সৌ মি ত্র ব সু
তৃপ্তি মিত্র বলে কাউকে আমি চিনতাম না। একেবারে চিনতাম না বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, কিন্তু যাঁর কথা আপনাদের শোনাব তিনি তৃপ্তি মিত্র নন, তাঁকে আমি জেঠিমা বলে ডাকতাম, এবং এখনো পর্যন্ত ওই তৃপ্তি মিত্র নামটার তুলনায় এই আত্মীয় সম্বোধনটাই আমার জিভে আগে আসে। লেখার মধ্যে বারবার জেঠিমা জেঠিমা করলে আদেখলেপনা মনে হবে, তাই আমি তৃপ্তি মিত্রই লিখব, কিন্তু কলম ফসকে যদি দু-একবার ওই সম্বোধন বেরিয়ে পড়ে, ক্ষমা করে দেবেন।
এ হলো বহুরূপীতে ঢোকার পরের পর্বের কথা। তার আগের একটা সময়ের কথা বলে নিতে হবে, যখন রেডিওতে শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় শুনি মন দিয়ে, এবং যাকে বলে ফ্যান হয়ে যাই। ক্লাস এইটে পড়ার সময় প্রথম বহুরূপীর নাটক দেখবার সুযোগ ঘটল। আমার বাড়িতে নাটক দেখার চল ছিল না, ঠাকুমার কাছ থেকে এক টাকা জোগাড় করে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের দোতলার পেছনের সারিতে বসে বাকি ইতিহাস দেখেছিলাম রেডিওর সেই শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রকে দেখব বলে। বাকি ইতিহাসে শম্ভু মিত্র অভিনয় করতেন না সে তো আর আমি জানি না, ক্লাস এইটের বোধবুদ্ধিতে কুমার রায়কেই শম্ভু মিত্র বলে ভেবেছিলাম, সে কথা ভেবে আজ বেজায় হাসি পায়। তৃপ্তি মিত্র তিনটি চরিত্রে অভিনয় করতেন সেই নাটকে, তার মধ্যে কম বয়সী চরিত্রটি করছেন শাঁওলী – এমনটাই আমার বিশ্বাস হয়েছিল। সে একেবারে প্রথম নাটক দেখার অভিজ্ঞতা, তারপর আস্তে আস্তে পাঁড় নাটক দেখিয়ে হয়ে উঠলাম – রাজা অয়দিপাউস দেখলাম, পুতুল খেলা দেখলাম, চার অধ্যায় দেখলাম। পাশাপাশি দেখি পিএলটির নাটক, অজিতেশের নান্দীকার। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ উৎপল দত্তের বামপন্থী রাজনীতির আর অসাধারণ জমজমাট নাটক দেখে পিএলটির ভক্ত হয়ে যান, অজিতেশের উদ্দাম যৌবন অনেককে টেনে নেয় নান্দীকারের দিকে, আমার পছন্দ কিন্তু বহুরূপী থেকে সরে না। আর সেই মুগ্ধতার পথ বেয়ে বহুরূপীতে ঢুকে পড়লাম, তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের প্রথম বছর।
ধারাবাহিক স্মৃতি নেই, টুকরো-টাকরা দু-একটা ঘটনার কথা মনে আছে, আপাত তুচ্ছ তার কোনো কোনোটা থেকে এমনকি আমার নাট্যবোধ গড়ে উঠছিল, এতটাও বলা যায়। যেমন একদিন, তৃপ্তি মিত্র আর কুমার রায় বসে আছেন মহলাঘরে, এমনিই ঘরসংসারের কথা চলছে। হঠাৎ তৃপ্তি মিত্র হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে লম্বা জিভ কেটে বলে উঠলেন, ‘এই কুমার, সাড়ে ছটা বাজে, শুরু করো।’ তারপরেই সংলাপ – ‘তুমি কালও ইলেকট্রিকের বিলটা দাওনি?’ ফার্স্ট ইয়ারের সেই অবোধ কিশোরটির সামনে তখন খুলে যাচ্ছে অজানা একটা বিস্ময়ের জগৎ। এই তো চোখের সামনে গল্প করছিলেন দুজনে, পলক ফেলার আগে ঢুকে পড়লেন নাটকের মধ্যে? কী করে হয় এমন?
