শ রী ফ আ তি ক – উ জ – জা মা ন
সৃষ্টিশীল ব্যক্তির দ্বারাই শিল্পের সৃষ্টি হয়। শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ভাবনা হয়ে ওঠে শিল্পসৃষ্টির কাঁচামাল, যা নিরন্তর মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে। যে অভিজ্ঞতা ও ভাবনাকে তিনি তাঁর নিজস্ব বিচারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাকেই সর্বোচ্চ দক্ষতায়, নিজস্ব শৈলীতে, পছন্দসই মাধ্যম ও প্রকাশভঙ্গিতে তুলে ধরেন। আর এভাবেই যে শিল্পটি সৃষ্টি হয় তা শিল্পরসিকদের অনুভূতি, ধীশক্তি ও আবেগকে তাড়িত করার পাশাপাশি তার রসবোধকে পরিতৃপ্ত করে।
সেই সমস্ত শিল্পী যাঁরা বিভিন্ন সময়ে শিল্পের আহবানে সাড়া দিয়ে একাগ্রচিত্তে শিল্পের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছেন এবং সৌন্দর্য সৃষ্টির পাশাপাশি তার বিকাশের ধারাকে বহমান রেখে মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও তার রস উপলব্ধির ক্ষেত্রে অবিরাম সাধনা করে গেছেন তাঁরা নমস্য। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, রেমব্রান্ট, ভারমিয়ার হলো সেইসব নাম, যা উচ্চারণে আমাদের অনুভূতিতে বিশেষ শিহরণ জেগে ওঠে। তাঁরা বিষয়বৈচিত্র্য, প্রকাশভঙ্গি বা শৈলীগত বৈশিষ্ট্যে ছিলেন অনন্য এবং শিল্পী হিসেবে তাঁদের যে অর্জন তা কেবল স্বপ্নদ্রষ্টা বা হাতের নৈপুণ্যের ভিত্তিতে নয়, বরং উভয় বিষয়ের নিরিখেই মূল্যায়িত হয়ে থাকে।
তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি শিল্পজগৎ তার আস্থা হারাতে শুরু করে। যে ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ দেখা যায় তার মূলে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অদ্ভুত এক উপলব্ধি যে সৌন্দর্য, প্রগতি, আশাবাদ, খাঁটি মৌলিকত্ব অর্জন আর সম্ভব নয়। এই অনুভূতির বেশ কিছু কারণ ছিল। উনিশ শতকে দ্রম্নত বিস্তারলাভকারী মতবাদ ন্যাচারালইজম (শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘স্বভাববাদ’ এবং দর্শন ও ধর্মের ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতিবাদ’ হিসেবে পরিচিত) ধর্মীয় বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে থাকা মানুষদের মাঝে একধরনের নৈঃসঙ্গ্য জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি পৃথিবী সম্পর্কে এক বিশাল শূন্যতার ধারণা পোক্ত করে তোলে। সংশয়বাদ ও অযৌক্তিকতাবাদের মতো দার্শনিক মতবাদ বোধ, যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। এর সঙ্গে বিবর্তনবাদের মতো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও প্রচলিত পদ্ধতিকে অস্বীকার করার মতো প্রবণতা মানুষের মাঝে একধরনের হতাশাবাদী ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করে। উদারবাদ ও মুক্তবাজার তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এঁদের অনেকে আভাঁ গার্দ শিল্পগতিধারার সদস্য ছিলেন। এঁরা নতুন রাজনৈতিক স্রোতকে গভীর হতাশার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিজ্ঞান ও পুঁজিবাদের সমন্বয়ে সংঘটিত প্রযুক্তিগত বিপস্নবকে অনেকে অমানবিকীকরণের পদ্ধতি হিসেবে দেখছিলেন, যা মানুষকে আর্থিক সচ্ছলতা দিলেও হৃদয়বৃত্তিকে ধ্বংস করে ফেলবে বলে ধারণা করেছিলেন।
উনিশ শতকের শিল্পবিপস্নব সমাজে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। যোগাযোগব্যবস্থার নতুন মাধ্যম চলাচলকে সহজ করে তুলেছিল। মানুষ ও তাদের ভাবনাগুলো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্রম্নততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছিল। এইসব পরিবর্তন এবং তার ফলে শিল্পের প্রকাশভঙ্গি কীভাবে বদলে যাবে তা নিয়ে শিল্পজগতে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছিল। পরবর্তী শতকে সারা ইয়োরোপজুড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেসব মৌলিক শিল্প আন্দোলন জন্মলাভ করেছিল তার মধ্যে অন্তর্মুদ্রাবাদ, অভিব্যক্তিবাদ, ঘনকবাদ, দাদাবাদ, ভবিষ্যবাদ, পরাবাস্তববাদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এইসব আন্দোলনের একটি বিষয় সব শিল্পীই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন, তা হলো ‘ধারণা’ – ছায়াসম্পাত, রং, শূন্যস্থান ইত্যাদির ধারণা; নতুন প্রযুক্তি ও সমাজে তার অর্থ; শিল্পের অর্থ, শিল্প কি তার আপন শক্তিতেই টিকে থাকবে নাকি অন্য কোনো মতবাদের সমর্থক হিসেবে গুরুত্ব লাভ করবে – এইসব বিতর্কিত ধারণা। তারা বাড়ি, ক্যাফে, বিদ্যাপীঠে অহরহ মিলিত হতে লাগলেন; ছবি আঁকলেন, বিতর্ক করলেন, ঘোষণাপত্র রচনা করলেন, আলোচনা, ঝগড়া, লড়াই সবই চালিয়ে গেলেন। এই সমস্ত ধারণার পাশাপাশি রং, বিন্যাস, কাঠামো ইত্যাদির তাত্ত্বিক অর্থ প্রচার করে Der Blaue Reiter, 391 ও Dada-এর মতো পত্রিকা প্রকাশিত হলো।
