ত প ন ভ ট্টা চা র্য
দুহাজার এগারোর ডিসেম্বরে (পাঁচ থেকে চব্বিশ) আচার্য নন্দলাল বসুর একটা উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী হয়েছে কলকাতার আকার-প্রকার গ্যালারিতে। এই প্রদর্শনীর বিষয় হলো, সাধারণভাবে পোস্টকার্ডে আঁকা ছোট সাইজের নন্দলালের ড্রইং। এছাড়া ছাপাই ছবি, সচিত্রকরণের নিদর্শন ইত্যাদিও রয়েছে। নানান মাধ্যমেও তিনি এঁকেছেন, যেমন পেনসিল ড্রইং, তেমন কালি, কলম, তুলি, জলরং, মিশ্র মাধ্যম ইত্যাদি।
নন্দলাল বসুর সারা জীবনের কাজে ড্রইং একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়ে রয়েছে। এমনো বলা যায় যে, প্রধান ভূমিকাই নিয়েছে তাঁর বিচিত্র ও ভিন্ন ভিন্নভাবে করা ড্রইংগুলি। ড্রইংয়ের মাধ্যমে তিনি যেন জীবন ও প্রকৃতির ক্রমাগত নিদর্শন ধরে রাখছেন, ড্রইংগুলি হয়ে উঠেছে দৃশ্যমান ডায়েরির মতো। দৃষ্টিগোচর কিন্তু সৃষ্টিশীল একটা জগৎ ক্রমাগত আঁকা হয়ে চলেছে। যত ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে নন্দলাল কাজ করেছেন, তার সবকিছুর নিদর্শন রয়ে গেছে এই ড্রইংগুলিতে এবং শিল্পীর যে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া তাও জানা যায় এই ড্রইংগুলি মারফত। যেহেতু এই ড্রইংগুলি করা হয়েছে সাধারণত প্রকৃতির ভেতর বদ্ধ ঘরের বাইরে, তাই এসবের সরাসরি উপস্থিতি যেমন রয়েছে, তেমন তারা খুবই অভিব্যক্তিপূর্ণ। শুধু লাইনেও কী সুন্দর এঁকেছেন তিনি!
ড্রইংয়ে এক বিচিত্র, ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা তৈরি করেছিলেন নন্দলাল। তাঁর ড্রইং যেমন স্বতোৎসারিতভাবে করা, তেমন তাঁর একটা গঠনের দিকও রয়েছে। যেমন অনেক কাজেই পশ্চিমি অ্যাকাডেমিক ধরন রয়েছে, ছায়া-তাপের খেলাও লক্ষ করা যায়, তেমন দূর পূর্বের চীনা-জাপানি ড্রইং স্টাইলও নজরে আসে। তাঁর অসংখ্য নিসর্গচিত্র, ল্যান্ডস্কেপগুলি ফরাসি শিল্পী পাউল সেজানের ড্রইংয়ের কথা মনে পড়ায়। সেজানের ড্রইংয়ের সংবেদনশীলতা নজরে পড়ে নন্দলালের গ্রামের ঘরবাড়ি, গাছপালা, পাথর, নদীজল ইত্যাদির ড্রইংগুলিতে। তার অসংখ্য ড্রইংই সুন্দর ও true to life, যা দর্শকের সঙ্গে একটা সরাসরি সম্পর্ক নির্মাণ করে। ড্রইং নন্দলালের কাছে কেবল প্রারম্ভিক বা প্রস্তুতি পর্বের সূচনা নয় অন্য কোনো মাধ্যমে বড় কাজের জন্য বরং তা একটা নিটোল সম্পূর্ণতা। নন্দলালের এমন কিছু ড্রইং রয়েছে যা জেন্ কবিতার মতোই আনন্দদায়ক। যেমন ১৪.১০.৪৮-এ করা একটা খুবই ছোট সমুদ্র-দৃশ্য এতটাই সম্পূর্ণ এবং এমন প্রকাণ্ডতা রয়েছে সেই ছবিতে যে অবাক করে। তেমন জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা টাক ডুমা ডুম ডুম বইটির সচিত্রকরণে এমন ছায়া-শরীর নির্মাণ করেছেন তিনি, যা আজকের বিখ্যাত আমেরিকান শিল্পী কারা ওয়াকারকে মনে পড়ায়।
