অ মি তা ভ মৈ ত্র
‘Nothing is worth more than laughter. It is strength to laugh and abandon oneself’
-Frida Kahlo
একটি শরীরে যখন সেই শরীরের বাইরে পৃথিবী চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর আক্রমণে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে সেই শরীর, প্রথমে মৃদু কাতরানির শব্দে, তারপরে ভারী পাথরের মতো হুড়মুড় করে, সশব্দে – যখন সেই শরীর উপশম চায় না আর, পরিত্রাণ চায় না, শুধু ঘোরের মধ্যে হাতে, পায়ে, গলায় হাতুড়ির আঘাতে বসে যাওয়া ধারালো লোহাগুলোকে অনুভব করে যায়, আচ্ছন্ন চেতনায় শুধু কিছু একটা খোঁজে, কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে – সেই শরীর তখন প্রতীক হয়ে ওঠে অন্য কিছুর, হয়তো অশুভের, হয়তো দিব্যতার এবং আইকন হয়ে ওঠে। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে একজন শিল্পীর শ্রেষ্ঠ যা দেবার থাকে, যা দিতে চেয়ে তার এই প্রাণ দিয়ে দেওয়া, তাই এই বোধি, এই আইকনিসিটি। ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্টের এযাবৎ যত চিত্র ও ভাস্কর্য হয়েছে সেখানে ক্রুশকাঠে ঝুলে থাকা শরীরটির প্রধানতম এবং একমাত্র শর্তই হচ্ছে মুখটিকে যন্ত্রণা, তৃষ্ণা, হিংসা, ক্রোধ থেকে শূন্য করে রাখা। একা ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্ট বিশাল আকাশে শুধুমাত্র একটা পাখির ছবির মতো অবান্তর। ক্যানভাসে উপস্থিত অন্য মুখগুলোর সংঘর্ষময় অনুভূতির মধ্যেই তাঁর মহিমা ধরা যায়। ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্টের মধ্যে এক অমোচনীয় অসহায় নাটকীয়তা আছে, যা খ্রিষ্টকে সর্বতোভাবে প্রতীক করে দেয়। প্রতীকের অনুভূতি থাকে না। পূর্ণচন্দ্রালোকের দিকে সে শুধু হাত আয়না তুলে ধরে। খ্রিষ্টকে নিয়ে যত ছবি আঁকা হয়েছে তার নব্বই ভাগই ক্রুশবহন, ক্রুশারোহণ, ক্রুশ থেকে অবতরণ, সমাধিপাত্রে সমর্পণ সংক্রান্ত। মৃত্যু ছুঁয়ে আছে প্রতিটি বিষয়কে। তাঁর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ, যা জীবন, তার ছবি তুলনায় নগণ্যই। অন্য কোনো মহাজীবন থেকে, খ্রিষ্ট এখানেই আলাদা। নিষ্ক্রিয় যন্ত্রণাগ্রহণ ও রক্তস্রাবী মৃত্যু খ্রিষ্টকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তার যাপিত জীবন, অসাধারণত্ব ও আত্মার দিব্যতা থেকে। এখানেই তিনি জীবনবহির্ভূত, প্রতীক। এখানেই তিনি আইকন। আইকনের সংস্পর্শে থাকার মোহ অনেকেই এড়াতে পারি না আমরা। শিল্পীদের বিশেষ সুবিধে একটা আছেই এ ব্যাপারে। ছবির কোনো চরিত্রের মধ্যে নিজের মুখ বসিয়ে মৃত্যুত্তীর্ণ করে দেন নিজেকে। তিশানের একটি ছবি এনটুমমেন্ট। মৃত খ্রিষ্টকে সমাধিপাত্রে রাখা হচ্ছে। কয়েকজন ধরে নামাচ্ছে ভারী দেহটিকে। খ্রিষ্টের মাথার পেছনেই জোসেফ। এই মুখটি তিশানের, আমরা জানি, নিরুপায়ভাবে তিশানের।
কিন্তু মুখচ্ছবিটুকুই শুধু তিশানের। তিশানের প্রকৃত মুখ রাখা নেই এখানে।