বেশিরভাগ শিল্পসমালোচক একমত যে আধুনিকতাবাদের উৎপত্তি উনিশ শতকের শেষপাদে এবং প্রভাবশালী শিল্পমতাদর্শ হিসেবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তা টিকে ছিল বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। এর সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে মৌলিক নন্দনতত্ত্ব, কলাকৌশলগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিয়মিত ফর্মের বদলে শূন্যস্থানিক বা ছান্দিক ফর্ম এবং আত্মসচেতনতা প্রকাশের পাশাপাশি সত্যিকার মানবিক সম্পর্কসমূহের অনুসন্ধান, শিল্পের বিমূর্তায়ন এবং কল্পরাজ্যের স্বপ্ন অন্যতম। এই বিষয়গুলো উত্তরাধুনিক শিল্পে অনুপস্থিত। উত্তরাধুনিকতার আবির্ভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বলা হয়ে থাকে, আধুনিকতা এই পর্যায়ে এসে খানিকটা গুরুত্ব হারিয়েছিল এবং সমগ্রতাবাদের সঙ্গে তার বিশেষ এক যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল। উত্তরাধুনিকতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা চল্লিশের দশকে, বিশেষ করে হোর্হে লুই বোর্হেসের রচনায় লক্ষ করি। তবে বেশিরভাগ সমালোচক মনে করেন, উত্তরাধুনিকতার জন্ম আধুনিকতার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য এবং পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশকে এসে এই ধারাটি আধুনিকতাবাদ থেকেও প্রবল হয়ে ওঠে। তখন থেকে উত্তরাধুনিকতা বিতর্কশূন্য না হলেও শিল্পসাহিত্য, সংগীত, দর্শনের একটি প্রবল প্রভাববিস্তারী ধারা হিসেবে চলে আসছে। ১৯৯০ সালের শেষপাদে একটা কথা খুব জোরেশোরে শোনা গিয়েছিল যে উত্তরাধুনিক যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। Post শব্দটি দ্বারা আধুনিকতার মৃত্যুবারতা ঘোষিত হয়েছে অর্থাৎ সত্য, বস্ত্তনিষ্ঠতা, আত্মা, আত্মনিষ্ঠতা, কল্পরাজ্য, মৌলিকতা, মূল উৎস, সততা, ভাবালুতা ইত্যাদি আদর্শের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু trans উপসর্গ যোগ করে উল্লিখিত মতাদর্শের পুনর্জন্ম ও সর্বব্যাপিতা ঘোষণা করা হচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হতাশা চরম উদ্বেগে পরিণত হয়। আর শিল্পীরা এমন এক শিল্পনির্মাণ ধারার প্রতি সাড়া দেন যেখানে যুক্তি, শৃঙ্খলা, মর্যাদা, আশাবাদ, নিশ্চয়তার মতো বিষয়গুলো উধাও হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীতে পিকাসো তাঁর ক্যানভাসে এক বিচূর্ণিত পৃথিবী তুলে ধরলেন, যেখানে শূন্যদৃষ্টির নিঃসঙ্গ ও হতাশ মানুষেরা ভিড় জমাতে লাগল। অনাকর্ষণীয় ছেঁড়াখোঁড়া পরিবেশে আবেগহীন নারী-পুরুষদের দেখা গেল এডওয়ার্ড হুপারের ক্যানভাসে। উইলেম দ্য কুনিংয়ের ‘নারী’ সিরিজের ছবিতে সব হারানোর ভীতি এবং দালির পরাবাস্তববাদী জগতে স্বপ্ন ও বাস্তবের অদ্ভুত দ্বৈরথ লক্ষ করা গেল। অ্যান্ডি ওয়ারহলের অকিঞ্চিৎ বা লঘুকরণ পদ্ধতি কিংবা এদুয়ার্দ মুঙ্খ কর্তৃক গভীর শূন্যতার দিকে ধাবমান পৃথিবীতে গুরুত্বহীন হয়ে ওঠার ভীতি মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখাল তার অস্তিত্বের প্রহেলিকা।
বিংশ শতাব্দীতে শিল্পবিষয়ক অনেক সংলাপই অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করার অভিপ্রায় সম্পর্কিত। যুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকাল থেকেই বিভিন্ন শিল্পঘরানা বিষয়বস্ত্তর বাস্তবসম্মত উপস্থাপনার চর্চা চালিয়ে আসছিল। যারা বাস্তবতা থেকে খুব দূরে গিয়ে শিল্পচর্চার সাহস দেখাতে পারছিল না তাদের এই বিষয়গুলো নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে অভ্যাস করানো হতো। বড় বড় গ্যালারিতে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না, ফলে অনেকে অপ্রচলিত শিল্পসামগ্রী নিয়ে বিমূর্ততার স্বাধীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে লাগল, তার সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়তে