logo

অবিস্মরণীয় সব স্মৃতিতে কাইয়ুম ভাই

সৈয়দ জিয়াউর রহমান

আমাদের প্রিয় কাইয়ুম ভাই, বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আজো আমরা তা ভাবতে পারি না। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকা থেকে টেলিফোন পেয়ে আমরা ওয়াশিংটনে বসে বাংলাদেশের টেলিভিশনে দেখেছিলাম ঢাকায় উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনের মঞ্চে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে কীভাবে তিনি ঢলে পড়লেন চিরনিদ্রার কোলে। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য আজো আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় – এখনো আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। তবে এটা সত্য যে, এই নশ্বর জগতে তিনি আর নেই। এখন কেবল আমাদের কাছে রয়ে গেছে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনার কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি। এই স্মৃতি নিয়েই আমরা তাঁকে স্মরণ করি। আমরা তাঁকে কাছে পাই।
১৯৬০-এর দশকের শুরম্ন থেকে কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে ছিল আমার অমত্মরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পরে এই সম্পর্ক পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয় বৈবাহিক সূত্রে। ১৯৭০ সালে তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কাইয়ুম ভাই।
মনে পড়ে ১৯৬২ সালে কাইয়ুম ভাই তাঁর বিয়ের বছর দুয়েক পরে থাকতেন ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় একটি বাড়ির দোতলায়। সেখানে প্রায়ই হানা দিতাম বিকেলের দিকে – উদ্দেশ্য আড্ডা আর গান শোনা। কাইয়ুম ভাইয়ের সংগ্রহে ছিল তখনো পুরনো দিনের অনেক ভালো ভালো বাংলা গানের রেকর্ড। একদিন এমনি এক বিকেলে হাজির হয়েছি তাঁর বাড়িতে প্রখ্যাত শিল্পী দিলীপ কুমার রায়ের গান শোনার জন্য। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন কবি জসীমউদ্দীন। এসেই হাঁক দিলেন – ‘কাইয়ুম কোথায়, বাংলার কবি এসেছে তোমার ঘরে। তাঁর জন্য
চা-টার ব্যবস্থা করো।’ কাইয়ুম ভাই কবিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন – ‘চা-টা তো উপলক্ষ মাত্র, বাংলার কবির আসল উদ্দেশ্যটা কী?’ তিনি অনুমান করেছিলেন, কবি জসীমউদ্দীন তাঁর নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের যে প্রচ্ছদ তাঁকে অাঁকতে দিয়েছেন তার অগ্রগতির তাগিদ দিতেই সম্ভবত এসেছেন। কিন্তু কবি বললেন – ‘আজকে এসেছি তোমার কাছে গান শোনার জন্যে। ডিএল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের গানের কোনো রেকর্ড আছে তোমার কাছে?’ কাইয়ুম ভাই হেসে বললেন – ‘আপনারা আজ দুজনেই কি কোনো যুক্তি করে এসেছেন?’ জসীমউদ্দীন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন – ‘কী রকম?’ কাইয়ুম ভাই বললেন – ‘জিয়াও এসেই বলেছে দিলীপ কুমার রায়ের গান শুনবে, আপনিও তাই বললেন!’ কবি এবার আমাকে অনেকটা বিস্ময়ের কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন – ‘তুমি কি দিলীপ কুমার রায়কে জানো?’ বললাম – ব্যক্তিগতভাবে জানার তো কোনো উপায় নেই। তবে সওগাত সম্পাদক নাসিরম্নদ্দীন সাহেবের কাছে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। তাঁর সঙ্গে নাসিরম্নদ্দীন সাহেবের ছিল ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জসীমউদ্দীন সাহেব বললেন – ‘কলকাতায় দিলীপ কুমার রায়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সামনে বসে গান শুনেছি।’ পরে আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন – ‘কাইয়ুম আমার চা-টা কোথায়?’ আমি জসীমউদ্দীন সাহেবকে বললাম, ‘আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ চা-টার কথা বলার জন্য। কারণ আমি চায়ের কথা বলেছি, কিন্তু সেই সঙ্গে ‘টা’-এর কথা বলতে পারিনি চক্ষুলজ্জায়।’ কবি বললেন – ‘তোমাকে একটা উপদেশ দেই, কখনো খাবার ইচ্ছার কথাটা পেটে চেপে রাখবে না, প্রকাশ করবে।’ কাইয়ুম ভাই আমাকে ঠাট্টা করে বললেন, ‘আজ আপনার একটা বাড়তি লাভ হলো – এই উপদেশ!’ কবি জসীমউদ্দীনের এই উপদেশ ভুলিনি কখনো!
