আ বু ল হা স না ত
আবদুস শাকুর শাহ দীর্ঘদিন ধরে লোকজ ধারায় অবগাহনের মধ্য দিয়ে যে চিত্রভাষা নির্মাণ করেছেন তার মূল্য অসীম। এই ধারার পরিপুষ্টি সাধনে তাঁর বিরতিহীন প্রয়াস বাংলাদেশের চিত্রকলাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এ কেবল ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ হয়ে ওঠেনি। লোককলার আধুনিকীকরণের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের হাজার বছরের বাঙালিত্বের সাধনাকেও নানাভাবে উন্মোচন করছেন। ছবির মধ্যে গল্প বলার অভিমুখিনতা এবং ছবির মধ্যে লোককথার যে উপাদান এ আমাদের কয়েকজন অগ্রজ শিল্পীর শিল্পবোধ ও জীবনবোধকেও স্মরণ করায়।
ইতোপূর্বে আবদুশ শাকুর মৈমনসিংহ গীতিকার নানা অনুষঙ্গকে তাঁর চিত্রপটে যে পরিপ্রেক্ষিত-জ্ঞানে উপস্থাপন করেছেন তা তাঁর সৃষ্টিকে তাৎপর্যময় ও অর্থময় করে তুলেছে।
বাঙালির লোকায়ত শিল্পরূপকে নবীন আলোক সঞ্চার করে বাংলাদেশের চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন শিল্পী আবদুস শাকুর শাহ। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প তাঁর হাতে নতুন ব্যঞ্জনা অর্জন করেছে। দীর্ঘদিন লালিত এই শিল্পরূপকে নব অবয়ব ও আকার দিয়েছেন তিনি। বিশেষত মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনিকে অবলম্বন করে তিনি অঙ্কন করেছেন অগণিত চিত্র। এই গীতিকার কাহিনির মধ্যে প্রেম, বিরহ ও জীবনসংগ্রাম নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। মানবিকবোধের প্রকাশে শিল্পী আবদুস শাকুরকে অনুপ্রাণিত করেছে এ-বিষয়কে অবলম্বন করে চিত্র-অঙ্কনে। এই ভুবনে তিনি পেয়ে যান বৃহত্তর জীবন ও প্রেমের অনুষঙ্গ। অন্যদিকে লৌকিক শিল্পরূপের বর্ণ ও অলংকরণ। এই দুয়ের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে তাঁর চিত্রভুবন। মহুয়া ও মলুয়ার জীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর শিল্পিত কুশলতায় ও উপস্থাপনের গুণে হয়ে ওঠে চিত্রগুণসমৃদ্ধ। ঐতিহ্য-আশ্রিত বিচ্ছুরণ এবং নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ হয়ে ওঠে আধুনিক।
বাঙালির রূপকল্পের ছন্দ, লৌকিক শিল্পধারা পূর্বসূরিদের সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ হয়েছিল। তিনি এ-ধারাকেই আত্তীকরণ করে তাঁর সৃজনশীলতার উদ্যানকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্ন ও কারম্নকলা বিভাগ থেকে বিএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ভারতের বরোদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এখানেই তিনি ভারতের বিখ্যাত চিত্রকর কে.জি. সুব্রহ্মণ্যনকে শিক্ষক হিসেবে পান। তাঁরই দীক্ষা ও শিল্পরম্নচি তাঁকে প্রভাবিত করে। এই সময় থেকে তিনি বাঙালির লৌকিক জীবন ও শিল্পধারা পুনরাবিষ্কারে ব্রতী হন ও তাঁর সৃজনী-উৎকর্ষ নতুন মাত্রা অর্জন করে।
শিল্পের লোকায়ত রূপের সন্ধান প্রয়াস মাত্র কয়েকজন শিল্পীর নানা কাজে প্রত্যক্ষ করা যায়। কামরম্নল হাসান, এস এম সুলতান, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ চৌধুরীর ঐতিহ্য-অন্বেষা আজ ইতিহাসের অমত্মর্গত হয়ে আছে। এঁদের নির্মাণ ও সৃষ্টিতে কখনো-সখনো রেখা ও রূপকল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে এই ক্ষেত্রে শাকুরই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী, গল্প বলার ঢঙে বোধকরি একক কৃতিত্বের দাবিদার। এ হয়ে ওঠে প্রবলভাবে, তীব্রভাবে ও তীক্ষনভাবে আত্মপরিচয় প্রশ্নে উজ্জ্বল এক দৃষ্টামত্ম।