লাগল। নিজেদের স্বপ্ন প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফলতা পেল। আর এভাবে নতুন এক শিল্পঘরানা তৈরি হলো, যারা বিষয়ের চেয়েও বেশি নতুনত্ব ও মৌলিকত্বকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল। দর্শকদের উপলব্ধির দুর্বোধ্যতার বিনিময়ে এই শিল্পীরা শিল্পচর্চায় প্রচুর স্বাধীনতা নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করল। অনেক শিল্পী যারা প্রথম বিমূর্তায়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল তারা আরো গভীরভাবে চেনা জগতের অনুশীলনের পরিবর্তে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির অনুসন্ধান চালাল।
বিংশ শতাব্দী আত্মবিচ্ছিন্নতার কালও বটে। যখন পিকাসো ও মুঙ্খ চারপাশে তাকিয়ে তা্দের হতাশাজনক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন তখন অন্যরা শিল্পকে গুরুত্বহীন বিবেচনা করে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাদের যুক্তি ছিল যে, স্থিরচিত্র ও সাহিত্য যথাক্রমে ছবি ও কাহিনির মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরছে। অনেকে তাঁদের ছবি থেকে প্রচুর বিষয়াবলি ছেঁটে ফেললেন। শিল্প হয়ে উঠল রং, রেখা ও মাত্রার কৌশলী রচনা। কিন্তু তাও বিতর্কহীন রইল না। পিয়েরে মন্ড্রিয়েন ও বার্নেট নিউম্যানের নিষ্ফলা রঙের পাঠে ত্রিমাত্রিকতার অনুপস্থিতি অনুভূত হলো। তারপর কাসিমির ম্যালেভিচের প্রায় একরঙা ছবিতে রঙের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ল। জ্যাকসন পোলকের এলোমেলো অসংহত রঙের ফোঁটা বা ছিটার মধ্যে শৈল্পিক ভূমিকার ঘাটতি নজর এড়াল না।
উত্তরাধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদের বিরোধকল্প বৈশিষ্ট্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, যা ছিল আধুনিকতার মূলে, আর তার সূচনা হয়েছিল ফরাসি চিত্রশিল্পী মানের মাধ্যমে। প্রচলিত অনুকৃতিমূলক চিত্রকলার অনেক কিছুই তিনি বর্জন করেছিলেন এবং বাস্তবানুগতা, নকশাধর্মিতা, বিমূর্তায়ন ইত্যাদি বাদ দিয়ে তিনি বিরোধকল্প নিয়ে এসেছিলেন।
আভাঁ গার্দের অবস্থান ছিল বিতর্কিত। অনেক প্রতিষ্ঠান যুক্তি খাঁড়া করেছিল যে স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রগতিবাদী, অগ্রগামী দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় তখনকার শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উত্তরাধুনিক চিত্রকলা ‘আমাদের সময়কার শিল্পে’র সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়ে উঠছে। উত্তরাধুনিকতা শিল্পের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং আভাঁ গার্দের পুরাণ উলটে দিচ্ছে। উত্তরাধুনিক শিল্পের প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হলো কলকারখানার উপাদান ও পপ-সংস্কৃতির চিত্রকল্পের সমন্বয়ে উঁচু ও নিচু সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপন। ১৯৯০-৯১ সালে কার্ক ভারনিডো ও অ্যাডাম গপনিক নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে High and Low : Modern Art and Popular Culture প্রদর্শন করেন। উত্তরাধুনিক শিল্পকলা উচ্চমার্গীয় শিল্প ও নিচু পর্যায়ের শিল্পের যে পার্থক্য তা প্রায় দূর করে দিয়েছে। উত্তরাধুনিকতাবাদ তাঁর শিল্পের সঙ্গে বাণিজ্যিক, নিচু ও কদাকার মানের শিল্প-উপাদান যোগ করেছে। উত্তরাধুনিক গোথিক, রেনেসাঁ ও ব্যারোক থেকে শৈলী ধার করে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তাদের শিল্পগতিধারার সঙ্গে মিলিয়েছেন। আর এগুলো উত্তরাধুনিকতার অতিপরিচিত বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। আমূল বদলে ফেলার বাসনা ও নতুন শিল্পধারা উত্তরাধুনিকতাবাদের প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ পূর্বলক্ষণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, যার উদ্ভব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। কারিগরি উপাদান ও কোলাজের মতো কৌশলের সঙ্গে ঘনকবাদ, দাদাবাদ ও পরাবাস্তববাদের মতো আভাঁ গার্দ শিল্পমতবাদ যুক্ত হয়, যার প্রবক্তারা শিল্পের প্রকৃতি ও মূল্য নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে পিটার বার্গার ঐতিহাসিক আভাঁ গার্দ ও আধুনিকতাবাদের পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। পিকাসোর কোলাজের ব্যবহারকে ক্রাউস আভাঁ গার্দ চর্চার অংশ হিসেবে দেখেছেন।