তাঁর আত্মার প্রক্ষেপ নেই। নিজেকে তিনি দেখাচ্ছেন স্রেফ একজন অভিনেতা হিসেবে, যাকে জোসেফের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। আত্মপ্রতিকৃতি তো আর মুখের লাবণ্য, রাজকীয়তা বা আলোছায়া ধরার জায়গা নয়! তা নগ্ন, বিশুদ্ধ আত্মাকে প্রকাশ করে শুধু। মাধ্যমটির ওপর শিল্পীর দক্ষতা দেখানোর ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিকৃতি একটি ভুল রাস্তা। হতে পারে এজন্যই সুবিখ্যাত শিল্পীদের অনেকের আত্মপ্রতিকৃতিই শুধুমাত্র ত্বকের ও পোশাকের ওপর রং ও আলোছায়ার কারিকুরি ছাড়িয়ে অন্য কোথাও পৌঁছে দেয় না আমাদের। প্রথাগত চিত্রশিক্ষা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। যখন নিজেকে এঁকেছেন তিনি, তাঁর আত্মার সবটুকু বিষ ও বিশল্যকরণী তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন সেখানে।
আত্মপ্রতিকৃতির আরেকজন দানব ছিলেন পিকাসো। তাঁর শেষদিকের করা নিজের একটা মুখ – যেখানে অবোধ জড়- চেতনার ভয়ার্ততার সারাৎসার ফুটে থাকে চোখের বিস্ফারে, শক্ত করে চেপে রাখা ঠোঁটে। প্যারিসের এক হোটেলে আয়নার সামনে গোঁফদাড়ি কামাচ্ছেন পিকাসো, খবর পৌঁছল আপলিনেয়র মারা গেছেন। মুখ থেকে মুহূর্তেই সরে গেল সবটুকু রোদ। বেঁকে-চুরে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকল আস্তে আস্তে। অবিশ্বাস নিয়ে পিকাসো তাকিয়ে আয়নার দিকে। দেখছেন মুখের ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে সময় – পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় দিগন্ত ছড়ানো মরুভূমিতে যেভাবে চাঁদের ছায়া ছুটে যায়। হাতের রেজর নামিয়ে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল। আঁকতে বসে গেলেন নিজের সদ্য আবিষ্কৃত মুখ।
যদি দানব হন পিকাসো – রেমব্রান্ট, একজন ওলন্দাজ হলেন আত্মছবির ঈশ্বর, যেখানে, দেহের ভেতর থেকে পেশল জলের মতো পাথর ফাটিয়ে বিচ্ছুরিত হয় তাঁর নিবিড়তম আত্মা। তাঁর স্ব-চিত্রের মুখে আনন্দ আসক্তি বিযুক্তি বিষাদ। আলোমাখা তুলি নিয়ে অন্ধের মতো তিনি ক্যানভাসে খুঁজছেন নিজের মুখ।
‘শরীর শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’
প্রতিধ্বনি যেভাবে ধ্বনিকে খোঁজে সেভাবেই ফ্রিদা খুঁজেছিলেন শরীরকে। তাঁর স্ব-চিত্রগুলোর পরতে পরতে ঝরনার জলের নিচে অভ্রের ছুরির মতো ঝকঝক করে ওঠে তাঁর শরীর – ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত যন্ত্রণাদীর্ণ রক্তমাংসের স্তব্ধ স্থির হিমস্রোত – তাঁর ফেটিশ, তাঁর পৃথিবী। নিজের শরীর যে ফেটিশ বা পবিত্র প্রতীক হয়ে ওঠে তাঁর কাছে – সংগত কারণ আছে তার। অসম্ভব অজাগতিক বিশাল এক জীবনব্যাপী যন্ত্রণার উৎস তাঁর রক্তমাংস। ১৯১৩ সালে, ফ্রিদা কাহলো, পিতা জর্মন আর মা ভারতীয় মেক্সিকান, ছবছর বয়স তখন, পোলিওয় সরু হয়ে গেল ডান পা, বেঁকে গেল পায়ের পাতা। খুঁতটুকু ঢাকা দিতে ছেলেদের মতো ট্রাউজার পরা শুরু করলেন, আর একটু বড় হয়ে পা ঢাকা মেক্সিকান পোশাক। যখন মেক্সিকো সিটিতে জর্মন কলেজের ছাত্রী, ফ্রিদা হয়ে উঠলেন এক দুর্দান্ত টমবয়। বিদ্রোহী এবং অদম্য ছেলেদের দলের নেত্রী। অধ্যাপকদের নিয়ে রগড় করা হয়ে উঠল কলেজের প্রধান কাজ। বিখ্যাত মেক্সিক্যান ম্যুরালিস্ট দিয়েগো রিভেরা, যাঁকে ভবিষ্যতে বিয়ে করবেন ফ্রিদা, তাঁর সঙ্গে এখানেই দেখা হয়েছিল ফ্রিদার।
