রা মে ন্দু ম জু ম দা র
প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস পালন করা হয়। এ দিবস প্রচলন করে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) ডান্স কমিটি। বিশ্বের একজন খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী বা পরিচালককে এ দিবস উপলক্ষে বাণী প্রদানের জন্যে কেন্দ্রীয় আইটিআই থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২০০৯ সালে আইটিআইয়ের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাণী প্রদান করেছিলেন আকরাম খান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্তের দিন আমি নির্বাহী পরিষদে সভাপতিত্ব করছিলাম, তাই আমার জন্যে এটা ছিল বিশেষভাবে আনন্দ ও গর্বের। আকরাম খান তাঁর বাণীর শুরুতেই বলেছিলেন : ‘এই বিশেষ দিনটি সেই ভাষার প্রতি নিবেদিত যে ভাষা পৃথিবীর সব মানুষ বলতে পারে, যে ভাষা আমাদের শরীর ও আত্মার অন্তর্নিহিত ভাষা, যে ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষদের এবং একইসঙ্গে আমাদের সন্তানদের।’ প্যারিসে আইটিআই আয়োজিত নৃত্য দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তিনি নিজে সে বাণী পাঠ করেছিলেন। এরপর আকরাম খান তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যখন ‘দেশ’ প্রকল্পের প্রস্ত্ততি পর্বে বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন ব্রিটিশ কাউন্সিলের সৌজন্যে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হতে পেরেছিলাম।
একক নৃত্য প্রযোজনা ‘দেশ’-এর লন্ডনে উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ৪ অক্টোবর ২০১১-তে স্যাডলার্স ওয়েলস থিয়েটারে। পরপর কয়েকদিন ‘দেশ’ পরিবেশিত হয়। সৌভাগ্যক্রমে সে সময়ে আমি লন্ডনে ছিলাম এবং আকরাম খান কোম্পানির সৌজন্যে একটি প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। লন্ডনের এ প্রদর্শনীগুলোর প্রতিটিই ছিল মিলনায়তন পূর্ণ। কারণ ইতোমধ্যে আকরাম খান আন্তর্জাতিকভাবে নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। সুতরাং তাঁর এই নতুন নৃত্য পরিবেশনা দেখতে দর্শকদের আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। ২০০০ সালে আকরাম খান নৃত্যে অনন্যসাধারণ নতুন শিল্পী হিসেবে টাইম আউট লাইভ পুরস্কার লাভ করেন। তারপর থেকে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক স্বীকৃতি ও সম্মাননা এসেছে। আর ‘দেশ’ তাঁর সাফল্যের একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ২০১২-তে ‘দেশ’ ত্রয়োদশ ক্রিটিকস সার্কল ন্যাশনাল ডান্স অ্যাওয়ার্ডসে শ্রেষ্ঠ আধুনিক কোরিওগ্রাফির পুরস্কার লাভ করে এবং আকরাম খান লাভ করেন শ্রেষ্ঠ পুরুষ নৃত্যশিল্পীর পুরস্কার। একই বছর লন্ডনের সাউথ ব্যাংক স্কাই আর্টস অ্যাওয়ার্ডসে ‘দেশ’ নাচের ক্যাটাগরিতে পুরস্কার অর্জন করে।
লন্ডনের প্রদর্শনীর পর আমি যখন তাঁকে বলি যে, এ প্রযোজনাটি বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তখন তিনি বলেন যে সে ইচ্ছা তিনি শুরু থেকেই মনের ভেতর লালন করছেন। এ প্রযোজনার সঙ্গে আনুষঙ্গিক এত কিছু জড়িত যে, বাংলাদেশে আসা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ কাউন্সিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও অন্যদের সহায়তায় এ কঠিন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মতো মঞ্চ ছিল বলেই ‘দেশ’ প্রযোজনা করা সম্ভব হয়েছে। ভারতে অনেক আধুনিক মঞ্চ আছে। কিন্তু জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চের ওপরে এতটা খোলা জায়গা কোথাও নেই। এর জন্যে আমরা গর্ববোধ করতে পারি বৈকি। তবে প্রয়োজন এ স্থাপনাটির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের দেশে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে স্থাপনা হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কোনো অর্থ বরাদ্দ থাকে না।