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমি ইউএসআইএসের তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের কাজে নিয়োজিত। ঊনসত্তরের ডিসেম্বরের শেষদিকে একদিন কাইয়ুম ভাই এলেন তোপখানা রোডে প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে ইউএসআইএসের দোতলায় আমার অফিসে। বললেন – ‘আপনার সঙ্গে একটা জরম্নরি কথা বলতে এসেছি।’ বললাম – ‘বলুন।’ তিনি বললেন, ‘আপনাকে একটু বাইরে আসতে হবে।’ আমার মনে হলো, তিনি হয়তো এমন কোনো জরম্নরি কথা বলতে এসেছেন, যা এই ঘরে – আমার আরেক সহকর্মী বসেন – তার সামনে বলতে চাইছেন না। কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে আমার অফিস-ঘরের বারান্দায় এক কোনায় এসে দাঁড়ালাম। কাইয়ুম ভাই কথা শুরম্ন করলেন। বললেন, ‘আপনার মেজ মামি থাকেন নিউমার্কেটের সামনে আজিমপুর ফ্ল্যাটে, তিনি এসেছিলেন আমার শ্বশুরবাড়িতে।’ আমি ভাবলাম, এটা কী এমন জরম্নরি কথা। আজিমপুর শেখসাহেব বাজার রোডে কাইয়ুম ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি আমার মামির ফ্ল্যাট থেকে হেঁটে যাওয়ার পথ, সেখানে মামি যেতেই পারেন। কাইয়ুম ভাই হেসে বললেন, ‘আরো কথা আছে – এক মহিলা ঘটক আপনার মেজ মামিকে আমার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি আমার শ্যালিকাকে পছন্দ করেছেন আপনার জন্যে।’ বললাম, ‘সে কী, আমি তো কিছুই জানি না।’ কাইয়ুম ভাই বললেন – ‘পরদিন আপনার আম্মাকেও নিয়ে এসেছিলেন। তিনিও পছন্দ করেছেন। আপনাকে বলেননি, আপনি হয়তো মেনে নিতে চাইবেন না, তাঁরা ঠিক করেছেন, আপনার মামাকে দিয়ে বিয়ের কথাটা বলাবেন। কারণ তাঁর কথা আপনার মেনে না নেওয়ার কোনো উপায় থাকবে না।’ তারপর কাইয়ুম ভাই হঠাৎ করে আমার একটা হাত ধরলেন এবং কিছুটা আবেগের কণ্ঠে বললেন – ‘আমাকে কতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন?’ বললাম – ‘শতভাগ’। হেসে বললেন – ‘তাহলে একটা কথা বলি, আমার শ্যালিকার সঙ্গে বিয়ের প্রসত্মাবটা মেনে নেবেন। আপনি ঠকবেন না – এই আশ্বাস দিতে পারি।’ তারপর ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে আমাদের বিয়ে হলো। কাইয়ুম ভাইয়ের আশ্বাস শতভাগ সঠিক হয়েছে – আমাদের বিবাহিত জীবনের ৪৬ বছর পরও। আমি ঠকিনি – জিতেছি। আর তার জন্য ঋণী হয়ে থেকেছি কাইয়ুম ভাইয়ের কাছে সারাজীবনের জন্য।
বিয়ের পর কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বড় ভাইয়ের মতো। তিনি আমার চেয়ে ছয় মাসের বড়। কিন্তু কাইয়ুম ভাই সম্পর্কের দূরত্বটা ভেঙে দিলেন আগের মতোই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে।
তারপর বছরখানেকের মধ্যেই শুরম্ন হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমরা থাকতাম শাহজাহানপুর এলাকায়। জায়গাটা খুব একটা নিরাপদ ছিল না। কাইয়ুম ভাই আমাদের জন্য বাড়ি ঠিক করে দিলেন সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় – চারদিকে বাগান আর গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটি দোতলা বাড়ির নিচের তলার পুরোটা। নির্জন কিন্তু নিরাপদ। বাড়ির দেয়ালের পেছনে বড় একটি মাঠ, তার পরই কাইয়ুম ভাইয়ের বাবার বাড়ি। তিনি প্রতিদিন আসতেন আজিমপুর থেকে এবং আমাদের নিয়ে যেতেন তাঁর বাবার বাড়িতে। যুদ্ধের সর্বশেষ খবরাখবর নিয়ে আলোচনা করতাম আমরা সেখানে। সে সময় ঢাকার সংবাদপত্রে, রেডিওতে পাকিসত্মানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নানা নির্দেশ আর যুদ্ধের মিথ্যা খবর ছাড়া আর কিছু থাকত না। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে অনেকেই তখন স্বাধীন বাংলা বেতার আর অল-ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের খবর শুনতেন কানের কাছে রেডিও ধরে। সে সময় ইউএসআইএসের কূটনৈতিক-ব্যাগে আসত টাইম, নিউজউইক সংবাদ সাময়িকী আর ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমসের মতো সব পত্র-পত্রিকা। সেগুলোতে থাকত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং তার পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমতের উৎসাহজনক নানা সংবাদ।
সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই আসতেন এসব পত্র-পত্রিকা পড়তে। মাঝেমধ্যেই আমি এগুলো সংগোপনে বাড়ি নিয়ে আসতাম আর এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতেন ইউএসআইএসের তথ্য বিভাগের কর্মকর্তা গ্রান্ট পার। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জোরালো সমর্থক। কাইয়ুম ভাই বললেন, ‘আমি কয়েকজনকে বলে রেখেছি তোমার এখানে আসার জন্যে – তবে সাবধান থেকো, চেনাজানা না হলে বাড়িতে ঢুকতে দিও না কাউকে।’ একদিন এক সন্ধ্যায় এলেন আগাগোড়া চাদর-মোড়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক –
দাড়ি-গোঁফে মুখের প্রায় সবটাই আচ্ছন্ন। বললেন – ‘আপনার কাছে নাকি আমেরিকান পত্র-পত্রিকা আছে?’ বললাম – ‘আপনাকে তো চিনতে পারছি না।’ বললেন, ‘আমি আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম আমাকে পাঠিয়েছে।’ শিল্পী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল। বললাম – ‘আপনাকে তো চেনাই যায় না!’ বললেন – ‘পরিস্থিতি বাধ্য করেছে আমার এই বেশ ধারণে।’ শিল্পী আমিনুল ইসলামের মতোই আসতেন দাড়ি-গোঁফে আচ্ছন্ন অপরিচিত বেশে আমাদের বন্ধুকবি হাসান হাফিজুর রহমান, আহমদ রফিক, খোরশেদ আলম ও আরো অনেকে। বেশিরভাগ সময়ই কাইয়ুম ভাই বসে থাকতেন জালঘেরা বাইরের বারান্দায় সতর্ক প্রহরায়।
একদিন কাইয়ুম ভাই এসে বললেন – ‘চলো কিবরিয়া সাহেবকে উদ্ধার করতে হবে। আর্ট কলেজের শিক্ষক প্রখ্যাত শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া কলেজের যে হোস্টেলে থাকতেন সেখানে পাকিসত্মানি বাহিনী হামলা চালিয়েছে ব্যাপকভাবে এবং অন্য আরো কয়েকজনের সঙ্গে কিবরিয়া সাহেবও হোস্টেলের সামনের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। কাইয়ুম ভাই আমাকে নিয়ে প্রথমে গেলেন আর্ট কলেজে সিনিয়র শিক্ষক আনোয়ার সাহেবকে ওঠাবার জন্য। কারণ তিনি জানেন কিবরিয়া সাহেব এখন কোথায়। আনোয়ারম্নল হক সাহেব আমাদের নিয়ে গেলেন কিবরিয়া সাহেবের আশ্রয়স্থলে। সেখান থেকে কিবরিয়া সাহেবকে নিয়ে আমরা গেলাম ধানম–তে এক বাড়ির সামনে। আনোয়ার সাহেব বললেন – ‘কিবরিয়ার প্রণয়িনী থাকে এই বাড়িতে, সে আমাদের আর্ট কলেজের ছাত্রী। সে এখন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কেবলি কানণাকাটি করছে, কারণ তার বিশ্বাস আর্ট কলেজের হোস্টেলে পাকিসত্মানি বাহিনী যে আক্রমণ চালিয়েছে তাতে কিবরিয়ার বেঁচে থাকার কথা নয়।’ আনোয়ার সাহেব কাইয়ুম ভাইকে বললেন – ‘এখন আমাদের দায়িত্ব ওই মেয়ের হাতে কিবরিয়াকে তুলে দেওয়া, তাতে কিবরিয়ার একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে।’ আনোয়ার সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ হলো। কিবরিয়া সাহেব তখন একটা সার্বক্ষণিক ভীতিতে আচ্ছন্ন, কেবলই কাঁপছেন, কথা বলতে পারছেন না। কাইয়ুম ভাইয়ের এ উদ্যোগ না হলে সেদিন কিবরিয়া সাহেবের উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সম্ভব হতো কি না সন্দেহ।
মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই একদিন পাকিসত্মানি সৈন্যদের একটি দল তাদের দোসর আলবদরের কয়েকজনকে নিয়ে আজিমপুরে আমার শ্বশুরবাড়িতে হামলা চালায় – এবং আমার স্ত্রীর বড় বোনের ছেলে তিতুমীর কলেজের বি.কম ক্লাসের ছাত্র বাবুলকে ধরে নিয়ে যায়। বাবুল ছিল নিরীহ গোবেচারা গোছের, সে কেবল পড়াশোনা আর রেডিওর গান শোনা নিয়ে থাকত। আসলে আমার শ্যালক মনি ছিল মুক্তিযোদ্ধা। তাকে ধরতেই পাকিসত্মানিদের এই অভিযান। কিন্তু তাকে না পেয়ে হাতের কাছে থাকা বেচারা বাবুলকে ধরে নিয়ে যায় নরপশুরা। এরপর কাইয়ুম ভাই আর আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি বাবুলকে ঢাকা শহরের থানায় থানায় – সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে অসংখ্য তরম্নণকে ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে পাকিসত্মানিরা। পরে একদিন খবর পাওয়া গেল, বাবুলকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে মিরপুর ব্রিজের ওপর থেকে নিচে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাবুলের সঙ্গে আর যে-কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাকিসত্মানি সৈন্যরা তাদের মধ্যে পালিয়ে এসে একটি ছেলে এ তথ্য প্রকাশ করে।
তবু আমরা হাল ছাড়িনি। এর কয়েক মাস পরই পাকিসত্মানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে। দেশ হানাদারমুক্ত হয়। তার পরদিন মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর এলাকায় সন্ধান পাওয়া যায় বিসত্মীর্ণ এক বধ্যভূমির। সেখানে হাজার হাজার তরম্নণের মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অধ্যাপক মনসুর উদ্দীনের ছেলে আজিমপুর এলাকায় ‘ফড়িং’ নামে পরিচিত সাহসী এক তরম্নণ কাইয়ুম ভাই আর আমাকে নিয়ে যান সেখানে। সেদিন কাঁটাসুরের বধ্যভূমিতে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মৃতদেহের যে বীভৎস দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা সম্ভব নয়। এক স্থানে প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি মৃতদেহ একসঙ্গে তার দিয়ে বেঁধে মাত্র কয়েক ইঞ্চি নিচে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে বাবুলের মৃতদেহ থাকতে পারে সন্দেহে ওপরে কিছুটা জেগে থাকা তারের একটি অংশ ধরে টান দিতেই উঠে এলো সেসব মৃতদেহের এক অংশ। কাইয়ুম ভাই দাঁড়িয়েছিলেন আমার পেছনে। তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন ছোট বাচ্চাদের মতো। আমরা তাড়াতাড়ি চলে এলাম সেখান থেকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কিছু পরে ঢাকায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কাইয়ুম ভাইকে তাঁর প্রচ্ছদ শিল্পের অনন্য কৃতিত্বের জন্য স্বর্ণপদক বিজয়ী ঘোষণা করে – এবং তাঁকে এই স্বর্ণপদক দেওয়ার জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের ডানদিকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সুদৃশ্য ভবনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নতুন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছিলেন প্রধান অতিথি এবং বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ছাড়াও আরো অনেকেই যোগ দেন ওই অনুষ্ঠানে।