তৈরি করা হয় মিক্সড মিডিয়ার একটি চিত্রকর্ম। নিচে লেখা থাকে – ‘এ বন্ধুত্ব অটুট হোক’। চীনা প্রেসিডেন্ট বিমানে ওঠার আগে হাতে পান শিল্পকর্মটি। তিনি আমানুলকে শিল্পশিক্ষা দানে চীনে আমন্ত্রণ জানান। আমানুল তখন বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে যান। রফিকের ছবি তোলা এবং চীনা প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ – পাকিস্তান সরকার অবশ্যই ভালো চোখে দেখেনি। বাতাসে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। আসাদুল হকের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় ইতোমধ্যে চুয়ান্নতে বাংলা একাডেমীতে সাহিত্য সম্মেলনে প্রদর্শিত হয় ‘আমার দেশ’ চিত্রমালা। কলকাতা থেকে আসা কবি-সাহিত্যিকদের নজরে আসে তাঁর কাজ। প্রশংসা পান তাঁদের। এই সূত্রকে অবলম্বন করে চাকরি ছেড়ে বেহালা বিক্রি করে কলকাতা চলে যান। আসাদুল হক কলকাতায় বাংলাদেশ এমবাসিতে কাজ করতেন। ভাইয়ের আপার সার্কুলার রোডের ডরমিটরিতে থাকতে শুরু করলেন। আমানুলের মনে তখন সিনেমা বানানোর সাধ।
কলকাতায় তাঁর আধা বেকার জীবন। মাঝে মাঝে ট্রেনে চেপে পাবনা ফিরে আসতেন। ঢাকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের হাতছানি তো ছিলই। শাহজাদপুরে ‘রানী কুঠিরে’ বাবা তখনো বেঁচে আছেন। ফটোগ্রাফার আমানুলের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। কলকাতায় টাকা ফুরিয়ে গেলে মাঝে মাঝে হুন্ডি করে টাকা পাঠাতেন সদ্য চাকরিপ্রাপ্ত ছোট ভাই আহাসানুল হক। দুশো টাকা পাঠিয়ে চিঠিতে লিখতেন, ‘২০০ পৃষ্ঠার একটি বই পাঠালাম।’ আমানুল কলকাতার ঘরের জানালা দিয়ে পাশের বস্তির মানুষের ছবি তুলতেন। কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখি নিয়ে রূপকধর্মী কাজ করতেন তখন। কাক কীভাবে খাবার লুকিয়ে রাখে, আর অন্য কাক তা কীভাবে চুরি করে খায় – এসবের মাঝে তিনি মানুষের স্বভাবের মিল খুঁজে পান। তৈরি করেন ফটো স্টোরি ‘ক্রো অ্যান্ড হিউম্যান নেচার’। এসব লিখতেন আর সদ্যবিবাহিত অনুজ আসাদুল হককে বলতেন, ‘ওসব গান-বাজনা ছেড়ে এবার একটু মানুষ ও তার জীবনসংগ্রাম নিয়ে ভাব!’
কলকাতার পুরনো দোকান থেকে ভাঙা ক্যামেরা কিনে নিজেই মেরামত করে নিলেন। পরিচয় হয়েছে বিখ্যাত সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়ে গেল এই উদার মানুষটির সঙ্গে বাঙাল তরুণের। এরপর শুধু সত্যজিতের ও তাঁর ছবির ছবি তোলা, গল্প আর শেখা, বন্ধুত্ব চলল বাকিটা জীবন। সত্যজিতের সব ছবি তোলা হলো সেই ভাঙা ক্যামেরায়। সারাজীবনই তিনি অতি আধুনিক, দামি কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেননি। উদ্ভাবনীশক্তি, দেশীয় কারিগরি, মেধা ও শিল্পবোধ দিয়েই রচিত হতো সেকালের আলোকচিত্রীদের ছবি। আজ ‘পয়েন্ট অ্যান্ড সুটের’ যুগে সবাই ফটোগ্রাফার কিন্তু আমানুলরা মাত্র কয়েকজনই।
প্রায় দশ বছর কলকাতায় কাটিয়ে মধ্য ষাটে দেশে ফিরলেন। পূর্ব বাংলার রাজনীতি তখন উত্তাল। গণ-অভ্যুত্থানের ছবি তুললেন তিনি। একাত্তরে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গণহত্যার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তোলেন তিনি।