শিল্পজগৎ কি তাহলে তার অন্তিমে পৌঁছে গেল? যখন তা পিকাসো ও মুঙ্খের নজরে দেখা হয় তার নাকি কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিষয়বস্ত্ত লঘুকারীর দল যা রচনা করল তার মধ্যে অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতি লক্ষ করা গেল। আর এভাবেই সম্মিলিতভাবে শিল্পজগতের হর্তাকর্তারা ঐকমত্যে পৌঁছালেন যে শিল্পের কোনো বিষয়বস্ত্ত নেই, নেই কোনো বিশেষ মাধ্যম কিংবা কলাকৌশল এবং শিল্পীর ভূমিকাও গৌণ হয়ে পড়েছে। শিল্প হয়ে গেছে অবস্ত্ত বা একধরনের অনস্তিত্বের প্রতিবেদন।
১৯১৭ সালে একটি প্রদর্শনীর জন্য কিছু পাঠাতে অনুরুদ্ধ হয়ে মারসেল ডুশ্যাম্প একটি মূত্রাধার পাঠিয়ে দিলেন। ডুশ্যাম্প শিল্পের ইতিহাস জানতেন, জানতেন শিল্পের মাধ্যমে সভ্যতা কী অর্জন করেছে। শিল্পকলা মানুষের সৃষ্টিশীলতার চরম প্রকাশের একটি মাধ্যম, যা কলাকৌশল বা দক্ষতা দাবি করে। তাঁর অজানা ছিল না যে শিল্পের এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে মানুষের অনুভূতি, মন, আবেগকে প্রবলভাবে আলোড়িত করার। তারপরও তিনি যে মন্তব্য করলেন তা অদ্ভুত। পানির সরঞ্জাম ক্রয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হলো যে শিল্পী বড় কোনো স্রষ্টা নন, আর শিল্পও বিশেষ কোনো সৃষ্টি নয়, বরং কারখানায় অনেকে মিলে যা প্রস্ত্তত করে তার মূল্য বেশি। শিল্পদর্শনের অভিজ্ঞতা মহান বা উত্তেজনাকর নয়, বরং তা বিভ্রান্তিকর এবং কোনো শিল্পকর্ম দেখার পর দর্শক বিশেষ একধরনের অরুচি নিয়ে ফিরে আসেন। তারপরও ডুশ্যাম্পের উদ্দেশ্য কিন্তু কোনো তৈরি জিনিস প্রদর্শন ছিল না। মূত্রাধার পাঠিয়ে তিনি যে বারতা পাঠাতে চেয়েছিলেন তা হলো : শিল্প হলো তাই যার ওপর মূত্র ত্যাগ করা যায়।
১৯৪০ শতকের শেষভাগে জ্যাকসন পোলকের আমূল বদলে দেওয়ার চরমপন্থা সমস্ত সমসাময়িক শিল্পধারাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি মনে করতেন যে, একটি শিল্পকর্ম সৃষ্টির পথপরিক্রমা শিল্পকর্মটি সৃষ্টি করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। পোলক ইজেলে ক্যানভাস সাজিয়ে ছবি আঁকার প্রথাগত পথ পরিহার করে মেঝেতে ক্যানভাস ফেলে চারকোনা থেকে রং ছিটিয়ে, লেপ্টে, তুলি টেনে, কলকারখানার সামগ্রী ব্যবহার করে চিত্রকল্পে, বিনা চিত্রকল্পে যে ছবি এঁকেছেন তা বিমূর্ত প্রকাশবাদ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এর পাশাপাশি উইলেম দ্য কুনিং, ফ্রানজ ক্লাইন, মার্ক রথকো, ফিলিপ গাসটোন, হ্যানস হফম্যান, ক্লিফোর্ড স্টিল, বার্নেট নিউম্যান প্রমুখ শিল্পের বৈচিত্র্যম–ত দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
বিমূর্ত চিত্রকলায় ১৯৫০ থেকে ১৯৬০-এর মধ্যে অনমনীয় প্রান্তসীমা চিত্র (Hard-edge painting), ফ্রাঙ্ক স্টেলার জ্যামিতিক বিমূর্তায়ন, ক্লিমেন্ট গ্রিনবার্গের উত্তর-বন্ধনহীন বিমূর্তায়ন (Post-painterly abstraction), বর্ণিল জমিন চিত্রকলা (Color field painting) ইত্যাদি ধারা সংযুক্ত হয়েছে।
১৯৬০ সালের শেষদিকে উত্তর-ন্যূনকল্পবাদ (Post minimalism), ইচ্ছানিরপেক্ষ শিল্প (Process Art) ইত্যাদি এসেছে বিপস্নবী মতবাদ হিসেবে। উত্তর-ন্যূনকল্পবাদের লক্ষ্য ছিল শিল্পকে ন্যূনতম কয়েকটি রং, রেখা, গঠনের ভেতর দিয়ে মৌলিক জ্যামিতিক আকারে সীমাবদ্ধ রাখা। কোনো বস্ত্তকে উপস্থাপন এর উদ্দেশ্য নয়। একে হাতেখড়ি শিল্পও (ABC art) বলে। ন্যূনকল্পবাদী চিত্রকলায় ন্যূনতম উপাদান ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফললাভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এই শিল্পগতিধারা মূলত আমেরিকান চিত্রকলা, যা ১৯৬০-৭০-এর মাঝে বিকাশ লাভ করে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন ডোনাল্ড জুদ, জন ম্যাকক্রাকেন, অ্যাগনিস মার্টিন, ড্যান ফ্ল্যাবিন, রবার্ট মরিস, ফ্রাঙ্ক স্টেলা। আধুনিকতাবাদের লঘু উপাদানের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং বিমূর্ত প্রকাশবাদের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়াজাত। ইচ্ছানিরপেক্ষ শিল্পও জ্যাকসন পোলকের উৎসাহে কতিপয় শিল্পী নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ভিন্নধর্মী শৈলী, বিষয়, উপাদান, কালচেতনা, শূন্যস্থান বিভাজন ইত্যাদি এই শিল্পধারার বৈশিষ্ট্য। ন্যান্সি গ্রেভস, রোনাল্ড ডেভিস, হাওয়ার্ড হজকিন, ল্যারি পুনস, জেনিস কাউনেলিস, ব্রিস মার্ডেন, ব্রুস নাউম্যান, রিচার্ড টারটেল, ওয়াল্টার ডার্বি ব্যানার্ড প্রমুখ এই ধারায় শিল্পচর্চা করেছেন।
