ই ম রা ন ফি র দা উ স
‘দুনিয়ার অন্য কোনো ফিল্মমেকারের কাছ থেকে আমি যতটা না শিখেছি আকিরা কুরোশাওয়ার নিকট হতে
নিয়েছি তারও অধিক।’
– স্টিভেন স্পিলবার্গ (জ. ডিসেম্বর ১৮, ১৯৪৬)
১৯৯২ সালে চলচ্চিত্রবেত্তা ব্রেট কার্ডুল্লো আকিরা কুরোশাওয়াকে জিজ্ঞেস করেন ‘সিনেম্যাটিক বিউটি’ কী? উত্তরে আকিরা বলেন, ‘সিনেম্যাটিক বিউটি অবশ্যই তাই, যা কোনো ফিল্মে বর্তমান থেকে সেই ফিল্মকে ফিল্ম হয়ে ওঠার চলমান চিত্ররূপে দৃশ্যায়িত করে।’ আকিরা কুরোশাওয়ার সিনেমায় গতি নিঃসন্দেহে পায় অমায়িক ভাষা। সিনেবাজারে একজন কর্তৃত্বপরায়ণ দৃশ্য-কারিগর হিসেবে সুপরিচিত আকিরার প্রজ্ঞা ও মেধা নিয়ে টুঁ শব্দটি করার স্পর্ধা হবে না কোনো (সুস্থ) মানুষের। মহাশয়ের চলচ্চিত্রমালার মধ্যমণি হয়ে আছে তাঁর নির্মিত চরিত্রগুলোর তেজোদীপ্ত কারনামা; কাহিনি উৎসারিত চরিত্র সমুদয় যেন অবতীর্ণ হয় মিথ্যার বিরুদ্ধে মানবিকতা ও জ্ঞানের অগ্নিপরীক্ষায়… এ যেন ব্যক্তি আকিরারই আত্মদ্বন্দ্বের প্রতিবিম্ব। সিনেম্যাটিক বিউটি যদি আকিরা কুরোশাওয়ার মুদ্রার এক পিঠ হয় তবে আরেক পিঠে রয়েছে ভায়োলেন্স। শারীরিক বা মানসিক, উভয় প্রকার ভায়োলেন্স ওই অগ্নিপরীক্ষায় মীমাংসা সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পরিবারের সাত সন্তানের মাঝে ছোট ছেলে আকিরার পৃথিবীতে শুভেচ্ছা স্বাগতম ঘটে ১৯১০ সালের ২৩ মার্চ বুধবারে। তাঁর জবানিতে জানা যায় তাচিকাওয়া নাুী শিক্ষার্থীবৎসল একজন গুরুর গল্প, যিনি শৈশবে আঁকিবুকির ক্লাসে তাঁকে যারপরনাই উৎসাহ দিয়ে থাকতেন। আকিরার মতে, ওই শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তাঁর মনের জানালায় কোনো একদিন আবিষ্কার করেন দৃশ্যকল্পের আসমান-জমিন। শৈশবে এভাবেই আকিরার মন রং-পেনসিলের স্বচ্ছ ভালোবাসায় সিক্ত হয়।
ছাত্রাবস্থায় আর্ট স্কুলে একজন প্রতিভাবান পেইন্টার রূপে সুবিদিত আকিরা দীক্ষালাভ করেন পশ্চিমা কলাশৈলীতে। আর্ট স্কুলের পাট চুকিয়ে ১৯২৮ সালে নিট্টেন প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রথম সৃজনশীলতার স্বীকৃতি পান। পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে সমমনা একদঙ্গল তরুণ শিল্পোৎসাহীর সঙ্গে যুক্ত হন প্রলেতারিয়েত শিল্পী সংঘে, যাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল উনিশ শতকের রুশ সাহিত্য, তবে সাকির গেলাস হাতে নিয়ে ফিওদর দস্তয়ফস্কিকে ঘিরে কথার তুবড়ি ছুটত সবচেয়ে বেশি। দস্তয়ফস্কি সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘তিনি মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে খুবই সৎভাবে তাঁর লেখা করেছেন।’ সংঘে যোগদানের ক্ষেত্রে আকিরার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শিল্পচর্চার এই নব আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা ও বোঝা।
আকিরা কুরোশাওয়ার অনুপ্রেরণাদাতার তালিকায় আরো পাওয়া যায় সহোদর হেইগোর নাম। হেইগোর বদৌলতে তাঁর সিনেমার সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয় ঘটে। সিনেমাপাগল হেইগো কাজ করতেন ভিনদেশি নির্বাক ছবির ধারাভাষ্যকার বা বেনশি হিসেবে। সিনেমামাতাল ভাইটির আকস্মিক আত্মহত্যা আকিরার সংবেদনশীল মনে বইয়ে দেয় মগ্নচৈতন্যের শিস। আকিরার বয়স যখন বিশের একটু ওপরে তখন হেইগো আত্মহত্যা করেন। এর চার মাস পরে কুরোশাওয়া পরিবারের বড় ছেলে মারা যান। চারজন ছেলের মধ্যে তখন কেবল আকিরাই বেঁচে থাকেন। তখন তাঁর বয়স ছিল তেইশ বছর।
১৯৩২ সালে প্রলেতারিয়েত শিল্পী সংঘ থেকে বের হয়ে এসে পেইন্টার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও ঠিক মন বসাতে পারছিলেন না। মাঝে কেটে যায় আরো বছর তিনেক। এমন দশায় নতুন কিছু করার কথা ভাবছিলেন। ১৯৩৫ সালের কোনো এক সকালে প্রাতরাশের থালায় চোখ আটকে যায় দৈনিকের পাতায়। নতুন ফিল্ম স্টুডিয়ো ফটো কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিজে (পরবর্তী সময়ে যার নাম হয় তোহো) লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে সহকারী চিত্রপরিচালক পদে আবেদন করেন এবং কাজিরো ইয়ামামোতোর নির্দেশনায় শ্র“তিচিত্র নির্মাণকর্মে নিযুক্ত হন। ইয়ামামোতো আকিরাকে যত না পছন্দ করতেন সহকারী হিসেবে, ততোধিক ভালোবাসতেন সিনেমা ছাড়াও জগতের অন্য সব বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ও অভিনিবেশের কারণে! কর্মাসক্ত আকিরা নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে ইয়ামামোতোর ছায়াছবিগুলোর জন্য পূর্ণাঙ্গ স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করেন এবং আস্ত একেকটা সিকোয়েন্সের নির্দেশনা দিতে আরম্ভ করেন। নিজের কাজের প্রতি চরম যতœবান এই কারুশিল্পীর পাকা হিসাবির মতো শুটিং-পূর্ব যাবতীয় আয়োজন এন্তেজাম করা ও চিত্রগ্রহণক্ষণে পুরো পরিস্থিতির ওপর দখল রাখার ব্যাপারে আছে ঈর্ষণীয় সুনাম। তিনি সেট ডিজাইন থেকে আরম্ভ করে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সরণপথ পর্যন্ত জ্যামিতির মাপে ছেঁকে ফেলতেন… ঠিক যে মতে একজন পেইন্টার তাঁর ক্যানভাসকে ভাগ করে ফেলে থাকেন। বস্তুত আমরা জানি, আকিরার মানসে দৃশ্যকাব্য প্রথম হাজির হয়েছিল পেইন্টিংয়ের বিমূর্ত কল্পনা নিয়ে। তবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে ‘প্রতিদিনকার একঘেয়েমির মধ্যে তখন সিনেমা আমাকে যে বৈচিত্র্য এনে দিত, সিনেমা দেখায় আমি যে আনন্দ পেতাম, তা আর কোথাও পেতাম না। তাই সিনেমা আমি প্রাণভরে উপভোগ করতাম। ছোটবেলায় দেখা অনেক ছবির বিশেষ বিশেষ অংশ আমার স্মৃতিতে আজো অম্লান হয়ে আছে।’ এই গল্পের সূত্র ধরে আমরা খোঁজ পাই তাঁর প্রিয় সিনেমা টিচার ইয়ামামোতোর। আকিরা বলতে থাকেন, ‘মহাত্মা ইয়ামামোতো ছিলেন সব সেরা শিক্ষকদের একজন। তিনি তাঁর অসামান্য পদ্ধতিতে আমাদের কাজ শিখিয়েছিলেন। তিনি, মনে হয়, তাঁর অধীত বিদ্যার সবটাই আমাকে শেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বলতেন, ‘আমি কুরোশাওয়াকে এটুকুই শিখিয়েছি যে কী করে মদ খেতে হয়। এর বেশি আর কিছুই না।’ ইয়ামামোতো ছিলেন ইয়াসিজিরো ওজুর সমসাময়িক
বাস্তববাদী চিত্রনির্মাতা। আকিরা মনে করেন, ইয়ামামোতো শিক্ষক হিসেবে সফল। কেননা ইয়ামামোতোর কাজের সঙ্গে তাঁর সহকারীদের কাজের কোনো মিল নেই। তাঁর অনুপ্রেরণার তালিকায় আরো আছেন জন ফোর্ড, আবেল গাঁসের ‘লা রু’, ভাববিলাসী জর্জ স্টিভেন্সের ছবি, জঁ রেনোয়ার ‘মাই লাইফ অ্যান্ড মাই ফিল্মস’, ফ্রাঙ্ক কাপরা, উইলিয়াম ওয়াইলার এবং অবশ্যই কেঞ্জি মিজোগুচি। পাশাপাশি তিনি আরেকজনের নাম নিয়েছেন, যিনি তাঁকে ‘প্রভাবান্বিত করেননি কিন্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয় পরিচালক’, তিনি মাইকেল আন্তোনিয়নি!