১৯২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঈশ্বর নির্বাচিত করলেন ফ্রিদাকে চিত্রশিল্পী (মূলত আত্মপ্রতিকৃতির) হিসেবে। বৃষ্টির দিনে মেক্সিকো সিটি থেকে কোরোকান যাওয়ার পথে – সঙ্গে ছেলে বন্ধু আলেজান্দ্রো গোমেজ – দ্রুতগামী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা খেল বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা ইলেকট্রিক ট্রলির সঙ্গে। চিৎকার কান্না রক্তস্রোত। একটা মোটা লোহার পাত ফ্রিদার শিরদাঁড়া চূর্ণ করে, তলপেট জনন অঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে রক্ত ক্লেদ মাংস মাখামাখি হয়ে। পরে দেখা গেল এ ছাড়া ফ্রিদার কাঁধ, পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে। এগারো টুকরো হয়ে গেছে ডান পায়ের হাড়, পায়ের পাতা ভেঙে দুমড়ে গেছে। ঈশ্বরের নির্বাচন প্রাথমিকভাবে শেষ হলো। ক্রুশ কাঠের মতোই এক যন্ত্রণাময় শক্ত ফ্রেমে তিন মাস আটকে থাকলেন ফ্রিদা। অসাধারণ মনের জোরে বেঁচে উঠলেন, হাঁটাচলার শক্তিও অল্প অল্প ফিরে এলো। প্রায় অলৌকিক যেন তাঁর এই ভস্ম থেকে ফের পাখির শরীর নিয়ে উড়ে আসা। কিন্তু তীব্র সর্বাত্মক, দুমড়ে-মুচড়ে পাগল করে দেওয়া যন্ত্রণা, ক্লান্তি, দুর্বলতা সারাজীবন আর মুক্তি দিল না তাঁকে। পরের ঊনত্রিশ বছরে বত্রিশবার অপারেশন সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে, যার বেশিরভাগই মেরুদণ্ডে, পেলভিসে আর ডান পায়ে। প্রতিটি অপারেশন ব্যর্থ। সাতচল্লিশ বছরের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় তাঁকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে রক্তস্রোত ঝরিয়ে যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন বেহুঁশ হয়ে কাটাতে হয়েছে। যন্ত্রণাকে ভুলতে ডুবে থেকেছেন মেক্সিকান মদ টাকিলা, নানা ধরনের মাদক আর সিগারেটে। কোনো বন্ধু নেই, সঙ্গী নেই। মাকে বারবার আঁতুড়ঘরে যেতে হয়েছে। ছোটবেলায় নার্সের হাতে বেড়ে ওঠা। মায়ের প্রতি কোনো অনুভূতি নেই। বাবা ব্যস্ত তাঁর কাজের পৃথিবীতে। এক অদ্ভুত কাজ করল মেয়েটি। নিজের অস্তিত্বকে দ্বিখণ্ডিত করে সৃজন করল কাল্পনিক একটি বন্ধু। নিজের যন্ত্রণা, হতাশা, অবরুদ্ধ স্বপ্ন ও বাসনার জগৎ খুলে দিলো তার কাছে। ছেলেবেলার েস্নহহীনতাকে ভুলতে পারেনি মেয়েটি। সেই বঞ্চনা রাগ বর্ণনা করেছে ‘My Nurse and I’ ছবিতে, যেখানে নিজেকে সে দেখিয়েছে ‘with the face of a grown woman and the body of a little girl, in the arms of my nurse, milk dripping from her breast.’ কোমরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত নার্সটির মুখের জায়গায় প্রি-কলাম্বিয়ান টিওটিহায়াকান মুখোশ – যেখানে মিশে যায় ম্যাডোনা ও শিশুর বাইবেলীয় অনুষঙ্গের সঙ্গে আদিম মাতৃকা রূপ। যৌনতা, মাতৃত্ব ও মৃত্যু একাকার হয়ে যায় এখানে।
