logo

আমার থিয়েটার গরিবের থিয়েটার

পদ্মশ্রী এইচ কানহাইলাল

ভারতের মণিপুর রাজ্যের অন্যতম খ্যাতিমান নাট্যদল কলাক্ষেত্র প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১১-এ অংশ নেয় তাদের প্রযোজনা ডাকঘর নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের এ নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন স্বনামধন্য নির্দেশক পদ্মশ্রী কানহাইলাল। রবীন্দ্রনাথ এ নাটকটির মূল চরিত্র অমল সম্পর্কে লিখেছেন – ‘যে মানুষ উন্মুক্ত পথের আহ্বান শুনতে পেয়েছেন অমল তার অন্তরাত্মার প্রতিনিধিত্ব করে, চতুর মানুষরা যে বেড়া তৈরি করে সেখান থেকে সে মুক্তি চায়। সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তিরা অনড় মতবাদের যে দেয়াল তোলে অমল সেখান থেকে মুক্তি চায়।’ শ্রী কানহাইলাল তাঁর নাটকে রবীন্দ্রনাথের এই কথাটিই তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। নাটকটি প্রসঙ্গে শিল্প ও শিল্পীর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন অলোক বসু।
সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ করা হলো :

শিল্প ও শিল্পী : ডাকঘর নাটকটি প্রযোজনা করার কথা কেমন করে কীভাবে ভাবলেন?
শ্রী কানহাইলাল : এটি প্রযোজনা করার চিন্তা আমার মাথায় ছিল না। ২০০৫ কি ২০০৬-এ কলকাতায় গিয়েছিলাম এক নাট্যোৎসবে অংশ নিতে। সেখানে প্রয়াত হাবিব তানভীরের সঙ্গে দেখা। তিনি এবং সুমন মুখোপাধ্যায় আমাকে রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক প্রযোজনা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। এবং তাঁরা বললেন, ডাকঘর নাটকটি করলেই ভালো হয়। তাঁদের অনুরোধে সায় দিলাম।
শিল্প ও শিল্পী : হাবিব তানভীর এবং আপনি, আপনারা কেউই বাঙালি নন। অথচ একজন অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ করার। আর একজন প্রযোজনা করলেন রবীন্দ্রনাথ।
শ্রী কানহাইলাল : দেখুন, আমরা বাঙালি না হলেও ভারতীয়। আর রবীন্দ্রনাথ যেমন বাঙালি, তেমনি ভারতীয়, সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের। তাঁর নাটক পৃথিবীর যেকোনো সংস্কৃতির জন্যই প্রাসঙ্গিক। তিনি তো ভারতের জন্য গৌরব। তাই ভাষার সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয়নি।
শিল্প ও শিল্পী : আপনার ডাকঘর প্রযোজনার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
শ্রী কানহাইলাল : দেখুন, ডাকঘর নাটকে রবীন্দ্রনাথ যা বলতে চেয়েছেন, আমি এ নাটকে সেটিই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
শিল্প ও শিল্পী : রবীন্দ্রনাথের এই নাটকে সংলাপের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অথচ আপনার ডিজাইনে সংলাপের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে।
শ্রী কানহাইলাল : আমি প্রথাবিরোধী কাজ করতে পছন্দ করি। মুখের ভাষাকে দেহের ভাষায় ও মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এ নাটকে। ফলে নাটকটি বাচনিক থেকে অবাচনিক নাট্যক্রিয়ায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। এ নাটকের কুশীলবগণ চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ও ক্যাথারসিস প্রক্রিয়ায় অভিনয়কলা সৃজন করেছেন।
শিল্প ও শিল্পী : পাঁচ-ছয়টি ভাষায় সংলাপ রয়েছে এ নাটকে, এটি কেন?
শ্রী কানহাইলাল : আমি বলেছি, আমি প্রথাবিরোধী। হতে পারতো এ নাটকটি শুধু মণিপুরি ভাষায়। কিংবা বাংলায় অথবা অহমিয়ায়। আমার চ্যালেঞ্জটাই ছিল সেখানে। আমি মুখের ভাষাকে গৌণ করতে চেয়েছি। অন্তর্ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। সেখানে ছয়টির জায়গায় ৬০টি ভাষা হলেও লাভ-ক্ষতি ছিল না অথবা একটি ভাষা হলেও লাভ-ক্ষতি হতো না। আমার এ নাটকের অভিনয়শিল্পীরা ভারতের ছয়টি ভাষার মানুষ। অভিনয় সৃজনে তাঁরা যাঁর যাঁর ভাষাকে ব্যবহার করেছেন ক্যাথারসিস প্রক্রিয়ায়।
শিল্প ও শিল্পী : এ নাটকে মণিপুরের সংস্কৃতির স্বাক্ষর অত্যন্ত প্রবল। এ সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
শ্রী কানহাইলাল : দেখুন, আমি যেমন ভারতীয়, তেমনি মণিপুরি। মণিপুরের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও মণিপুরি সংস্কৃতির সমঝদার ছিলেন। একজন মণিপুরি হয়ে আমার সংস্কৃতির ছাপ আমার কাজে তো থাকবেই।
শিল্প ও শিল্পী : আমরা মণিপুরের থিয়েটারের সঙ্গে পরিচিত হই রতন থিয়ামের কাজের মাধ্যমে। আপনার কাজ এই প্রথম দেখলাম। দুজনের কাজে বিস্তর ফারাক। এটা কেন?
শ্রী কানহাইলাল :  এক থিয়েটারের ছাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কানাইলাল ও রতন থিয়ামের থিয়েটারের মধ্যে পার্থক্য কী? সে উত্তর দিয়েছিল, কানহাইলালের থিয়েটার গরিবের থিয়েটার আর রতন থিয়ামের থিয়েটার ধনীর থিয়েটার। আপনি যদি দেখে থাকেন দুটো থিয়েটারের পার্থক্য বুঝবেন। তবে রতন থিয়ামের ক্র্যাফটম্যানশিপ বেশ উঁচু মানের। তাঁরা থিয়েটার করেন অনেকটা মিলিটারিদের মতো। তাঁদের মহড়া হয় এসি রুমে। আর থিয়েটারটা হয় প্যালেসে। আমি সাদামাটাভাবে থিয়েটার করি। আমি আমার অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় নাট্য নির্মাণ করি। এই নাটকের জন্য আগরতলা, অসম থেকে শিল্পী এসেছেন। আমরা একসঙ্গে থাকি, খাই, এক ধরনের চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়ে যাই। আমার নাটকে বাইরের আড়ম্বর থাকে না। থাকে অন্তরের আন্তরিক আবেদন।
শিল্প ও শিল্পী : আপনার থিয়েটারের প্রস্তুতি পর্ব নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
শ্রী কানহাইলাল :  থিয়েটার শিখবো বলেু আমি ১৯৬৮ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় ভর্তি হয়েছিলাম। আমার ভালো লাগেনি। তিন-চার মাস পরে ফিরে এসেছি ইমফলে। সেই থেকে নিজের মতো করে কাজ করে গেছি। সবার কাছ থেকে শিখেছি। আজকে ঢাকার দর্শকদের কাছ থেকেও শিখেছি অনেক কিছু।
শিল্প ও শিল্পী : আপনাকে ধন্যবাদ, ব্যস্ততার মাঝেও সময় দেওয়ার জন্য।
শ্রী কানহাইলাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।

Leave a Reply