দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আমাদের প্রিয় কাইয়ুম ভাই এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর। কিন্তু তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে এখনো তিনি বেঁচে আছেন এবং আমরা তাঁকে প্রতিনিয়তই কাছে পাই তাঁর অবিস্মরণীয় সব স্মৃতিতে। এমনি এক স্মৃতি তাঁর আমেরিকায় আসার।
আমাদের একমাত্র সন্তান আসিফ জন্মলগ্ন থেকেই কাইয়ুম ভাইয়ের অপার স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত। তিনি তাকে এতটাই ভালোবাসতেন যে ১৯৭৬ সালে আমাদের ওয়াশিংটনে আসার আগে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই হয় তিনি শামিত্মনগরে আসতেন আমাদের বাড়িতে, আর না হয় আমাদের যেতে হতো আসিফকে নিয়ে আজিমপুরে তাঁর কাছে। আমরা আমেরিকায় আসার পর তিনি বেশ কিছু ছড়া লিখলেন আসিফকে নিয়ে এবং সেগুলো বই আকারে প্রকাশ করলেন বাংলা একাডেমি থেকে। শিশু মনোরঞ্জনের অপূর্ব সেই ছড়ার বই। তারপর দিন-রাত খেটেখুটে ছবি আঁকলেন বেশ কিছু এবং সেসব ছবি বিক্রির পয়সায় টিকিট কেটে আমেরিকায় এলেন কাইয়ুম ভাই আর তাঁর পত্নী। আমার স্ত্রীর বড় বোন, শিল্পী তাহেরা চৌধুরী আসিফকে দেখার জন্য।
কাইয়ুম ভাই আমেরিকায় ছিলেন চার মাসের মতো এবং এ সময়টা আমাদের কেটেছে এক অনন্য আনন্দঘন পরিবেশে। আমাদের তখন মনে হতো আমরা ঢাকায়ই আছি।
ওয়াশিংটনে প্রথম কয়েক সপ্তাহ কেটেছে কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে নানা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে। ওয়াশিংটন আমেরিকার রাজধানী ছাড়াও এখানে আছে এদেশের দুশো বছরেরও বেশি স্বাধীনতার ইতিহাসের নানা নিদর্শন। আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে – এসব নিদর্শনের প্রায় প্রতিটিরই ইতিহাস কাইয়ুম ভাইয়ের জানা।
তারপর তাঁকে নিয়ে গেছি ওয়াশিংটনের সব বিখ্যাত মিউজিয়াম দেখতে। জন স্মিথসন নামে একজন ইংরেজ দানবীরের দেওয়া অর্থে ওয়াশিংটনে গড়ে উঠেছে প্রায় চলিস্নশটি মিউজিয়াম। এসব মিউজিয়াম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর। পশ্চিমি দুনিয়ার একমাত্র এখানেই মিউজিয়ামের জন্য কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না দর্শনার্থীদের। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্পকলার বিশাল সব মিউজিয়াম :
ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট, মডার্ন পেইন্টিং মিউজিয়াম, স্যাকলার গ্যালারি, হাবহর্ন গ্যালারি অব আর্টস, স্কাল্পচার গার্ডেন, পোর্ট্রেট গ্যালারি, আমেরিকান আর্ট মিউজিয়াম, আমেরিকান হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, আর্কাইভস অব আমেরিকান আর্টস, আর্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বিল্ডিং, ফ্রিয়ার গ্যালারি অব আর্ট, রেনউইক গ্যালারি, আফ্রিকান-আমেরিকান মিউজিয়াম এবং অন্য আরো অনেক মিউজিয়াম। এছাড়া আছে রেড ইন্ডিয়ানদের ইন্ডিয়ান-আমেরিকান মিউজিয়াম, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মিউজিয়াম ‘নিউজিয়াস’ এবং বিশাল বাইবেল মিউজিয়াম। মাত্র চার মাসে এগুলোর সব দেখা সম্ভব নয়। তবু কাইয়ুম ভাই যতটা পেরেছেন দেখেছেন।
ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট মিউজিয়ামে কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে গেছি প্রায় প্রতিদিন। বিশাল এই মিউজিয়ামে আছে বিশ্ববিখ্যাত সব শিল্পীর মধ্যে – লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মিকেল এঞ্জেলো, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, গোইয়া, রেনোয়াঁ, রেমব্রান্ট, মাতিস, ক্লদ মনে, পাবলো পিকাসো, জ্যাকসন পোলোক, সালভাদর দালি, দিয়েগো রিভেরা, অ্যান্ডি ওয়ারহল, নরম্যান রকওয়েল প্রমুখের শিল্পকর্ম। এর প্রায় প্রতিটির সামনে কয়েক ঘণ্টা ধরে এবং কোনো কোনো সময় প্রায় সারাদিন দাঁড়িয়ে দেখেছেন কাইয়ুম ভাই বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে।
তার মধ্যে তাঁর একটি চিত্রকর্ম দেখার ঘটনা আজো আমার দৃষ্টিপটে স্পষ্ট। মিউজিয়ামের একটি কক্ষক্ষ ছিল ঊনবিংশ শতকের ইমপ্রেশনিজম আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ফরাসি শিল্পী ক্লদ মনের ছবি। তাঁর একটি বিখ্যাত শিল্পকর্ম দেখছিলেন কাইয়ুম ভাই দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে। আমি তাঁর সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারিনি, পাশে একটি লম্বা টুলে বসে পড়েছিলাম। হঠাৎ কাইয়ুম ভাই আবেগাপস্নুত কণ্ঠে আমাকে ডাকলেন – বললেন, ‘আমাকে একটু ধরো, আমার সারা শরীর কাঁপছে।’ আরো বললেন, ‘আমি ভাবতে পারিনি মনের আঁকা এই অরিজিনাল পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়াব।’ আমি তাঁকে ধরে দেখলাম, সত্যি সত্যি তাঁর শরীর কাঁপছে। তিনি শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছিলেন শিল্পকলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এক শিল্পী ক্লদ মনের অনন্য এক শিল্পকর্ম।