আজ বুঝতে পারি ব্যাপারটা অত অবাক হবার মতো কিছু নয়, আমি নিজেও হেসেখেলে এমনটা করে ফেলতে পারব, কিন্তু সেই বয়েসে যে কতটা ধাক্কা লেগেছিল তা বুঝি এখনো ঘটনাটা ভুলতে পারিনি দেখে। আজ মনে হয়, এই উদাহরণ আমার মনের মধ্যে অস্পষ্টভাবে তৈরি করে দিয়েছিল এমন একটা বোধের বীজ – নাটক করতে গেলে আলাদা করে কোনো আয়োজন না হলেও চলে, এমনকি বাইরের কোনো উপাদানও তত জরুরি নয়, দুজন মানুষ তাঁদের ব্যক্তিপরিচয় থেকে ছোট্ট লাফে চরিত্রের ভেতর ঢুকে পড়লেই শুরু হয়ে যেতে পারে অভিনয়।
২
আর একটা ঘটনার কথা বলি। আমি বহুরূপীতে আসার পরপরই তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় বাদল সরকারের যদি আর একবার নাটকের মহলা শুরু হয়। তাতে একটা পার্ট জুটে গেল আমার, বুডঢা জিন বলে এক ছোটখাটো দেবতার চার সাগরেদের অন্যতম। আমার কাজ ছিল বারদুয়েক মঞ্চে ঢুকে অন্যদের সঙ্গে নাচা।
তা একবার সম্ভবত কাউকে টেপরেকর্ডার বাজানোয় অভ্যস্ত করার জন্যে বারবার ওই নাচের জায়গাটা বাজানো হচ্ছে। তখন মহলা নয়, কাজেই আমি অন্যদের সঙ্গে মহলাঘরের বাইরে বসে আছি। তৃপ্তি মিত্র হঠাৎ এসে বললেন, ‘এখানে বসে আছো কেন, বাজনা শুনে যার নাচতে ইচ্ছে করে না সে কখনো স্টেজে নাচতে পারে? যাও, প্র্যাকটিস করো।’ এখন কথাটার মানে বুঝতে পারি, কথাটা যিনি বলেছিলেন বুঝতে পারি তাঁকেও। নিজের কাজ সম্পর্কে একটা তীব্র আবেগ জেগে থাকার কথা শিল্পীর মনে, যখনই সুযোগ পাবেন তখনই তার মধ্যে ঢুকে পড়ার ভালোবাসা থাকা চাই, এখন তো আমার নাচার কথা নয় বলে বসে থাকা তাঁকে মানায় না।
দলের মধ্যে শম্ভু মিত্র ছিলেন সকলের শ্রদ্ধার ও সমীহের পাত্র, কিন্তু ঠিক ঘরের লোক নন। এটা যে কেবলমাত্র আমাদের ছোটদের বেলায়ই প্রযোজ্য তা নয়, যাঁরা খুবই সিনিয়র, যাঁরা, কুমার রায়, দেবতোষ ঘোষ বা শান্তি দাসদের ব্যবহারেও সেই সমীহ প্রকাশ পেত। খুব সামান্য একটা কথা বলি, শম্ভু মিত্র এঁদের সকলকেই তুমি বলতেন, জেঠিমার সম্বোধন কিন্তু ছিল তুই। এমন নয় যে শম্ভু মিত্র মানুষটা খুব সজারুগোছের জীব ছিলেন, ভুরু কুঁচকে রাগী চোখে ছাড়া তাকাতেই পারতেন না। তুমুল আড্ডা মারতে পারতেন এবং মারতেন, কিন্তু ওই – একটা দূরত্ব ছিলই। তৃপ্তি মিত্র ঠিক তার উলটো। একেবারেই
মা-মাসিগোছের ধরন ছিল তাঁর, বেদম জোরে হাসতে পারতেন, শাঁওলীদি ছাড়া আর কোনো মহিলাকে আমি অত জোরে হাসতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, ঠিক জানি না কীভাবে ব্যাপারটাকে বোঝাব – যে-কোনো প্রতিক্রিয়াই খুব অনর্গলভাবে বেরিয়ে আসত তাঁর মুখে-চোখে। রাগ করলে সমস্ত শরীর দিয়ে ফুটে বেরোতো সেই রাগ, এবং একটু পরেই স্তিমিত হয়ে যেত। ভালোবেসে কথা বললে সে ভালোবাসাটা যেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে ফেলা যেত। আর ছিল অবাক হওয়ার ক্ষমতা। কত সহজে যে তাঁকে অবাক, এমনকি হতচকিত করে দেওয়া যেত তা শুধু তাঁর সঙ্গে যাঁরা মিশেছেন তাঁরাই জানেন। আমার নিজের মনে হয়, স্বভাবের এই বৈশিষ্ট্য তাঁর অভিনয়ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিতে পেরেছে। একটা তত্ত্বই না হয় খাড়া করবার চেষ্টা করা যাক, দেখি পাঠক একমত হন কি না। তৃপ্তি মিত্রের অভিনীত বিখ্যাত চরিত্রগুলি – যেমন ছেঁড়া তারের ফুলজান, রাজার সুদর্শনা, রক্তকরবীর নন্দিনী, পুতুল খেলার বুলু এবং সর্বোপরি অপরাজিতার নামচরিত্র এরা সবাই খুব সরলচোখে জীবনকে দেখতে চেয়েছে, জীবনের নানা চোরাবাঁকে পড়ে তাই তাদের কষ্ট দুঃখ বিস্ময় সবটাই খুব অাঁকাড়া বলে মনে হয়।