ঐতিহ্য থেকে পরিগ্রহণ করেন আবদুস শাকুর। রং-রেখায় তাঁর ছবির উজ্জ্বলতা-বিশিষ্টতা আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। হরেক রঙে ও রেখায় তিনি মানুষ ও প্রকৃতি অঙ্কন করেন। তাঁর ছবি দেখে মনে ঐতিহ্যিক প্রবাহ কতভাবে না সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত আবদুস শাকুর শাহর একক প্রদর্শনী আমাদের ঐতিহ্য-জিজ্ঞাসার নব রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করে আমরা আনন্দিত হয়েছি। প্রদর্শনীর ছবিগুলো সম্প্রতি করা এবং সুদূরের গীতময়, লাবণ্যগুণসমৃদ্ধ। তাঁর ছবিতে কথা আসে গল্প নিয়ে। বিরহ-বেদনাও উপেক্ষণীয় হয় না। পুরান দিনের জন্য ব্যাকুলতা তৈরি করে।
শিল্পী শাকুরের চিত্রভাষা যেন হাজার বছরের গ্রামীণ জনপদের নানা অনুষঙ্গের পথ ধরে আমাদের এক দীর্ঘ যাত্রার পথে নিয়ে যায়। আবদুস শাকুরের শিল্পচর্চায় বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি, গ্রামীণ জীবনধারা, প্রাচীন কাব্যের নানা অনুষঙ্গ অনুপ্রেরণার ভূমিকায় আছে অনেকটা সময় ধরেই। ভারতের বরোদার এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিল্প-শিক্ষক কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনের উৎসাহে আবদুস শাকুর শিল্পী যামিনী রায়, কামরম্নল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরীদের দীর্ঘ চর্চিত লোকজ চিত্রকলার ঐতিহ্যিক প্রবাহের জল হাওয়া দিয়ে পরিপক্ব করেছেন। টেরাকোটা, নকশিকাঁথা এবং পটচিত্রের মতো লোকজ সংস্কৃতি থেকে নেওয়া নানা মোটিফের ব্যবহার তাঁর কাজের প্রধানতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তার সঙ্গে দেশজ নানা প্রাচীন গল্প এবং গীতিকাব্য থেকে আহরিত অংশবিশেষের লিপিকলা এবং সেসব কাব্যের নানা মানবের দেহাবয়বকে তিনি যে বিশেষ অঙ্কনরীতির আয়ত্ত করেছেন, তা বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে শাকুরকে বিশেষ স্থান দিয়েছে। সর্বোপরি শিল্পী আবদুস শাকুরের শিল্পচর্চায় বাঙালি জাতীয় সত্তা এবং স্বরূপচেতনা উজ্জ্বলতা অর্জন করেছে। এ চেতনা আমাদের ভাবনার দিগমত্মকে প্রসারিতও করে।
গ্যালারি শিল্পাঙ্গনের প্রতিষ্ঠাতা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমেদ স্মরণে এই প্রদর্শনী নানা কারণে হয়ে উঠেছে তাৎপর্যময় ও গুরম্নত্ববহ। শাকুর এই প্রদর্শনীতে এমন কিছু কাজ উপহার দিয়েছেন যা তাঁর পূর্ববর্তী কাজ থেকে হয়ে উঠেছে ভিন্নধর্মী; কয়েকটি ছবিতে গল্প আছে এবং গল্প ছাড়িয়েও তিনি এমন কিছু মুখাবয়ব অঙ্গন করেছেন, যা সত্যিকার অর্থেই তাঁর শৈলী ও বিশিষ্টতা সত্ত্বেও আলাদা আদল দিয়েছে।
শিল্পী আবদুস শাকুর নানা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। শৈলী ও প্রকরণে এক নবীন বোধে উপনীত করেছেন সৃষ্টিকে। মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজের পর তিনি এই প্রদর্শনীর অনেক ছবিতে আমাদের দেশের নানা ঐতিহাসিক ও লোকজ ফর্মের আধুনিক উপস্থাপন এবং মৌলিক ধারণা অবতারণা করেছেন, কাগজ দিয়ে করা ছোট আকৃতির নানা কোলাজ এবং গোয়াশের কিছু চিত্রকর্ম সৃজন করেছেন, যার মাধ্যমে শিল্পী এদেশের লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর পুরনো ভালো লাগাকে নতুন মাত্রায় আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। এছাড়া পূর্বেকার প্রদর্শনী থেকে এ প্রদর্শনীর চরিত্র অধিক পরিমাণে সৃজনধর্মী। গল্প বলা ছাড়াও তিনি কিছু অবয়বধর্মী ছবি অঙ্কন করেছেন। এসব চিত্রগুচ্ছে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরো গভীর হয়ে উঠেছে। n