ওয়াশিংটনে গল্প-আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন কাইয়ুম ভাই। তারপর সেসব ছবির একটি প্রদর্শনী করা হয়েছে ঘটা করে এবং তাতে দর্শক সমাগম ঘটেছে প্রচুর। এছাড়া ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ সমিতি একটি আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনায় সম্মানিত করেছে তাঁকে। এসব নিয়ে কাইয়ুম ভাইয়ের একটি বিশদ সাক্ষাৎকার প্রচার করেছি ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠানে।
কাইয়ুম ভাই পরে ওয়াশিংটন থেকে পেনসিলভানিয়া রাজ্যের ঐতিহাসিক ফিলাডেলফিয়া শহরে গেছেন আমেরিকার স্বাধীনতার অনন্য সব নিদর্শন দেখতে। সেখানে বিশেষ উৎসাহ নিয়ে দেখেছেন বিশাল ‘লিবার্টি বেল’ – স্বাধীনতার ঘণ্টা, আর ইনডিপেনডেন্স হল। এই ইনডিপেডেন্স হলে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে গৃহীত হয়েছে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং পরে আমেরিকার সংবিধান।
কাইয়ুম ভাই দ্বিতীয়বার সস্ত্রীক আমেরিকায় আসেন ২০০৮ সালে – বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কানাডার টরন্টো আর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে তাঁদের চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষক্ষ। প্রদর্শনী শেষ করে কাইয়ুম দম্পতি আসেন ওয়াশিংটনে। সে সময় তাঁরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন মাসখানেক। ওয়াশিংটন থেকে পরে তাঁরা গিয়েছিলেন পশ্চিম উপকূলে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো শহরে কাইয়ুম ভাইয়ের বড় ভাইয়ের ছেলে সাঈদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে। সান ফ্রান্সিসকো তাঁর খুব ভালো লেগেছিল। এছাড়া তাঁরা লস এঞ্জেলেসেও গিয়েছিলেন। পরের বার কাইয়ুম দম্পতি পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে গিয়েছিলেন তাঁদের ছেলের কাছে। ছেলে জাবের তখন পিএইচডি করছিল সেখানে।
কাইয়ুম ভাই আর খোকন আপা (কাইয়ুমপত্নী শিল্পী তাহেরা চৌধুরী) তৃতীয়বার আসেন ওয়াশিংটনে ২০১২ সালে। তখনো তাঁরা এসেছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পীদের চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষক্ষ। তাঁদের নিয়ে এসেছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের —– শিল্পী সুবীর চৌধুরী। আর সঙ্গে ছিলেন কাইয়ুম ভাইয়ের ছেলে জাবেরের শ্বশুর-শাশুড়ি সাংবাদিক-কবি আবুল মোমেন ও সংগীতশিল্পী শীলা মোমেন। ওয়াশিংটনে আমাদের বাড়িতে তখন এই পাঁচজন অতিথি নিয়ে আনন্দমুখর জমজমাট সময়।
মাঝখানে সুবীর চৌধুরী আর কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে মেরিল্যান্ড রাজ্যের রকভিলে আমাদের বাড়ির কাছের প্রখ্যাত শিল্পকলা ভবন স্ট্র্যাথমোর হাউসে। আমেরিকান অপেরা ও উচ্চাঙ্গ সংগীতানুষ্ঠান এবং চিত্রপ্রদর্শনীর জন্য এই স্থান সুপরিচিত। সুবীর চেয়েছিলেন পরের বছর এখানে বাংলাদেশি শিল্পীদের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের। এ নিয়ে আমরা সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছি।
কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না অদৃষ্টের কারণে। পরের বছর আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম বেড়াতে। ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে আসার আগের দিন সুবীর আর সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত কাইয়ুম ভাই আর আমাকে আপ্যায়ন করেছিলেন ঢাকা ক্লাবে নৈশভোজে। সে সময় সুবীরকে বলেছিলাম – ‘আসছেন তো আগামী বছর ওয়াশিংটনে চিত্রপ্রদর্শনী করতে?’ সুবীর কিছু বলার আগে তাঁর পক্ষ থেকে কাইয়ুম ভাই জোর দিয়ে বলেছিলেন – ‘সুবীর তো যাবেই, আমিও যাব।’ বিধাতার কী বিধান – ওই বছরই সুবীর চলে গেলেন এবং তার পরে পরেই ৩০ নভেম্বর চলে গেলেন কাইয়ুম ভাইও না-ফেরার দেশে।
কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে হাসি-আনন্দ, সুখ-দুঃখ, বিষাদ-বেদনার এসব স্মৃতি চির ভাস্বর আমাদের, তাঁর পরিবার-পরিজনের হৃদয়ে। প্রতিনিয়তই। কেবল তাঁর প্রয়াণ দিবসে নয়।