দুই
‘ছবির কথা যদি মুখে বলতে পারা যেত তাহলে ক্যামেরায় তোলার আর দরকার হতো না, হতো কি?’
প্রথম দিকে তোহো স্টুডিয়োতে তাঁর কাজ ছিল চিত্রনাট্য লেখা। অন্য পরিচালকদের জন্য চিত্রনাট্য লিখতে লিখতে সিনেমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই শাখার ওপর দখল তৈরি হয় আকিরার। ১৯৩৬-১৯৪১ সালের মধ্যে তোহো স্টুডিয়ো প্রযোজিত পঁচিশটি সিনেমায় তিনি চিত্রনাট্যকার, সহকারী পরিচালকসহ বিবিধ ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করেন। কখনো কাজ করেছেন সম্পাদনায়, আবার কখনো ডাবিংয়ে। ছবি করার এমন এন্তার অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়ে দেয় সিনেমা বানানোর মতো একটা এলাহি কাণ্ড কী উপায়ে সুস্থিরভাবে সামলাতে হয়। ঐতিহাসিক বিষয় তাঁর ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে, কাজ করেছেনও বড় জমিনে। তাঁর ছায়াছবিতে চিরদিনের পৃথিবী বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে – এই হাহাকার বার্তা পাওয়া যায়। তাঁর সিনেমাগুলোর আরেকটা বৈশিষ্ট্য ভ্রাম্যময়তা। দীর্ঘ সাতান্ন বছরের একনিষ্ঠ পেশাজীবনে শুধু বিষয়গত বৈচিত্র্যেই নয়, কারিগরি দিক থেকেও তিনি জাপানি সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন অনেকাংশেই। তাঁর পরিচালিত/নির্মিত ছায়াছবির সংখ্যা
কড়ায়-গণ্ডায় ছাব্বিশটি। এক্ষণ, আমরা তাঁর বিখ্যাত কিছু ছবির কথা ও তৎসংলগ্ন অর্জনের খবরগুলো নিয়ে আলাপ করব।
সুগাতা সানশিরো (১৯৪৩)
চিত্রনাট্য রচনায় মুন্শিয়ানার ছাপ রাখা কুরোশাওয়ার শুধু লিখে লিখে বড় পর্দায় কল্পনার উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়ে পোষাচ্ছিল না। এমন দিনে তাঁর হাতে এসে পড়ে ঔপন্যাসিক ৎসেনুয়ো তমিতার সুগাতা সানশিরো নামের উপন্যাসটি। বইটি হাতে পাওয়া মাত্রই এক দমে শেষ করে ফেলেন আকিরা। পড়তে পড়তে তিনি জেনে ফেলেন পৌরাণিক ও সমসাময়িক – দুই কালের গল্প বলা এ সিনেমাটাই তাঁকে বানাতে হবে। সুগাতা সানশিরো পরিচালনার মধ্য দিয়ে পরিচালক হিসেবে ১৯৪৩ সালে তাঁর অভিষেক ঘটে। পুরো শুটিংটা হয় ইয়াকোহামাতে ১৯৪২-এর শীতকালে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে জাপান তখন মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তো, এইদিকে শুটিং, এডিটিং যথেষ্ট মসৃণভাবে সম্পন্ন হলেও ফ্যাঁকড়া বাধে সেন্সর বোর্ডে ছাড়পত্র আনতে গিয়ে। তদানীন্তন জাপানি সরকার মনে করে, সিনেমার বিষয়বস্তু জাপানি লোকাচারমুখিন হলেও মেজাজ বা মনোভঙ্গির দিক থেকে এটি ‘ইঙ্গ-মার্কিন’ ধ্বজাধারী। ফলাফল ছাড়পত্র দিতে বেঁকে বসে কর্তৃপক্ষ। এমতাবস্থায়, বুজুর্গ নির্মাতা ওজুর আগ্রহ ও হস্তক্ষেপে কোনোরকম ক্ষত ছাড়াই সিনেমাটা ১৯৪৩-এর ২৩ মার্চ মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর এক শনিবার ঘুরে আরেক শুক্রবার আসার আগেই ছবিটি দর্শক/সমালোচকদের হৃদ-মাঝারে ঠাঁই করে নেয়। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে বানানো প্রথম সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবেও সফল হয়। সুগাতা সানশিরো একজন মানুষের নিজের সঙ্গে তো বটেই শত্র“র সঙ্গে লড়াই-সংগ্রামের আকর্ষণীয় ও চমকপ্রদ প্রতিমূর্তি উপস্থাপন করে। যেমন একটা দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ও অ্যান্টিগোনিস্ট জুডো-মাস্টারদ্বয় মুখোমুখি মরণপণ লড়াই করছেন, তাঁদের পাশ দিয়ে হু হু করে বইছে এলোমেলো বাতাস আর তাতে ময়দানের লম্বা লম্বা ঘাসগুলো অস্থিরভাবে ঝাপ্টা খেয়ে পড়ছে পরস্পরের ওপর কিন্তু মাস্টারদ্বয়কে এসবের কিছুই স্পর্শ করে না; তাঁরা লড়াই করছেন ওই অ-স্থির ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে। যেন কোনো এক গুপ্ত পুরাণের চরিত্র তাঁরা। এরকম দুর্দান্ত কোরিওগ্রাফড ফাইটিং সিকোয়েন্সটি আমরা পুনর্বার প্রত্যক্ষ করি আরেক অস্কার বিজয়ী অ্যাং লির ‘ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্রাগনে’! অতএব, পাঠক বুঝতেই পারছেন, ১৯৪৩ সালে ‘আকিরা কুরোশাওয়া’ নামের তেত্রিশ বছরের মেধাবী যুবকটি কেন জাপানে ‘টক অব দ্য টাউন’ হয়ে উঠেছিলেন!
ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল (১৯৪৮)
ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলকে আকিরা কুরোশাওয়ার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে পয়লা ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিপূর্ণ সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এর পেছনের বছরগুলোতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোলাহল লেগে থাকায় সরকারের চাপে পড়ে তাঁকেও গোটা পাঁচেক প্রোপাগান্ডা সিনেমা বানাতে হয়েছিল। ১৯৪৮ সাল নাগাদ যুদ্ধের দামামা বন্ধ হলে মানুষ আবার খুঁজে নিতে শুরু করেছিল নিজ নিজ ঠিকানা, ব্যক্তিগততা ও জীবনের হারানো সুর। এই ছবি করতে গিয়ে নির্মাতা খুঁজে পান তোশিরো মিফুনকে, যিনি ইকিরু ছাড়া কুরোশাওয়ার প্রায় এক কুড়ি মানে ষোলোটি সিনেমার হয় প্রধান চরিত্রে নতুবা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজ করেছেন। মিফুন আকিরার অসম্ভব প্রিয় অভিনেতাদের একজন। মার্লোন ব্র্যান্ডো স্ট্রিট কার নেমড ডিজায়ারে মার্কিন মুল্লুক তথা পশ্চিমে ক্রোধী যুবার যে ইমেজ পেশ করে সমাদৃত হয়েছিল… সে ঘটনা ঘটার কিয়ৎকাল আগে কুরোশাওয়ার ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলে তোশিরো মিফুন তা করে পর্দা কাঁপিয়ে ফেলেছেন। ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলে এক জুয়াড়ির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তোশিরো মিফুন, যে হঠাৎ জানতে পারে তার যক্ষ্মা হয়েছে। এই রোগ সারে না ধরে নিয়ে সে তার অবশিষ্ট জীবনটুকু যেমন-তেমনভাবে নষ্ট করে ফেলতে চায়। এই সময় তার পরিচয় হয় মদ্যপ অথচ অসম্ভব পরোপকারী ডাক্তারের সঙ্গে। ডাক্তারের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন আকিরার আরেক পছন্দের কুশীলব তাকাশি শিমুরু। এই ডাক্তারের পাল্লায় পড়ে সে নিজেকে পালটায়। এই ছায়াছবিতে কোনো প্লট নেই, আছে কতকগুলো সমান্তরাল ঘটনাপ্রবাহ। রূপকের অসাধারণ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সমকালীন জাপানের জীবন-রাজনৈতিক বাস্তবতা মেলে ধরা এই ঐতিহাসিক ছবিকে দেওয়া হয় সে বছরের সিনেমার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদক ‘কিনেমা জুনপো’। চলচ্চিত্র সমালোচক পিটার কাউই অবশ্য ছবিটির কাহিনি বয়নে খুঁজে পেয়েছেন বার্গম্যান যে তারুণ্যের চপলতা নিয়ে পৃথিবীকে দেখে অভ্যস্ত ঠিক ওই রকম চঞ্চলতা। তবে কুরোশাওয়া বলেছেন – ‘এই সিনেমার ভেতর দিয়ে আমি আমার অস্তিত্বের অজানা বিষয়গুলোকে জ্ঞানের সীমায় খুঁজে পেয়েছিলাম।’
স্ট্রে ডগ (১৯৪৯)
স্বরচিত (অপ্রকাশিত) ডিটেক্টিভ নভেল অবলম্বনে ১৯৪৯ সালে আকিরা স্ট্রে ডগ নির্মাণ করেন। ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তোশিরো মিফুন এই ছবিতে অভিনয় করেন সার্ভিস রিভলবার-পাগল একজন ডিটেক্টিভ পুলিশের চেহারায়। স্ট্রে ডগকে ‘নয়্যার’ ও ‘বাডি কপ’ ফিল্ম ধারার উদ্বোধনী সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করেন চলচ্চিত্রবেত্তারা। আকিরা তাঁর অন্যতম প্রিয় লেখক (বুলগেরিয়ান) জর্জ সিমোননের শৈলীর অনুকরণে গল্পের প্লট সাজিয়েছিলেন। মিফুনের চরিত্রের গঠনের সঙ্গে সিমোননের কল্পিত ডিটেক্টিভ পুলিশ জুল মেইগ্রেটের চরিত্রের বেশ মিল পাওয়া যায়। রিভলবার-প্রিয় একজন পুলিশের রিভলবার খোয়া যাওয়া এবং সেটি ফেরত পেতে শহরের বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি চষে ফেলার কিস্সা বড় পর্দায় প্রজেকশনের ছলে কুরোশাওয়া দেখতে চেয়েছেন যুদ্ধ-পরবর্তী একটি নগরের জেগে ওঠা ও নাগরিকবৃন্দের হিত-অহিত জ্ঞানের বিনির্মাণের সংকটটাকে। তোহো স্টুডিয়োর ‘গডজিলা’র আশু নির্মাতা ও আকিরার বন্ধু ইশোরো হোন্ডার ক্যামেরা যেন ডকুমেন্টারির রোদচশমা দিয়ে ফিকশন ধারণের প্রাত্যহিক কর্তব্য পালন করে যায়। ফলত স্ট্রে ডগ শুধুমাত্র চোর-পুলিশ দ্বৈরথ না থেকে হয়ে ওঠে একটি নগরের পুরাঘটিত অতীতের প্রামাণ্য দলিল।
রশোমন (১৯৫০)
সেলুলয়েডের ফিতায় বা হাল আমলে ডিভিডির মোড়কে যাঁরা আকিরা কুরোশাওয়াকে খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা দেখামাত্রই পরিচিত হয়ে থাকেন টেকনিক্যালি-ঋদ্ধ, শিল্পসিদ্ধ বড় দৃশ্যকাব্য শিল্পীর সঙ্গে। তিনি রশোমন দিয়ে পশ্চিমাদের নতুন করে জাপানি ছায়াছবি দেখতে শিখিয়েছেন। ১৯৫১ সালে এই ছবি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে সর্বোচ্চ সম্মান ‘গোল্ডেন লায়ন’ লাভ করে এবং অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম জেতে। সেইসঙ্গে বিশ্বের দরবারে জাপানি মুভিকে সাড়ম্বরে হাজির করে। রশোমন এক টিকিটে দুই গল্পের ছবি। গল্পকার রুইনোসুকে আকুতাগাওয়ার নিরীক্ষাধর্মী দুটি ছোটগল্প রশোমন ও ইন আ গ্রেভ থেকে যথাক্রমে প্রেক্ষাপট ও প্রতিবেশ এবং কাহিনি ও চরিত্র বিন্যাস অংশটুকু নেওয়া হয়েছে। কাহিনির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিক থেকেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ সরণ লক্ষ করি, যেমন আকিরা প্রথমেই সরে এসেছিলেন জাপানি চলচ্চিত্রকারদের অন্যতম প্রিয় সময় তোগোকাওয়া যুগ থেকে (১৬০৩-১৮৬৭) দ্বাদশ শতকে। রশোমনে আমরা দেখতে পাই, চারটি ক্যারেক্টার আলাদাভাবে একই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে, শুধু সামুরাইয়ের বিদেহী আত্মার বক্তব্য বসানো হয় এক ভবিষ্যদ্দ্রষ্টার মুখে। বাকি তিনজন অর্থাৎ সামুরাইয়ের স্ত্রী, দস্যু, কাঠুরিয়া – যার যার মতো করে আলাপ করে। আর এখানেই খেলাটা জমে ওঠে। মূল ঘটনা হলো, সামুরাই ও তার স্ত্রী গভীর জঙ্গল দিয়ে যাওয়ার সময় বনদস্যুর কবলে পড়ে এবং দস্যু সামুরাইকে কতল করে তার বউয়ের ইজ্জত লুটপাট করে। কিন্তু প্রত্যেকের গল্প শোনার পর আর বোঝার উপায় থাকে না মেয়েটিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি করা হয়, নাকি সে নিজে দস্যুটিকে এই কাজে প্রলুব্ধ করে তার স্বামীপ্রবরকে হত্যার ব্যাপারে প্ররোচিত করেছিল। এসব পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্য থেকে মূর্ত হয়ে ওঠে সত্যের আপেক্ষিকতা। কাহিনির এমন তা-না-না দেখে সেই সময় অনেক সমালোচক খেপে ওঠেন কুরোশাওয়ার ওপর… তাদাশি ইজিমা তো বলেই ফেললেন, ‘ছবিটির শৈল্পিক গুণমানে আমরা মুগ্ধ। তবু এ-কথা বলতেই হয় যে রশোমন অত্যন্ত মূল্যবান ব্যর্থ ছবি!’ অনেকেই বুঝলেন না যে আকিরা বলতে চেয়েছেন – সত্যি কথা বলছে ‘কে’? প্রকৃতপক্ষে এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব দরকারি নয়। তার চেয়ে বরং আকিরা জানতে আগ্রহী ‘সত্য আসলে কী, ঘটনা ও সত্যের সম্পর্ক কী’ ইত্যাকার দার্শনিক দ্বন্দ্ব। এ ছবিতে তোশিরো মিফুন অনবদ্য অভিনয়শৈলীর জন্য পেয়েছেন দর্শকদের টুপি খোলা অভিনন্দন। রশোমন ভ্রমণের মাঝ দিয়ে আকিরা কুরোশাওয়া মূলত বলতে চেয়েছেন পশ্চিমের রিডিং গ্লাস দিয়ে পৃথিবীকে অবলোকন করাই শেষ কথা নয়, পৃথিবীকে আরো বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার অবকাশ রয়েছে, তথাপি সত্য একটাই নয়, অনেক সত্য রয়েছে।
সেভেন সামুরাই (১৯৫৪)
১৯৫০-১৯৫৮, জাপানির সিনেমার তখন সেই স্বর্ণযুগ, প্রতিবছরই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে একাধিক ভালো ছবি। দর্শকরা ওজুর কাছ থেকে পেয়েছে টোকিও স্টোরি (১৯৫৩),আর্লি ¯িপ্রং (১৯৫৬)। মিজোগুচি নিবেদন করছেন ইয়াং কেউই ফেই (১৯৫৫), নিউ টেলস অব দ্য টায়ের ক্লান (১৯৫৫)। দর্শকরা আরো দেখছে ইচিকাওয়ার কনফ্লাগার্সন (১৯৫৮), গোশোর ফোর চিমনিজ (১৯৫৩), কিনোশিতার ব্যালাড অব দ্য নারায়ামা (১৯৫৮) প্রভৃতি সিনেমা। এরই মাঝে কুরোশাওয়া উপহার দিলেন সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), দ্য হিডেন ফোরট্রেস (১৯৫৮), ইয়োজিম্বো (১৯৬১)। এর মধ্যে সেভেন সামুরাইয়ের কাছে হলিউড কারখানা চরম ঋণী। সেভেন সামুরাইয়ের বরাতে হলিউডের ওয়েস্টার্ন জরাঁর সিনেমায় নবচাঞ্চল্যের সূত্রপাত হয়। ইকিরুর (১৯৫২) দুই চিত্রনাট্যকার শিনোবু হাশিমোতো ও হিদেউ ওগুনিকে পঁয়তাল্লিশ দিন গেটলক চুক্তিতে আবদ্ধ করে আকিরা একটি সরাইখানায় ওঠেন এবং সেভেন সামুরাইয়ের চিত্রনাট্য আবির্ভূত হয়। এইটাই আকিরার প্রথম যথার্থ সামুরাই প্রকল্প। এই সময়ের চোখে সেভেন সামুরাইয়ের গল্প আর দশটা মারদাঙ্গা ছবির মতো মনে হলেও এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, এই সিনেমার মাধ্যমেই পর্দায় গল্প বলার নবরীতির সূচনা হয়েছিল। সাত ডাকাতের প্রচেষ্টায় একটি নিপীড়িত গ্রাম ও অধিবাসীদের বাইরের শত্র“দের হাত থেকে বাঁচানোর গল্পটি যে কত রোমহর্ষক উপায়ে বলা যায় কুরোশাওয়া তা-ই দেখিয়েছেন আমাদের। সেভেন সামুরাই চলচ্চিত্র-ভাষায় নতুন কিছু শব্দ যোগ করে। যেমন – ঘটনাপরম্পরার উপাদান হিসেবে ছবির নায়ক(দের) অভিন্ন লক্ষ্যে একটি দলে শামিল করে সকলের উপস্থিতি যথাযথভাবে জাহির রাখার কারুকৌশলটি কুরোশাওয়া আমাদের প্রথম শিখিয়েছেন। পরবর্তীকালে এই ভাষার অভাবনীয় প্রয়োগ আমরা দেখি জে লি থম্পসনের গান্স অব নাভারনে (১৯৬১), ল্যুইস মাইলস্টোনের ওশেন’স ইলেভেনে (১৯৬০), রবার্ট অলড্রিচের ডার্টি ডজনে (১৯৬৭)। এই যে আমরা এখন চার-পাঁচটা নায়কসংবলিত ছবির ট্রেলার দেখেই ভেবে নিতে পারি কীভাবে মূল নায়কের সঙ্গে দর্শকের পরিচয় ঘটবে, নায়কের মাঝে জীবনের প্রতি অনীহা থাকবে (কিনা!), সিনেমায় কনিষ্ঠ নায়কের সঙ্গে সুন্দরী নারীর প্রণয় ঘটবে এবং গল্পের সাধারণ মানুষদের বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে সর্বদা নিজেদের বাঁচাবার আকুতি… এর সবই এখন হরদম বিভিন্ন ছবিতে দেখতে পেলেও এই সবকিছুর সঙ্গে আমাদের চিন-পরিচয় ঘটেছে প্রথমত সেভেন সামুরাইয়ের হাত দিয়ে। কালজয়ী এই ছবি জাপানের বোদ্ধারা মোটেও ভালোভাবে নেননি। পরবর্তীকালে ইউরোপ এবং হলিউডে ছবিটির তুমুল জনপ্রিয়তা জাপানি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি পুনরায় প্রচারে উৎসাহিত করেছিল।
কাগেমুশা (১৯৮০)
জাপানি ছবির স্বর্ণযুগ অব্যবহিতকালে পারফেকশনিস্ট কুরোশাওয়ার হাতে কাজের পরিমাণ কমে যায়। পুরো ষাটের দশক আকিরার সিনেমা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি। নাম করার মতো ছবি ছিল ইয়োজিম্বো (১৯৬১)। সেভেন সামুরাইয়ের পর তিনি নির্মাণ করেন রেড বিয়ার্ড। আর রেড বিয়ার্ড তাঁর জীবনে জ্বেলে যায় লাল বাতি! আগে-পিছে আরো কিছু সিনেমার হতাশাজনক ফলাফল, লোকজীবনে দূরদর্শন বা টিভির প্রবেশ, প্রযোজকদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া এবং সমালোচকদের লাগামহীন সমালোচনায় তিনি এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন যে, আত্মহননের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তারপরও বেঁচে ছিলেন (হয়তো) বেকেটের মতো গডোর প্রতীক্ষায়। সেইসব দিনরাত্রিতে বেকেট তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দিতেন : ‘সবকিছু ছাপিয়ে প্রতিটা দিনই অন্যসব দিনের মতোই।’ জাপানি সিনেমার বিষণœ সম্রাট তাই হাজির হন এবার দেরসু উজালা ও কাগেমুশা নিয়ে। সোভিয়েত-জাপান প্রযোজনা দেরসু উজালা বিষণœ সম্রাটকে এনে দেয় ১৯৭৫-এর অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম!
