logo

আমার গোপন জীবন সালভাদর দালি

ভাষান্তর : হা সা ন ফে র দৌ স

১৯৪২ সালে নিউইয়র্কের ডায়াল প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় সালভাদর দালির আত্মজৈবনিক গ্রন্থ, Vie secrete de Salvador Dali, যা পরে দি সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি নামে ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই বইটি যেমন খ্যাতি, তেমনি কুখ্যাতির জন্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দালিকে বিনয়বোধের জন্য কেউ দোষারোপ করবে না, তবে দালি এই গ্রন্থে নিজেকে নিজেই যেভাবে গৌরবে ভূষিত করেছেন, তাঁর ঘনিষ্ঠজনও তাতে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়েছেন বলে শোনা গেছে। কেউ কেউ এই গ্রন্থটিকে দালির নিজের আঁকা ছবির মতো সুন্দর, জটিল ও বহুস্তর-বিশিষ্ট বলে বাহবা দিয়েছেন। আবার অন্য অনেকে, যেমন জর্জ ওরওয়েল, পুরো গ্রন্থটিকে অসৎ ও মিথ্যা বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ এক কল্পকাহিনি বলে তা বাতিল করে দিয়েছেন। প্রায় ৪০০ পাতার এই বই ইংরেজিতে একাধিকবার অনূদিত হয়েছে। শিল্প ও শিল্পীর পাঠকদের জন্য মূলত ১৯৯৩ সালে হাকন শেভালিয়ারের ইংরেজি অনুবাদের ভিত্তিতে এই গ্রন্থটি বাংলায় অনূবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন হাসান ফেরদৌস। চলতি সংখ্যায় এই আত্মজীবনীর ভূমিকাটি পত্রস্থ হলো।
ছয় বছর বয়সে আমার ইচ্ছা ছিল পেশাদার পাচক হবার। সাত বছরে ইচ্ছা হলো নেপোলিয়ন হব। বলতে কি, তখন থেকেই আমার ইচ্ছা কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তেই থাকে।
স্তাঁধাল কোথায় যেন এক ইতালিয়ান রাজকুমারীর কথা লিখেছেন, গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় আইসক্রিম খেতে খেতে সে মন্তব্য করেছিল, ‘ভাগ্যিস, আইসক্রিম খেলে পাপ হয় না।’ ছয় বছর বয়সে রান্নাঘরে কিছু খাওয়া মাত্রই আমার জন্য পাপ ছিল। আমার বাবা-মা বাড়ির এই কোনায় যাওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। রান্নাঘরের বাইরে আমি লালা মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম, সেই রূপকথার ঘরে এক ফাঁকে যাবার সুযোগ কখন আসে তার প্রতীক্ষায়। অবশেষে সুযোগ মিললে আমি কাঁচা এক টুকরো মাংস অথবা ভাজা মাশরুম তুলে গিলতে গিয়ে প্রায় দম বন্ধ হয়ে মরার জোগাড়, আর তাই দেখে কাজের মেয়েরা হেসে কুটি কুটি। সে খাবার মুখে দিয়ে, তার মাতাল করা সুগন্ধ নাকে নিয়ে আমার যে অনুভূতি হতো তা কেবল ভীতি ও পাপবোধ থেকেই পাওয়া সম্ভব।