ফ্রিদার জীবনে পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি স্রোতের উপস্থিতি সবসময়ই। বাবা-মায়ের সূত্রে তাঁর রক্তে ইউরোপ ও মেক্সিকোর রক্ত, সংস্কৃতি, প্রাচীন ও আধুনিকতা, সুস্থতা ও অসুস্থতা, উভযৌনতা নারী ও পুরুষদের সঙ্গে – এই দ্বৈত থেকেই উঠে এসেছিল তাঁর ছবি My Grandparents, My Parents and I (১৯৩৬)। শৈশবে যে কোবাল্ট-নীল বাড়িটিতে তিনি ছিলেন, ছবিটিতে দেখা যায় সেই বাড়ির চত্বরে ফ্রিদা, নগ্ন, লাল রিবন হাতে দাঁড়িয়ে। এই ছবির পেছনে তাঁর বাবা মাকে জড়িয়ে পৌঁছে গেছে দুই প্রান্তে সস্ত্রীক পিতামহ ও মাতামহদের কাছে। ফ্রিদার নাভির সঙ্গে ছবির ওপরে মায়ের গর্ভের নাড়ির যোগসূত্রের হালকা একটা প্রতিধ্বনি আছে ছবিটিতে। আবার তাঁর কুড়ি বছরের বড় বিখ্যাত ম্যুরালিস্ট স্বামী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর The two Fridas আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় ফ্রিদার দুটি সত্তাকে – আংশিক ইউরোপীয় ও আংশিক মেক্সিকান, রক্তাক্ত হৃদয়ের বিশ্বস্ত স্ত্রী আর স্বাধীন স্বাবলম্বী নারী, ঐতিহ্যময় মেক্সিকান পোশাকে। যতদিন তিনি দিয়েগোর স্ত্রী ছিলেন তাঁর শিল্পচর্চাকে হালকা শৌখিনতা বলেই ধরে নেওয়া হতো। কাহলো যখন টের পেলেন এটা, তিনি নিজের শিল্পীসত্তাকে সরিয়ে, দাম্পত্যজীবনের দায়িত্বে ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে। যদিও ফ্রিদা ও দিয়েগো দুজনেই বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন, তবু ওঁদের সম্পর্ক ছিল তীব্র নির্ভরতা, পারস্পরিক পুষ্টি, আর ভালোবাসার – যার প্রমাণ ফ্রিদার ডায়েরি, যেখানে অসংখ্যবার ফিরে ফিরে এঁকেছেন দিয়েগোর মুখ, লিখেছেন –
Diego beginning
Diego builder
Diego my child
Diego my boy friend
Diego painter
Diego my love
Diego my husband
Diego my friend
Diego my mother
Diego my father
Diego my son
Diego me
Diego universe
Diego in my urine Ñ Diego in my mouth Ñ in my heart, in my madness, in my sleep.
দিয়েগো ফ্রিদা কাহলোর ছবি সম্পর্কে একবার বলেছিলেন ‘যন্ত্রণাঋদ্ধ কবিতা’ Ñ যে কবিতার শিকড়ে রয়েছে, দুঃখজনকভাবেই, কাহলোর শারীরিক যন্ত্রণা ও অনুভূতির একাকিত্ব যতখানি, তার চেয়েও বেশি দিয়েগোর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর দিয়েগোর থেকে পাওয়া রক্তপাতহীন আঘাতগুলো । যদিও রাশিয়া থেকে নির্বাসিত ট্রটস্কির সঙ্গে মেক্সিকোয় নিজের বাড়ি ‘ব্লু হাউসে’ তীব্র ইন্দ্রিয়ঘন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ফ্রিদার (স্বামী দিয়েগো আর ট্রটস্কির স্ত্রী নাতালিয়া সেডোভা দুজনেই তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন), তবু নিজের বোনের সঙ্গে স্বামীর গোপন সম্পর্ক যখন জানলেন ফ্রিদা, নিঃস্ব ও অসহায়ভাবে ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেলেন তিনি। ১৯৪০ সালে ‘Self portrait with cropped hair’ আঁকলেন দিয়েগো রিভেরা থেকে বিচ্ছিন্ন ফ্রিদা, ছবিতে তাঁর প্রিয় মেক্সিকান গাউন নেই, দৃষ্টিতে সেই ‘জীবন’ নেই, তাঁর প্রিয় কেশপাশ পুরুষের মতো কর্তিত, পুরুষের পোশাকে ফাঁকা চেয়ারে একা বসে ফ্রিদা, নিজের নারীত্বকে সমূলে উৎপাটিত করেছেন তিনি।
দিয়েগো রিভেরা, যাঁর মুখের অসংখ্য স্কেচে ভর্তি ছিল তাঁর ডায়েরির পাতা, যেখানে প্রতিকৃত হয়েছেন ফ্রিদার ছবিতে, সেখানে বাস্তব আর ফ্যান্টাসি মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়েছে। তৃতীয় চোখ, কোথাও তাঁকে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় চোখ, কোথাও ফ্রিদার শরীরে মিশে আছেন দিয়েগো (‘Diego and I’ অথবা ‘Diego in my thoughts’)| ‘Thinking of death’ ছবিতে নিজের কপালে বসিয়ে দিয়েছেন মৃত্যুর প্রতীক। ‘Henry Ford Hospital’ ছবিতে হাসপাতালের লোহার বিছানায় ফ্রিদার নগ্ন রক্তাক্ত শরীর, গর্ভপাতের পরে। শরীরের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, রক্তমাখা স্ত্রী অঙ্গ, পেলভিসের হাড়ের টুকরো, শামুক, অর্কিড আর তালা। শরীর থেকে রক্তবাহী শিরাগুলো বাইরে এসে সংযোগ স্থাপন করেছে বস্তুগুলোর সঙ্গে। বাইরে ছড়িয়ে থাকা বস্তুগুলোর মধ্যে, ফ্রিদার অন্তর্নিহিত পুরুষসত্তা বা অ্যানিমার একটা প্রকাশ আছে।
একটা বাচ্চা মেয়েকে যখন কিছু খেলনা দিয়ে মাটিতে এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে এই হচ্ছে ঘর, সে খেলনা পুতুল সব সেই ঘরের মধ্যে রাখে। একটা ছেলে সেখানে পছন্দ করবে চারদিকে খেলনাগুলো ছড়িয়ে খেলতে। এই ছবিতে শুয়ে থাকা রক্তøাত ফ্রিদাই কেন্দ্র। বিচ্ছিন্ন বস্তুখণ্ডগুলোর অস্তিত্ব শুধু ফ্রিদার রক্তবাহী শিরার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বলেই অর্থময়। শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ধাতুখণ্ডের জন্য তিনি সন্তানধারণে অসমর্থ ছিলেন। কিন্তু বারবার জেদি গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর ব্যর্থ আক্রোশ – নিজের অক্ষমতার জন্য। তাঁর ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীর আইকন হয়ে ওঠে যন্ত্রণার। অসহায়তার।
সিলভিয়া প্লাথের শেষের দিকের কবিতার সঙ্গে চাপা যোগাযোগ যেন আছে ছবিটির। ফ্রিদার চেতনায় গাঢ় দাগ রেখেছিল খ্রিষ্টীয় সন্ত ও শহীদদের বিষয়ে আঁকা ধর্মীয় ছবি, যার মেক্সিকান নাম ‘রিট্যাবলো’। এজন্যই The Henry Ford Hospital শুধু তাঁর ব্যক্তিগত চিৎকার হয়ে না থেকে হয়ে ওঠে যাবতীয় অলৌকিক নিষেধ, ট্যাবু ভেঙে দেওয়া এমন একটি নারীর অনুভূতি, যার শরীর কোনো নিষ্কলঙ্ক গর্ভাধান ঘটায় না, যে কোনো দেবশিশুর জন্ম দিতে অসমর্থ, শুধু