পাঠক নিশ্চয় স্বীকার করবেন যে, এটা নাগরিকতার লক্ষণ নয়। নাগরিক মানুষ তার আবেগ সবটা প্রকাশ করে না, অনেকটাই ঢেকেচেপে রাখে। সেদিক থেকে কেউ যদি তৃপ্তি মিত্রকে গ্রামীণ বলেন আমি কোনোভাবে কোনো আপত্তি করব না। এই সুবাদে একটা কথা বলতে চাই। কোথায় যেন এই ধরনের একটা কথা পড়েছিলাম, শিল্পীর প্রাথমিক কাজই হলো অবাক হওয়া, যে কোনো কিছুতেই অবাক হয় না তার তো কোনো কিছু বলবারই থাকে না, সে তাহলে শিল্পী হবে কেমন করে? তৃপ্তি মিত্র প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়ে এই কথাটা অন্য মানে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।
যাক গে, গল্পে ফিরে যাই। সবাই জানেন, তৃপ্তি মিত্র একটা একক অভিনয় করেছিলেন, নীতিশ সেন নামে অধুনা বিস্মৃত নাটককারের সেই নাটকের নাম ছিল অপরাজিতা। অপরাজিতার প্রচুর অভিনয় হতো এখানে সেখানে। নাটকটা খুব জমেছিল, লোকজন কম, উদ্যোক্তাদের খরচাও নিশ্চয় অনেকটা কম পড়ত। অপরাজিতার অভিনয়ে তাঁর সঙ্গে যেতাম ছোট একটা দল, তাদের মধ্যে ছিল রমাপ্রসাদ বণিক, সে আবহ বাজাত, দিলীপ ঘোষ আলোর দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে যেতেন রেজাদা, মানে মহম্মদ রেজা। মঞ্চ সাজানোর ইনচার্জ ছিলাম আমি, তার বাইরে নাটকের মধ্যে টেলিফোনের একটা বড় ভূমিকা ছিল, সেই ফোনগুলো বাজাবার দায়িত্ব ছিল আমার ওপরে। বারীন ভান্ডারী মিস্ত্রি হিসেবে সঙ্গে যেত। তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে যেত মেরী, তাঁর পরিচারিকা। এই হলো মোটের ওপর অপরাজিতার দল।
একবারের কথা খুব মনে পড়ে। আগরতলায় ডাক এসেছে, প্লেনে করে যাওয়া হবে। আমি তো ছোট ছেলে, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি – আমার বাবা ঠাকুরদা তাঁর বাবা ঠাকুরদা কেউ কখনো প্লেনে চড়েননি। আর সত্যি, এখন যেমন কথায় কথায় মানুষজন ফ্লাইট ধরে, তখন ব্যাপারটা এতটা সহজ ছিল না। যাই হোক, প্রবল উত্তেজনা নিয়ে প্লেনে তো চড়ে বসলাম। জানালার ধারে বসে আছেন তৃপ্তি মিত্র, নিরুদ্বিগ্ন মুখে বই পড়ছেন। আমি তাঁর পাশ দিয়ে জানলায় উঁকিঝুঁকি মারছি। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল বই, মজার চোখে তাকালেন আমার দিকে – ‘কি, জানলার ধারে বসবি?’ আমি ঘাড় নাড়তে না নাড়তে উঠে দাঁড়ালেন, আমার কপাল খুলে গেল। তিনি প্লেনেই ফিরেছিলেন, বাদবাকি আমরা ফিরেছিলাম ট্রেনে। ফিরে খবর পেলাম, বাড়িতে ফোন করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, সৌমিত্র খুব ভালো আছে, প্লেনে চড়া খুব এনজয় করেছে ইত্যাদি। মা-মাসি ছাড়া কী বলা যাবে একে?
