জা হি দ মু স্তা ফা
আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক চারুশিল্পচর্চার সূচনার কিয়ৎকাল পরেই পাশ্চাত্য আধুনিক শিল্পধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইউরোপে উচ্চতর শিল্পশিক্ষার সুযোগ পাওয়া নবীন শিল্পীদের হাত ধরে বাংলার সমকালীন শিল্পের অবয়বে পরিবর্তনের সূচনা দেখতে পাই। শিল্পী মুর্তজা বশীর এই বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়ার এক অন্যতম কান্ডারি।
উত্তরার গ্যালারি কায়ায় তাঁর ষাট বছরের নির্বাচিত কিছু ড্রয়িং, কোলাজ ও অয়েল প্যাস্টেল মাধ্যমে আঁকা চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হলো সম্প্রতি। এতে শিল্পীর চল্লিশটি কাজ স্থান পায়। প্রদর্শনী চলেছে সেপ্টেম্বর ১২ থেকে ২৫, ২০১৪ পর্যন্ত।
জীবিত বয়োজ্যেষ্ঠ চারুশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম মুর্তজা বশীর – পেরিয়ে গেছেন জীবনের আশি বছর। এখনো তিনি ছবি আঁকায় সক্রিয়, শিল্পভাবনায় আলোড়িত, তাড়িত। তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন শিল্পের সুখ ও দুঃখে জড়িয়ে – এই ভাবনা সুখদায়ক, নবীনদের জন্য অনুপ্রেরণা।
শিল্পীজীবনেরই ষাট পেরিয়েছেন মুর্তজা বশীর। তাঁর শিল্পীজীবনে অনেকবার শিল্পভাষা পরিবর্তন করে চিত্রচর্চা করেছেন। নির্দিষ্ট শিল্পরীতির গন্ডিতে তিনি আবদ্ধ থাকতে চাননি। একই মানুষ একই ছবির পুনরাবৃত্তি করবেন, একই রেখায় হাঁটবেন-চলবেন এতে তাঁর আস্থা নেই। এজন্য বারবার তিনি বদলেছেন শিল্পের করণপদ্ধতি, বিষয়-আশয়।
শুরু করেছিলেন ঢাকার আর্ট স্কুলে দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৪৯ সালে ভর্তি হয়ে। পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক ধারার অঙ্কন ও আলোছায়ার অনুশীলন। রেখাধর্মী অঙ্কনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তখনই ডানা মেলেছিল। রেখাঙ্কনে সেই টান এখনো বিদ্যমান মুর্তজার। তাঁর-অঙ্কিত রেখায় ১৯৫২-এর ভাষা-আন্দোলন প্রাণ পেয়েছিল। জনগণের মুক্তিসংগ্রামে দায়বদ্ধ হয়েছিলেন একজন সৃজন শিল্পী ও সচেতন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে। পরে এই দায়বদ্ধতা নিজেদের ব্যক্তিগত সংকটে আর অব্যাহত থাকেনি। ১৯৫৬ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আগেই পশ্চিমের শিল্পের আঙ্গিকগত পরিবর্তনের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরিবর্তন আসে তাঁর আঁকার ধরনে, বাস্তবতার জায়গায় আসে ফর্মের অঙ্কনশৈলী।
কিউবিজম বা ঘনবাদে আকৃষ্ট হয়ে দ্বিমাত্রিক স্পেসকে জ্যামিতিক ফর্মে বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করেন। পরিপ্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করে জ্যামিতি বিভক্ত অঞ্চলগুলো রঙে ভরাট করে ছবিতে ফর্ম ও বর্ণের ছন্দময়তা তৈরি করেন। সাবজেক্ট ও অবজেক্টের ধরনকে প্রধান না করে দুটিকেই ডিজাইনের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার মাতিসীয় পদ্ধতি নিয়ে মুর্তজা নিরীক্ষা শুরু করেন। অনেকটা সুপার ইম্পোজের মতো নানা অনুষঙ্গকে মিলিয়ে এক ধরনের ঘনবাদী চিত্রচর্চা করেন তিনি। এরপর অনেকবার তিনি নিজের চিত্রকরণশৈলীর পরিবর্তন করেছেন। তবে বেশ কিছুকাল যাবৎ যে নারীমুখগুলো তিনি আঁকছেন, তাকে অনেকটা শুরুর দিককার ঘনবাদী প্রেমে দীক্ষিত মুর্তজার কাজের ধরনের প্রত্যাবর্তন বলা যায়।
জ্যামিতি আগের মতো খন্ড-বিখন্ড নয় – সে এখন অনেক সহজ। নারী অবয়বের নানা কৌণিক অংশের বিভাজনে তার প্রয়োগ অঙ্কনকে অনেকখানি লোকশিল্পীদের আঁকার ধরনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে। এই গঠনে একই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন মাতিস, পিকাসো থেকে কামরুল হাসান এবং অবশ্যই লোকশিল্পশৈলীর সহজিয়া আঁকার ধরন। সব মিলিয়ে গঠন আধুনিক ও শেকড়সন্ধানী।
মুর্তজার এই নারীরা শহর ও গ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী। উচ্চ-অনুচ্চ রঙের পাশাপাশি প্রয়োগ থেকে ফভিজমের সম্পর্ক মেলে। তবে এসব কাজে রেখাঙ্কনের গুরুত্ব দেওয়ায় বর্ণমায়া আর যথার্থ থাকে না। অবয়বগুলো ত্রিমাত্রিক মায়া থেকে মুক্ত হয়। নারীসুলভ কমনীয়তা তাদের মুখাবয়বে থাকলেও চোখের দৃষ্টি তীব্র আকুতিময়। তারা যেন নিজ-নিজ অবস্থানকে সংহত করার অঙ্গীকার করছে উন্নত গ্রীবায় ও দৃষ্টিতে। মানবশরীর ও অবয়বের ভেতরকার কাঠামো শিল্পী অঙ্কন-জ্যামিতিতে তুলে ধরেন। একটা অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষকের মতো মানসিকতায় তিনি আঁকেন। এখানেই মুর্তজা বশীরের স্বকীয়তা নিহিত।
এবারের প্রদর্শনীর জন্য নারী অবয়বকেন্দ্রিক কাজগুলো শিল্পী প্রধানত করেছেন ক্যানভাসে অয়েল প্যাস্টেলে। শারীরিক কারণে তেলরঙে এখন কাজ করতে চিকিৎসকের বারণ আছে বলে প্যাস্টেলেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে নিয়েছেন। সম্প্রতি কিছু লাইন ড্রয়িংও করেছেন। এগুলোর সঙ্গে গ্যালারিতে শোভাবর্ধন করেছে ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল অবধি ইতালির ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন আঁকা কতক রেখাচিত্র। প্রায় ষাট বছর আগের রেখাচিত্রগুলোয় শিল্পীর অনুশীলনমূলক অঙ্কনের তৃষ্ণা থাকলেও, তাতে একধরনের সম্পন্নতার গুণ আছে। শিল্পীর রেখাঙ্কনের সেই জাদুকরী হাতের পরশ যেন এখনো সমানতালে বিদ্যমান। এখনকার রেখাচিত্রগুলো সে-কথাই মনে করিয়ে দেয়। সহপাঠী শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর তরুণ অবয়বও ধরা পড়েছে মুর্তজার স্কেচখাতার পাতায়।
গেল বছর স্বল্প সময়ের জন্য ফ্লোরেন্সে গিয়ে মনে পড়েছে – প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন এই নগরে প্রায় ষাট বছর আগে বাংলাদেশ থেকে আসা যুবক মুর্তজা বশীর এই শান্তা মারিয়া নুভোলি রেলওয়ে স্টেশনে পা রেখেছেন, হেঁটেছেন এর পাথুরে স্ল্যাবের ধুলোবিহীন রাস্তায়। তখন ওখানে হয়তো বাঙালির আকাল ছিল – এখন অনেক বাঙালির বসবাস। ভাবতে অবাক লাগে, মুর্তজার চিত্রপটে এতকাল পরেও জাগরূক ফ্লোরেন্স – ওদের ভাষায় ফিরেনজে!