এক রসুইখানায় যাওয়া বারণ ছাড়া আমার প্রায় পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। আট বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিছানায় হিশু করতাম শুধু মজা করার জন্য। পুরো বাড়িতে আমার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। কোনো কিছুতেই আমার মন ভরত না। বাবা-মা দুজনেই আমাকে রীতিমতো মাথায় তুলে রাখতেন। যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমন পর্বে – যা রাজার ভোজ নামে পরিচিত – প্রতিবছর মস্ত ভোজের আয়োজন হতো। একবার সে উপলক্ষে আমি এক রাজপোশাক উপহার পেয়েছিলাম। সোনালি মুকুট, বড় বড় টোপাজ পাথর দিয়ে মোড়া। সঙ্গে চমৎকার পশমি হাতকাটা ছোট কোট। বলতে গেলে তখন থেকে প্রায় সবসময়ই ওই সাজপোশাক পরে রাজার ভান করে থাকতাম। কাজে ব্যস্ত গৃহপরিচারিকারা আমাকে রসুইখানা থেকে তাড়িয়ে দিত, কতদিন গেছে লম্বা বারান্দার এক কোণে সেই রাজার সাজপোশাক পরে আমি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছি। এক হাতে থাকত রাজদণ্ড, অন্য হাতে বালিশ-তোশক পেটাবার চামড়ায় মোড়া এক বেলুনি। রাগে আমার শরীর রি-রি করে কাঁপত, ইচ্ছে হতো মেয়েগুলোকে দিই কয়েক ঘা। আমি বলছি গ্রীষ্মের মধ্য দুপুরের ঠা-ঠা রোদের ঠিক আগের প্রহরের কথা। রসুইঘরের ভেজানো দরজা দিয়ে চোখে পড়ত দজ্জাল মেয়েগুলো হুটোপুটি করছে, তাদের দুহাতে লাল রং মাখা, গুরু নিতম্ব, আর মাথায় খাড়া খাড়া চুল। ঘর্মাক্ত মেয়েগুলোর গায়ের গন্ধ, ছড়ানো-ছিটানো আঙুর, দগদগে গরম তেল, খরগোশের বগলের পশম, মেয়োনেজ মাখানো ছুরি, শিমের বিচি, পাখির কিচিরমিচির, আর তার সঙ্গে ঘোড়ার কটু গন্ধ, এইসব হরেক জিনিস মিলে আসন্ন আহারের এক অভাবিত আগাম সুগন্ধ আমার নাকে এসে লাগত। ধোঁয়া ও ভনভনে মাছির ওপর এসে পড়া সূর্যের আলোর ফোকর গলে মাখানো ডিমের সাদা অংশ চোখে পড়ত, তা দেখে মনে হতো ঠিক দম হারানো একটা ঘোড়া, মুখে ফেনা নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, আর কেউ তাকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য চাবুক হাঁকিয়ে রক্তাক্ত করছে।
সোজা কথায়, বুঝতেই পারছেন, আমি ছিলাম একদম বখে যাওয়া এক বালক।
আমার জন্মের তিন বছর আগে মেনিনজাইটিস রোগে ভুগে আমার বড় ভাই মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যায়। তার মৃত্যুতে আমার বাবা-মা ভীষণ মুষড়ে পড়েন। কেবলমাত্র আমার পৃথিবীতে আগমনের পরেই তাঁদের স্বস্তি মেলে। আমি ও আমার ভাই ছিলাম যেন দুই ফোঁটা পানি, চেহারায় এমন সাদৃশ্য ছিল আমাদের দুজনের, কিন্তু আচার-আচরণে আমরা ছিলাম একদম ভিন্ন। আমার মতো (আমার মৃত) ভাইয়ের চেহারাতেও ‘জিনিয়াসে’র ছাপ ছিল (স্বীকার করছি, ১৯২৯ সাল থেকে আমি যে একজন জিনিয়াস, সে ব্যাপারটা সচেতনভাবে আমার