১৯৮০ সালে জাপানের স্থানীয় মুভি মার্কেটে মুদ্রা উপার্জনের তালিকায় কাগেমুশা ছিল এক নম্বর, এটি আয় করে ২.৭ বিলিয়ন ইয়েন। কাগেমুশার অর্থ ছায়া-যোদ্ধা। এ যাত্রায় আকিরার পুনরাগমন ঘটে রাজকীয়ভাবে, তবে এই আগমন পথ তাঁর ছবিগুলোর মতো স্মুথ ছিল না। কাগেমুশার স্ক্রিপ্ট তৈরি করে লগ্নিকারকের অভাবে বেকার বসেছিলেন মেলা দিন। প্রিয় পরিচালকের এই দশা জেনে স্টার ওয়ারস্ খ্যাত জর্জ লুকাস উতলা হয়ে তড়িৎডাকে আকিরাকে উড়িয়ে আনেন সানফ্রান্সিস্কোতে ১৯৭৮-এর জুলাইয়ে। কাগেমুশার চিত্রনাট্য পড়ে এবং কুরোশাওয়ার নিজ হাতে আঁকা রঙিন স্টোরিবোর্ড দেখে উত্তেজিত/আলোড়িত জর্জ লুকাস তাৎক্ষণিকভাবে টোয়েন্টিনথ সেঞ্চুরি ফক্সের সঙ্গে আলাপ করেন। লুকাসের পীড়াপীড়ি আর ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার ওকালতির দরুন ফক্স কাগেমুশার আন্তর্জাতিক স্বত্ব কিনে নেয়। বিবিধ ঝুট-ঝামেলা, শুটিংয়ের পয়লা দিনে মূল অভিনেতার রদবদল Ñ সব মিলিয়ে ১৯৭৯-এর এপ্রিলে আরম্ভ হওয়া শুটিং শেষ হয় মার্চ ১৯৮০-তে। ১৯৮০-র এপ্রিলে মুক্তি পাওয়ার পাঁচদিনের মাথায় দুম করে হিট হয়ে গেলে সমালোচকদের টনক নড়ে ওঠে! একই বছরের কান ফিল্ম ফেস্টিভালের পাম দ’অর জিতে নেয় ছবিটি। জর্জ লুকাসের ভাষ্য অনুযায়ী, কুরোশাওয়া সিনেমার অন্তিম তথা যুদ্ধবিগ্রহের দৃশ্যে পাঁচ হাজার এক্সট্রা আর্টিস্ট নিয়ে সারাদিন শুটিং করেন এবং এর থেকে মাত্র নব্বই সেকেন্ডের দৃশ্য ব্যবহার করেন। সম্পাদনায় কুরোশাওয়ার হাতযশের প্রমাণ পাওয়া যায় স্পেশাল ইফেক্টের বাহার দেখে। সিনেমাটাকে টানটান রাখতে এডিটিংয়ের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। ভয়ংকর সুন্দর ভিজ্যুয়াল আর কাহিনি বুননের চমৎকারিত্ব ছবিটিতে যোগ করেছে পারলৌকিক মাধুর্য। এই এপিক ছায়াছবি সম্পর্কে কুরোশাওয়ার মন্তব্য, ‘কাগেমুশা এই দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত হয়েছে যে, একজন ছায়া-যোদ্ধা এমন একটি যুদ্ধ বসে বসে দেখছেন, যাতে তিনি নিজে জড়িত রয়েছেন, এমন এক জায়গায় বসে আছেন, যেখান থেকে চারদিকের যুদ্ধ দেখা যায়।’
আলোচিত এই ছবিগুলোর পাশাপাশি আকিরা কুরোশাওয়া নির্মিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি নিয়ে সংক্ষেপে বললে বলতে হয়, তাঁর সিনেমা করার মধ্যে একরকম অনন্যতাসূচক ব্যাপার রয়েছে। কুরোশাওয়ার ছবি থেকে যেমন পশ্চিমারা দেদার কপি-পেস্ট করেছে, সেখানে কুরোশাওয়া প্রিয় নির্মাতা জন ফোর্ডের ঘরানার আবেগে বানিয়েছেন আন্তর্জাতিক পদক জেতা হিডেন ফোরট্রেস। আর হিডেন ফোরট্রেস দেখতে বসেই জর্জ লুকাসের মস্তিষ্কের থিয়েটারে নাজেল হয় স্টার ওয়ারসের প্লট। কুরোশাওয়া শুধু জাপানি সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্য পড়েছেন একটি তৃষিত পাঠকের মন নিয়ে। এই ভালোবাসা থেকে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ ও কিং লিয়ার অবলম্বনে যথাক্রমে থ্রোন অব ব্লাড ও র্যান বানিয়েছেন; র্যানকে বিবেচনা করা হয় আকিরার অন্যতম ‘ফাইনেস্ট ওয়র্ক’ হিসেবে। এবং ম্যাক্সিম গোর্কির লোয়ার ডেপথস্ ও দস্তয়ফস্কির দ্য ইডিয়টের সিনেমা সংস্করণ অনেক দর্শককে জুগিয়েছে ভাবনার জ্বালানি। এছাড়া ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর ড্রিমস ছবিতে আটটি ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে তিনি ভেবেছেন এক নতুন পৃথিবীর কথা। যুদ্ধবিরোধী, মানব কর্তৃক প্রকৃতি ধ্বংসবিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন রঙিন সেলুলয়েডে ভর করে, দেখাতে চেয়েছেন শুভ্র-রঙিন-আকাশের-দিন। মাদাদায়ো আকিরা কুরোশাওয়ার দীর্ঘ পরিচালক জীবনের শেষ ছবি। ছবিটিতে গল্প বলতে বিশেষ কিছুই নেই। সিনেমার সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা হচ্ছে একটা বেড়ালছানার হারিয়ে যাওয়া। সত্যি বলতে কী, মাদাদায়োর নিস্তরঙ্গ ছন্দ, অনাটকীয়তা এবং ক্যামেরার ধৈর্যশীল পর্যবেক্ষকের ভূমিকা কুরোশাওয়ার চেয়ে আরো বেশি জাপানি ইয়াসুজিরো ওজুকে মনে করায়। এ ছবিকে এক দিক দিয়ে ওজুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। শেষ ছবি মাদাদায়োর বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘এখনো না’! হয়তো তিনি ভেবেছিলেন এখনো ক্ষান্ত দেওয়ার সময় আসেনি!…স্বাপ্নিক মানুষরা চিরটাকাল স্বাপ্নিকই থেকে যায়। তবে মানবতা ও মূল্যবোধকে সর্বদা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হিসেবে ভাবা বিষণœ/নিয়তিবাদী কুরোশাওয়ার সব ছবিতেই দেখা যায় জীবনের উদ্যাপন, আছে জীবনের জয়গান।
তিন
‘আমি তাঁদের (সমালোচক) বলতে চাই, মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় দিয়ে ছবি দেখতে। কারণ আমি সেভাবেই সিনেমা করে থাকি।’
প্রত্যেক মানুষের যেমতি রয়েছে আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসূচক ভাষা সেমতি ফিল্মমেকারদের আছে নিজ নিজ স্বর। মহাত্মা তারেক মাসুদ বলতেন, ‘একজন নির্মাতাকে শুধু ‘নির্মাতা হব’ বলে নির্মাতা হওয়ার চেষ্টা না করে একজন কারিগর হিসেবে নিজেকে দেখতে হবে। টেকনিকস্ আর মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট।’ কুরোশাওয়া ছিলেন এই বর্গের নির্মাতা। পেইন্টার হওয়ার কারণে রং, কম্পোজিশন, লাইন, নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে তাঁর ছিল স্বচ্ছ জ্ঞান এবং দীর্ঘদিনের সহকারী পরিচালক জীবনে সাধিত হয়েছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ। সিনেমা বানানোর ক্র্যাফটটা হাতের মুঠোয় থাকায় সাবলীলভাবে ক্যামেরার দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিক বাস্তবতা নির্মাণের খেলা খেলতে পারতেন অনায়াসে।