মুর্তজা ফ্লোরেন্স থেকে ফিরেছেন বটে। তবে দেশে ফেরার আগে গেছেন লন্ডনে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখেছেন, ঘুরেছেন, প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তারপর একসময় ফিরেছেন স্বদেশে। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে।
মুর্তজা বশীরকে বলা যায় – তিনি বিভিন্ন সিরিজকেন্দ্রিক শিল্পী। বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের পটভূমিকে মনে রেখে তিনি এঁকেছেন ‘এপিটাফ’ সিরিজ। কবরের গায়ে লেখা এপিটাফের বাণী নয়, শিল্পের ফর্ম হিসেবে তাঁর এই গ্রহণ। জীবন ও মৃত্যুর চরম বৈপরীত্যকে শিল্পী প্রকাশ করেছিলেন এসব কাজে।
নববইয়ের দশকে আমরা অন্য এক মুর্তজাকে পেলাম ‘পাখির পাখনা’ সিরিজে। বিমূর্ততা থেকে মূর্ততার অভিযাত্রায় শিল্পীর একটি পদক্ষেপ এটি। এই সিরিজের বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীটির আয়োজক ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
আশির দশক থেকে নতুন অনেক বিষয়কেন্দ্রিক সিরিজ চিত্রকর্ম শুরু করেন। জায়নামাজের নকশা, তাবিজ-কবজে সেমেটিক হরফে লেখা বচন, কলেমা তাইয়্যেবা – এসব ইসলামি বিষয়কে জীবনের বাস্তবতা হিসেবেই নিজের চিত্রপটে তুলে ধরেছেন। প্রথম জীবনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার সময়ের বিবর্তনে পথ হারিয়েছে। এরপর নানা পথ ঘুরে শিল্পী পরিণত বয়সে খুঁজে নিয়েছেন ধর্মীয় মূল্যবোধ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন – ইসলামের সঙ্গে শিল্পের বিরোধ নেই। শিল্পী সততই পরিবর্তন করেছেন শিল্পশৈলী। এই পরিবর্তনে তিনি বরাবর থেকেছেন স্বচ্ছ। এখানেই শিল্পী হিসেবে তাঁর সততা।
গ্যালারি কায়ায় আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে দেখলাম, বেশ কতক কোলাজ করেছেন শিল্পী। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – ‘মুক্তি এখন’, ‘স্বপ্ন’, ‘আর যুদ্ধ নয় ১ ও ২’ এবং ‘ভেনাসের জন্ম, বতিচেল্লির প্রতি শ্রদ্ধা’। কাজগুলো ১৯৯০-৯১ সময়কালের। ‘মুক্তি এখনে’র পটভূমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। মুক্তির মশাল উঁচিয়ে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা যেন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মুর্তজা বশীরের চোখে ও মননে। সেটিই তিনি তুলে ধরেছেন সমুদ্রজলে হাঁটু গেড়ে বসা মুক্তির প্রতীক এক নারীর ভঙ্গিতে।
যুদ্ধ মানবজাতির জন্য সর্বদা অকল্যাণকর। এই বার্তা আরো বিশদভাবে প্রতীকায়িত করেছেন শিল্পী তাঁর যুদ্ধবিরোধী দুটি কোলাজ কর্মের মাধ্যমে। আর ‘স্বপ্ন’ শীর্ষক কোলাজে বিবৃত হয়েছে মানুষের অবচেতনার অনুভূতিপ্রবণতা। স্বপ্ন দেখা নারী যেন নদীর মতো শুয়ে আছে আদুল গায়ে পাথুরে পাহাড়ি উপত্যকায় আদি যুগের কয়েকটি ঘোড়ার ছোটাছুটি।
বতিচেল্লির অমর সৃষ্টি ‘ভেনাসের জন্ম’ দেখেছি ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে। শামুকের খোল থেকে উত্থিত দেবী ভেনাসের নিরাভরণ দেহ বস্ত্রাবৃত করতে ছুটে আসছে দুটি অ্যানজেল। কী অসামান্য ব্যগ্রতার এক মুহূর্ত ধরা পড়েছে ওই চিত্রকর্মে। সেই অমর সৃষ্টির এক কোলাজ গড়েছেন মুর্তজা শিল্পী বতিচেল্লির প্রতি সম্মান জানিয়ে। এখানে ভেনাস উঠে আসছে। বদলে গেছে পেছনের পটভূমি। অ্যানজেলের বদলে ব্যালে শিল্পীর শরীর চালনা, আর চিত্রপটের ডানদিকে সার্কাসের পাঁচজন শিল্পী যেন হাত দিয়ে চোখ ঢেকে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখছেন সৌন্দর্যদেবীকে। এই কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের এক গ্রেট মাস্টার স্মরণ করেছেন পুরনো এক গ্রেট মাস্টারকে।
মুর্তজা বশীর বহুমাত্রিক শিল্পী। চিত্রকলায় অসামান্য রেখাচিত্র থেকে তেলরঙে, অ্যাক্রিলিকে ক্যানভাসে সদা সক্রিয় ছিলেন। কোলাজেও তিনি আমাদের গুরুশিল্পীদের অন্যতম প্রতিভূ। তাঁর লেখা উপন্যাস আলট্রামেরিন তাঁর ছাত্রজীবন ও যৌবনের এক অনবদ্য সৃষ্টি। কবিতা লেখনীতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তুমুল সৃজনশীল এই মানুষটির দীর্ঘজীবন কামনা করি। তাঁর দেওয়ার ক্ষমতা – আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা।