logo

আমার কিছু কথা

সোমনাথ হোর

১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি তৃতীয় বার্ষিকে আমি শিল্পী-শিক্ষক সফিউদ্দীনের কাছে কাঠখোদাইয়ের প্রথম পাঠ নিলাম। ইতোমধ্যে আমার চীনা কাঠখোদাইয়ের (জাপবিরোধী যুদ্ধকালীন) একটি বই হাতে এলো। অপূর্ব কুশলী সেসব কাজ দেখে মনে হলো, আমাকে অনেক মকশো করতে হবে। সরু নরুন (বুলি, এনগ্রেভার) দিয়ে কাঠ কাটতে গিয়ে কতবার রক্তপাত হয়েছে, তবু যতদিন না জলে মাছ চলার মতো করে বুলি চালাতে পেরেছি ততদিন অনুশীলন করে চলেছি। বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শ্রমিকের মুখ, কৃষকের সংগ্রাম, কলকাতায় ধর্মঘট কিংবা গ্রামে কৃষকের সভা, শোভাযাত্রা ইত্যাদি। মনে হতো ছাপ নিয়ে এগুলো জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। একমাত্র দৈনিক স্বাধীনতার মাধ্যমে যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে, অবশ্য অনেক পরে।
১৯৪৯-এর ১ মার্চ পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে আত্মগোপন করতে বাধ্য হই। আত্মগোপনে থাকাকালে অসংখ্য লিনো কেটে পোস্টার করেছি। সেগুলো নিজের হাতে শত শত ছেপেছি এবং কলকাতায় ও আশপাশের শ্রমিক এলাকায় সেগুলো দেয়ালে লাগানোও হয়েছে। এছাড়া দিনে আট-দশ ঘণ্টা ধরে সেটের পর সেট প্রমাণ সাইজের রঙিন পোস্টার করেছি। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সেগুলো উপস্থাপিত হতো এবং স্বাভাবিক কারণে অধিকাংশই পুলিশের হেফাজতে চলে যেত। এখন মনে হয়, কী অর্থহীন অসম সংগ্রাম-প্রচেষ্টা। অথচ কিছুই বৃথা যায়নি। আমি শুদ্ধ শিল্পী হতে পারিনি সত্য; কিন্তু শোষিত মানবের বেদনার্ত জীবন আমার তুলিতে তুলিতে এসিডে প্লেটে কিংবা মাটিতে মোমে এমন এক ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, যার বাইরে যাওয়ার পথ আমার জানা নেই। এই চক্রব্যূহের ভেতরেই আমার সংগ্রাম ক্ষেত্র। একই জায়গায় দাঁড়িয়েই আমাকে লড়তে হচ্ছে। বাইরের পৃথিবী আমি দেখি অন্যের হাতে, অন্য শিল্পীদের কাজে। সে বড় সুন্দর। দর্শক হিসেবে তার মাধুর্য পান করি। শিল্পী হিসেবে পারি না। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের অবতারণা করতে লোভ হচ্ছে। আত্মগোপনকালে বিভিন্ন আস্তানায় ছিলাম।
দু-দুবার ছিলাম কংগ্রেসকর্মীর বাড়িতে। প্রথমবার এক গ্রামের, নাম ভুলে গেছি, লোকাল কমিটির সভাপতির বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে – হৃত স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের অজুহাতে। আমার স্বাস্থ্য তখন উদ্ধার করার মতোই। ওখান থেকে কলকাতায় অত্যন্ত সৎ ও উৎসর্গীকৃত এক কংগ্রেসকর্মীর বাড়িতে। নাম সুধীন নিয়োগী। তিনি কর্পোরেশনে শিক্ষকতা করতেন এবং রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর শাশুড়ি আর্যবালা সেন কমার্শিয়াল শিল্পী পরিচয় দিয়ে এ ব্যবস্থা করেন। এ আস্তানায় থেকে আমি বিপুল পরিমাণ লিনোকাট করি এবং রঙিন পোস্টার আঁকি প্রায় এক বছরের ওপর। আর্যবালা দেবী ছিলেন কমিউনিস্ট দরদি। তিনি রোজই খোঁজখবর নিতেন এবং নিকটস্থ তাঁর বাড়িতে লিনো ছাপার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। সুধীনবাবু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি হৃদয়ঙ্গম করেন; কিন্তু না পুলিশে খবর দিয়েছেন, না স্থান ত্যাগ করতে বলেছেন। তখন বিধান রায়ের শাসনকাল এবং পুলিশের দাপট নির্মম।

দুই
লিখে পোস্টার জোগানোই ছিল আমার কাজ। জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা যখন প্রায় জনশূন্য হলো, তখন আমরা জাপবিরোধী ও ফ্যাসিবিরোধী পোস্টার দেয়ালে সাঁটছি কিংবা শোভাযাত্রা করে রাস্তায় প্রদর্শন করছি।
’৪২-এর মে মাসে সম্ভবত ৭/৮/৯ তারিখ নাগাদ চট্টগ্রাম পতেঙ্গা বিমানবন্দরে জাপানি বিমানবাহিনীর গুলিতে শত শত মজুর মারা গেল। সে কদিন আমি চট্টগ্রাম শহরে ছিলাম। প্রথম দিনেই ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর পলায়ন প্রস্তুতি এবং জাপানি আক্রমণকারীর নৃশংস বর্বরতা এখনো সভয়ে স্মরণ করি। অবশ্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জেনারেল ওয়াভেলের বিশেষ নির্দেশে ব্রিটিশরা পলায়ন স্থগিত রাখে এবং স্থানে স্থানে কাটা নারকেল গাছের নকল বিমানবিধ্বংসী অবয়ব সরিয়ে সত্যিকারের অস্ত্রসজ্জা শুরু করে। সেদিনের পরিস্থিতিতে দশজন জাপানিও চট্টগ্রাম অনায়াসে দখল করে নিতে পারত। সেবার শরতে আমরা অনুমান করলাম চালের সংকট দেখা দেবে, বর্মা জাপানি দখলে। চাল আমদানি বন্ধ। বর্ষা ভালো হয়নি।
পুরো শীতকাল গ্রামের বাড়িতে আমার রোগশয্যায় কাটল। গ্রীষ্মের শুরুতে চারদিকে হাহাকার। আমাদের একবেলা দুমুঠো মোটা চালের ভাত, অন্য বেলা জাউ খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। সন্ধে হলেই শুনি পাড়ায় পাড়ায় কান্না, সকালে শুনি অমুক অমুক মারা গেছে, কোনো পাড়ায় লোকেদের নিরম্বু উপবাস। আমাদের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আমাদের বন্ধুরা – সকলেরই বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সরকারি সাহায্যে লঙ্গরখানা খুলল। রোজ অতি অখাদ্য খিচুড়ি রান্না করে অভুক্তদের দিনে একবেলা করে হাটের নাটমন্দিরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা হলো। দেখা গেল, লোকসংখ্যা দিনে দিনে কমছে। শোথ রোগ (dropsy), পেটের গোলমালে বেশ কিছু লোক মারা গেল। ধোপা, নাপিত, কুমোর, জেলে – এরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। দিনমজুররা যুদ্ধায়োজনের কাজে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ল – কোথাও সেনাছাউনি হচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে কিংবা বিমানঘাঁটি বসছে। এ সময় চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি আমাকে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলেন কী করে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের ড্রইং করতে হয়। তাই থেকে আবার পোস্টার করা। সেগুলো গ্রামেগঞ্জে নিয়ে গিয়ে প্রদর্শনী করে জনমনে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চার করা। তদানীন্তন জেলা নেতৃত্ব, বিশেষ করে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের আগ্রহে আমি শহরে এলাম সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে। রাস্তায় রাস্তায় খাতা হাতে অত্যন্ত কাঁচা ড্রইং করতাম। মৃত্যুপথযাত্রীদের ওইভাবে আঁকা খুব নির্মম অধ্যবসায়। তবু এঁকে যেতাম। বুঝতে চেষ্টা করতাম, এই ক্ষত কেন। রোগগ্রস্ত ক্ষুধার্তরা সর্ব-অঙ্গে দগদগে ঘা নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায়। তাদের রক্ষা করার কেউ নেই। এরই মধ্যে মনে নেই – ঠিক কোন সময়ে – কালারপুলে জাপানিরা বোমা ফেলল। গিয়ে দেখলাম, পুলের ধারে মাঠে পড়ে আছে বোমার আঘাতে নাড়িভুঁড়ি বের হওয়া বারো/তেরো বছরের একটি মেয়ের শব। আমিনা বেগম কি আমিনা খাতুন নাম হবে। দেখা যায় না, তবু আঁকলাম। হয় ক্ষুধায়, নয় যুদ্ধের ক্ষত। আরো আঁকতাম পোড়োবাড়ি, যেগুলোর বাসিন্দারা ভুখা মারা গেছে কিংবা গ্রামের চালচুলোহীন স্কুলবাড়ি, যেখানে পড়–য়ারা কেউ অবশিষ্ট নেই। তেতাল্লিশে অল্প সময়ের জন্য কলকাতায় আসি; সেখানেও একই দৃশ্য – মৃত্যুর মিছিল। যারা চলচ্ছক্তিহীন তারা অসহায় জিজ্ঞাসা নিয়ে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যারা একেবারে বসে পড়েনি তারা সন্ধ্যায় ‘দুটো ফ্যান দাও’ ‘ফ্যান দাও’ আর্তধ্বনিতে পাড়ায় ভীত শিহরণ তুলছে। যারা জীবিত অথচ অনুভূতিহীন নয়, সেই মধ্যবিত্তের মনে এক অজানা ত্রাস।
[অপ্রকাশিত লেখাটি সোমনাথ হোরের কন্যা চন্দনা হোরের সৌজন্যে প্রাপ্ত। -সম্পাদক]

Leave a Reply