কাছে ধরা পড়ে। এই বিশ্বাস গভীরভাবে আমার মনে প্রোথিত হওয়া সত্ত্বেও তা আমার মধ্যে কোনো গভীর মহিমাবোধের জন্ম দেয়নি। তবে মানছি, এর ফলে মাঝেমধ্যে এখনো আমি গভীর তৃপ্তিবোধ করে থাকি)। আমার ভাইটি দারুণ প্রতিভাধর ছিল, যদিও এক ধরনের গভীর বেদনাবোধে ঢাকা থাকত তার সেই প্রখর ধীমত্তা। সে তুলনায় আমি ছিলাম রীতিমতো বোকাসোকা, তবে সবকিছু গভীরভাবে বিবেচনার ক্ষমতা ছিল আমার। অতি শৈশব থেকেই যৌন বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল প্রবল, মায়ের দুধ খাওয়ার বয়স থেকে প্রতিটি যৌন অভিজ্ঞতা আমার মনে সযতেœ জমা আছে। দেহসুখের যে-কোনো সম্ভাবনা আমি প্রবল স্বার্থপর আগ্রহে আঁকড়ে ধরতাম। অতি সামান্য খোঁচা থেকেই আমি হয়ে উঠতাম দুর্বিনীত। শিশুকালে একবার আমি আমার পরিচারিকার গাল সেফটিপিন দিয়ে খুবলে দিয়েছিলাম। মহিলাটিকে আমি যথেষ্ট পছন্দ করতাম, কিন্তু তারপরেও খুবলে দিয়েছিলাম, কারণ যে দোকানে মিষ্টি পেঁয়াজ কিনবার জন্য আমি বায়না ধরেছিলাম, গিয়ে দেখি সে দোকান বন্ধ। সোজা কথায়, খুবই কামেল ছিলাম আমি। আমার ভাই সম্ভবত আমার প্রথম সংস্করণ ছিল, তবে সবকিছুতেই তার থাকত একধরনের নিরঙ্কুশতা।
আমরা এখন জানি, আঙ্গিক বা ফর্ম হলো যে-কোনো বস্তুর সংবীক্ষণ প্রক্রিয়ার ফলাফল – বস্তুকে চতুর্দিক থেকে প্রবলভাবে চেপে ধরার ফলে যে সুনির্দিষ্ট স্থানগত প্রতিক্রিয়া হয়, তাকে যেভাবে পিষে চিড়েচ্যাপটা করা হয়, আর তার ফলে জন্ম নেয় যে স্ফীতির, তাই হলো সে বস্তুর জন্মের বহির্গত অবয়বের মৌল প্রতিক্রিয়া। কতবারই না একগুঁয়েমির কারণে কত সৃষ্টিশীল মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার এমন মানুষ, যে কেবল তা-ই করে, যা করা সম্ভব, যে নিজেকে যথাসময়ে বাসনার সঙ্গে সংগতি রেখে বদলে নিতে সমর্থ, তার পক্ষে সম্ভব স্থানগত প্রতিক্রিয়ার নির্মমতার আগে নিজের আঙ্গিক আবিষ্কার।
অকীক মণি – যার জন্ম গভীর সমুদ্রের জল ও শ্যাওলায় – যেভাবে সে পল্লবিত হয়, তার চেয়ে অধিক নির্ভার, চিত্তাকর্ষক ও মনোহর এমন আর কী আছে? অথচ পূর্ণ আকার অর্জনের জন্য অকীক মণিকে যেতে হয় প্রবল বিরুদ্ধতার ভেতর দিয়ে। সহ্য করতে হয় নিরন্তর নিষ্পেষণ, যার ফলে তার প্রতিটি কমনীয়, বায়বীয় ও অনিন্দ্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও শেষ নিঃশ্বাস বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিজের উদ্ভিজ্জ অস্তিত্বের চূড়ান্ত খনিজ স্বপ্নে উপনীত হতে সে অবিরত লড়ে যায়। বস্তুত, অকীক মণির ক্ষেত্রে অবশেষে আমরা যা পাই তা উদ্ভিদের খনিজ পদার্থের পরিণতি নয়। অকীক এমন কোনো উদ্ভিদও নয়, যা অবশেষে খনিজে বিলুপ্ত হয়। বরং উলটো, সে হলো বৃক্ষের প্রাণঘাতী ভ্রমের ভেতর দিয়ে খনিজ জগতের নিষ্করুণ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক কাঞ্চন মণির আবির্ভাব।