বিমূর্ত প্রকাশবাদের উত্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সমাহার শিল্প (Assemblage Art), যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পসামগ্রী ও অন্যান্য বস্ত্তনিচয়, এমনকি পশু পাখি ও বাণিজ্যিক স্থিরচিত্র একত্রে ব্যবহার করা। এই শিল্পধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন রবার্ট রশেনবার্গ আর এটাই পপ আর্ট ও ইনস্টলেশন আর্টের শুরু ছিল।
লিও স্টেইনবার্গ ১৯৬৯ সালে রশেনবার্গের চিত্রকলা বর্ণনা করতে ‘উত্তরাধুনিক’ পদটি প্রথম ব্যবহার করেন। স্টিফেন বেস্ট ও ডগলাস কেলনার রশেনবার্গকে আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের মধ্যবর্তী ক্রান্তিকালীন সময়ের শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যিনি মার্শেল ডুশ্যাম্প দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। অ্যানসেল্ম কাইফারও তাঁর কাজে বিভিন্ন উপাদান জড়ো করেছেন।
১৯৫০-এর দশকে একই সঙ্গে ব্রিটেন ও আমেরিকায় শুরু হওয়া একটি শিল্প আন্দোলনের নাম পপ আর্ট, যা চারুকলার প্রচলিত ঐতিহ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বিজ্ঞাপন, খবর, হাসির বই ইত্যাদি থেকে চিত্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করে। লরেন্স অ্যালোয়ে এই পদটি ব্যবহার করেন। পপ আর্টে পরিচিত পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিভিন্ন উপাদানকে বিচ্ছিন্ন করে অপ্রাসঙ্গিক সূত্রে গাঁথা হয়। পপ আর্ট যতটা না এই শিল্পকে বোঝায় তার থেকে বেশি ইঙ্গিত করে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে। এই শিল্পগতিধারাও বিমূর্ত প্রকাশবাদের প্রতিক্রিয়ারূপে উদ্ভব হয়েছিল। ব্যবহৃত দৃশ্যগ্রাহ্য বস্ত্তপুঞ্জ ও চিত্রকল্প দাদাবাদের মতোই। পপ আর্ট ও ন্যূনকল্পবাদ উত্তরাধুনিকতাবাদের আগে শুরু হয়েছিল। বিজ্ঞাপনের চলমান চিত্রকল্প যেমন – পণ্যের নকশা ও প্রতীক এই শিল্পে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
১৯৭৭ সালে রবার্ট পিনকাস উইটেন ন্যূনকল্পবাদকে খারিজ করে উত্তর-ন্যূনকল্পবাদ মতবাদটি প্রকাশ করেন। ইভা হেস, কিথ সোনিয়ার, রিচার্ড সিরা প্রমুখের শিল্পকর্মকে চিহ্নিত করতে তিনি এই পদটির অবতারণা করেন।
আধুনিক চিত্রকলার নিরন্তর নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার এবং ধ্রম্নপদী চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের প্রত্যাবর্তন উত্তরাধুনিক শিল্পকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পগতিধারাকে ধ্রম্নপদী বাস্তববাদ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। উত্তরাধুনিকতার আরেকটি শিল্পধারা হলো ধারণাগত শিল্প। এ নামে চিহ্নিত করার কারণ হলো, অন্যদের মত বা ধারণার বিরোধিতাই শুধু নয়, আক্রমণ বা কটূক্তির মাধ্যমে আঘাত করা। এ মতবাদের উদ্দেশ্যই হলো বিতর্ক তৈরি করা। ডুশ্যাম্প, জন কেইজ, রশেনবার্গের চিত্রকলা ধারণাগত শিল্পের পূর্বলক্ষণ। অনেক ধারণাগত শিল্প সৃষ্টি হয়েছে দর্শক ছবি দেখছে এমন অবস্থান চিত্রায়ণের মাধ্যমে, শিল্পকর্মটির মৌলিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মাধ্যমে নয়।
উত্তরাধুনিক শিল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো ব্রাত্যশিল্প (Lowbrow art), যা একটি ব্যাপক প্রচলিত সাধারণ মানুষের শিল্প আন্দোলন। পাঙ্ক সংগীত, রাস্তার সংস্কৃতি ও ক্যালিফোর্নিয়ার নিচু সংস্কৃতি এই শিল্পের উৎস। এটা পপ-পরাবাস্তববাদ হিসেবেও পরিচিত। ব্রাত্যশিল্প উত্তরাধুনিকতাবাদের মূল বিষয়বস্ত্ত উঁচু-নিচু শিল্পের মধ্যে যে ভেদরেখা তা মিটিয়ে দেয়।
