সা গ র চৌ ধু রী
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা BBC-র প্রযোজিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো যেসব চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয় তাদের একটা হলো BBC-1, আরেকটা BBC-2, এবং এই দুটি চ্যানেলে সাধারণত যদিও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে তাদের বিষয়বস্ত্ত খানিকটা মিলেও যায়। BBC-1-এর একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের নাম ‘অ্যান্টিকস রোডশো’ (Antiques Roadshow), নাম থেকেই এটার বিষয়বস্ত্ত আন্দাজ করা হয়তো কঠিন নয়। ‘অ্যান্টিকস’, অর্থাৎ প্রাচীন, দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্রের অনুসন্ধান ও মূল্যায়ন করায় বিশেষজ্ঞ কয়েকজন ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের (কখনো-সখনো বিদেশেরও) নানা জায়গায় ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সংগ্রহ করা ওই ধরনের জিনিসপত্রের – পুরনো মুদ্রা, ছবি, অলংকার, তৈজসপত্র সবকিছুই হতে পারে – প্রাচীনত্ব, বিশুদ্ধতা, এখনকার বাজারে তাদের দাম কেমন হতে পারে ইত্যাদি যাচাই করেন এবং টেলিভিশন ক্যামেরায় তোলা তাঁদের এইসব কাজকর্মের ছবি ও বিবরণই অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। এই অনুষ্ঠানমালার প্রথমটা তৈরি ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়েছিল ১৯৭৭ সালে, এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ তারিখ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এক ঘণ্টার এই অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে। এর বিষয়বস্ত্তর ভিত্তিতে রচিত হোম অ্যান্ড অ্যান্টিকস (Home & Antiques) নামে একটা সাময়িক পত্রিকাও BBC-র তরফে প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাজ্যের বাইরে অন্য যেসব দেশে অনুষ্ঠানের আন্তর্জাতিক সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে তারা হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্র। BBC-1-এর এই অনুষ্ঠানের মতো হুবহু একই রকমের না হলেও অনেকটা একই ধরনের – বলা যেতে পারে একই ঘরানার আরেকটা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে BBC-2 চ্যানেল, যেটার নাম ‘কালচার শো’ (Culture Show)। দুষ্প্রাপ্য বা দুর্মূল্য জিনিসপত্র ছাড়াও, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত আরো নানা ধরনের বিষয়, যেমন সংগীত, সাহিত্য, অভিনয় ইত্যাদিও এ অনুষ্ঠানে স্থান পায়। দেশের বিভিন্ন মিউজিয়ামে বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা শিল্পকর্মের নিদর্শন, সময়ের চাপে মলিন, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া প্রাচীন ছবি বা অন্য কোনো জিনিস পরিষ্কার করে তার আসল চেহারা ফুটিয়ে তোলার প্রক্রিয়াও (restoration) টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়। এই অনুষ্ঠানটিও দর্শকদের কাছে যথেষ্ট প্রিয়।
BBC-র এই দুই চ্যানেলের দুই অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করার একটা খুবই মজার – ইন্টারেস্টিং – কারণ আছে। ‘অ্যান্টিকস রোডশো’ আর ‘কালচার শো’ এই দুই অনুষ্ঠানেই একই ব্যক্তিকে নিয়ে প্রায় হুবহু একই ধরনের, কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত, দুটি তথ্যচিত্র সম্প্রচারিত হয়েছে মোটামুটি এক বছরের ব্যবধানে, নিঃসন্দেহে coincidence বা সমাপতনের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এই ব্যক্তি হলেন অ্যান্টনি ভ্যান ডাইক (Anthony Van Dyck), যাঁকে সপ্তদশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লেমিশ (Flemish), অর্থাৎ উত্তর ফ্রান্স ও বেলজিয়াম অঞ্চলের