অশোধিত জরায়ু-রক্ত ঢেলে দিতে পারে। যার উর্বরতা নেই, কিন্তু শরীরের ক্ষুধা, মাতৃত্বের ক্ষুধা পুরোমাত্রায় রয়েছে। মেক্সিকান লোকগাথায় লোরোনা অশুভ নারীর আর্কিটাইপ। আগ্রাসী যৌনতার শিকারি। সে মাতৃকা ও প্রেমনিষ্ঠার বিরুদ্ধে একা উদগ্র দাঁড়িয়ে, প্রেমিকের প্রত্যাখ্যান ও অবিবাহে এক অস্বাভাবিক শরীরী তাড়নায় যে শিশুহত্যা করে চলে। ফ্রিদার ছবিতে নানাভাবে এই লোরোনার অস্পষ্ট মুখের ছায়া। গর্ভপাত বারবার ফিরে এসেছে ফ্রিদার ছবিতে। ‘Frida and the abortion’ ছবিতে পৃথিবীর উর্বরতার বিপ্রতীপে নিজের শূন্যতাকে ঘৃণা, বা ‘গব ধহফ সু ফড়ষষ’ ছবিতে একটি নগ্ন পুতুলশিশুর সামনে নিজের নগ্নতাকে নিুরেখা দেন। কোনো কোনো ছবিতে শরীরের সীমারেখা ভেঙে যায়। ‘Roots’ ছবিতে দুটি অর্ধশায়িত নগ্ন নারীমূর্তি, যাদের শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে মাটিতে। ‘The wounded deer’ ছবিতে নটি তীরবেঁধা এক ছুটন্ত হরিণের শরীরে ফ্রিদা বসিয়ে দেন নিজের মুখ, তাঁর রক্তাক্ত যন্ত্রণার ধারণা দিতে।
একটি কথা, প্রসঙ্গের বাইরে, বলে রাখা যায় এখানে। ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতির শরীরের মধ্যে একধরনের আড়ষ্টতা, জড়িমা ও অনড়তা আছে। কয়েকটি কারণ থাকতে পারে এর। ফ্রিদার বাবা গিরেলমো ছিলেন ফটোগ্রাফার। বন্ধু টিনা মোদোত্তি, যাঁর মাধ্যমে দিয়েগোর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তাঁর, সেও ছিল ফটোগ্রাফার। ফ্রিদার অবচেতনে ফটোগ্রাফ নেওয়ার মুহূর্তের অনড়তা প্রভাব ফেলেছিল হয়তো। আর একটি কারণ আছে, যা অনেক বেশি বাস্তব। দুর্ঘটনার পর যখন সারা শরীর প্লাস্টারের পোশাকে ঢাকা, বাইরের পৃথিবী যখন রুদ্ধ – হিংস্র আক্রমণাত্মকভাবে ফ্রিদা তখন ছবি আঁকতে শুরু করলেন। শরীরের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলো। ঘরের দেয়ালে সিলিংয়ে তিনি লাগিয়ে নিলেন বড় বড় আয়না, যাতে ছোটখাটো শারীরিক কাজগুলো নিজেই করতে পারেন, নিজের ওপর কেন্দ্রীভূত করতে পারেন নিজেকে। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে দেখার মধ্যে অস্তিত্বের অর্থময়তা বুঝতে পারেন যাতে।
ছবির একটা বিশেষত্ব এই যে, দৈর্ঘ্য আর প্রস্থের ভেতরেই আলোছায়া আর বর্ণসম্পাতে বেধ বা থার্ড ডাইমেনশনের ধারণা দিতে হয়। ছবিতে এই বেধ বা তৃতীয় তল একটি অবাস্তবতা। তৃতীয় তলের অবাস্তবতা ছবিতে প্রথম ও দ্বিতীয় তলের বাস্তবতাকেও আঘাত করে। ছবিতে আঁকা বস্তুগুলোর মধ্যের দূরত্ব এবং বস্তুগুলোর সঙ্গে দর্শকের দূরত্ব পুরোপুরি কাল্পনিক। তাদের অবস্থান পূর্ব-নির্দিষ্ট, আগাম-নির্ধারিত। শিল্পী যে দূরত্ব থেকে তাঁর ছবির বিষয়কে দেখেছেন, দর্শকের উপায় নেই তার থেকে এক ইঞ্চি এগিয়ে-পিছিয়ে বিষয়টিকে দেখার। দর্শকের শরীর থেকে কুড়ি ফুট দূরে ক্যানভাসে যে আপেলটি আছে, কুড়ি ফুট এগিয়ে দর্শক যদি সেই আপেলে দাঁত লাগাতেও যান, কুড়ি ফুট দূরত্বেই সেই আপেল থেকে যাবে তখনো। কিন্তু ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে অদ্ভুতত্ব এখানেই যে, দর্শকের মনে হতে পারে ছবির মধ্যে কোথাও যেন একটা আয়নার চরিত্র রয়েছে। দর্শক ছবির দিকে এগোলে ছবি থেকেও একটা কিছু এগিয়ে আসে দর্শকের দিকে, আয়নার ছবির দিকে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিলে আয়না থেকেও যেন বাড়িয়ে দেওয়া হাতের একটা বিভ্রম সামনে আসে। ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্টের ছবির মধ্যেও একই বিভ্রম তৈরি হয়। আমি এখনো জানি না, ফেটিশিজম থেকে দূরত্ব ও নৈকট্যের এই বিভ্রম, একই সঙ্গে, এভাবে আসে কি না। Mariao Parniola বলেছেন, ফেটিশ প্রতীক নয়, অন্যকিছুর চিহ্ন বা আকারও নয়। সে বৈধ শুধু নিজের কাছেই, তার মুক্তি তার স্বায়ত্তশাসনে। আত্মপ্রতিকৃতি বিষয়ে ফ্রিদার এই তীব্রতা তাঁর বেঁচে থাকার অন্যতম উপায়। আরোগ্যর অন্যতম শর্ত যেন। বাস দুর্ঘটনা, পোলিও, বারবার গর্ভপাত, বত্রিশবার ভুতুড়ে শল্যচিকিংসা, মৃত্যুর আগে হাঁটু থেকে কেটে বাদ দেওয়া ডান পা (ঈশ্বরপুত্রকেও আজীবন এত ‘শরীর’ হতে হয়নি), শুধু এই শরীরেরই অধিকার থাকে সমস্ত পার্থিব বন্ধন মায়া মোহ লাবণ্য ও সংকোচ ছিঁড়ে নিয়ে নিজেকেই একমাত্র বিষয় করে তোলার। সেই শরীরই হয় তার অস্তিত্বের কেন্দ্র, পৃথিবীর দিকে খুলে ধরে রাখা সাহসী বুক যে পৃথিবী শুধু তরবারি হয়ে বল্লম হয়ে কেটে বসে গেছে তার মাংসে, এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিয়েছে তাঁকে। নার্সিসাসের আত্মা তাঁর ছবির হাজার মাইলের মধ্যে নেই, যা আছে তার থেকে তিলমাত্র বেশি লাবণ্য তিনি মঞ্জুর করেননি তাঁর প্রতিকৃতিদের। তাঁর ছবি আমাদের স্বস্তির পরপারে। ‘My birth’ ছবিতে তিনি দেখছেন এক মহিলার রক্তাক্ত জননপথ থেকে বেরিয়ে আসছে পূর্ণবয়স্ক ফ্রিদার মাথা। এরকম ফেটিশিজম, পৃথিবীতে শুধু ফ্রিদাই পারেন ভাবতে। ফেটিশ পুজোর বিষয় করে তোলে না কোনো কিছুকে। কোনো জাদু আয়নাও তুলে ধরে না সামনে। সে তার বিষয়টিকে শুধুমাত্র বিষয় হিসেবেই চূড়ান্ত গুরুত্ব দেয়। ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে তাঁর ফেটিশ – তাঁর ছিন্নভিন্ন শরীরের মাংস হাড় চর্বি ও ক্বাথ – যা তাঁর নিজের নয় আর, এমনকি অন্যেরও নয়। তারা স্রেফ বিষয়; থাকতে এসেছে। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মুখে যন্ত্রণাহীন দিব্যতার মধ্যে ফেটিশিজম নেই, শিল্পী খ্রিষ্টকে বস্তুর নিরপেক্ষতা দিতে পারেন না। হতে পারে নিজের সামান্য ছায়া তিনি ছড়িয়ে দিলেন তাঁর আঁকা খ্রিষ্টের মধ্যে কিন্তু সে ছায়া খ্রিষ্টের পায়ে পড়বে বড়জোর। তার মধ্যে adoration থাকবে। কাঁটার মুকুট পরানো মুখে নিজের আদল দেওয়ার কথা শিল্পী ভাবতে পারবেন না। ফ্রিদা খ্রিষ্টকে আঁকেননি কখনো। খ্রিষ্টের চেয়ে অনেক বেশি শারীরিক যন্ত্রণা, বিষ নেন যিনি, ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্ট তাঁকে আকর্ষণ করে না যে, এটাই স্বাভাবিক, এমনই হওয়ার।