আকিরা কুরোশাওয়াকে নিয়ে রচিত প্রায় সকল আত্মজীবনীর বরাতে, নির্মাতার নিজ জবান মারফতে আমরা জানতে পারি যে সিনেমা নির্মাণের প্রতিটা ধাপে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করা তাঁর স্বভাবধর্ম। কুরোশাওয়াকে ইন্টারভিউ করার পর এক সাক্ষাৎকারগ্রহীতার ভাষ্য ছিল এরকম – ‘অন্যদের সঙ্গে মিলে নিজে চিত্রনাট্য করেন, প্রোডাকশন ডিজাইন তত্ত্বাবধান করেন, কুশীলবদের নিয়ে মহড়া দেন, শুটিংয়ের দিন যাবতীয় আয়োজন নিশ্চিত করে তবেই ক্যামেরা ওপেন করেন এবং সম্পাদনার টেবিল তাঁর শেষ ঠিকানা।’ একটি সিনেমার সিনেমা হয়ে ওঠার সব কটি ধাপে সক্রিয় অংশগ্রহণ আকিরা কুরোশাওয়া উপভোগ করতেন। ১৯৫০-এর দশকের মধ্যে কুরোশাওয়া এমন কিছু কৌশল রপ্ত করেছিলেন, যা তাঁর ছবিগুলোকে অনন্য করে তুলত। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে কুরোশাওয়া একই সহযোগী সৃজনশীল কলাকুশলী, কর্মী বাহিনী এবং কুশীলবদের নিয়ে কাজ করে গেছেন। জাপানে কুরোশাওয়া ও তাঁর দলকে আদর করে ডাকা হয় কুরোশাওয়া-গুমি বা ‘কুরোশাওয়ার দল’ বলে। এই দলে ছিলেন সংগীত রচয়িতা ফুমিও হায়াসাকা, মাসারো সাতু, শিল ইচিরো ইকেবে প্রমুখ। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন আসাকায়ো নাকাই, তাকাই সাতো, কাজু মিয়াগাওয়া। শিল্প নির্দেশক হিসেবে ছিলেন ইয়োশিরো মুরাকি।
চিত্রনাট্য
চিত্রনাট্য সিনেমার সৌভাগ্যের প্রসূতি। কুরোশাওয়ার মতে, ‘চিত্রনাট্য, শুটিং ও সম্পাদনার মধ্যে সম্পাদনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু চিত্রনাট্য যদি ভালো না হয়, কোনোরকম সম্পাদনাই কোনো কাজে আসবে না।’ এ কারণেই একজন মিডিয়োকার চিত্রনির্মাতা ভালো একটা স্ক্রিপ্ট থেকে চলনসই সিনেমা তৈরি করতে সমর্থ হলেও একজন ওস্তাদ নির্মাতার পক্ষে বাজে স্ক্রিপ্ট থেকে উত্তম চলচ্চিত্র পয়দা করা সম্ভব হয় না। ইয়ামামোতো সর্বদা আকিরাকে বলতেন, ‘যদি ভালো চিত্রপরিচালক হতে চাও আগে চিত্রনাট্য লেখা শেখো।’ কুরোশাওয়ার একদল বাঁধা চিত্রনাট্যকার ছিলেন, ঘুরেফিরে তাঁদের সঙ্গে তিনি কাজ করতেন। যেমন, আইজিরো হিশাইতা, রিউজু কিকুশিমা, শিনোবু হাশিমোতো, হিদেও ওগুনি এবং মাসাতো ইদে। আর স্ক্রিপ্ট লেখার দিনগুলোতে নির্বাচিত চিত্রনাট্যকারসহ কুরোশাওয়া চলে যেতেন লোকালয় থেকে দূরে কোনো সরাইখানায়। যেন তিনি এবং তাঁরা নিত্যকার টানাপড়েন থেকে দূরে বসে সর্বোচ্চ অভিনিবেশ নিয়ে কাজটি সমাধা করতে পারেন। পাশাপাশি কুরোশাওয়া চিত্রনাট্য, চরিত্রের ডিটেইল সম্পর্কে বিশদ, বিস্তারিত ও কল্পনাপূর্ণ বর্ণনা টুকে রাখতেন। শুধু সেভেন সামুরাইয়ে তিনি ছয়টি নোটবুক ব্যবহার করেছিলেন। যাতে বোঝাই ছিল সাত সামুরাইয়ের চরিত্র বর্ণনা, যার মধ্যে ছিল প্রত্যেকের দৈহিক বিবরণ, তাদের পরিধান, টেবিল ম্যানার্স থেকে শুরু করে প্রত্যেকের জুতার ফিতা বাঁধার স্টাইল পর্যন্ত! তিনি যখন সাহিত্য থেকে চিত্রনাট্য করতেন তখন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে সাহিত্যকে পালটে নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। তাঁর মতে, চরিত্রগুলোর কায়া এবং সিনেমাটির আঙ্গিক উদ্ভূত হয় লেখনীর মধ্য দিয়েই।
শুটিং
আকিরা তাঁর প্রথমদিককার ছায়াছবিগুলোতে শুটিংয়ের সময় স্ট্যান্ডার্ড লেন্স এবং ডিপ ফোকাস লেন্স ব্যবহার করতেন আর চিত্রগ্রহণের মান কেমন ছিল পাঠকের তা নিয়ে প্রশ্ন করার আর অবকাশ আছে কি… যখন ছবিগুলোই আছে আমাদের চোখের সামনে। কিন্তু সেভেন সামুরাইয়ে (১৯৫৪) এসে সিনেম্যাটিক টেকনিকে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে, তিনি লং লেন্স ও মালটিপল ক্যামেরার ব্যাপক ব্যবহারে মেতে ওঠেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একাধিক কোণে ক্যামেরা স্থাপন করলে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তখন ক্যামেরা উপস্থিতির দিকে নজর না দিয়ে নিজেদের দায়িত্বটুকু আরো মনোযোগ দিয়ে পালন করতে পারেন এবং একাধিক পারস্পেক্টিভ থেকে ঘটনার ঘনিয়ে ওঠার মুহূর্তগুলো ফিল্মবন্দি করা সম্ভব হয়। একাধিক ক্যামেরা থাকার ইতিবাচক দিক স্বীকার করে তাৎসুয়া নাকাদাই বলেন, এর ফলে তাঁরা আরো সাবলীল অভিনয় করার সুযোগ পান। তবে এরকম নিরীক্ষার শক্তিশালী প্রভাব পড়ে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে, নির্দিষ্ট করে বলা যায় বৃষ্টির মধ্যে চূড়ান্ত সংঘর্ষের দৃশ্যটিতে। সমালোচক স্টিফেন প্রিন্স মনে করেন, লং লেন্সের বদলে সংঘর্ষ ক্ষেত্রে টেলিফটো লেন্স ব্যবহার করলে সামুরাই সিনেমার ইতিহাসে তা অভূতপূর্ব নজির রাখতে পারত।
রশোমনেও একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। সম্পাদনাকালে যখন যে ক্যামেরার শটটি সবচেয়ে ভালো মনে হয়েছে, সেটিকেই ব্যবহার করেছেন।
হিডেন ফোরট্রেসে এসে তিনি উপর্যুপরি ব্যবহার শুরু করলেন ওয়াইডস্ক্রিন বা অ্যানামরফিক প্রসেসর। পরবর্তী ছবিগুলোতে ওয়াইডস্ক্রিন, মালটিপল ক্যামেরা এবং লং লেন্সের ব্যবহার দুর্বার গতিতে বেড়ে গেলে ভিজুয়্যাললি নতুন নতুন সম্ভাবনা উঁকি-ঝুঁকি দিতে শুরু করে। যেমন লোয়ার ডেপথসের উদ্বোধনী দৃশ্যে এই তিনের চতুর প্রয়োগের ফলে একটি ছোট কামরায় উৎপাদিত হয় নাটকীয় স্নায়বিক চাপ এবং ক্যামেরার চলন যেন পায় মানবীয় ভাষা, যা বিনা বাক্য ব্যয়ে বুঝিয়ে দেয় ঘরে উপস্থিত মানুষেরা ক্ষমতা কাঠামোয় কোথায় কে অবস্থান করছে।
প্রতিটা দৃশ্য ‘পারফেক্ট’ হতে হবে বলে, তাঁর নাম ছিল ‘দ্য পারফেকশনিস্ট’। চলচ্চিত্র সৃষ্টির সময় স্বৈরাচারী হয়ে যেতেন বলে নাম হয় ‘এমপেরর’।
