ত প ন ভ ট্টা চা র্য
ষাটের দশকে ভারতে যেসব শিল্পী পরিচিত হন, তাঁদের মধ্যে শিল্পী ভিভান সুন্দরম্ অন্যতম। বরোদার এম এস বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি ষাটের দশকে। ষাটের দশকেই বিমূর্ত, যন্ত্র ইত্যাদি ছবি থেকে বেরিয়ে এসে যাঁরা আখ্যানমূলক চিত্রকলায় পারদর্শিতা দেখান, যেমন বরোদার শিল্পীরা – ভূপেন খাক্কর, গুলাম শেখ, নীলিমা শেখ; তেমনই একজন ছিলেন ভিভান সুন্দরম্। ভিভান শিল্পীদের পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মাসি ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী অমৃতা শেরগিল (১৯১৩-৪১) এবং মা-মাসির তরফে দাদু ছিলেন ফটোগ্রাফার ওমরাও সিং শেরগিল। ১৯৮৩-৮৪ সালে ভিভান প্রায় নয় ফিটের (২২৭ দ্ধ ১৭৫ সেমি) এক বিশাল ক্যানভাসে তেলরঙের ছবি আঁকেন, যার বিষয় ও নাম হলো ‘The sher-gil family’। ছবিতে মাসি অমৃতাকে একটা ক্যানভাসে ছবি আঁকতে দেখি, আরেকদিকে দেখা যায় ভিভানের মা ও অন্যদিকে হাঙ্গেরিয়ান দিদিমা বসে আছেন। এবং খোলা দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে দেখা যায় ওমরাও সিংকে। আলোছায়ায় থাকা চরিত্রগুলো যে যার নিজস্ব জগতে রয়েছে, যা পরস্পরের ভেতর দিয়ে বইলেও ক্রমাগত বিচ্ছিন্নও তারা। এরা যে যার ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
এই ছবি দিয়েই শুরু, তারপর ক্রমাগত শৈল্পিকভাবে ভিভান তাঁর নিজের পরিবারের ভেতর মনোনিবেশ করে চলেন। তিনি অমৃতা শেরগিলের সৃষ্টিশীলতা ও উপস্থিতিকে নির্মাণ ও বিনির্মাণ করেন নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই। শেরগিল পরিবার নিয়ে তিনি একটা উপস্থাপনা শিল্প (installation art) করেন ১৯৯৫ সালে, যার নাম দেন ‘The sher-gil archive’, যেখানে তিনি চিঠি, পোশাক, ফটোগ্রাফ, বাক্স ইত্যাদির সহযোগিতা নেন। তারপর ২০০১ থেকে ওমরাও সিংয়ের করা পুরনো ফটোগ্রাফকে কম্পিউটারে appropriate করে নির্মাণ করেন digital photo montage। এক্ষেত্রে নানা পুরনো ফটোগ্রাফকে তিনি ডিজিটালে মেশান এবং তাতে নতুন করে কাহিনি নির্মাণ করেন। ভিভানের আগের করা চিত্রকলাটিই যেন ফটোগ্রাফিক মন্তাজে কত ভিন্ন রূপ নিয়ে নিল। তবু সাধারণভাবে ওমরাও সিংয়ের ছবিগুলো ছিল পারিবারিক ফটোগ্রাফ, অসংখ্য ছবি, যার ভেতর প্রতিভাময়ী কন্যা অমৃতা শেরগিলের ও নিজের ওরিয়েন্টাল উপস্থিতিতে আত্মপ্রতিকৃতিগুলো ডিজিটাল উপায়ে হয়ে ওঠে রহস্যময়, বিয়োগান্ত নাটক, ক্যানাইডোস্কোপিক পুনর্নির্মাণ, পিতা ও কন্যার সম্পর্ক, তাঁদের যৌনতা ও তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ও উপস্থিতি ঘিরে আরো কত নাটক হয়, যা অনুভূতি ও তীব্রতায় অনন্য হয়ে ওঠে আন্তন চেকভের নাটকের মতোই। সাদা-কালোর তীব্রতা এই ডিজিটাল ফটো মন্তাজগুলোকে এমন এক রূপকল্প দিয়েছে, যা একই সঙ্গে অভিজাত ও নশ্বর। কখনো মনে হয়, কোনো দূর অতীতের চাঁদনী রাতে নারী-পুরুষের এই নাটকগুলো হয়ে চলেছে। উজ্জ্বলতা ও মৃত্যুর ভেতর অস্তিত্বের কত যে টানাপড়েন, একরূপতা সেখানে ক্রমাগত মিলিয়ে যায় এবং তাই নানা অনুভবে, পরিচয়চিহ্নে ফুটে ওঠে।