আকরামের জন্মের আগেই তাঁর বাবা-মা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আকরামের বেড়ে ওঠা ব্রিটিশ সংস্কৃতির মধ্যে, তবে বাড়িতে তাঁর বাবা-মা সবসময় বাংলায় কথা বলতেন। ছোটবেলা থেকে আকরাম নাচ শিখেছেন, একটু বড় হয়ে ভারতে কত্থক নৃত্যে তালিম নিয়েছেন। ধ্রুপদী নৃত্যের সঙ্গে আধুনিক নৃত্যভঙ্গিমা মিলিয়ে তিনি তাঁর শিল্প সৃষ্টি করেন। তাঁর মনের ভেতরে যে সবসময় তিনি লালন করেন এক টুকরো বাংলাদেশ, তা চমৎকারভাবে ধরা দিয়েছে ‘দেশ’ নৃত্য পরিবেশনায়।
‘দেশ’ আকরাম খানের আত্মানুসন্ধানের গল্প। তাঁর আত্মপরিচয় খুঁজতে চেষ্টা করেছেন এ প্রযোজনায় – কখনো তিনি ফিরে গেছেন বাংলাদেশে আবার কখনো তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন তাঁর পরিচিত লন্ডনকে। ‘দেশ’ এক ব্যক্তির কাহিনিকে ছাড়িয়ে জন্ম দিয়েছে বৃহত্তর অনেক মানবিক প্রশ্নের – যে জন্যে প্রযোজনাটি এত দর্শকনন্দিত হয়েছে।
প্রযোজনার শুরুতেই আকরামকে আমরা দেখি হারিকেন হাতে মঞ্চের একপাশ থেকে এগিয়ে আসছেন। মঞ্চের মাঝখানে কবরের মতো এক লোহার গোলকে তিনি প্রচন্ড জোরে হাতুড়ি পেটান। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর পিতার সঙ্গে কাল্পনিক সংলাপ। কথা হয় চট্টগ্রামের এক অপারেটারের সঙ্গে তাঁর ফোনের ভয়েস মেইলের গোলমাল নিয়ে। অনেকটা সময় জুড়ে সম্ভবত তাঁর কন্যা ঈশিতার সঙ্গে কথা বলেন। এখানেই তিনি ঈশিতার কাছে সুন্দরবনের গল্প বলেন। বলেন দক্ষিণ রায় ও বনবিবির কথা। সুনদরবনকে মেলান লন্ডনের উইম্বলডন পার্কের সঙ্গে। তিনি যখন বাড়িতে নৃত্য অনুশীলন করছিলেন, তখন বারবার তাঁর বাবার ডাকে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর পিতার সঙ্গে যে প্রজন্মের ব্যবধান, সেটা এখানে ধরা দেয়।
এ প্রযোজনার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে নববইয়ের দশকে বাংলাদেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। ফিরে আসে নূর হোসেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে-পিঠে লেখা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত যে বাংলাদেশ, তার উত্থান-পতনের সঙ্গে আকরাম নিজেকে মেলাতে চান, কিন্তু বাস্তবতা তাঁকে বারবার দূরে ঠেলে দেয়। জন্ম দেয় তাঁর মধ্যে এক চরম অস্থিরতা।
শুরুতে যে কবরসদৃশ গোলক আমরা দেখেছিলাম, সেখান থেকে আকরাম তুলে নেন ছোট্ট একটি চারাগাছ। কবরের গহবর থেকে বের করেন তাঁর বাবার পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে যেন হঠাৎই অনুভব করেন তাঁর শেকড়ের সত্তা। কিন্তু তাও তাঁকে প্রশান্তি এনে দেয় না। নেপথ্যে উচ্চারিত সংলাপ তাঁর মানসিক দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। একপর্যায়ে ওপর থেকে নেমে আসা টুকরো টুকরো পর্দার মধ্যে ওপরে পা বাঁধা অবস্থায় মাথা নিচে দিয়েও পরিবেশন করেন নৃত্যভঙ্গিমা।