ডাচ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীভুক্ত, চিত্রশিল্পী বলে মনে করা হয়। কারো কারো মতে অবশ্য ভ্যান ডাইকের স্থান নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ওই সময়ের আরেকজন বিখ্যাত ফ্লেমিশ চিত্রশিল্পী পিটার পল রুবেনসের (Peter Paul Rubens) পরেই, এবং ভ্যান ডাইক নিজেও রুবেনসের কাজকর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং তাঁর অঙ্কনশৈলীকে অনেকাংশে অনুসরণ করতেন। টিশিয়ান (Titian বা Tiziano) প্রমুখ ইতালীয় শিল্পীর প্রভাবও তাঁর কাজের ওপরে গভীরভাবে পড়েছিল।
ভ্যান ডাইকের জন্ম আনুমানিক ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে, বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প শহরে। খুব অল্প বয়স থেকেই তাঁর শিল্প-প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর প্রথম স্বাধীন কাজের যেসব নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলোর রচনাকাল সম্ভবত ১৬১৫-১৬ খ্রিষ্টাব্দ, যখন তাঁর বয়স সতেরো কিংবা আঠারো। পরবর্তীকালে তিনি একজন অত্যন্ত সফল প্রতিকৃতি শিল্পীতে পরিণত হন এবং মানুষের প্রতিকৃতি ছাড়াও ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনি-আশ্রিত বিষয়বস্ত্ত ও চরিত্রের ভিত্তিতে তাঁর অাঁকা ছবি বেলজিয়াম ও ইতালি দুই দেশেই ব্যাপকভাবে সমাদৃত হতে থাকে। নকশা রচনায় এবং ‘এচিং’ বা ‘এনগ্রেভিং’, অর্থাৎ ধাতুর পাতের ওপরে রেখাচিত্র খোদাই করাতেও তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তবে কালক্রমে তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি, সেইসঙ্গে প্রভূত সম্মান ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস এবং তাঁর সভাসদদের ও তাঁদের পরিবারবর্গের বেশকিছু দৃষ্টিনন্দন প্রতিকৃতি এঁকে। তাঁর আঁকা এইসব ছবির জন্যই প্রধানত আজকের যুগ তাঁকে একজন প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে মনে রেখেছে। ইংল্যান্ডের রাজপরিবার ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভ্যান ডাইকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, যখন রাজা ছিলেন প্রথম জেমস। তবে এর কিছুদিন পরেই তিনি ইতালিতে চলে যান এবং ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেদেশেই ছিলেন। এই ছয় বছরের বেশিরভাগটাই ভ্যান ডাইক কাটিয়েছিলেন জেনোয়া শহরে এবং একজন প্রতিকৃতি শিল্পী হিসেবে কেবল এই শহরে নয়, সেদেশের প্রায় সর্বত্রই প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ঐতিহ্যিকভাবে ‘দ্য বালবি চিলড্রেন’ (The Balbi Children) নামে পরিচিত, কারণ এটা পরবর্তীকালে পাওয়া যায় কনস্টানটিনো বালবি নামে অষ্টাদশ শতকের এক ব্যক্তির নিজস্ব সংগ্রহ থেকে। ছবিতে দেখা যায় জেনোয়ার কোনো অভিজাত পরিবারের তিনটি শিশুর পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি, তবে তাদের সঠিক পরিচয় জানা যায়নি। এছাড়া ভ্যান ডাইক ‘জেনোইজ প্যাট্রিসিয়ানস’ (Genoese Patricians) নামে পরিচিত অভিজাত যোদ্ধৃবৃন্দের একাধিক ছবি এঁকেছিলেন, যেগুলোও প্রতিকৃতি অঙ্কনে তাঁর মুন্শিয়ানার স্বাক্ষর বহন করে। জেনোয়ার পর ভ্যান ডাইক চার-পাঁচ বছর কাটিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসে, তারপর ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন মোটামুটি স্থায়ীভাবেই এবং রাজা প্রথম চার্লসের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য শিল্পী হিসেবে রাজার, রাজপরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিবর্গের প্রচুর ছবি অাঁকেন। ভ্যান ডাইকের অাঁকা প্রায় সমস্ত ছবিতেই রাজার ও তাঁর পরিবারের লোকজনের অতি সুঠাম ও ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক চেহারা চিত্রিত হয়েছে, যদিও