পোশাকসজ্জার ব্যাপারেও তাঁর পারফেকশনিস্ট চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি মনে করতেন, অভিনেতাকে সিনেমার শটের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পোশাক দিলে বিষয়টা বাস্তবসম্মত হয় না। এজন্য অনেক সময় তিনি অভিনেতাদের শুটিংয়ের এক সপ্তাহ আগে পোশাক দিয়ে দিতেন। অভিনেতাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই পোশাক পরতে হতো এবং পোশাকের সঙ্গে নিজের বন্ধন বাড়িয়ে তুলতে হতো। বিশেষ করে সেভেন সামুরাই ছবিতে এটার দরকার পড়েছিল। কারণ এ ছবির লোকজন অধিকাংশই ছিল গরিব কৃষক। এ কারণে অভিনেতাদের বারবার বলে দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন কাপড় এমনভাবে পরে যে শুটিংয়ের সময় বোঝাই যায় সেটার অবস্থা ভালো না।
র্যান ছবির একটি দৃশ্যে বিশাল দুর্গ প্রাসাদ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এজন্য শিল্প নির্দেশক ইয়শিরো মুরাকিকে দিয়ে মাউন্ট ফুজির ওপরে আলাদাভাবে একটি দুর্গ সেট তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। এই দুর্গটি তৈরিই করা হয়েছিল পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
সম্পাদনা
চলচ্চিত্রকে বলা হয় সময়কে কাজে লাগানোর শিল্প, এই সময়কে পরপর গেঁথে আখ্যান তৈরি করা হয় সম্পাদনার টেবিলে। আকিরা বলেন, ‘সম্পাদনা কক্ষেই প্রকৃত জীবনের সূচনা হয়। সেই ধরনের জীবন ও গতি যা আমি চাই। … সহকারী পরিচালক রূপে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমি জেনে গিয়েছিলাম যে সম্পাদনা করতে না জানলে চিত্রপরিচালক হওয়া যায় না। বাছাই-সংযোজনের শেষ পর্ব এই সম্পাদনা। তার চেয়েও বড় কথা, নির্মিত ছবির মধ্যে গতিসঞ্চার ও জীবনসৃষ্টির পদ্ধতিই হচ্ছে সম্পাদনা।’ আকিরা কুরোশাওয়া পরিচালনার পাশাপাশি নিজেই সম্পাদনা করতেন। এই সব বিশিষ্ট গুণ চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।
প্রোডাকশন চলাকালীন প্রতিদিন একটু একটু করে সম্পাদনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। এই অভ্যাস যথার্থভাবে তাঁকে সাহায্য করে যখন তিনি মালটিপল ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করা শুরু করেন। কারণ এর ফলে প্রতিদিন একরাশ ফুটেজ জমা হতো এবং শুটিং শেষে প্রতি সন্ধ্যায় বসে প্রথমে রাশ ফুটেজ দেখতেন এবং তারপর সম্পাদনা টেবিলে বসে যেতেন। ফলে দেখা যেত শুটিং করতে বেশি সময় নিলেও পোস্ট প্রোডাকশনে কখনো অতিরিক্ত সময় লাগত না। যেমন ১৯৬১ সালে ইয়োজিম্বোর স্থানীয় প্রিমিয়ার ছিল ২০ এপ্রিল। আর শুটিং শেষ হয়েছিল এপ্রিলের ১৬ তারিখে। সম্পাদনার প্রশ্নে সহযোগীরা তাঁকে তুলনা করতেন কম্পিউটারের সঙ্গে। তাঁদের মতে, প্রযুক্তিগত লিনিয়ার এডিটিং করতে হলেও কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর কুরোশাওয়ার মস্তিষ্কের কারখানায় অবিরাম চলত নন-লিনিয়ার এডিটিং! সম্পাদনার ক্ষেত্রে কুরোশাওয়ার সিগনেচার ট্যুল ছিল ওয়াইপের ব্যবহার। সিনেম্যাটিক পাঙ্কচুয়েশনের ক্ষেত্রে ওয়াইপের এত বহুল ব্যবহার আর কারো ছায়াছবিতে দেখা যায় না। ওয়াইপের পাশাপাশি তিনি স্ট্রেইট কাট ও ডিজল্ভেরও ব্যবহার করেছেন। তবে ওয়াইপকে তিনি নিয়ে গেছেন স্ট্রেইট কাট ও ডিজল্ভের বিকল্প শৈল্পিক স্তরে। হিসাব করে দেখা গেছে, ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলে কমসেকম বারো বার ওয়াইপ ব্যবহার করেছেন। কুরোশাওয়ার সম্পাদনাশৈলীর আরেকটি দিক হলো তিনি সচরাচর এক শটে কাজ সারতেন না বরং একটা অ্যাকশনকে টুকরো টুকরো করে সাজাতেন। এর ফলে একটা আপাত সাধারণ দৃশ্যে আবেগের আবেশ ছড়িয়ে দেওয়া যেত।
প্রকৃতি ও জল-হাওয়া
কুরোশাওয়ার ছবির আরেকটি বড় ট্রেডমার্ক হলো ইমোশন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আবহাওয়ার সাহায্য নেওয়া। যেমন, রশোমনের শুরুর দৃশ্যের অঝোরে বৃষ্টিপাত, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে সেভেন সামুরাইয়ের শেষ যুদ্ধের দৃশ্য, স্ট্রে ডগের প্রচণ্ড উত্তাপ, ইয়োজিম্বোতে প্রচণ্ড শীত, ইকিরুতে তুষারপাত এবং থ্রোন অব ব্লাডে কুয়াশা।
রশোমনই প্রথম ছবি, যা সরাসরি সূর্যের আলোতে চিত্রায়িত, কুরোশাওয়া প্রাকৃতিক আলোতে শুট করতে চাইতেন, কিন্তু বনে গাছপালার ভেতর দিয়ে যে আলো আসত তা চিত্রায়ণের জন্য দুর্বল, এ সমস্যা সমাধানে কুরোশাওয়া আয়না ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন দিক থেকে আয়নায় আলো প্রতিফলিত করা হতো, সে প্রতিফলিত আলো রিফ্লেকটিং বোর্ডে ফেলা হতো। এতে সূর্যের আলোতে শুটিং করা হলেও কখনো তা তীব্র মনে হয়নি। ছবির শুটিংকালে সচেতনভাবে আলোকে ভালোর এবং ছায়াকে খারাপের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছবিতে যে বৃষ্টির পানি দেখানো হয়েছে তাতে ক্যালিগ্রাফিক কালি মেশানো ছিল। কারণ সাদা-কালো ছবিতে স্বচ্ছ পানির বৃষ্টি তেমন বোঝা যেত না।
সেভেন সামুরাইয়ের তুমুল বৃষ্টির দৃশ্যটি অবশ্যই কৃত্রিমভাবে আয়োজন করা হয় কিন্তু দেখে কে বলবে যে এটি প্রকৃতির দান নয়! এই দৃশ্য সম্পর্কে স্টিফেন প্রিন্স মনে করেন – ‘The final battle [in Seven Samurai] is a supreme spiritual and physical struggle, and it is fought in a blinding rainstorm, which enables Kurosawa to visualize an ultimate fusion of social groups… but this climactic vision of classlessness, with typical Kurosawan ambivalence, has become a vision of horror. The battle is a vortex of swirling rain and mud… The ultimate fusion of social identity emerges as an expression of hellish chaos.’ ইয়োজিম্বোতে তিনি বায়ুকে ব্যবহার করেছেন রূপক হিসেবে। বায়ুর গতিবেগের তারতম্যের মধ্য দিয়ে চরিত্রদের ভাগ্যের অনুকূল ও প্রতিকূল দশাকে দ্যোতিত করেছেন।
বৃষ্টি নিয়ে আকিরা কুরোশাওয়ার একধরনের অবশেসন আছে। একটা গল্প আছে এরকম…
প্রিয় পরিচালক জন ফোর্ডের সঙ্গে একবার কুরোশাওয়ার দেখা হয়। ‘অলটাইম’ চোখে সানগ্লাস পরে থাকা ফোর্ড কুরোশাওয়াকে বলেন, ‘আপনি বৃষ্টি সত্যি ভালোবাসেন, না?’
