ফা হ মি দু ল হ ক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’র চেয়ে অর্থবহ, তাৎপর্যপূর্ণ ও খ্যাতিমান ভাস্কর্য আর নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যটি কেবল মুক্তিযুদ্ধের স্মারকই নয়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনন্য এক মঞ্চে পরিণত হয়েছে এই ভাস্কর্য। মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রসংগঠন কিংবা স্বাধীন যে-কোনো সংগঠনের প্রতিবাদ সমাবেশের প্রথম পছন্দ এই ভাস্কর্যের পাদদেশ।
এই ভাস্কর্য নিয়ে পরিচালক সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল সম্প্রতি অপরাজেয় বাংলা (২০১১) নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। হেলাল কানাডাপ্রবাসী হলেও দেশের টানে বারবার বাংলাদেশে আসেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, কেবলই প্রামাণ্যচিত্র। তাঁর অন্যান্য প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে বিশ্বাসের রঙ (২০০৫), স্মৃতি একাত্তর (২০০৬), ছবির হাট (২০০৮), সিনেম্যানিয়া (২০০৯) এবং আনিকা’স হোম (২০১০)। বিশ্বাসের রঙ চলচ্চিত্রটি মন্ট্রিয়ল ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সাধু লেংটা বাবার দর্শন এবং তাঁর শিষ্যদের বার্ষিক সম্মিলনভিত্তিক চলচ্চিত্রটি পূর্ব বাংলার লোকজ দর্শনের এক অনন্য ডকুমেন্টেশন। সিনেম্যানিয়া চলচ্চিত্রটিও বিষয়ের দিক থেকে ভিন্ন রকম। চলচ্চিত্রের ব্যানার ও হোর্ডিং বানান যাঁরা, সেইসব মানুষ এবং একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে যাবার যে প্রেক্ষাপট বাংলাদেশে বিরাজমান, চলচ্চিত্রটি সেই দিকে আলোকপাত করে।
একটি ভাস্কর্য নিয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয় হিসেবে কি খুব কৌতূহলোদ্দীপক কিংবা চাঞ্চল্যকর? কিন্তু ফিচার দৈর্ঘ্যের (৫৬ মিনিট) প্রামাণ্যচিত্রটি দেখার পর মনে হবে, একটিমাত্র ভাস্কর্যকে ঘিরেও একটি প্রামাণ্যচিত্র হতে পারে। কারণ এই ভাস্কর্য নির্মাণপ্রক্রিয়া নিয়ে কম কান্ড হয়নি, কম গল্প নেই একে ঘিরে। আবার এই ভাস্কর্যের নির্মাণকাহিনির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক এক প্রসঙ্গ। ফলে অপরাজেয় বাংলা চলচ্চিত্রটির দুটি অংশ। প্রথম অংশে এই মহান ভাস্কর্যটির নির্মাণপ্রক্রিয়া এবং সেই নির্মাণপ্রক্রিয়ায় অনাবিষ্কৃত এক অধ্যায় উন্মুক্ত হয় দর্শকের কাছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বিমানবন্দরে বাউল ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে নিকট অতীতে যে ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’ গঠিত হয়েছিল তার অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীদের নির্মিত ‘অপরাজেয় বাংলা’র রেপ্লিকা ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ। প্রকৃত ভাস্কর্য ও রেপ্লিকা ভাস্কর্য নির্মাণের প্রেক্ষাপট প্রামাণ্যচিত্রটিতে এক জায়গায় হাজির করার মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে ভাস্কর্য নির্মাণপ্রক্রিয়ায় যে ধর্মীয় বাধা, কালে কালে তার রূপ যে বিশেষ বদলায় না, এই বার্তা প্রদান করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য হওয়ার পরেও যেমন ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য নির্মাণে নানান বাধা এসেছে, তেমনি বাউল ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। চলচ্চিত্রটির প্রথম অংশের ভাস্কর্যটিতে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, দ্বিতীয় অংশের উপলক্ষ ভাস্কর্যের প্রণোদনা ছিল লোকজ বাউল দর্শন।
মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আর লোকজ বাউল দর্শন – এই দুই ধারা পরস্পরের খুব নিকটজন না হলেও উভয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক ইসলামের বিরোধের প্রেক্ষাপটটি এই বেলায় বলে নেওয়া দরকার। তা না হলে ‘অপরাজেয় বাংলা’ নির্মাণের গল্প ও ক্ষণিকের জন্য দেখা দেওয়া ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’ কীভাবে পরস্পর-সংশ্লিষ্ট বিষয় হয়ে একই চলচ্চিত্রে হাজির হলো তার কারণটি বোঝা যাবে না।