উত্তরাধুনিক শিল্পের সঙ্গে বিভিন্ন ধারার সম্পৃক্ততা এর একটি বড় বৈশিষ্ট্য। ডিক হিগিনস্ একে চিহ্নিত করার জন্য Intermedia পদটি বেছে নিয়েছেন। ইহাব হাসান Intermedia-কে ফর্মের fusion, ক্ষেত্রের confusion বলেছেন। ১৯৮০ সালে ক্রেইগ ওয়েন্স তাঁর The Allegorical Impulse : Toward a Theory of Postmodernism নিবন্ধে উত্তরাধুনিক শিল্পের বৈশিষ্ট্য হিসেবে রূপকাশ্রয়ী প্রণোদনার পুনরাবির্ভাবকে চিহ্নিত করেছেন। আবার ১৯৭০-এর পুরো দশকজুড়ে ভাস্কর্য ও চিত্রকলার প্রথাগত গঠনের ফিরে আসা এবং ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে নব্যপ্রকাশবাদী শিল্পীদের শিল্পকর্মসমূহকে উত্তরাধুনিক ধারা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাণিজ্যিক শিল্পবাজারের সঙ্গে এর যোগাযোগ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকে নব্যপ্রকাশবাদকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির কূটচক্রান্ত হিসেবে দেখেছেন। ফেলিক্স গুটারি উত্তরাধুনিকতাকে আধুনিকতার ‘অন্তিম শ্বাস’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে সমালোচকরা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন মার্শেল ডুশ্যাম্প, পল সেজান, ওয়েজিলি ক্যান্ডিনেস্কি শিল্পকলায় নতুন ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন সন্দেহ নেই।
২০০০ সালে নৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক সূত্রে উত্তরাধুনিক-পরবর্তী সময়কালকে চিহ্নিত করার জন্য আমেরিকার সংস্কৃতিতাত্ত্বিক এরিক গ্যানস উত্তর-সহস্রাব্দবাদ (Post-Millennialism) পদটি প্রথম প্রকাশ করেন। উত্তরাধুনিক পদটিকে তিনি ‘বলি চিন্তা’ (victimary thinking)-এর সঙ্গে মিলিয়েছেন এবং তাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন অসভিৎস ও হিরোশিমার অপরাধী ও নির্যাতিতদের অভিজ্ঞতার মাঝে মীমাংসার অযোগ্য এক নৈতিক বিরোধ হিসেবে। গ্যানসের মতানুযায়ী, উত্তরাধুনিক নৈতিকতার উৎপত্তি প্রান্তিক বলি ও অপরাধী অধিকৃত স্বাপ্নিক কেন্দ্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব থেকে। উত্তরাধুনিকতা এই অর্থে সহিংসতার বলি বিষয়ক রাজনৈতিক ভাবনাকেন্দ্রিক। আধুনিক কল্পরাজ্য বা সমগ্রতাবাদের বিরোধিতার জন্য ফলদায়ক মনে করার পাশাপাশি পুঁজিতন্ত্র ও উদার গণতন্ত্রের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর কারণে উত্তরাধুনিকতাবাদকে সেইভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনীহা লক্ষ করা যায়। উত্তরাধুনিকতার বদলে উত্তর-সহস্রাব্দবাদ সহিংসতার বলি বিষয়ক চিন্তাকে বাদ দিয়ে একটি অহিংসতার ভাবনাকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি বিশ্বে চলমান হিংসা-বিদ্বেষ-অসূয়াকে শান্ত করতে সংলাপকে উৎসাহিত করে। গ্যানসের উত্তর-সহস্রাব্দবাদ নান্দনিক-রাজনৈতিক আলোচনায় যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে।
২০০৬ সালে ব্রিটিশ প–ত অ্যালান কারবি উত্তর-উত্তরাধুনিকতাবাদের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যায়ন প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি এই মতবাদকে ‘ছদ্ম-আধুনিকতাবাদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি তাৎক্ষণিক, সরাসরি, অগভীর সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ, যা ইন্টারনেট, সেলফোন, আমত্মঃসম্পর্কিত টেলিভিশন বা ওই জাতীয় মাধ্যম দ্বারা সম্ভব, তাকে বোঝাতে চেয়েছেন। তার সঙ্গে যোগ করেছেন এক ‘বিশেষ প্রতিরূপের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা’ যা ‘অজ্ঞতা, উগ্রবাদ ও উদ্বেগ’কে সমর্থন করে। এইসব কর্মকা– অংশগ্রহণকারীদের মাঝে একটা ঘোরলাগা অবস্থার সৃষ্টি হয়। উল্লিখিত মাধ্যমে হালকা বিষয়ে ভাসা-ভাসা ও তাৎক্ষণিক অংশগ্রহণকে বলা হচ্ছে ‘নীরব আত্মসংবৃতি’ বা Silent autism, যা আধুনিকতার স্নায়ুবিকার ও উত্তরাধুনিকতার আত্মরতিকে ছাড়িয়ে গেছে।
কারবি ছদ্ম-আধুনিকতাবাদের মাঝ থেকে নান্দনিকভাবে মূল্যবান কোনোকিছু সৃষ্টি হয়েছে তেমন মনে করেন না। ২০০৯ সালে Digimodernism : How New Technologies Dismantle the Postmodern and Reconfigure our Culture শীর্ষক গ্রন্থে কারবি উত্তরাধুনিক-পরবর্তী সময়কার সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।