কুরোশাওয়া একটু হাসেন, ‘তার মানে, আপনি আমার সিনেমা বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখেছেন!’
ধ্বনি ও সংগীত
অন্য অনেক বিষয়ের মতো ধ্বনি ও সংগীতের ব্যবহার সম্পর্কে কুরোশাওয়া প্রাথমিক ধ্যান-ধারণাটা পেয়েছিলেন গুরু ইয়ামামোতোর কাছ থেকেই। তাঁর কাছ থেকেই শিখেছিলেন আবহধ্বনি ও ইমেজের সঠিক মেলবন্ধের মধ্য দিয়েই ছায়াছবির নিজস্বতার সৃষ্টি হয়। আকিরা মনে করেন, ‘চলচ্চিত্রে ধ্বনি শুধুমাত্র দৃশ্যের সঙ্গী নয়। প্রকৃত ধ্বনি শুধুমাত্র ইমেজের সঙ্গে সংযোজিত হয় না, এর উৎকর্ষ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।’ আর সংগীত বিষয়ে তাঁর মতামত হলো, ‘সংগীত যেন একাধারে সুর (মেলোডি), ছন্দ (রিদম), ঐকতান (হারমোনি) এবং অন্যধারে যা কিছু দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক ও দৃশ্যমান – এই দুইয়ের মধ্যে সংযুক্তি পরিপূর্ণরূপে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারে। অর্থাৎ সংগীত যেন খালি শব্দ, কোনো অর্থ নেই এমন না হয়।’ সংগীতের ব্যবহারের ক্ষেত্রে আকিরার কাজে একধরনের আয়রনিক দশা লক্ষ করা যায়। যেমন, ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেলে আখ্যানের অন্তিমে গ্যাংস্টার মাৎসুনাগার ক্ষয়িষ্ণু দৃশ্যে জে ই জোনাসনের ‘কুকু ওয়াল্টজে’র ব্যবহার পুরো দৃশ্যে একধরনের শ্লেষ ছড়িয়ে দেয়।
সংগীতের এরূপ প্রয়োগ আকিরার ছবির সাধারণ গুণ। যেমন আমরা আরো দেখি স্ট্রে ডগে চরম পরিণতির দৃশ্যে ডিটেক্টিভ মুরাকামি ও খুনি ইয়োসা কর্দমাক্ত মাঠে ক্রোধোন্মত্তভাবে যখন ধস্তাধস্তি করছে তখন অদূর থেকে হঠাৎ প্রশান্তি নিয়ে ভেসে আসে মোৎজার্টের সোনাটার সুর!
চার
‘আমি মনে করি আমার সব ছবিরই একটা সাধারণ বিষয়বস্তু রয়েছে। সেই সাধারণ বিষয়টি হলো প্রকৃতপক্ষে একটি প্রশ্ন : মানুষ কেন সুখী হতে পারে না?’
বর্ষণপ্রিয় আকিরা কুরোশাওয়ার চলচ্চিত্রগুলো তারল্যভরা। তাঁর ছবির দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে জড়িয়ে থাকে পেলব সান্দ্রতা। কুরোশাওয়া আমাদের ভ্রমণ করান না কোনো পরাবাস্তব জগতে অথবা আচমকা জাম্প কাট করে মুখোমুখি করেন না ঝাঁঝালো
বাস্তবতার। দস্তয়ফস্কি, তলস্তয় ও তুর্গেনেভের উপন্যাসগুলোর চেতনায় তিনি অন্বেষণ করেন সেইসব উপাদানের, যা ব্যক্তিমানুষের বাস্তবতা গড়ে তোলে, তিনি আরো অনুসন্ধান করেন ওই চন্দ্রমল্লিকা ফুল, যার সুবাসে মানুষ অনুভব করতে জানে স্বীয় বাস্তবতাকে। কুরোশাওয়া আমাদের শিখিয়েছেন বিগত অতীত নিয়ে দুঃখভারাক্রান্ত না হয়ে বর্তমানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে। তাঁর কথায়, ‘আমি নিজেও আমার অতীতে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে অনাগ্রহী। আমার ছবির নায়কেরাও তাদের অতীতকে অবহেলা করে এবং তারা ঘটমান বর্তমানেরই অংশ।’
আকিরার সিনেমার প্রেক্ষাপট হিসেবে বারবার ফিরে এসেছে আশাহীন পৃথিবী। আর তাঁর চরিত্ররা প্রতিনিয়ত আশা অক্ষুণœ রাখার জন্য সংগ্রামরত থাকে। পাঠক জানবেন, এই সংগ্রাম শুধুমাত্র আকিরা কুরোশাওয়ার ছবির মানুষদের সংগ্রাম নয়… এটি আপামর জনসাধারণের সংগ্রাম। তাই যুদ্ধবিরোধী, পরমাণু বোমাহীন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, নিসর্গপ্রেমী, শান্তিকামী সকল মানুষই এই সংগ্রামের সমান অংশীদার।
উল্লেখযোগ্য সিনেমাসমূহ : সুগাতা সানশিরো (১৯৪৩), স্ক্যান্ডাল (১৯৫০), রশোমন (১৯৫০), ইকিরু (১৯৫২), দ্য সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), দ্য হিডেন ফোরট্রেস (১৯৫৮), থ্রোন অব ব্লাড (১৯৫৭), রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫), দেরসু উজালা (১৯৭৫), কাগেমুশা (১৯৮০), র্যান (১৯৮৫), ড্রিমস (১৯৯০), র্যাপসোডি ইন আগস্ট (১৯৯১), মাদাদায়ো (১৯৯৩)।
তথ্যসূত্র
১. পাল, অতনু (সম্পা.), ১৯৯৬, নিজের কথা, কলকাতা : বাণীশিল্প
২. আচার্য, নির্মাল্য, পালিত, দিব্যেন্দু (সম্পা.), ২০০৫, শতবর্ষে চলচ্চিত্র (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
৩. ফিরদাউস, ইমরান (সম্পা.), ২০০৭, দূর প্রাচ্যের চলচ্চিত্রকথা, ফ্ল্যাশব্যাক, বর্ষ ১১, সংখ্যা ১, ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ
৪. দে শুট পিকচার্স। ০১,
, http:// www. cadetcollegeblog. com/ mohib/ 11780
5. Akira Kurosawa, http://en.wikipedia.org/wiki/Akira_Kurosawa
6. Biography for Akira Kurosawa, http://www.imdb.com/name/nm0000041/bio
7. Gosling, Chris, Akira Kurosawa : Master of Cinema by Peter Cowie, http://tinyurl.com/b8l7avl
৮. হক, আশরাফুল, স্মরণ : আকিরা কুরোশাওয়া রশোমনের স্রষ্টা,
তারিখ : ০৩-০৯-২০০৯, http://tinyurl.com/a45tvdh
৯. রহমান, মুম, আকিরা কুরোশাওয়ার রশোমন,
তারিখ : ১০-০৮-২০১২, http://tinyurl.com/b39r9f3
১০. হক, ফাহমিদুল, আকিরা কুরোশাওয়ার সাক্ষাৎকার (অনুবাদ), http://tinyurl.com/a8r3nv7
১১. আরিফ, রুদ্র, তারেক মাসুদের সাক্ষাৎকার, http://tinyurl.com/b5sdocg