অপরাজিতা নিয়ে কত জায়গায় যে গেছি, আর কত রকমের গল্প যে জমে আছে স্মৃতিতে। শিলচরে তো তুমুল গন্ডগোলের মধ্যে পড়েছিলাম। অভিনয়ের মধ্যে মাইক খারাপ হয়ে গেল, নাটক বন্ধ। তাড়াতাড়ি সারানো হলো, আবার শুরু হবে নাটক, তৃপ্তি মিত্র এক একটা ঝুলন্ত মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন ‘শুনতে পাচ্ছেন, শুনতে পাচ্ছেন?’ হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘আর ন্যাকামি করতে হবে না।’ তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে একটা-দুটো ক্রুদ্ধ কথাকাটাকাটি, মঞ্চে ঢুকে পড়ল রমা। তার তখন তরুণ বয়েস, জেঠিমার এমন প্রকাশ্য অপমান সহ্য করতে পারে কখনো? তুমুল ঝগড়া, কোনোমতে থামিয়ে নাটক শুরু করা হলো। উদ্যোক্তাদের
দু-একজন চুপি চুপি বলে গেলেন, যিনি স্টেজে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁকে মারবে বলে গুন্ডারা তৈরি হয়েছে। ফলে রমাকে গোপনে অন্য জায়গায় পাচার করে দেওয়া হলো, ভোরবেলা ফ্লাইট ধরে জেঠিমার সঙ্গে সে ফিরে গেল কলকাতা। পরদিন সকালে, দলের অন্যেরা বাজারে গেছে, এক রিপোর্টার এলেন আমার কাছে। তাঁর মুখেই খবর পেলাম, রমা নাকি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছে, সমগ্র কাছাড়বাসী অসভ্য। বলা বাহুল্য, একথা সর্বৈব মিথ্যে, কিন্তু রিপোর্টারকে সে কথা বোঝানো কি চাট্টিখানি কথা, বিশেষ করে সেই বয়েসের আমার পক্ষে?
বহুরূপীতে খুচখাচ পার্ট করি, অয়দিপাউসে জনতা,
ঘরে-বাইরেতে ভীড়, আর একেবারে নিজের পার্ট বলতে যা বোঝায়, ফোল্ডারে রীতিমতো নাম ছাপা আছে – যদি আর একবারে বুডঢা জিনের অনুচর। এই যদি আর একবার আমার কপাল খুলে দিলো। সেই গল্পটা করি।
এ নাটকে শান্তি দাস একটি বড়সড় চরিত্রে অভিনয় করতেন। কোনো একটা অভিনয়ের দিন তিনি থাকতে পারবেন না। বলে রাখা দরকার, সেই বয়েসে আমার স্মৃতিশক্তি ছিল সাংঘাতিক, শোনামাত্র
যে-কোনো সংলাপ মুখস্থ হয়ে যেত। গোটা অয়দিপাউস কিংবা অপরাজিতা নাটকটা একাই বলে দিতে পারতাম। তা শান্তিকাকার পার্টটা কে করবে, অভিনয় বাতিল করে দিতে হবে কি না এই নিয়ে বড়দের মধ্যে একটু গুজগুজ ফুসফুস চলছে। তৃপ্তি মিত্র দলে এলেন, কুমার রায় তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন মহলাঘরের পাশের ছোট ঘরে। সেখানে কুমারকাকা জেঠিমাকে কী সব বোঝাচ্ছেন, মাঝে মাঝে উচ্চকিত হয়ে উঠছে জেঠিমার গলা – ‘তুই কী বলছিস কুমার, ও তো একেবারে বাচ্চা ছেলে, গীতার সঙ্গে মানায় কখনো?’ উত্তরে কুমার রায় – ‘আপনি কেন ভাবছেন মণিদি, আমি মেকআপ দিয়ে ঠিক করে দেব।’ কী নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝতে পারছি না এমন তো নয়, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে, কান গরম, হলকা বেরোচ্ছে সেখান থেকে। একটু পরে তৃপ্তি মিত্র এলেন আমার কাছে। ‘শোনো, শান্তির পার্টটা একটু করো তো, দেখি। তোমাকে করতে হতে পারে।’ করলাম। মঞ্চেও করলাম। পরদিন দলে ঢুকতে একগাল হেসে আমাকে বললেন, ‘এই যে হিরো, আয়।’ সেই থেকে তুই।