২০১০ সালে সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক টিমোথিউস ভারমিউলেন ও রবিন ভ্যান ডেন আক্কারের মধ্যে উত্তর-উত্তরাধুনিকাবাদ বিষয়ক বিতর্ক চলার সময় স্বআধুনিকতাবাদ (Metamodernism)-এর আবির্ভাব। উত্তরাধুনিকতাবাদের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই মতবাদের উৎপত্তি, যা আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদের উপাদানসমূহ একত্রিত করে। তাঁরা তাঁদের নিবন্ধ Notes on Metamodernism-এ দাবি করেছেন যে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে উত্তরাধুনিক মানসগঠনের কোনো পরিবর্তন ছাড়াই আধুনিক বৈশিষ্ট্য ফিরে আসছে। তারা স্বআধুনিকতাবাদকে একটি ক্রমাগত দোদুল্যমানতা, মানসগঠন ও অবস্থানের মাঝে নিয়ত বিন্যাসবদল বলে চিহ্নিত করেছেন, যা আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতার স্মৃতি জাগিয়ে তোলে বটে কিন্তু চূড়ান্তভাবে তা এক বিশেষ অনুভূতিপ্রবণতাকে নির্দেশ করে, যা আসলে ওই দুটো মতবাদের কোনোটাই নয় : যার একটির লক্ষ্য সর্বজনীন সত্যের মাঝে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আকুল আকাঙক্ষা আর আরেকটির লক্ষ্য প্রত্যাশা ও সন্দেহ, আন্তরিকতা ও ব্যাজস্ত্ততি, প্রজ্ঞা ও সরলতা, নির্মাণ ও বিনির্মাণের মাঝে রাজনৈতিক সম্পর্ক অন্বেষণ। তাঁরা আরো উল্লেখ করেছেন যে, স্বআধুনিকতাবাদ আরেক ভবিষ্যৎ, আরেক স্বআখ্যানের প্রত্যাশা করে যদিও তারা জানে যে সেই ভবিষ্যৎ বা আখ্যানের কোনো অস্তিত্ব নেই বা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা নেই, যদি থাকেও তা সহজাতভাবে সমস্যাসংকুল। শিল্পে তাঁরা অলৌকিকতাবাদ, রোমান্টিকতা, আশা, সততা, আখ্যান ও মহিমময়তার প্রত্যাবর্তন কামনা করেন। যে শিল্পী ও সংস্কৃতিচর্চাকে তাঁরা এই মতবাদের আওতাভুক্ত করেছেন তা হালো BIG and Herzog and de Meuron-এর স্থাপত্যকলা, মিশেল গন্ড্রি, স্পাইক জনজি, গাস ভ্যান সান্ট ও ওয়েজ অ্যান্ডারসনের চলচ্চিত্র, পিটার ডুইগ, ওলাফুর ইলিয়াসন, সায়লা কামেরিক প্রমুখের চিত্রকলা এবং জাপানের হারুকি মুরাকামি, রবার্তো বোলানো, ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস ও জেনাথান ফ্রানজেন প্রমুখের সাহিত্য।
শিল্প স্বভাবগতভাবেই গুরুতবপূর্ণ। শিল্প হলো শিল্পীর অস্তিত্বের প্রকাশ আর সেইসঙ্গে সে নিজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চায়। শিল্প হলো যোগাযোগের মাধ্যম। শিল্পীর ভাবনা ও অনুভূতি দর্শকের কাছে পৌঁছায় তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। যখন কোনো শিল্পী একটা সপ্তাহ, মাস বা বছর বা তারও বেশি সময় কোনো শিল্প সৃষ্টির পেছনে নিয়োগ করেন, তিনি মনে মনে বলে থাকেন যে এ তাঁর সামর্থ্য ও সময়ের যোগ্য ফল এবং তিনি যখন তা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেন তিনি তাদের কাছ থেকেও সেইরূপ মনোযোগ দাবি করেন। নিশ্চয় তারা কোনো গুরুত্বহীন বিষয়ে সময় নষ্ট করবেন না, কিংবা অন্যদেরও তা করার জন্য প্ররোচিত করবেন না যদি না তাঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে কিছু নেই। ডুশ্যাম্প ও অন্যরা প্রতিনিধিস্থানীয় শিল্পী। তাদের মাধ্যমেই শিল্পকলা এক আত্মসচেতন বিচ্ছিন্নতার গল্পে পরিণত হয়েছে।
তবে সবকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও শিল্পীর নিজস্ব পছন্দ থাকে। তিনি চলমান বৈরাগ্যধর্মিতা, নৈরাশ্য বা আশাবাদের খেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং নিদেনপক্ষে কিঞ্চিৎ বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে থাকেন, অথবা পৃথিবীর দিকে একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে তাকান, কিংবা পূর্বসূরি শিল্পীরা যে দিকগুলো আমাদের সামনে আগেই তুলে ধরেছেন তা পুনঃআবিষ্কারের চেষ্টা করেন। একথা সত্য যে, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো যে মানুষের শক্তিশালী শারীরিক ফর্ম গঠন করেছিলেন, রেমব্রান্ট চরিত্র চিত্রায়ণে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন, ভারমিয়ার ছায়াসম্পাতে যে দক্ষতা দেখিয়েছেন সেই ভাবনা থেকে এখনকার শিল্পীরা অনেক দূরে সরে এসেছেন।
আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পর্যায় পেরিয়ে শিল্পকলা আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে তাকে বিশ্লেষকরা উত্তর-উত্তরাধুনিক শিল্পগতিধারা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এখানে শৈলী অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো মনোভঙ্গির পরিবর্তন। শিল্পী তাঁর অনুভূতি প্রকাশের পূর্ণ দায়দায়িত্ব গ্রহণে সমর্থ। তবে কখনো কখনো সেই অনুভূতির সুস্পষ্ট কোনো অবয়ব নাও থাকতে পারে, কিংবা অসম্পূর্ণও হতে পারে। প্রায়ই একজন শিল্পী একটি আধ্যাত্মিক খুজলি প্রত্যাশা করেন, যেটাকে সে ভালোমতো চুলকাতে পারে। শিল্পী তাঁর শৈল্পিক প্রকাশমাধ্যম