গোলাপ ফুলের ব্যাপারটাও তাই। প্রতিটি ফুলই বেড়ে ওঠে বন্দিশালায়। নান্দনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আঙ্গিকহীনতাই হলো প্রকৃত মুক্তি। মরফলজির সাম্প্রতিক আবিষ্কারের কল্যাণে আমরা জানি (গয়্যটেকে ধন্যবাদ এমন একটি অমূল্য শব্দ আবিষ্কারের জন্য। লিওনার্দো হয়তো এ শব্দের সঠিক মূল্য দিতে পারতেন), বৈপরীত্য ও সংঘাতময় প্রবণতা যে বহু বিপুল জটিলতাপূর্ণ সংঘাতের জন্ম দেয়, তার ফলেই সৃষ্টি হয় নিখুঁত আঙ্গিকের স্তরবিন্যাস।
একমুখী ও একগুঁয়ে মানুষেরা যেমন অতি কঠোর নিয়মকানুনের অনুশাসনে ঝরে গেছে, ঠিক তেমনি যাদের বহুমাত্রিক ও নৈরাজ্যমুখী মন, নিজেদের বহুমুখিনতার কারণে তারা পল্লবিত হতে পেরেছে। আমার ভাই, যার কথা আগে বলেছি, ছিল সেই রকম একমুখী, স্থির ভাবনাচিন্তার একজন মানুষ। অন্যদিকে ক্ষীণধী আমি ছিলাম বহুমুখী, একসঙ্গে নানা স্তরে, নানা পথে অগ্রসরে আগ্রহী। অতি সহজেই আমি চেতনাবদ্ধ সকল বস্তুকে মিষ্টির সঙ্গে তুলনীয় ভাবতাম, আর মিষ্টিকে ভাবতাম চেতনাজাত বস্তু। সবকিছুর দ্বারাই আমি প্রভাবিত হতাম, কিন্তু কোনোকিছুই আমাকে পুরোপুরি বদলাতে পারত না। আমি ছিলাম দুর্বলচিত্ত, ভীরু; কিন্তু নিজ অবস্থানে প্রত্যাবর্তনে সমর্থ। আমার অস্থির মন হিস্পানীয় কঠোর মানসিকতার মধ্যেও আমার ধীমত্তার অকীক মণির স্বকীয়তা উদ্ধারে সমর্থ ছিল। আমার ভাইয়ের নামানুসারে বাবা-মা আমার নাম রেখেছিলেন সালভাদর। আমার নিয়তি ছিল স্প্যানিশ চিত্রকলাকে তার পতিতাবস্থা থেকে, বিশেষত যান্ত্রিক ও মধ্যমেধার বর্বরতা থেকে উদ্ধার। পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার কাছে রাফায়েলের মতো মানুষদের প্রকৃত দেবতা বলে মনে হয়। কেন এখন আর কোনোক্রমেই রাফায়েল ধাঁচের আঙ্গিকের ধারেকাছে পৌঁছানোও সম্ভব নয়, সম্ভবত আমিই একমাত্র চিত্রকর যার কাছে একথা সম্পূর্ণ জ্ঞাত। আমার নিজের কাজই আমার কাছে এর ধরনের বিপর্যয় ছাড়া অন্যকিছু মনে হয় না। সম্ভব হলে আমি হয়তো এমন একসময়ে বাস করতাম যখন কোনো কিছুকে কোনো বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের আর কোনো প্রয়োজন থাকত না। তার পরেও বর্তমানের দিকে চোখ ফিরিয়ে আমাকে একথা বলতে হয় – বিশেষজ্ঞদের প্রতি সকল শ্রদ্ধাসহই বলছি – অন্য কারো সঙ্গে নিজের স্থান পরিবর্তনের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না। অনুমান করি, ধীমান পাঠক হয়তো ইতিমধ্যে টের পেয়ে গেছেন, বিনয়বোধ ঠিক আমার ভূষণ নয়।
আমি অন্ততপক্ষে এমন একজনকে জানি যার পক্ষে সম্ভব হয়েছে রেনেসাঁকালীন সৌম্য পরিপূর্ণতা অর্জন, আর সে হলো আমার স্ত্রী গালা। দৈবক্রমেই তাঁকে নির্বাচনে আমি সমর্থ হয়েছিলাম। গালার রয়েছে বিতোফেনের নাইন্থ সিম্ফনির মতো অভিব্যক্তি, যাতে প্রকাশ হতো নিখুঁত এক অন্তঃপ্রকৃতির বহিঃরেখা। উপবিষ্ট গালা নিখুঁত, তার রয়েছে ঠিক সেই রকম সুষমা, যা মেলে রোমের সান পিয়েত্রো গির্জার নিকটস্থ ইল তেম্পিয়েতো দি ব্রামান্তে। স্তাঁধাল যেমন ভ্যাটিকানের প্রতিটি খিলান দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন, আমিও গালার অহংয়ের প্রতিটি তন্বী-খিলান মেপে দেখতে সমর্থ, সমর্থ তার শৈশবের কোমল ও ঋজু স্তম্ভসমূহ ও তার স্মিত হাস্যের সোপানাবলি নির্ণয় করতে। ইজেলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর সময় চোখের এক কোণ দিয়ে দেখে আমি ঠিকই বুঝতে সমর্থ, গালা রাফায়েল বা ভারমিয়ারের যে-কোনো ছবির মতো নিখুঁত, নিপাট। আমাদের আশপাশে যাকেই দেখি, মনে হয় এরা অসমাপ্ত অথবা ত্র“টিপূর্ণভাবে আঁকা ছবির মতো। অথবা এরা যেন কাফের সড়কে সামান্য কটি মুদ্রার বিনিময়ে ছবি আঁকার জন্য বসে থাকে যেসব ক্ষুধার্ত চিত্রকর, তাদের আঁকা ছবি।
আগেই বলেছি, সাত বছর বয়সে আমি নেপোলিয়ন হতে চেয়েছিলাম। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলা দরকার। আমাদের বাড়ির তিনতলায় একটি আর্জেন্টেনীয় পরিবার বাস করত। তাদের এক কন্যা উরসুলিতার সুন্দরী হিসেবে দারুণ সুখ্যাতি ছিল। গুজব ছিল, বিখ্যাত কাতালনীয় লেখক ইউজেনিও দ’রস তাঁর লা বেন প্লান্তাদা (বা সুপ্রথিতগণ)-এ কাতালনীয় নারীত্বের প্রতীক হিসেবে উরসুলিতাকে নির্বাচন করেছিলেন। সাত বছর হতে না হতেই তিনতলার সেই সুন্দরীর প্রতি আমার সুতীব্র আগ্রহ জেগে ওঠে। আমি হঠাৎ হঠাৎ আঙিনায় জলের কলে পানি খাওয়ার গভীর আনন্দ পরিত্যাগ করে তিনতলার ব্যালকনির সামান্য শব্দ শুনে সেদিকে দৃষ্টিপাত করতাম এই আশায় যে, সেখানে দরজাটি বোধ হয় এবার খুলবে। বাসায় যেমন, তিনতলাতেও তেমনি আমাকে রীতিমতো পুজো করা হতো। সেখানে প্রতিদিন ঠিক ছয়টার সময়, এক বিশাল টেবিলে খেলনা সারস সামনে রেখে, গোটা কয়েক আর্জেন্টেনীয় পরী মাতে – অর্থাৎ এক ধরনের আর্জেন্টেনীয়
চা – পান করত। আমিও সেখানে থাকার সুযোগ পেতাম। রুপোর পেয়ালায় রাখা সে চা টেবিলের চারদিকে এক ঠোঁট হয়ে অন্য ঠোঁটে ঘুরত। এই ঠোঁট-স্পর্শতা আমার মনে যে চিত্তচাঞ্চল্যের সঞ্চার করে তাতে একদিকে থাকত এক বিচিত্র নৈতিক সংকট, অন্যদিকে ঈর্ষার হীরক দ্যুতি। সে চা আমার কাছে মনে হতো মধু। আর মধু তো রক্তের চেয়ে মিষ্টি। রক্ত – মানে বংশ – সেখানে আমার মায়ের মাধ্যমে উপস্থিত থাকত। তা সত্ত্বেও আমার ঠোঁট ও মুখ সে স্পর্শ-সুখে এক নিশ্চিত ও গভীর যৌন আনন্দে উদ্বেলিত হতো। আমার ইচ্ছা হতো নেপোলিয়নের পানীয় গ্রহণ করি। একথা বলার কারণ, নেপোলিয়নও থাকত তিনতলার সে বসার ঘরে। যে টেবিলে বসে মাতে পান হতো, তার মাঝামাঝি থাকত কাঠরঙা টিনের এক পিপা। মাতে রাখা হতো সেখানেই। আর সে পিপার মাঝ বরাবর ছিল নেপোলিয়ন। মাতের পিপায় আঁকা নেপোলিয়নের সে ছবি আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। দীর্ঘদিন আমি তাঁর পর্বতসম অহং, তাঁর ফর্সা ও তুলতুলে পেট, রাজকীয় গোলাপি গণ্ডদেশ, মাথায় রাখা কালোরঙা টুপির বহিরাবরণ দেখে এই ভক্ষণযোগ্য নেপোলিয়নকে নিজের রাজকীয় মডেল নির্বাচন করেছিলাম।
সে সময় সবাই প্রণোদনাময় একটি গান গাইত :

Napoleon en el final

De un ramillette colossal
(শেষমেশ নেপোলিয়ন
একটি মস্ত পুষ্পস্তবক)।
তখনো আমার চেতনার পূর্ণ বিকাশ হয়নি, কিন্তু তাতে কী, পিপায় আঁকা নেপোলিয়নের ওই ক্ষুদ্র চিত্রটি আমার মনপ্রাণ জুড়ে ছিল। ব্যাপারটা যেন গরম কড়াইতে রাখা ডিমের কুসুম (যদিও কড়াইয়ের তখন পর্যন্ত পাত্তা নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুসুমটি সে কড়াইয়ের ঠিক মাঝখানে)।
অন্যকথায়, ওই সাত বছর বয়সের মধ্যেই আমি নিজের ভবিষ্যৎ নিচ থেকে একদম ওপরে – অর্থাৎ পাচক থেকে রাজা – এই শ্রেণিবিন্যাসে সুচিহ্নিত করে ফেলেছিলাম। মাতের পিপা, তার পুষ্টিযুক্ত পানীয়ের গোপন পুলক আমার কাছে পরিণত হয়েছিল স্থাপত্য-আঙ্গিকের এক নন্দিত মন্দিরে। একই সঙ্গে রসুইঘরের অর্ধ মানবী-অর্ধ অশ্ব যে কামজ চেতনার জন্ম দিয়েছিল, তার স্থান করে নিচ্ছিল তিনতলার বসার ঘরের এক প্রকৃত রূপসী, ১৯০০ সালে সৌন্দর্যের প্রতীক, উরসুলিতা।
পরবর্তীকালে আমার চিন্তাভাবনা কখন কী খোরাক থেকে প্রসারিত হয়, ক্রমশ সে গল্প আমি আপনাদের বলব। আপাতত এইটুকু বলছি, আমার চিন্তাজগতের একটি উৎস ছিল ভক্ষণযোগ্য ওই নেপোলিয়ন, যার মাধ্যমে আমি আমার শৈশবের দুই প্রধান ফ্যান্টাসি পূরণে সক্ষম হয়েছিলাম – একটি হলো পুষ্টিযুক্ত বাচনিক বিকারগ্রস্ততা, অন্যটি চোখ ধাঁধানো আত্মিক সাম্রাজ্যবাদ। সব কথা শোনার পরেই আপনারা বুঝে উঠবেন, দোলখাওয়া চেয়ারের ওপর রাখা ঈষদুষ্ণ দুগ্ধসংবলিত পঞ্চাশটি পানপাত্র কেন আমার কাছে নেপোলিয়নের মাংসালো জানুর মতো প্রতীয়মান হয়। এই চিত্তাকর্ষক গ্রন্থে এইরূপ ও ততোধিক প্রহেলিকাপূর্ণ নানা বিষয়বস্তুর খোলস উন্মোচন করা হবে। তবে অন্যকিছু আর যাই হোক, একটা জিনিস একদম গোড়া থেকে বলে রাখি, আর তা হলো, এই গ্রন্থে আমি যা বর্ণনা করেছি তার সকল দায়দায়িত্ব শুধুমাত্র আমার।

[প্রবন্ধে ব্যবহৃত ড্রইং সালভাদর দালির ডাইয়েরি থেকে ব্যবহৃত]

Leave a Reply