বাস্তবে তাঁর মডেলরা হয়তো তেমনটা ছিলেন না। চার্লস নিজেই ছিলেন বেশ খর্বাকৃতি, তাঁর দৈহিক উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুটেরও কম, সুতরাং ভ্যান ডাইকের অাঁকা ছবিতে নিজের সুন্দর দেহসৌষ্ঠব দেখে তিনি নিশ্চয়ই পরিতোষ লাভ করতেন। প্রতিকৃতি অাঁকার সময়ে ভ্যান ডাইকের এই ‘ইচ্ছাকৃত অতিরঞ্জনের’ জন্যই চার্লসের সভাসদদের এবং অন্যান্য অভিজাত, ধনাঢ্য লোকজনের মধ্যে তাঁকে দিয়ে নিজেদের ছবি অাঁকানোর জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায় এবং শিল্পী জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির তুঙ্গে উঠে যান।
প্রথম চার্লস ছিলেন সমস্ত ব্রিটিশ রাজা-রানির মধ্যে শিল্পকলাসামগ্রীর সবচেয়ে উৎসাহী ও বদান্য সংগ্রাহক, এবং আর্ট বা শিল্পকলাকে তিনি দেখতেন রাজকীয় মর্যাদা ও আড়ম্বর সম্পর্কে নিজের রুচি ও ধারণাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার একটা মাধ্যম হিসেবে। ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীয় শহর মানতুয়ার শাসক গনজাগা পরিবার (Gonzagas of Mantua) তাদের অসাধারণ শিল্পকলা সংগ্রহ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় এবং চার্লস সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু কিনে নেন। এর তিন বছর আগে সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকেই চার্লস প্রথম শ্রেণির বিদেশি চিত্রশিল্পীদের ইংল্যান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইতালির টাস্কানি অঞ্চলের শিল্পী ওর্যাজিও জেন্টিলেসচিকে (Orazio Gentileschi) সপরিবারে ইংল্যান্ডে এসে বাস করতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। রুবেনসের ওপরেও তাঁর নজর ছিল এবং শেষ পর্যন্ত রুবেনস ইংল্যান্ডে আসেন ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক কূটনৈতিক মিশনের সদস্য হিসেবে, যদিও তিনি এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হননি। তবে প্রায় নয় মাসের মতো ইংল্যান্ডে বাস করার সময়ে তিনি বেশকিছু ছবি আঁকেন এবং অ্যান্টওয়ার্প থেকে রাজার জন্য আরো কিছু ছবি আনিয়েও দেন। তাঁর এই অবদানের জন্য রাজা চার্লস তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
জেনোয়া শহরে এবং নেদারল্যান্ডসে থাকার সময়েও ভ্যান ডাইক ইংল্যান্ডের রাজসভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন এবং রাজা প্রথম চার্লসের লোকজনকে বিভিন্ন দেশ থেকে ছবি সংগ্রহ করে আনায় সক্রিয় সাহায্য করেছিলেন। নিজের অাঁকা বেশ কয়েকটি ছবিও তিনি রাজকীয় সংগ্রহের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিল রাজার এক প্রিয় কর্মচারী এন্ডিমিয়ন পোর্টারকে সঙ্গে নিয়ে অাঁকা আত্মপ্রতিকৃতি, পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে অাঁকা একটি ছবি (রিনাল্ডো অ্যান্ড অ্যারমিডা, বর্তমানে আমেরিকার ভার্জিনিয়া রাজ্যের বাল্টিমোর মিউজিয়াম অভ আর্টের সংগ্রহে) এবং রাজপত্নী হেনরিয়েটা মারিয়ার জন্য অাঁকা একটি ধর্মীয় ছবি। চার্লসের ভগ্নি এলিজাবেথের (Queen Elizabeth of Bohemia) প্রতিকৃতিও তিনি এঁকেছিলেন নেদারল্যান্ডসের হেগ (the Hague) শহরে ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ওই বছরেরই এপ্রিল মাসে ভ্যান ডাইক লন্ডনে ফিরে আসেন, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে রাজসভায় সাদরে গ্রহণ করা হয়, জুলাই মাসে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি প্রদান করা হয় এবং তাঁর জন্য সাম্মানিক ভাতা নির্ধারিত হয় বছরে ২০০ পাউন্ড – আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে এটা ছিল একটা বিপুল অঙ্কের অর্থ, যা থেকে বোঝা যায় রাজা প্রথম চার্লসের কাছে এই শিল্পীর