বড় চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ প্রথম পেলাম মনোজ মিত্রের লেখা পাখি নাটকে। এই পার্ট পাওয়ার একটা প্রকাশ্য আর গোপন কারণ আছে। প্রকাশ্য কারণটা হলো, নীতুর চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল দেবতোষ ঘোষের, কিন্তু মহলা শুরু হবার সময়ে মুম্বাই (তখন বলা হতো বোম্বাই বা বম্বে) থেকে শচীনশঙ্কর ব্যালে ইউনিট এলো সাতদিনের জন্যে কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে। প্রতিবছরই আসতেন তাঁরা, দেবতোষকাকা তাঁদের অনুষ্ঠানে ঘোষণার দায়িত্বে থাকতেন। এই কটা দিন তাঁকে বহুরূপী থেকে ছেড়ে দিতে হবে, আমাকে বলা হলো প্রক্সি দিতে। আর গোপন কারণটা শাঁওলীদি পরে ফাঁস করেছিল আমার কাছে – ওই চরিত্রে নাকি আমাকেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল, যদি না পারি, তখন বাদ দিতে সুবিধে হবে বলে মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল দেবতোষ ঘোষের নাম।
পাখির মহলা নিয়ে একটা কথা খুব মনে পড়ে, বলতে পারেন এই ঘটনাটা শিল্প, মেলোড্রামা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার
প্রচলিত-প্রথাগত সব ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। পাখি মনোজ মিত্রের প্রথমদিককার লেখা, তাঁর শক্তির পূর্ণ প্রকাশ এখানে ঘটেছে বলে মনে হয় না। একটু আবেগতাড়িত গল্প, যেখানে নীতু বলে গরিব হারিকেনওয়ালা একটি ছেলে তার বড়লোক বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিতে চায়। নাটকে একটি দীর্ঘ এবং আবেগময় সংলাপ ছিল নীতুর, যেখানে সে তার নিজের এই অদ্ভুত আচরণকে ব্যাখ্যা করে। ‘পাগল, হ্যাঁ, আমি পাগল। না খেয়ে খেয়ে আর অভাবে থেকে থেকে আমি পাগলই হয়ে গেছি’ – এ ধরনের বাক্য দিয়ে শুরু হয়েছিল সে সংলাপ। জায়গাটা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে
ঠাট্টা-তামাশা করতাম, সেন্টু টেন্টু ইত্যাদি বলতাম। একদিন সাহসে বুক বেঁধে জেঠিমাকে বললাম, ‘এই জায়গাটা একটু মেলোড্রামা মনে হয় না?’ কল্পনাও করতে পারিনি, অমন দপ্ করে জ্বলে উঠবেন। ‘- মেলোড্রামা? খেতে না পাওয়া কাকে বলে জানো? উপোস করে থাকলে মানুষের শরীর ফুলে যায় জানো?’ অগ্ন্যুৎপাতের মতো করে বলে যাচ্ছেন, চারের দশকে মন্বন্তরের সময় কলকাতার রাস্তায় কী কী দেখেছিলেন তিনি, কেমন করে মানুষকে রাস্তায় পড়ে থেকে থেকে মরে যেতে দেখেছেন, দোতলার রান্নাঘরের লাগোয়া নর্দমা থেকে গড়িয়ে নামা ফেনের ভাগ নিয়ে মা আর শিশুসন্তানের মধ্যে রেষারেষি দেখেছেন। এর কোনো কোনো গল্প পরে পড়েছি, কিন্তু নির্বিকার হরফ তো বক্তার স্বর আর শরীরকে দেখাতে পারে না। সেই কোন বয়েসের কথা, এখনো পর্যন্ত ঠোঁট উলটিয়ে ‘মেলো’ শব্দটা ব্যবহার করতে আড়ষ্ট লাগে আমার, সদ্য কলেজের অাঁতলামি ওই এক ধাক্কায় ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তৃপ্তি মিত্র।
৩