ওমরাও সিং শেরগিলের পুরনো ফটোগ্রাফকে এই যে নতুনভাবে অধিকার করা এবং নতুন শিল্পীর সাপেক্ষে সাজিয়ে তোলা তাকে আমরা উত্তরাধুনিক উপায় বলেও ভাবতে পারি। ফলে ভিভান সুন্দরম্ ছবি আঁকার দিক থেকে শিল্পী যোগেন চৌধুরী, গুলাম শেখ প্রমুখের সমসাময়িক হয়েও পরবর্তীকালে নানা মাধ্যমে অক্লান্ত প্রয়াসের জন্য উত্তরাধুনিক প্রবক্তাও হয়ে ওঠেন। ভিভান ভারতীয় শিল্পে নব্যপন্থী আন্দোলনের পুরোধা নিঃসন্দেহে।
ভিভান এমন ফটোগ্রাফকে ডিজিটালভাবে মিলিয়ে দিচ্ছেন, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন অনুভবে তোলা। এতে ঐতিহাসিক যে সময়কাল তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে, কিন্তু তা আজকের একজন শিল্পীর ক্রিয়ায় কাব্যিক নির্মাণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের সময়কাল ও দৃশ্যকল্প মিলে যে খেয়াল রসের রচনা, তা অনুভব করে আমাদের উচ্ছ্বসিত হতেই হয়। এইভাবে আধুনিক অমৃতা শেরগিলকেও উত্তরাধুনিক অবস্থানে এনে ফেলেন ডিজিটাল ফটো মন্তাজের সাহায্যে ভিভান সুন্দরম্। এই ফটো মন্তাজগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, পশ্চিমি সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির যোগাযোগ নির্মাণ করা। প্রায়ই অমৃতা ও তাঁর বোন ইন্দিরা কখনো পশ্চিমের, কখনো প্রাচ্যের পোশাকে উপস্থিত হয়। বরং ওমরাও সিং তাঁর লম্বা দাড়িতে, পাগড়িতে এবং কৌপীনে প্রাচ্য উপস্থিতি হয়ে ওঠেন এবং অমৃতাদের হাঙ্গেরিয়ান মা কেবলই পশ্চিমি থেকে যান গাউনে, পিয়ানো বাজানোয়। ভিভানের এই ফটো মন্তাজগুলোতে ফিগারগুলোর উপস্থিতি, অবস্থানও নানা ইশারায় চিহ্নিত।
এই ফটো মন্তাজগুলোর পর ভিভান সুন্দরম্ আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন শিল্পী অমৃতা শেরগিলকে নিয়ে। তা হলো, অমৃতা শেরগিলের চিঠি ও লেখা দুই খণ্ডের বইতে প্রকাশ করা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এমন উচ্চমানের সম্পাদনা ও প্রকাশনা ভারতীয় বইয়ের ক্ষেত্রে বিরল। চিঠিগুলোর ভেতর দিয়ে যে অমৃতা উঠে আসে, তার সাংস্কৃতিক মান, রুচিবোধ, অঙ্গীকার এবং অসহায়তাও এত তীব্র ও উচ্চমানের যে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। সাধুবাদ দিতেই হয় ভিভান সুন্দরম্কে এত সুন্দরভাবে বইটা সম্পাদনা করার জন্য। বইটার নাম হলো jv Amrita Sher-gil a self-Portrait in letters and writing|বইটা তুলিকা প্রকাশন দিল্লি থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011