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের স্বাগত ভাষণের পর এক পর্যায়ে আমন্ত্রণ জানানো হয় কাইয়ুম ভাইয়ের বাবা আবদুল কদ্দুস চৌধুরীকে কিছু বলার জন্য। কাইয়ুম ভাই বসেছিলেন আমার পাশে, তাঁকে তখন বেশ নার্ভাস মনে হচ্ছিল। কাইয়ুম ভাইয়ের বাবা বললেন – ‘জয়নুল আবেদিন সাহেবের পীড়াপীড়িতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম আমার ছেলেকে আর্ট কলেজে দিতে। আমি চাইনি আমার ছেলে বসে বসে ছবি অাঁকবে – আর সমাজে মাথা তুলে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাঁড়াতে পারবে না। আমি চেয়েছিলাম আমার বড় ছেলেকে যেমন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে পদস্থ কর্মকর্তার আসনে বসিয়েছি, এই ছেলের জন্যও তেমন সুযোগ করে দেব। কিন্তু তাকে আর্ট কলেজে দেওয়ার পর থেকে আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি, নিজেকে কেবলই অপরাধী মনে হয়েছে। আর আজ – ’ বলেই থামলেন বাবা আবদুল কদ্দুস চৌধুরী। অনুষ্ঠানে তখন পিনপতন নীরবতা। এই নীরবতা ভঙ্গ করে আবার বললেন তিনি – বললেন আবেগজড়িত জোরালো কণ্ঠে – ‘কিন্তু আজ আমি এক প্রখ্যাত শিল্পীর গর্বিত পিতা।’ তাঁর এই ভাষণে অনুষ্ঠানে করতালি চলল অনেকক্ষণ ধরে। হঠাৎ পাশে কাইয়ুম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর দুই চোখ কান্নাভেজা। আরো অনেকের চোখ তখন অশ্রম্নসিক্ত।
১৯৭৬ সালে আমরা ওয়াশিংটনে চলে এলাম – ভয়েস অব আমেরিকার চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য। ঢাকায় কাইয়ুম ভাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। তার ওপর আমার চার বছরের ছেলে আসিফকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে, একদিনও ওকে না দেখে থাকতে পারতেন না। আমরা যেদিন আজিমপুর যেতাম না সেদিন তিনি শামিত্মনগরে আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন। আমার ওয়াশিংটনে চলে আসার পর তিনি আসিফকে নিয়ে সুন্দর একটি ছড়ার বই প্রকাশ করলেন বাংলা একাডেমি থেকে। তার মাত্র এক বছর পরই দিন-রাত পরিশ্রম করে বেশকিছু ছবি অাঁকেন কাইয়ুম ভাই, আর সেগুলোর বিক্রির পয়সায় তিনি আর খোকন-আপা (কাইয়ুম-পত্নী শিল্পী তাহেরা চৌধুরী) আসেন ওয়াশিংটনে। আমাদের তখন আনন্দঘন দিন। তিন-চার মাস ছিলেন আমাদের সঙ্গে আমেরিকায়। সে সময় কাইয়ুম ভাই গল্প-আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ছবি অাঁকলেন বেশকিছু। ওয়াশিংটনে ঘটা করে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হলো – এবং প্রদর্শনীতে দর্শক সমাগম ঘটল প্রচুর। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলল প্রদর্শনী। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা জানাল কাইয়ুম ভাইকে।
এ-সময় প্রায়ই তাঁকে নিয়ে যেতাম ওয়াশিংটন শহরের বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলোতে। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় ৩০টিরও বেশি মিউজিয়াম রয়েছে আমেরিকার এই রাজধানী শহরে – এবং পশ্চিমি দুনিয়ার একমাত্র এখানেই এই মিউজিয়ামগুলোতে কোনো প্রবেশমূল্য দিতে হয় না। এমনি একটি সমৃদ্ধ মিউজিয়াম ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি। এই মিউজিয়ামে কাইয়ুম ভাইকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আহার-নিদ্রা ভুলে সারাদিন কাটালেন এখানে। মিউজিয়ামের একটি কক্ষে ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ইমপ্রেশনিজম আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ প্রখ্যাত ফরাসি শিল্পী ক্লদ মনে-র ছবি। সেখানে তাঁর বিখ্যাত একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আবেগাপস্নুত হয়ে পড়লেন কাইয়ুম ভাই। হঠাৎ আমাকে কাছে ডেকে বললেন – ‘আমাকে একটু ধরো, আমার সারা শরীর কাঁপছে – আমি কখনো ভাবতে পারেনি মনের অাঁকা একটি অরিজিন্যাল অয়েল পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়াব।’ আমি তাঁকে ধরে দেখলাম সত্যি সত্যি তাঁর শরীর কাঁপছে। তিনি যথার্থই শিল্পীর অমত্মর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছিলেন বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম শিল্পী ক্লদ মনে-র ঐতিহাসিক এক শিল্পকর্ম।
এরপর ওয়াশিংটন থেকে যতবার ঢাকায় গেছি কাইয়ুম ভাই আমাকে নিয়ে গেছেন প্রধানত দুটি জায়গায় : বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে আর বেশিরভাগ সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে। এ দুটি স্থানই ছিল তাঁর প্রধান আড্ডার জায়গা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পরিচালক সুবীর চৌধুরীকে তিনি খুব সেণহ করতেন, সুবীরও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন যথারীতি। সুবীর কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে একবার ওয়াশিংটনে এসেছিলেন – আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তিন রাত আমার বাড়িতে। সে সময় বিদেশে বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিচিতি তুলে ধরার উদ্যোগে সুবীরের কর্ম-তৎপরতা প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধ হয়েছি। সুবীর অস্ট্রেলিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে ক্যানবেরায় এবং পরে সিডনির হাসপাতাল-শয্যায় আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই। সুবীর যেদিন হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ঢাকা থেকে সেদিন টেলিফোনে এ খবর জানিয়েছেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাইয়ুম ভাই। ঢাকায় কাইয়ুম ভাই আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আরো দুজনকে – কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত আর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান। মতিউর রহমানের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৯২ সালে।
পুরানা পল্টনে সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীনের কথাকলি প্রেসের আড্ডায়। সে সময় মতিউর রহমান ছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক। এই পত্রিকায় তিনি আমার একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন প্রথম পৃষ্ঠায় তিন কলামের হেডলাইন দিয়ে। এই তিনজনই কাইয়ুম ভাইয়ের খুব কাছের মানুষ। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে ২০১৩ সালে কাইয়ুম ভাইয়ের সঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর বর্ষ-সমাপ্তি উদ্যাপন করেছি রাত একটা অবধি সুবীর চৌধুরীর যোগ্য ব্যবস্থাপনায়। ওই আড্ডায় আবুল হাসনাত আর মতিউর রহমান ছাড়াও ছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী এবং আরো কয়েকজন – যাঁদের নাম এ মুহূর্তে মনে আসছে না। ৩১ ডিসেম্বরের সেই রাতের আনন্দঘন স্মৃতি মনে থাকবে চিরকাল। তার ক’দিন পর ৩ জানুয়ারি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে আমার ঢাকা ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় সুবীর চৌধুরী আর আবুল হাসনাত ঢাকা ক্লাবে আপ্যায়ন করেছিলেন কাইয়ুম ভাই আর আমাকে। কাইয়ুম ভাই আর সুবীর চৌধুরীর সঙ্গে সেই ছিল আমার শেষ আড্ডা। সুবীরকে তখন বলেছিলাম, ‘এই গ্রীষ্মে ওয়াশিংটনে আসবেন বলেছিলেন প্রদর্শনী করতে, আসছেন তো?’ কাইয়ুম ভাই সুবীরের পক্ষে জবাব দিয়েছিলেন – ‘ও তো যাবেই, আমিও যাব ওর সঙ্গে।’ একই বছর চলে গেলেন দুজনে – আগে আর পরে।