‘দেশ’ প্রযোজনার এক চমকপ্রদ অনুষঙ্গ এর কারিগরি নৈপুণ্য। অস্কার বিজয়ী শিল্প নির্দেশক টিম ইপ মঞ্চে রীতিমতো জাদু সৃষ্টি করেছেন। সুন্দরবনের জঙ্গল, চলন্ত হাতি, উড়ন্ত পাখি, নদীর ঢেউ – সবই ইন্টারঅ্যাকটিভ অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ ও সংগীত সংযোজন এক অসাধারণ আবহ সৃষ্টি করেছিল।
একপর্যায়ে আকরাম তাঁর কামানো মাথার ওপর মানুষের চোখ, মুখ এঁকে পাপেটের মতো তাকে ব্যবহার করেছেন। তার সঙ্গে সংলাপ বিনিময় করেছেন। ব্যাপারটির মধ্যে চমৎকার এক উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
আশি মিনিট ধরে আকরামের এই একক পরিবেশনার পেছনে যে কী প্রচন্ড শ্রম ও অনুশীলনের প্রয়োজন তা সহজেই অনুমান করা যায়। সারাক্ষণ মঞ্চে তাঁকে সক্রিয় থাকতে হয়েছে, অফুরন্ত এনার্জি দিয়ে প্রযোজনাটিকে টানটান উত্তেজনাপূর্ণ রাখতে হয়েছে।
আমরা যখন প্রযোজনাটি দেখি, তখন বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এর নানা ঐতিহাসিক ঘটনা বা সমাজবাস্তবতা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি; কারণ এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা পার হয়ে এসেছি। কিন্তু বিদেশে যারা কেউ এসব অনুষঙ্গের সঙ্গে পরিচিত নয়, তারা কেন এ পরিবেশনা দেখে এত মুগ্ধ হয়? সম্ভবত এর কারণ আকরাম খানের পরিবেশনার নৈপুণ্য। এ ক্ষমতা তিনি রাতারাতি অর্জন করেননি। এর জন্যে তাঁকে অনুশীলন করতে হয়েছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ‘দেশ’ তিনি পরিবেশন করেছেন অনেকবার। তা সত্ত্বেও ঢাকা এসে প্রতিদিন শিল্পকলা একাডেমির মহড়া কক্ষে মহড়া করেছেন। আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি এ ধরনের নৃত্য পরিবেশনার জন্যে কী শক্তির প্রয়োজন হয়, শরীরকে কতটা নমনীয় রাখতে হয়।
আমাদের বাংলাদেশে প্রধানত আমরা চিরাচরিত নৃত্যানুষ্ঠান দেখতেই অভ্যস্ত। শিক্ষার্থীরা ধ্রুপদী, আধুনিক বা লোকনৃত্য শেখার পর নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। কিন্তু আজকাল পশ্চিমা দুনিয়ায় অভিনয়ভিত্তিক যে আধুনিক নৃত্যকলা, তার চর্চা আমাদের এখানে নেই বললেই হয়। আমাদের বিবেচনায় শাস্ত্রীয় নৃত্য আয়ত্ত করে যদি তার সঙ্গে আধুনিক নৃত্যকলাকে মেশানো যায়, তবে নতুন ধারার নৃত্য পরিবেশনা আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। তার জন্যে চাই শিল্পীর উদ্ভাবনী চিন্তা। আকরাম খানের ‘দেশ’ যদি আমাদের নৃত্যশিল্পীদের মাঝে কোনো নতুন চিন্তার জন্ম দিতে সমর্থ হয়, তবেই এ বিশ্বনন্দিত পরিবেশনা বাংলাদেশে আয়োজন সার্থক হবে। অবশ্য আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের জন্যে তো ‘দেশ’ এক বিরল অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
নৃত্যানুষ্ঠানের দুদিনই নৃত্য পরিবেশনার পর আকরাম খান দর্শকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন লাজুক ভঙ্গিতে, হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে। এ পরিবেশনা দেখার পর তাঁর বাবার কী মন্তব্য ছিল – এ প্রশ্নের জবাবে আকরাম হাসতে হাসতে বলেন, ‘তিনি আমাকে বলেন – শুরুতেই আমাকে কবর দিয়ে দিলে?’ এ সফরে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাবা-মাও বাংলাদেশে এসেছিলেন। গর্বিত এ পিতা-মাতার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও গর্ববোধ করেছে আকরাম খানের জন্যে। এঁদের মতো মানুষরাই তো উজ্জ্বল করে চলেছেন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ। নিঃসন্দেহে আকরাম খান আমাদের সাংস্কৃতিক দূত।
ছবিগুলো তুলেছেন আলোকচিত্রী মিজানুর রহমান খোকা