লাঠি হাতে সাধারণ মানুষের মিছিল, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মিছিলে রক্তাক্ত হাত, মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ, মিরপুর বধ্যভূমিতে গলিত লাশ, শকুনের লাশ খাওয়া, বাঙালির বিজয় – সবকিছু তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘আমার দেশ’ চিত্রমালায়। মুক্তিযুদ্ধ পর্বটি শুরু হয়েছে বাঁশের লাঠি হাতে, লাঠিখেলার একটি রূপক ছবি দিয়ে। তার পরের ছবিতেই আমরা দেখি ক্লোজআপে মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র ধরা হাত। এই অধ্যায়টি শেষ হয় দুটো অর্থবহ ছবি দিয়ে। আমানুলের প্রিয় তিনটি বিষয় নদী, নদীতে পালতোলা নৌকা, পালে ঢেকে গেছে সূর্যাস্ত। বাংলার নিটোল সৌন্দর্যের মাঝে তীরে পড়ে আছে একটা মানুষের খুলি। ভয়ংকর সুন্দর! তার পরের ছবিটির প্রায় একই প্রেক্ষাপট, শুধু তীরে পূর্বদেশ পত্রিকার ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সংখ্যাটি পড়ে আছে। তাতে লেখা ‘জয় বাংলা’! খবরের কাগজের ওপরে রাখা পাকিস্তানি সেনার হেলমেট।
সদ্য স্বাধীন দেশে শিল্পীর কাজও কম ছিল না। আমানুল আবার ছুটলেন ‘আমার দেশ’ চিত্রমালা সংগ্রহে। নৌকা আর অনাথ মাঝিকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। দশদিন থেকে তিন মাস কেটে যেত নৌকায় নৌকায়। খাওয়া-বিশ্রামের সময় নেই। ভগ্ন শরীরে তিনি খুঁজছেন তাঁর ছেলেবেলার বেবি ব্রাউনির বাংলাদেশকে। দ্রুত হারিয়ে যাওয়া লোকজ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাইলেন ক্যামেরায়। তাই তিনি নিজ গ্রামে আয়োজন করতেন যাত্রাপালা। ছবি তুলতেন লাঠিখেলা, মেলা, মাটির পুতুল, কাঁসার বাটি, মাটির কুপি, গরুর গাড়ি, হুঁকো, শাপলা, ধান, পাট আর গ্রামের মেহনতি নারী-পুরুষ, সবাই যেন সর্বক্ষণ কর্মরত দেশগড়ার কাজে। কঠিন সংগ্রামে রত শ্রমজীবী মানুষের নেই এতটুকু বিশ্রাম। ছোট ঘুমন্ত শিশুটির পা বাঁধা আছে কর্মী মায়ের ঘরের দাওয়ায়। তাঁর নৌকা চলছে গ্রাম থেকে গ্রামে। বাউল, ফকির, শিশু, বৃদ্ধ, পালা-পার্বণ, বিয়ে – জীবনের কোনো অংশই আর বাদ পড়ল না গল্পচিত্র ‘আমার দেশ’ থেকে।
শহরের উঠতি মানুষের ভিড়, বৃত্তের প্রলোভন তিনি পেছনে ফেলে নিমগ্ন হলেন জীবনচিত্র রচনায়। প্রায় দুই দশকের অধিককাল ধরে চলল তাঁর এই সাধনা। একটা পাতলা, সহজে বহনযোগ্য কাগজের টুকরো তৈরি করা হয়তো সহজ, কিন্তু চিত্রমালা গাঁথা? গ্রামে-গঞ্জে পড়ে থাকা লোকজ জীবনের উপাদান, উপকরণ ও দর্শনকে তিনি ফুলের মতো আলতো হাতে তুলে এনেছেন, যা তখনো হারিয়ে গেছে, তা তিনি রচনা করেছেন ‘সজ্জিত চিত্রে’র মাধ্যমে। প্রামাণ্য ও শিল্পচিত্রের সীমানা তিনি ভেঙে দিয়েছেন বারবার। তৈরি করেছেন তাঁর নিজের ব্যাকরণ।
জীবনের অধিকাংশ সময়ে ঢাকা ও কলকাতার মতো বড় শহরে থেকেও তিনি শহরের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সত্যজিতের ছবি ছাড়া তেমন কিছু তোলেননি, অথবা আমাদের সেসব ছবি দেখা হয়ে ওঠেনি আজো। শহরের কৃত্রিম সৌন্দর্য তাঁকে টানত, তা তাঁর লেখায় ফিরে এসেছে বারে বারে। পদে পদে শিল্পরচনায় বাধা পেয়েছেন এই নিষ্ঠাবান শিল্পী। রাজনৈতিক রোষানল, বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা, ঈর্ষাকাতর কাকের ছোবল সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। তাই দৃষ্টির সামনে বিদ্যুতের তারের বাধা এড়িয়ে তিনি চলে গেলেন খোলা আকাশের নিচে, নদীতে সূর্যাস্তের কাছে, যেখানে জীবন কিছুটা ধীরে বইছে তখনো। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাঁকে মানসিকভাবে অনেকখানি ক্লান্ত করেছে। তাই যেন একটু অবকাশ খুঁজে পান স্বপ্নময় সজ্জিত চিত্র রচনায়। খালাতো বোন আদরের এ্রলির মধ্যে তিনি খুঁজে পান সরলতা, সৌন্দর্য। শুরু হয়ে গেল এলি ও অন্য মডেলদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এখানে উল্লেখ্য, শহুরে রুচিশীল মধ্যবিত্ত মডেলদের তিনি এড়িয়ে গেছেন। একদিকে স্বপ্ন, অন্যদিকে ঢাকার চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ বাস্তবতার ছবি। জীবনের দুই বিপরীত মেরুকে তিনি একত্র করেছেন ‘আমার দেশ’ চিত্রমালায়।
স্বাধীনতার পর দুই দশকের বেশি সময় ধরে এসব ছবি বিচিত্রা বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়। বিচিত্রার সঙ্গে তাঁর সখ্যের প্রমাণ মেলে সম্পাদকের এই লেখা থেকে – ‘আমানুল হকের সঙ্গে বিচিত্রার সম্পর্ক অনেক দিনের। আলোকচিত্রশিল্পী ও লেখক হিসেবে। সত্যজিতের অসুস্থতার খবর পেয়ে জুন মাসে গিয়েছিলেন কলকাতায়। সত্যজিৎ তখন ক্লিনিকে। সাংবাদিক/ফটোগ্রাফারদের প্রবেশ নিষেধ। সেখানে একমাত্র আমানুল হকই ছবি তোলেন এবং কথাবার্তা বলেন। তারই ভিত্তিতে এবারের প্রচ্ছদ পট ও কাহিনী। সে হিসেবে বলতে হবে এটি এক্সক্লুসিভ’ (১৩ বর্ষ, ১০ সংখ্যা, ১৭ আগস্ট ’৮৪)।
আমানুল হকের কাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তিনি তাঁর ছবির সঙ্গে লিখতেন। সন-তারিখের ক্যাপশন নয়, দীর্ঘ রচনা তাঁর ছবিকে এনে দেয় এক অন্য মাত্রা। দর্শক-পাঠকের কাছে উন্মোচিত হয় এক নতুন দিগন্ত। ‘একুশের তমসুক’ ও ‘প্রসঙ্গ সত্যজিৎ’-এ প্রসঙ্গক্রমে তাঁর জীবন ও অভিজ্ঞতার কথা যতটুকু লিখে গেছেন তাতে তাঁর জীবন ও কাজ যেন আমরা আরো একটু বেশি করে বুঝতে পারি। জীবনের শেষ দশ বছর তিনি কাটিয়েছেন মূলত গ্রন্থ রচনায়। লেখা ও ছবি সম্পাদনা ছিল তাঁর প্রধান কাজ। বর্তমানে সাহিত্য প্রকাশের অফিসে বন্ধু ও প্রকাশক মফিদুল হকের কাছে রাখা আছে ‘আমার দেশ’ ও আরো একটি বইয়ের পান্ডুলিপি। চিত্রগ্রন্থ ছাপানোর বিশাল ব্যয়ভার সংগ্রহের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মফিদুল হক। বেতার বাংলা পত্রিকার কাজী সালাউদ্দিন ছিলেন তাঁর শেষ চল্লিশ বছরের কর্মসঙ্গী। শেষের দিকে তিনি লিখতে পারতেন না। কাজী সালাউদ্দিন লিখতেন তাঁর কথা। বর্তমান বইগুলোর প্রকাশনায় এখনো তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে আজমলের বড় মেয়ে রোকেয়া মীনাক্ষী হোসেন বলেন, ‘মেজো কাকা শেষ বয়সেও ঘরের জানালা দিয়ে পিজির বর্ধিত ভবন নির্মাণের ছবি তুলতেন, শহরের শত শত শ্রমজীবী মানুষের ছবি পেলাম মৃত্যুর পর তাঁর ঘর গোছাতে গোছাতে।’
কাজের বাইরে কেমন ছিল এই মানুষটা, জানালেন তাঁর আদরের মীনাক্ষী, ‘স্বল্প চাহিদা, স্বল্পভাষী মানুষ। সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন, কাউকে অসুবিধায় ফেলতে চাইতেন না তিনি। ঘর গোছাতে গিয়ে একটা নোট পাই। শেষের দিকে বেশ কয়েকবার অসুস্থ ছিলেন। হয়তো তখন লেখা, লিখেছেন, ‘আমি মারা গেলে আমাকে কবর দেবে আজিমপুরে, আর যদি তোমাদের কোনো অসুবিধা না হয় তো পাঁচজন অভুক্ত মানুষকে খাওয়াবে এবং পাঁচজন মানুষকে কাপড় দেবে।’ এই আমাদের মেজো কাকা, অতি সাধারণ জীবনযাপন করে রেখে গেছেন অসাধারণ কর্ম। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদের জীবনের সকল দায়দায়িত্ব তিনি মেটাতেন পরম সুখে।’ আর বাকিটা খরচ করেছেন তাঁর আলোকচিত্র রচনায়। ভ্রমণ, সরঞ্জাম, অসুস্থতা, মডেল ও সহকারীদের বেতন-ভাতা, নৌকা ভাড়া – সব খরচ চুকিয়ে হাত শূন্যই থাকত বেশিরভাগ সময়। বিয়ে করেননি বলেই হয়তো কাজকে সাধনারূপে গ্রহণ করেছিলেন আর চলার পথে সকলকেই করে নিয়ে ছিলেন তাঁর বৃহৎ পরিবারের সদস্য। মীনাক্ষী যার নাম বাবা আজমল হক রেখেছিলেন, ছবি, দুই ভাই পরিবারে এই প্রথম সন্তানের ছবি তুলেছেন সারাজীবন। পরবর্তী সময়ে তাঁর কন্যাদ্বয় প্রেমা ও প্রৈতী হয়ে ওঠে দুই আলোকচিত্রীর খুদে মডেল। তাদের তগেন নানু, আজমল হক চিররুগ্ন, স্বল্পাহারী – আলুভর্তা ও ডাল খেয়েই জীবন কাটিয়ে দিলেন। খুঁতখুঁতে এই মানুষটি যখন গ্রামে, জলে-কাদায় যেতেন, তখন ঠিকই মানিয়ে নিতেন সেই পরিবেশের সঙ্গে। ‘তগেনের আদরটা অন্যরকম, যাকে করবে শুধু সেই বুঝবে। ছোট্ট একটি উপহারও পরম যত্নে সাজিয়ে দিতেন।’ মীনাক্ষীর ছোটবেলায় তোলা সাদাকালো ছবিটি নিজ হাতে রং করে দিয়ে পেছনে লিখে দিলেন, ‘ধীরে ধীরে বও, ওগো উত্তাল হাওয়া।’ পারিবারিক ছবিতেও তিনি ভাইয়ের বউদের ভঙ্গিমা দেখিয়ে দেন। বিষয়, আশপাশের পরিবেশ কোনোকিছুই যেন উপেক্ষার নয় তাঁর কাছে। কী তা পারিবারিক ছবি অথবা গণ-আন্দোলনের। তার এই খুঁটিনাটি, ডিটেইল ধরে রাখা থেকে আমরা পেয়ে যাই ভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পোস্টারের ছবি। শহীদ রফিক, শহীদ মিনার ভাঙা ও মসজিদ গড়ার পরিকল্পনার ছবি, মুক্তিযুদ্ধ ও চুয়াত্তরের মন্বন্তরের ছবির মতোই এই পোস্টার, দেয়াল চিকাও ইতিহাসের সাক্ষ্য। তাঁর বৃহৎ কর্মের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আমানুল রেখে গেছেন নবপ্রজন্মের জন্য বিশাল এক রত্নভান্ডার। তাঁর সমসাময়িক বিখ্যাত অনেক আলোকচিত্রশিল্পীকে আমরা হারিয়েছি আজ। অনেকের কাজ সেইসঙ্গে হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাস ও আলোকচিত্রীর জীবনসংগ্রাম ও অবদান বোঝার জন্য চল্লিশের দশকের আলোকচিত্রশিল্পীদের কাজ সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও উপস্থাপন জরুরি। অজ্ঞতা, উপেক্ষা ও হীন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কবল থেকে এসব কাজ উদ্ধার করে সংরক্ষণ করতে হবে। ফটো আর্কাইভ করার আধুনিক পন্থার দিকে হতে হবে মনোযোগী। শেষ বয়সে আমানুল প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি তাঁর গ্রন্থ রচনা বা ছবি প্রদর্শনীর কাজে।
আলোকচিত্রী হিসেবে নয়, একজন ভাষাসৈনিক হিসেবে আমানুল ২০১১ সালে একুশে পদক পান। বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসে আলোকচিত্রী ও সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর অর্জন অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল। আমরা, অনুজরা তাঁর গৌরবের অর্জনের সঙ্গী। তাই তাঁর স্বপ্নের সন্তান ছবিগুলোর যত্ন করার দায়িত্ব আমাদেরও।
সূর্যাস্তে যমুনার জলে আমানুলের শরীর-আত্মা মিশে থাক। সারারাত অপেক্ষার পর নতুন সূর্যের মতো তাঁর চিত্রমালা জ্বলে উঠুক বাংলার আকাশে।