বঙ্গের যে-ইসলাম তার কতকগুলো আলাদা রূপ রয়েছে, সর্বাংশে এক নয় তা। ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয়ের আগেই পির-দরবেশদের হাতে স্থানীয় একটি চেহারা লাভ করে, যাকে আমরা পপুলার ইসলাম (জনধর্ম) বলতে পারি, যা প্রকৃত আরব ইসলাম থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরায়েজি বা একই ধরনের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে জন্ম হয়েছে স্কলাস্টিক ইসলামের (শাস্ত্রীয় ধর্ম), যার গ্রহণযোগ্যতা ধর্মপ্রাণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেই বেশি। আর দেশবিভাগের আগ দিয়ে মুসলিম লীগের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে পলিটিক্যাল ইসলামের (রাজনৈতিক ধর্ম), স্বাধীন বাংলাদেশে যা জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য অনেক ছোট ইসলামি দলের মাধ্যমে চর্চিত হচ্ছে। রাজনৈতিক ইসলামের পক্ষে যারা তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় যেতে চায় এবং ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। সামাজিক পর্যায়ে অনেক আশঙ্কাজনক ধর্মীয় উন্মাদনা দেখা যাবার পরও বাংলাদেশের মুসলমানরা গড়পড়তা অন্য মুসলমান দেশগুলোর চেয়ে যে অপেক্ষাকৃত উদার, তা কিন্তু সুফিবাদ (জনপ্রিয় ইসলাম) ও লোকধর্মসমূহের প্রভাবে হয়েছে। সাধারণ মুসলিম সাইকিতে একটা স্থায়ী উদারনৈতিকতা বা উন্মুক্ততা সেঁটে আছে। অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তা যখন একটা চেহারা পাচ্ছে মধ্যযুগে, কাব্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে, তাতেও লোকধর্মসমূহের অবদান রয়েছে। লোকধর্মসমূহের উদারনৈতিক অ্যাপ্রোচ সমাজে যে সমতার পরিবেশ তৈরি করেছিল তার প্রেক্ষাপটেই বাঙালিত্বের চেতনা বিকশিত হয়। পরবর্তী সময়ে বাঙালিত্বের জোয়ারে দুবার বঙ্গ ভেসে গিয়েছিল, প্রথমবার প্রধানত হিন্দুদের দ্বারা, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় এবং দ্বিতীয় দফায় ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময়ে, প্রধানত মুসলমানদের মাধ্যমে।
তবে মুসলমান হয়ে পাকিস্তানি মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পেছনে সমাজতন্ত্রের ভূমিকা রয়েছে। সমাজতন্ত্রের সেক্যুলার মতাদর্শ আধুনিক তত্ত্বের মোড়কে বাঙালিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। যদিও ১৯৭১ সালে কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি কিন্তু তখন পর্যন্ত দর্শন হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদে কমিউনিজমের প্রভাব এমনটাই ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে চার মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছিলেন।
তবে সময় খানিক পাল্টেছে। সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। উদ্ভ্রান্ত বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক ইয়াং ইন্টেলিজেন্সিয়া নতুন কোনো মতাদর্শের দাস হতে চায়। এখন তারা বাউল দর্শনে দারুণ আগ্রহী। পোস্ট-মডার্ন তরুণ বুদ্ধিজীবী এখন শেকড়ে ফিরতে চায়। দেখা গেল সেক্যুলারিজমের বিচারে বাউলমত কম বিপ্লবী নয়। তবে কায়দা ভিন্ন আর গ্রাম্য একটা অবয়ব থাকায় এতদিন চোখে পড়েনি। ধর্মকথা নিয়েই আছে বাউল (রসুল, মদিনা, রওজা ইত্যাদি শব্দের বহুব্যবহার স্মর্তব্য), কিন্তু তার বক্তব্যের সার হলো স্কলাস্টিক বা শরিয়া ইসলামকে খারিজ করা। সেক্যুলারের আর বাউলের এরকম কিছু মূলনীতিতে কোনো ভেদ নেই। তাই তো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য নির্মাণের একসময় উদ্যোগ নিয়েছে বাঙালি সেক্যুলারপন্থীরা আর বাউলমূর্তি অপসারণের প্রতিবাদে পথে নেমেছে আজকের সেক্যুলার-বাউল মিশ্রণে গড়ে ওঠা ঢাকাস্থ তরুণ ইন্টেলিজেন্সিয়া। তাঁদের মধ্যে আছেন ভাস্কর, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট। আর উভয় ক্ষেত্রেই বাধাটা এসেছে রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে – ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণকাজ রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের বাধার কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে, আবার ২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনে নির্মীয়মাণ বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলে রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা।
চলচ্চিত্রের শুরুতে কয়েকজন তরুণ ভাস্কর ‘অপরাজেয় বাংলা’র সামনে এসে দাঁড়ান, ভাস্কর্যটি নিরীক্ষণ করেন, ভাস্কর্যটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন, মাপজোখ করেন; পরে দেখা যাবে এঁরাই চারুকলায় অপরাজেয় বাংলার রেপ্লিকা নির্মাণ করবেন, ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’-এর কর্মসূচির অংশ হিসেবে। তবে চলচ্চিত্রের প্রথম অংশ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ‘টকিং হেড ডকুমেন্টারি’ পদ্ধতিতে নির্মিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন ভাস্কর্য নির্মাতা আবদুল্লাহ খালিদ; ভাস্কর্যের মডেল বদরুল আলম বেনু, সৈয়দ হামিদ মকসুদ ও হাসিনা আহমেদ; ভাস্কর্যটি নির্মাণকালীন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদ; সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, যিনি তাঁর রিপোর্টে নির্মীয়মাণ ভাস্কর্যটির নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ দিয়েছিলেন; চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর, যিনি নির্মাণকালীন ‘অপরাজেয় বাংলা’র স্থিরচিত্র তোলার মধ্য দিয়ে প্রথম ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু করেছিলেন, প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, যাঁর প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ অ্যাসোসিয়েটস ভাস্কর্যটির কাঠামো গড়ে দিয়েছিল এবং রবিউল হুসাইন যিনি ভাস্কর্যটির বেদি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারগুলো থেকে জানা যায়, ডাকসুর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ভাস্কর নিজেই এরকম একটি কাজের কথা ওই সময়ে ভাবছিলেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা বাজেটের অর্ধেক জোগাড় করে ডাকসু এবং বাকি অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেয়। ভাস্কর নিজে কোনো সম্মানী নেননি। সমস্যা দেখা দেয় মডেল নিয়ে, কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিটিং দেওয়া খুব কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। টানা তিন মাস বারো ঘণ্টা করে সিটিং দেন মডেলরা। ভাস্কর্যের মাঝখানের গ্রামীণ যুবার মডেল ছিলেন বদরুল আলম বেনু, শহুরে মুক্তিযোদ্ধার মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ এবং সেবিকার মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ। বদরুল আলম বেনু আবদুল্লাহ খালিদের সহকারী হিসেবে নির্মাণপ্রক্রিয়ায়ও অংশ নেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলে দেশের রাজনীতির ধারা বদলে যায় এবং প্রায় পরপরই ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় ইসলামি চরমপন্থীরা জিপিওর সামনে বর্শা নিক্ষেপের ভাস্কর্যটিও ভেঙে ফেলে। পত্র-পত্রিকায় ভাস্কর্য নির্মাণের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা চলে। ‘অপরাজেয় বাংলা’র নির্মাণ বন্ধে জনমত তৈরির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চলে, তবে সেক্যুলারপন্থী শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া করে, কাউকে কাউকে ধরে মাথা ন্যাড়াও করে দেয়। বায়তুল মোকাররম থেকে এক শুক্রবারে ভাস্কর্যবিরোধী রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ভাস্কর নিজে নতুন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে ভাস্কর্য নির্মাণপ্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার জন্য আবেদন করেন। যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী ভাস্কর্যটি শেষ করার উদ্যোগ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট ও শিক্ষক সমিতিও তাতে সমর্থন দেয়। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে ভাস্কর্যটির নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু হয়। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন হয়, উদ্বোধন করেন একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