কদর কতটা ছিল। এই ভাতা প্রদানের সনদে ভ্যান ডাইকের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এইভাবে : Principalle Paynter in Ordinary to their Majesties (বানান সে যুগের লিখনরীতি অনুসারে)। সাম্মানিক এই ভাতা ছাড়াও তাঁর অাঁকা ছবির জন্য ভ্যান ডাইককে আলাদা করে অর্থ দেওয়া স্থির হয়েছিল, যদিও বাস্তবে রাজা চার্লস গোড়ার দিকের কয়েক বছর এই ভাতা দেওয়ায় গড়িমসি করেছিলেন এবং ছবির দামও যথেষ্ট কম দিয়েছিলেন। তবে লন্ডনের ব্ল্যাকফ্রায়ারস এলাকায় টেমস নদীর তীরে তাঁকে একটা বাড়ি দেওয়া হয়েছিল এবং শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে ‘এলথাম প্যালেস’ নামে একটা প্রাসাদের অংশবিশেষ তাঁর বিশ্রামাবাস হিসেবে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্ল্যাকফ্রায়ারসে ভ্যান ডাইকের স্টুডিওতে রাজা ও রাজপত্নীর আগমন ঘটত প্রায়শই, এবং ভ্যান ডাইকের জীবদ্দশায় তাঁরা নিজেদের প্রতিকৃতি অাঁকানোর জন্য কখনোই অন্য কোনো শিল্পীর সামনে বসেননি।
ভ্যান ডাইকের জীবনাবসানকে অকালমৃত্যুই বলা যেতে পারে কারণ ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে পরলোকগমনের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৩ বা ৪৪। রাজকীয় আড়ম্বরের সঙ্গে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা হয় লন্ডনের বিখ্যাত সেইন্ট পলস ক্যাথিড্রালের আঙিনায়। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন রাজা, রাজপত্নী ও সভাসদবর্গ ছাড়াও অগণিত অনুরাগী চিত্রশিল্পপ্রেমিক। জীবদ্দশায় অ্যান্টনি ভ্যান ডাইক তাঁর অাঁকা ছবি থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন কিন্তু স্থাবর সম্পত্তি রেখে যেতে পেরেছিলেন অতি সামান্যই। কারণ জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য তিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। তাঁর জীবনযাত্রার মান ছিল যেন ঠিক চিত্রশিল্পীর মতো নয়, বরং রাজার, রাজপুত্রের মতো।
এবারে BBC-র দুই চ্যানেলের দুই টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ। যে দুটি সমাপতনিক ঘটনার কথা আগে উল্লেখ করেছিলাম তাদের একটি ঘটেছিল ২০১২ সালে। ইংল্যান্ডের উত্তর ডার্বিশায়ার অঞ্চলে অসহায়, বৃদ্ধ লোকজনের জন্য এক গির্জার আশ্রয়াবাস পরিচালনা করতেন একজন যাজক, ফাদার জেমি ম্যাকলিয়ড। স্থানীয় প্যারিশ বা গির্জার এলাকার যেসব লোক উপাসনা বা অন্যান্য কারণে নিয়মিত গির্জায় যাতায়াত করত তাদের একজন একটা পুরনো ছবি গির্জাকে উপহার দেয়। এই ছবিটি কেনা হয়েছিল চেশায়ার অঞ্চলের একটা প্রাচীন জিনিসপত্র বিক্রির দোকান থেকে, চারশো পাউন্ড দামে। এর কিছুদিন পরে BBC-র কর্মীরা ‘অ্যান্টিকস রোডশো’ অনুষ্ঠানমালার নতুন সংস্করণ তৈরির কাজে ওই অঞ্চলে যাওয়ার পর ফাদার জেমি ওই পুরনো ছবিটা তাঁদের কাছে নিয়ে যান। ছবিটা দেখেই অনুষ্ঠানের প্রযোজক ও তাঁর সহযোগীদের ধারণা হয় যে সেটা হয়তো কেবলমাত্র একটা সাধারণ পুরনো ছবি অথবা কোনো বিখ্যাত শিল্পীর অাঁকা ছবির কপি নয় এবং সেটাকে তাঁরা নিয়ে যান অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়ামের (Ashmolean Museum) ডিরেক্টর, সপ্তদশ শতকের, বিশেষ করে ভ্যান ডাইকের অাঁকা ছবির বিষয়ে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ ড. ক্রিস্টোফার ব্রাউনের কাছে। ড. ব্রাউন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছবিটার ওপরে বহু যুগের জমে থাকা ময়লার আস্তরণ পরিষ্কার করার (অর্থাৎ সেটা restore করার) পর নিশ্চিত হন যে এটা স্বয়ং ভ্যান ডাইকেরই অাঁকা আসল ছবি, কোনোরকম কপি বা নকল নয়। এই ছবিটাও একটা প্রতিকৃতি এবং ভ্যান ডাইক এটা এঁকেছিলেন ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরের একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে মডেল করে। ড. ব্রাউন বলেন যে ছবিটা বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হলে তার দাম উঠবে কমপক্ষে চার লাখ পাউন্ড, আরো বেশি হলেও তিনি মোটেই আশ্চর্য হবেন না। ফাদার জেমির প্রতিক্রিয়া? তিনি বলেছেন, ‘এটা একটা দারুণ খবর এবং অবিস্মরণীয় মানসিক অভিজ্ঞতা।’ তাঁর গির্জার অতি প্রয়োজনীয় কিছু মেরামতের কাজ তিনি এখন সহজেই করাতে পারবেন আর দরকারি কিছু সরঞ্জাম কেনাও সম্ভব হবে। আর শিল্পকলারসিকদের, বিশেষত ভ্যান ডাইকের অনুরাগীদের কাছে তো তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছবির পুনরাবিষ্কার অবশ্যই একটা বিরাট প্রাপ্তি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ২০১৩ সালের। উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের ডারহ্যাম শহরের বোওজ মিউজিয়ামে (Bowes Museum) কয়েক দশক ধরে সংরক্ষিত একটা ছবিকে ধরে নেওয়া হয়েছিল ভ্যান ডাইকের অাঁকা একটা আসল ছবির কপি হিসেবে, যেটা সম্ভবত তৈরি করা হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে, অর্থাৎ শিল্পীর মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে। ছবিটা এক মহিলার প্রতিকৃতি, যার পরনে রুপালি ও সোনালি সাটিনের গাউন, গলায় ও কানে বহুমূল্য মুক্তার অলংকার, লম্বা কোঁকড়ানো চুলে গোঁজা একটা লাল রঙের ফুল। এই মহিলা ছিলেন রাজা প্রথম চার্লসের পত্নী হেনরিয়েটা মারিয়ার এক সহচরী, অলিভিয়া বোটেলার পোর্টার। মহিলার স্বামী এন্ডিমিয়ন পোর্টার (যাঁকে নিজের পাশে নিয়ে শিল্পী একটা আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন) ছিলেন ভ্যান ডাইকের বন্ধু এবং ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে অলিভিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ছবিটা অাঁকা হয়েছিল। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে সম্প্রচারিত BBC-2-এর ‘কালচার শো’ অনুষ্ঠানে এই ছবিটা সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিটাকে restore করে তার মূল চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াও অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে। কয়েকশো বছর ধরে ছবির ওপরে জমা ধুলোময়লা, পুরনো বার্নিশ অত্যন্ত সতর্কতা ও যত্নের সঙ্গে পরিষ্কার করে, যে রং দিয়ে ছবিটা অাঁকা তার নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করানো হয়, ‘কার্বন ডেটিং’ পদ্ধতিও এই পরীক্ষার অংশ, যা থেকে কোনো বস্ত্তর বয়সের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়। পরীক্ষক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ড. ক্রিস্টোফার ব্রাউনও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, অলিভিয়া বোটেলার পোর্টারের এই প্রতিকৃতি ভ্যান ডাইকের নিজেরই অাঁকা, দুশো বছর পরে তৈরি নকল নয়। ‘কালচার শো’ অনুষ্ঠানের এই সংস্করণের উপস্থাপক, যিনি একজন শিল্পকলা ইতিহাসবিদ এবং মূল্যবান ছবি বেচাকেনা যাঁর পেশা, বলেছেন, ‘ভ্যান ডাইকের আঁকা যে-কোনো প্রতিকৃতির পুনরাবিষ্কারই একটা অত্যন্ত বিরল ঘটনা, তবে ইংল্যান্ডে তাঁর প্রিয় বন্ধুদের একজনের পত্নীর প্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া তো চরম সৌভাগ্যের বিষয়। ছবির বাজার সম্পর্কে আমার নিজের যা অভিজ্ঞতা তার ভিত্তিতে বলতে পারি যে, এই ছবিটা যদি কপি হিসেবেই এবং ময়লা অবস্থায় নিলামে তোলা হতো তাহলে দাম পাওয়া যেত বড়জোর তিন থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড। কিন্তু আসল বলে প্রমাণিত হওয়ার পর এটার দাম হবে হেসেখেলে কমপক্ষে এক মিলিয়ন (দশ লাখ) পাউন্ড।’
এই দুই ঘটনাকে সমাপতনের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?