অপরাজিতা বহুরূপীর খুব বড় নির্ভর হয়ে উঠেছিল, বাঁচিয়ে দিয়েছিল কথাটা বলা ঠিক হবে কি না জানি না। আড়াই ঘণ্টা একাই অভিনয় করতেন, মঞ্চ থেকে এক লহমার জন্যে বেরিয়ে যাবার উপায় ছিল না। তখন তো আর কম বয়েসেরটি নন, শরীরের ওপর যে কী চাপ পড়ত তা এখন বুঝতে পারি। একটা ছোট ছবি মনে পড়ে। ১১এ নাসিরুদ্দিন রোডের সিঁড়ির নিচে তৃপ্তি মিত্র, মহলা দিয়ে ফিরছেন। আমি কী কারণে বোধ হয় শাঁওলীদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। দোতলার সিঁড়িতে উঠতে শরীর দিচ্ছে না। কোনোমতে রেলিং ধরে ধরে উঠলেন। গলা খারাপ থাকত তাঁর, মঞ্চের নানা কোণে থ্রোট লজেন্স ছড়ানো থাকত, অভিনয় করতে করতে মুখে পুরো দিতেন। ক্যান্সার ধরে ফেলবার পরেও অপরাজিতা করেছেন, এমনটাও হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে মঞ্চে দাঁড়াতে পারার ক্ষমতা নেই, নড়বড়ে পায়ে উঠে গিয়ে চালিয়ে গেছেন পুরো সময়। বিরতির পরে দ্বিতীয়ার্ধের ঘণ্টা বাজানো এবং তিনটে ঘণ্টার পরে পর্দা তোলার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর, সাজঘরে গিয়ে ঘণ্টা বাজাবার অনুমতি চাইছি, ক্লান্ত হাত তুলে ততোধিক ক্লান্ত গলায় অনুরোধ করছেন, বেলটা একটু দেরি করে দে। তখন নিজেকে কসাই বলে মনে হতো। তবু নাটকের শেষ সংলাপটি যখন উচ্চারণ করতেন জেঠিমা, ‘আমি অপরাজিতা রায়, আমি অপরাজিতা -’ তখন হাততালির ঝড় তাঁর বয়েস আর ক্লান্তিকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেত।
বহুরূপীতে অপরাজিতার শেষ অভিনয় কবে? ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বোলপুরে অপরাজিতার অভিনয়, তিনদিনের উৎসবে। প্রথম দিন পেশাদার থিয়েটারের নহবত, দ্বিতীয় দিনে আমাদের অপরাজিতা, তৃতীয় দিনে কালো হাত বলে যাত্রা। নাটক শুরুর অল্পক্ষণ পরেই গোলমাল বেধে গেল। শান্তিনিকেতনের সুভদ্র দর্শক নন, এঁরা সব বোলপুরের মাটো পাবলিক। একক অভিনয় তাঁদের পছন্দ হচ্ছে না। চিৎকার-চেঁচামেচি দিয়ে শুরু করে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেল, শুনলাম প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মালপত্র যা পারি গুছিয়ে পেছনের অন্ধকার মাঠ দিয়ে পালাতে হবে, জেঠিমাকে ডাকতে এসে দেখি দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন, আঙুলের ফাঁক দিয়ে চোখের জল গড়িয়ে নামছে। পরদিন সকালবেলা ট্রেনে ফিরব, বোলপুর স্টেশনে বসে আছি, হঠাৎ পারম্পর্যহীনভাবে বলে উঠলেন, ‘এ আর কিছু করা যাবে না, সব নষ্ট হয়ে গেছে।’
অপরাজিতার কথা থাক, বেশি বয়েসে তাঁর অন্য দু-একটা অভিনয় দেখার কথা বলি। বহুরূপী থেকে বেরিয়ে আরব্ধ নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করেছেন তখন, সেখানে অভিনীত হচ্ছে বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা সরীসৃপ। একটা পরিত্যক্ত পুরনো থিয়েটারবাড়ি, সেইখানে থাকেন এক অভিনেত্রী, তিনি কথায় কথায় পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করেন, পুরনো নাটকের সংলাপ আওড়ান। সেসব সংলাপ বলার সময় কী যে কণ্ঠের ব্যবহার, বসা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে কী যে আভিজাত্য। এক জায়গায় সেই অভিনেত্রী বলেন কম বয়েসে গিরিশচন্দ্রকে দেখার কথা। সংলাপটা ছিল এই ধরনের – ‘কে একটা বলল, গিরিশচন্দ্র এসেছেন, আমি মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, গিরিশবাবু।’ সত্যিই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেন, আমরা যেমন করে কথা বলতে বলতে খানিকটা অভিনয়ও করে ফেলি। ম্যাজিকটা হলো, বর্ণনাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি চোখের সামনে গিরিশচন্দ্রকে দেখতে পেতাম নাটক দেখার সময়, পরে দৃশ্যটা মনে করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। কী করে হতো এমনটা? আমি জানি না। সম্ভবত ওই অংশে জেঠিমা গিরিশবাবুকে দেখতে পেতেন বলেই সেই দেখাটা আমার মধ্যে অমন করে সঞ্চারিত হয়ে যেতে পারত।