মূল ‘অপরাজেয় বাংলা’ নির্মাণের গল্প এখানেই শেষ হয়। এরপর চলচ্চিত্রটি আরেকটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রবেশ করে। ‘অপরাজেয় বাংলা’র উনত্রিশ বছর পর, ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর রাজনৈতিক ইসলামপন্থীরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে মৃণাল হকের নির্মীয়মাণ বাউল ভাস্কর্যটি নামিয়ে ফেলে। তাদের দাবি একে সরিয়ে ওইখানে হজ মিনার করতে হবে, কারণ বাউল ভাস্কর্যটি নির্মিত হলে তা হাজি ক্যাম্পের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত করবে। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়। পাশাপাশি ধ্বংসসাধন করা হয় মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্যের। এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, পত্র-পত্রিকায় এবং বিশেষত ব্লগে। আর ঢাকায় গড়ে ওঠে ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’। চলচ্চিত্রটির প্রথম অংশ পুরোপুরি সাক্ষাৎকারনির্ভর, ফলে তাতে নিরিবিলি একটি ভাব রয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ মূলত আন্দোলনকে ধারণ করে, ফলে প্রতিবাদমুখর ও সরব। চারুকলাকেন্দ্রিক সেই আন্দোলনে রয়েছে মিছিল, রাজপথজুড়ে আল্পনা, অপরাজেয় বাংলার রেপ্লিকা নির্মাণ ও সেই রেপ্লিকাকে নিয়ে বিজয় দিবসের র্যালি – আন্দোলনকারীদের মতে, ‘শিল্প নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিবাদ করছি’। আরো আছে বাউল ভাস্কর্য অপসারণের কূপমন্ডূকতার প্রতিবাদে শ্রেষ্ঠ বাউল লালনেরই গান – ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’ – অবশ্য গাইছেন বাংলা ব্যান্ডের আনুশেহ, সেক্যুলার-বাউলের মিশ্রণের অনন্য উদাহরণ হিসেবে তাকে হাজির করা যায়।
পরিচালক এই দুই ঘটনাকে এক চলচ্চিত্রে হাজির করার মধ্য দিয়ে যে-বার্তাটি সহজেই দিতে পেরেছেন তা হলো রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ-সেক্যুলারিজম এবং লোকধর্মের বিরোধ পুরনো। তাই জাতীয়তাবাদী-সেক্যুলার ভাবনার প্রতীক ‘অপরাজেয় বাংলা’ বা লোকধর্মের প্রতীক বাউল ভাস্কর্য, পৌত্তলিকতার দোহাই দিয়ে আসলে দুই ক্ষেত্রেই তারা বাধা প্রদান করেছে। তবে জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলার এবং অধুনা নাগরিক লোকধর্মপ্রেমীরা আলাদাভাবে কিংবা একত্রে রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই আগেও করেছে, এখনো করছে। চলচ্চিত্রটি হয়তো এই কথাটিই সংক্ষেপে বলতে চায় যে, এদেশে রাজনৈতিক ইসলামের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি করে আছে রাজনৈতিক ইসলামের বিরোধিতা, যা গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমুন্নত রাখতে চায়।
ডিভি ফরম্যাটে চলচ্চিত্রটির চিত্রধারণ, সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ করেছেন সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল একাই। যে সামান্য নেপথ্য কণ্ঠ ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্রটির প্রথম দিকে, তার কাজটুকুও করেছেন পরিচালক। ব্যাপারটা স্বাধীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার দিক থেকে বেমানান নয় – এটা ব্যয়সাশ্রয়ী হয়েছে, নির্মাণ-ব্যবস্থাপনায় স্বাধীনতা পাওয়া গেছে এবং চলচ্চিত্রের আধেয় ও আঙ্গিকে নির্মাতার দখল প্রতিষ্ঠিত থেকেছে। প্রথম দিককার সামান্য ভয়েস-ওভার ন্যারেশন বাদে, টেক্সট ব্যবহার করে সিকোয়েন্সসমূহকে সম্পর্কিত করা হয়েছে কয়েকবার। নয়তো একের পর এক ইমেজকে পাশাপাশি রেখে, একটা অনুচ্চারিত বুনন তৈরি করা হয়েছে চলচ্চিত্রজুড়ে। চলচ্চিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এর আধেয়র জন্য, কিন্তু আঙ্গিকের জায়গায় কিছু সীমাবদ্ধতা চোখে পড়বে। অনেক ক্ষেত্রেই আলোক নিয়ন্ত্রণ যথাযথ হয়নি। শব্দগ্রহণেও ত্রুটি লক্ষ করা যাবে – যেমন আনুশেহর গানটির শব্দধারণ ঠিকমতো হয়নি। টাইটেলে যখন নবীন ভাস্করদের পেছনে রেখে ‘অপরাজেয় বাংলা’ শিরোনামটি ভেসে ওঠে, সম্পাদনা সে স্থানে মসৃণ হয়নি। তবে বাংলা বানানে ভুল চোখে পড়বে দৃষ্টিকটুভাবে – ভুল বানান চলচ্চিত্রটির সিরিয়াসনেসের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তবে এ-ধরনের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, শেষ পর্যন্ত, আঙ্গিকের চেয়ে আধেয়কেই বিচার করতে হবে; আঙ্গিক নিয়ে বিস্তর আলাপ এখানে প্রায় অপ্রয়োজনীয়। আধেয়ই চলচ্চিত্রটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে, উত্তর আমেরিকা ও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রটির বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক মুক্তিযুদ্ধ ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, শিল্পের স্বাধীনতা ইত্যাদি গুরুতর প্রসঙ্গে মানুষের যে সাড়া তার একটি অন্যতম দালিলিক ভূমিকা রাখবে।