আমরা প্রায় সকলেই দেখেছি ফ্রিদার আত্মপ্রতিকৃতি Broken column, যেখানে বস্তু ও নিজের শরীরকে সমান গুরুত্ব ও নৈর্বক্তিকতায় দেখেছেন ফ্রিদা কাহলো। শরীরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া লোহার পাতকে যেন সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে শরীর (ক্রুশবিদ্ধ খ্রিষ্টের ছবিতে পেরেক বা কাঁটার মুকুটকে এরকম সম্মান দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না), প্রবল কোনো ভূমিকম্পে যেন বিশাল অন্ধকার ফাটল সেই শরীরের মধ্যে। ছিটকে যাওয়া থেকে, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করছে আনুভূমিক চারটি ধাতুবন্ধনী, যা যান্ত্রিক আর নিস্পৃহ। সেই বন্ধনী যেন স্রেফ দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটির জন্য। শরীরের সে কেউ নয়। শরীরও গ্রহণ করেনি তাকে, নির্ভর করেনি তার ওপর। কোমরে আলতো জড়ানো সাদা কাপড়ে খ্রিষ্টের অনুষঙ্গ। সারা শরীরে অসংখ্য পেরেক পোঁতা। কিন্তু মুখ যন্ত্রণাহীন। যন্ত্রণা পেরিয়ে যাওয়া কোনো দিব্যতার ছবিও সেখানে নেই। লোহার পাত, ধাতুর কর্সেটের মতো মুখও একটি বস্তুই শেষ পর্যন্ত। দৃশ্য ও অদৃশ্যের মধ্যে যে দ্বিধান্বিত, দোটানায় পড়া সীমারেখা, ফ্রিদা ভেঙে দিয়েছেন তাকে। শরীর যুদ্ধ করে যাচ্ছে আক্রমণকারী বাইরের ঘটনাপুঞ্জের সঙ্গে Ñ যা আসলে বস্তুই।
জীবন আসলে দুভাবেই শুধু লেখা যায়। যখন কেউ কলমে লেখেন নিজেকে, কলমের কালি তখন হয়ে ওঠে তাঁর পবিত্র রক্ত। সেই রক্তপ্রবাহ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে কোথায় তিনি আছেন আর কোথায় নেই। লেখক নির্বাচন করছেন কী তিনি দেখবেন, কী দেখবেন না। এই নির্বাচনক্রিয়াটি লেখা হতে থাকা জীবনকে বস্তু হয়ে উঠতে বাধা দেয়। আর একটি উপায় থাকে, শিরার মধ্যে একটা সিরিঞ্জ রক্ত শুষে নিয়ে নাম-সাঁটা কাচের শিশিতে শান্ত দৈত্যের মতো ঢুকে যায়। রেডিওলজি ইকোগ্রাফি যন্ত্র নিঃশব্দে সাদা কাগজ বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও কোনো নির্বাচন নেই। শরীর এখানে একটি খণ্ড বস্তুর অতিরিক্ত কিছু নয়। গড়িয়ে আসা রক্ত, এগিয়ে আসা কাগজ বস্তুর সত্যগুলোকে নির্মোহভাবে বলে যায় যান্ত্রিক একঘেয়েমিতে।
খ্রিষ্টের শরীরের যন্ত্রণাকে (খ্রিষ্ট প্রধানত শরীরই) বোঝাতে ক্যানভাসে দরকার হয় বেদনাদীর্ণ ভয়ার্ত, বিস্মিত কিছু মুখ। এই মুখগুলো ছাড়া খ্রিষ্টকে দিব্যতা দেওয়া যাবে না। Broken column-এ ফ্রিদার চোখে জলের রেখা ঠিক এর বিপরীতে। ফ্রিদার যন্ত্রণা বোঝানোর কোনো দায় সে নেয় না। শরীরে প্রতিটি লোহার পাতের মতো, চোখের জলও একটি বস্তু। বস্তুর নিয়মেই সে আছে, থাকবে।
এখানেই ফ্রিদা ছাড়িয়ে যান খ্রিষ্টকে। পরিপূর্ণ ফেটিশ, দগদগে জীবন, এভাবেই হারিয়ে দেয় আরোপিত প্রতীককে। তখন ফ্রিদার শরীরের ক্ষতমুখগুলোই কোনোক্রমে খ্রিষ্ট হয়ে উঠতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।