কাইয়ুম ভাই যেদিন চলে গেলেন আমাদের শোকসমত্মপ্ত করে, সেদিনই তার মাত্র সাত-আট ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটন থেকে আমার সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়েছে প্রায় পঁয়তালিস্নশ মিনিট ধরে। ওয়াশিংটনে তখন রাত বারোটা, ঢাকায় সকাল দশটা। মাঝখানে একবার তিনি তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। সে তখন রান্নাঘর গোছানোর কাজে ব্যসত্ম। কারণ ওই রাতে আমাদের বাড়িতে রাতের খাবারে কিছু অতিথি আমন্ত্রিত ছিলেন। রান্নাঘরের টেলিফোন উঠিয়ে কাইয়ুম ভাইকে তাঁর শ্যালিকা বলেছিল, ‘এখন আমি খুব ব্যসত্ম, কথা বলতে পারব না, আগামীকাল টেলিফোন করব।’ পরদিন সারাদিন ধরে কান্নায় তাঁর একটিই কথা ছিল – ‘আমি কেন তখন টেলিফোনে কথা বলতে চাইলাম না। ‘আমার সঙ্গে কাইয়ুম ভাইয়ের যে-দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপ ছিল তাতে কাইয়ুম ভাই বলেছিলেন – ‘আর চার মাস পরে তাঁর ৮৩তম জন্মদিন উপলক্ষে বেঙ্গল গ্যালারি তাঁর ছবির একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করতে যাচ্ছে।’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘এই উপলক্ষে ৮৩টি ছবি দেবেন প্রদর্শনীতে।’ কাইয়ুম ভাই বলেছিলেন – ‘এতগুলো ছবি সম্ভব হবে কি না জানি না, তবে তোমার পরামর্শ অনুযায়ী চেষ্টা করে দেখব।’
এছাড়া কাইয়ুম ভাইকে নানা কথার মাঝে বলেছিলাম জগ্লুলের কথা। বিশিষ্ট সাংবাদিক অনুজপ্রতিম জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী আমার অত্যমত্ম সেণহাস্পদ। বাসের ধাক্কায় আকস্মিকভাবে প্রাণহানি ঘটে তাঁর। কাইয়ুম ভাইকে বলেছিলাম – জগ্লুল ঢাকায় এক মর্মামিত্মক বাস দুর্ঘটনার মাত্র মাসদেড়েক আগে ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। সে সময় জগ্লুল আমাকে বলেছিলেন – ‘কাইয়ুম ভাইকে দেখলে আপনার ছবি দেখি আর আপনাকে দেখলে চোখে ভাসে কাইয়ুম ভাইয়ের ছবি।’ কাইয়ুম ভাই শুনে হাসলেন, তারপর জগ্লুলের দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যুতে গভীর দুঃখবেদনা প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘জগ্লুলের মতো হাসিখুশির এ রকম প্রাণোচ্ছল একটি ছেলের এভাবে প্রাণহানি ঘটবে বাসের ধাক্কায় – এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
নিয়তির কী বিধান! টেলিফোনে আমার সঙ্গে এই কথা বলার মাত্র সাত ঘণ্টা পর কাইয়ুম ভাইও চলে গেলেন জগ্লুলের মতোই – আকস্মিকভাবে না-ফেরার দেশে।
এমনি অনেক ছোট-বড় ঘটনার স্মৃতি কাইয়ুম ভাইকে ঘিরে। কাইয়ুম ভাই এখন তাঁর বন্ধুবান্ধব ও অগণিত অনুরাগীর কাছে বেঁচে থাকবেন তাঁর অনন্য শিল্পকর্মের জন্য – তাঁর সহজ-সরল আকর্ষণীয় আর পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের জন্য। আর আমাদের শোকসমত্মপ্ত
পরিবার-পরিজনের কাছে তিনি থাকবেন নানা সময়ের, নানা ঘটনার এসব খ- খ- স্মৃতিতে চিরকাল। প্রিয় কাইয়ুম ভাইয়ের এই স্মৃতি চিরউজ্জ্বল আমাদের হৃদয়ে – চিরভাস্বর প্রতিনিয়ত। 

Leave a Reply