চারপাশের জগতের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গেই ড্রইং করে ফেলার ভেতর গ্রহণ-বর্জনের ক্রিয়া চলে অনবরত, নন্দলালের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টি একেবারে অব্যর্থভাবে প্রয়োজনীয়কেই শুধুমাত্র স্থান দেন ছবিতে। তাঁর ড্রইংয়ের ভারসাম্য কখনই অনাবশ্যক ভারী হয়ে ওঠে না, গ্রহণ-বর্জনের ভেতরই হালকা থাকে তা। ফলে শিল্পীর চোখ বলে তা অত্যন্ত রকমের সক্রিয় হলেই এমন হতে পারে। নানান শিল্প-পরম্পরা অধ্যয়নের ভেতর দিয়েই নন্দলাল তাঁর পরিণত বয়সে এমন শিল্পীর চোখ নির্মাণ করেছিলেন। কখনো সেই ড্রইংয়ের ভেতর কিছু লিখে তাকে আরো অন্তরঙ্গ করে তোলেন তিনি। দৃশ্যমান ডায়েরিটিও অন্য মাত্রা পায়।
আমরা জানি, পশ্চিমের একটা দীর্ঘ, অত্যন্ত সফল ড্রইং-পরম্পরা রয়েছে ড্যুর্রা, লিওনার্দো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, দেলাক্রোয়, সেজান প্রমুখ থেকে পিকাসো, মাতিস, জোসেফ বুই প্রমুখ পর্যন্ত। এমনই ড্রইং-পরম্পরা আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলায় নন্দলাল বসু শুরু করেন, যা শান্তিনিকেতনের অন্য শিল্পীরা যেমন বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, কে জি সুব্রাহ্মণ্যন আরো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যান। বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের কিছু কাজ রয়েছে যা সেজানকে মনে পড়ায় কিন্তু তাতে তাদের নিজস্ব মৌলিকতা নষ্ট হয় না। বিনোদবিহারীর রাজগীর ভূচিত্রগুলির কথা এখানে বলা হচ্ছে বা রামকিঙ্করের নানান পাহাড়ি দৃশ্য। দূর পূর্ব নিয়ে নন্দলালের উৎসাহ বিনোদবিহারীর ভেতরও সঞ্চারিত হয়েছিল।
সাধারণভাবে নন্দলাল বসুর ড্রইং সেক্যুলার বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। যেমন শান্তিনিকেতনের চারপাশের যে জনজীবন, যে সাঁওতালদের জীবন, অন্ত্যজ মানুষের জীবন, তা খুবই মানবিকভাবে নন্দলালের ড্রইংয়ে এসেছে। এর ফলে শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকেনি, একটা সামগ্রিকতা তৈরি হয়েছে অঞ্চলটার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের। যেমন সামগ্রিকতা তাঁর ড্রইংগুলিতেও আমরা পাই, যা নির্মিত হয়েছে অ্যাকাডেমিক, দূর পূর্ব স্টাইল মিলিয়ে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন ভ্রমণেও গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতায় যে গ্রাম দেশের ছবি পাই আমরা, যে ছন্দে, সম্পূর্ণতায় তারা উপস্থিত হয়, যে তৃপ্তির পরিচয় থাকে তেমনই লক্ষ করি নন্দলালের এই ড্রইংগুলিতে। নন্দলাল যে শ্রমিকদের আঁকেন, তাঁরা সংগ্রাম বা আন্দোলনের সড়কি হিসেবে আসেন না, আসেন নিজের কাজে মনোযোগী মানুষ হিসেবে, যেমন ছুতোর মিস্ত্রি, ছিপ বানানো শ্রমিক, মাঝি বা জয়নগরের মোয়ার ফেরিওয়ালা ইত্যাদি। তাদের গৌরবান্বিত, মর্যাদাসম্পন্ন করে উপস্থিত করা হয়। এসব কারণেই নন্দলালের আবেদন ভারতীয় সংস্কৃতিতে এত উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011