৪
খানিকটা এই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে একটা রেডিও নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে। গল্পটা এই রকম, বিধবা মায়ের দুই ছেলে কেউই পুরো দায়িত্ব নেবে না, ছমাস ছমাস করে মা দুজনের বাড়িতে থাকবে বলে ঠিক হয়েছে। আমি ছোট ছেলে, বেশ বড়লোক, মাকে নিয়ে এসেছি। বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থেকে নেমে মা বলবে, ‘অমু, এই বাড়িটা তোর?’ বললেন, আর আমার যে কী হলো, হাতে নাটকের পাতা, সামনে ঝোলানো মাইকের মুখ, সব মিলিয়ে গিয়ে একটা প্রাসাদের ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। এইসব অভিনয়ের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম বলে এ জীবনকে ধন্য বলে মানি।
বহুরূপীর ভেতরের সম্পর্কগুলো নিশ্চয় নষ্ট হয়ে আসছিল, একসময় ছেড়ে দিলেন দল। তাই নিয়ে তখনকার বহুরূপীর কেউ কেউ রসালো লেখা লিখেছেন, যেন এসব ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমি তা মনে করি না। আমি শুধু দুটো গল্প বলে আমার এ লেখা শেষ করব। দুটো গল্প পরস্পর-বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মনে হয়, ভাগ্যদেবতা এ দুয়ের মধ্যে একটা নিষ্ঠুর রাখি পরিয়ে দিয়েছেন।
তখন আমি বহুরূপীতে, বেশ ছোট ছেলে। কেয়া চক্রবর্তী মারা যাবার পর কালীপ্রসাদ ঘোষের গাড়িতে আমি, শাঁওলীদি আর জেঠিমা গিয়েছিলাম তাঁকে দেখতে। ফেরার সময় সবাই চুপ, হঠাৎ শাঁওলীদিই বোধহয় বলে উঠল, ‘খুব বেশি কষ্ট পায়নি, স্টিমারের প্রপেলারের ধাক্কাতেই মারা গেছে।’ জেঠিমা বললেন, ‘আমি কিন্তু এমন তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। বেশ টের পাব, মৃত্যু আসছে, অনেক দিন তার সঙ্গে লড়াই করব, তারপর মরব।’
কাছের মানুষেরা জানেন, তাঁর সে বাসনা অপূর্ণ থাকেনি। ক্যান্সার নিংড়ে নিংড়ে ছিবড়ে করে দেবার পর মৃত্যু রেহাই দিয়েছিল তাঁকে। তার অল্প আগে তৃপ্তি মিত্রকে কালিদাস সম্মান দেওয়া হয়েছে। তখন একেবারেই শেষ অবস্থা, বাড়িতেই সে সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করা হলো। সম্মানদাতারা এলেন বাড়িতে, তৃপ্তি মিত্র ঘরে ঢুকলেন, হাসিমুখে পুরস্কার নিলেন, অনুষ্ঠান যথাযথভাবে সম্পন্ন হলো।
শাঁওলীদির মুখে শুনেছিলাম, আড়ষ্ট কঠিন শরীরে শাড়ি পরিয়ে দেবার জন্যে সেদিন দুঘণ্টা সময় লেগেছিল, সহ্য করতে হয়েছিল অসহনীয় যন্ত্রণা। দুঘণ্টার পরিশ্রমে নিজেকে ঠিকঠাক করে যখন সকলের সামনে এলেন তিনি, মুখে অমলিন হাসি, কোনো ছায়া সে হাসিকে এতটুকু ম্লান করেনি।
মরণাধিক যন্ত্রণা পার হয়ে এই হাসি যিনি হাসতে পারেন তাঁকে অপরাজিতা না বলে আর কিছুই কি বলা সম্ভব? n