ব্যবহার করে জটিল বা দুর্বোধ্য আবেগ প্রকাশ করে থাকেন। বর্তমান শিল্পচিন্তার বড় একটি বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পকে ব্যাখ্যা না করা। লোকে শুধু দেখবে। শিল্পী কর্তৃক প্রকাশিত অভিব্যক্তির সঙ্গে দর্শকের অনুভবের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া বা শিল্পীর অনুভূতির প্রতি সমর্থন, সহমর্মিতা বা একাত্মতা জরুরি নয়। আবার অনেক দর্শকের মাঝে সেই তাত্ত্বিক জ্ঞান নেই, যা দিয়ে সে শিল্পীর বাণী উপলব্ধি করতে পারে। আর তা নতুন ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রে শিল্পীর জন্য বেশ সমস্যাই তৈরি করে থাকে। আবার তার সঙ্গে নতুন মাধ্যম যুক্ত হলে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে যায়। শিল্পীরা কখনো কখনো দর্শক সম্পর্কে উন্নাসিক ধারণা পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন যে, শিল্পকলা অনুধাবনের জন্য দর্শকরা নিজেদের যথেষ্ট শিক্ষিত করে তোলেন না। আর তাই ছবি কেনেন না। কিন্তু কেন কিনবেন? যা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন না তাঁরা তা কিনতে যাবেন কেন? আর তা থেকে শিল্পীরা উপসংহারে পৌঁছে যান যে আমাদের সংস্কৃতি আর শিল্পকলা অনুধাবন করতে পারছে না।
একজন উত্তর-উত্তরাধুনিক শিল্পী মনে করেন যে, শৈল্পিক প্রকাশের একটি আধ্যাত্মিক ও আবেগঘন বিষয়বস্ত্ত থাকে, তা সেই শিল্পীর কাছে কোনো অর্থ থাক বা না-ই থাক। এমনকি পরিপূর্ণ অর্থহীনতাও একধরনের অর্থ বহন করে। আচারনিষ্ঠতার প্রতি সাম্প্রতিক যে অতিমাত্রার ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে এমনকি ক্যানভাসে তার কোনো চিহ্ন না থাকলেও তাকে আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। যখন আমরা শিল্পে কোনো অর্থ তুলে ধরতে অনীহা প্রকাশ করে থাকি তখনই ঢালাও মন্তব্য করে বসি পৃথিবীর কোনো মানে নেই এবং হইচই করি যে নাস্তিবাদ সংস্কৃতিকে গিলে খাচ্ছে।
উত্তর-উত্তরাধুনিক যুগে আমরা ভাবতে প্রভাবিত হচ্ছি যে শিল্পের কোনো অর্থ নেই আর এ নিয়ে কথা বলারও কিছু নেই। যখন কেউ সমসাময়িক শিল্পে কোনো অর্থ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখনই তার গায়ে ভড়ংশূন্য বা ছলাকলাহীনতার (naive) তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। একমাত্র গ্রাম্যজনেরাই ভেবে থাকেন যে ওতে কোনো অর্থ থাকলেও থাকতে পারে! দৃশ্যগ্রাহ্যতার বাইরে কিছু থাকতে পারে না। শিল্পের লক্ষ্য হিসেবে স্বাপ্নিক শিল্পী অ্যালেক্স গ্রে বলেছেন : ‘বিংশ শতাব্দীতে মনুষ্য আত্মাকে অদ্ভুত এক বদমাশ গ্রাস করেছে, যার নাম ‘নাস্তিবাদ’ (nihilism)। নাস্তিবাদ হলো সমস্ত অস্তিত্বের অর্থহীনতায় বিশ্বাস করা এবং মনে করা যে কোনোকিছুর মধ্যে কোনো সত্য নিহিত নেই। আধ্যাত্মিকভাবে অন্ধ মানুষের আশাহীনতার অন্ধকারই নাস্তিবাদ, আর তা জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে প্রধান অভিব্যক্তিরূপে থেকে গেল।’
শিল্পী প্রত্নতাত্ত্বিক নন; তিনি পুনঃখনন বা অতীতের অন্ধ অনুকরণ করবেন না। যে জগৎ তাঁরা দেখেছেন তা পেছনে ফেলে সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে। প্রতিটি চিন্তাশীল ও আবেগপ্রবণ মানুষের মতো শিল্পীরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য রয়েছে যে, তিনি অতীতের কোনোকিছুকে ধারণ করবেন নাকি তা বাদ দিয়ে নিজের কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার রূপায়ণ ঘটাবেন। প্রত্যেক শিল্পীই তাঁর পছন্দের গভীর প্রকাশ ঘটাতে চান। প্রকাশের ক্ষমতাই আমাদের কাউকে শিল্পী হতে প্ররোচিত করে আবার এই ক্ষমতার অভাবেই অনেকের শিল্পকর্ম দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ হয়। কী প্রকাশ করতে হবে এবং কীভাবে তার কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণই সব।
একজন শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের অতীন্দ্রিয় বা আবেগঘন বিষয়কে একটি বোধের স্তরে উপস্থাপন করা একান্তই শিল্পীর দায়িত্ব। পঠনপাঠন ও আলোচনার মাধ্যমে একটি শিল্পভাষা নির্মাণ প্রয়োজন, যাতে তা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। দুর্বোধ্যতাই অনন্যমাত্রার শিল্প, এমন ধারণা থেকে শিল্পীদেরও বেরিয়ে আসতে হবে। আর এভাবেই সৃষ্টি হবে একুশ শতকের শিল্প, যা হয়ে উঠবে সংস্কৃতির উজ্জ্বল ও অর্থবোধক অংশ।