logo

অঁরি মাতিস : কাটা কাগজের জাদু

শে খ  গো লা ম  হা সা ন

প্রদর্শনী : অঁরি মাতিস, কাট-আউটস মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টস, নিউইয়র্ক ২১ অক্টোবর ২০১৪-৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬  মাতিসের পেপার-কাটের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় সত্তরের প্রথম দিকে, নির্মলেন্দু গুণের কাব্যগ্রন্থ অমীমাংসিত রমণীর মাধ্যমে। সে-গ্রন্থের প্রচ্ছদে মাতিসের ব্লু ন্যুড সিরিজের একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। ঠিক প্রতিচিত্র নয়, সে কাট-আউট অনুসরণে নতুন করে আঁকা ছবি। এ ছবি যে কাগজ কেটে বানানো, তা আমাদের পরিচিত পেইন্টিং নয়, সে বুদ্ধি আমার ছিল না। চমৎকৃত হয়েছিলাম, কোনো সন্দেহ নেই।

নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে এখন মাতিসের কাট-আউট নিয়ে প্রদর্শনী চলছে। দেখলাম, একটি নয়, মাতিস মোট চারটি ব্লু ন্যুড বানিয়েছিলেন। কাগজের ওপর গোয়াশের নীল রং ঢেলে রাঙানো কাগজ, তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে পছন্দমতো নানা আকার দিয়েছেন মাতিস। উদ্ভিন্নযৌবনা চার রমণী, তাদের দেহের প্রতিটি বাঁক, স্তনসন্ধি, ঊরু, নৃত্যের তালের মতো বাঁকানো দীর্ঘ প্রসারিত বাহু, নিষিদ্ধের আমন্ত্রণবাহী এই ছবি আমাদের বিস্মিত করে। শিল্পীর কল্পনা ও কারিগরি দেখে আমরা হতবাক হয়ে পড়ি। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, প্রতিটি রেখা একে অপরের সম্প্রসারিত প্রকাশ। একে ছবি বলব, না কবিতা?

সবচেয়ে বিস্ময়কর যা তা হলো, মাতিস কাগজ কেটে ব্লু ন্যুড সাজানোর এই খেলায় মেতেছেন এমন একসময়, যখন তাঁর বয়স বিরাশি বছর, মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে। কাগজ-কাটা নিয়ে কাজ অবশ্য তিনি শুরু করেছেন তারও আগে। ১৯৩৯ সালের পর আঙুলের ব্যথায় ব্রাশ ধরে ছবি আঁকা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এই সময় মাতিস একধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে মৃত্যুভয়ে ভীত করে তোলে। সফল অস্ত্রোপচারের পর তিনি বেঁচে ওঠেন বটে, কিন্তু তাঁর পক্ষে সাহায্য ছাড়া হাঁটাচলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হলেও তাঁকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হতো। পেপার-কাট নিয়ে তাঁর খেলা এই সময়েই শুরু। আরো একটি ঘটনা এই সময় মাতিসকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। প্রায় চল্লিশ বছর যে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করেছেন – যাঁর হ্যাট মাথায় ফভ ছবির জন্য তিনি প্রথম সবার দৃষ্টি কাড়েন – সেই আমেলির সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ ছিল মাতিসের অতি দক্ষ ও বুদ্ধিমান সহকারী ও মডেল রুশ তরুণী লিদিয়া। মনস্তাপ ও নিঃসংগতা দূর করতে একটি খেলা তাঁর প্রয়োজন ছিল। কাগজ-কাটা ছিল ঠিক সেই খেলা।

মোমার প্রদর্শনীতে মাতিস কী করে তাঁর পেপার-কাট তৈরি করতেন, তার একটি শব্দহীন ভিডিও রয়েছে। হুইলচেয়ারে বসা মাতিস, শিল্পী নন, মনে হয় আমাদের পরিচিত কোনো এক বুড়ো দাদু ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, লিদিয়াকে নির্দেশ দিচ্ছেন, কাগজে রং লাগানো অভিনিবেশ নিয়ে দেখছেন, দেয়ালে কাটা কাগজ পিন দিয়ে লাগানো তদারক করছেন। মাতিস নিজে বলেছেন, এই খেলার ভেতর দিয়েই তিনি এক নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছেন। ‘আমি এখন মুক্ত, সারাজীবন যা হতে পারিনি। এখন আমি যা খুশি করতে পারি, যা খুশি বানাতে পারি।’

যেসব কাট-আউট এখানে স্থান পেয়েছে, তার সব যে নারী বা পুরুষের দেহ বা দেহের রেখাচিহ্ন, তা নয়। বস্ত্তত মোমার প্রদর্শনীর অধিকাংশ কাজই ডেকোরেটিভ ধাঁচের। অর্থাৎ ফুল, পাখি, গাছের পাতা, নানা বিচিত্র আকারের নকশা। কিন্ডারগার্টেনের ক্লাসরুমে এদেশে এই রকম নানা রকম
কাগজ-কাটা দিয়ে ঘর সাজাতে দেখেছি। যেদিকেই তাকাই, চোখে পড়ে রঙের বিচিত্র বিস্ফোরণ। সবই দারুণ সজীব ও তরুণ, অবিশ্বাস্য কর্মশক্তিতে যেন তারা ফেটে পড়ছে। এ না ছবি, না দুই মাত্রার ভাস্কর্য। সে যাই হোক, এমন এক আশ্চর্য ফাগুনরঙা খেলা দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়। বাস্তব জগৎ থেকে চোখ ফিরিয়ে আমরা প্রবেশ করি এক রূপকথার রঙের ঝরনাধারায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে অবরুদ্ধ প্যারিস থেকে পালিয়ে আসেন মাতিস, প্রথম নিস শহরে, পরে যুদ্ধ সেখানেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় কয়েক মাইল ছাড়িয়ে প্রায় মফস্বলীয় ভাসঁ শহরে এসে ডেরা বাঁধেন। কাট-আউটের বড় কাজগুলো তিনি এখানেই শেষ করেন। যুদ্ধের পর প্যারিসেও সে কাজ অব্যাহত রাখেন। নিজের বসার ঘর, খাবার ঘর, যেখানেই সামান্য জায়গা পেয়েছেন, কাটা কাগজের ছবি দিয়ে দেয়াল ভরিয়ে তুলেছেন। ‘সুইমিং পুল’ নামে দেয়ালজোড়া একটি কাজ রয়েছে, যা আসলে মাতিসের খাবার ঘরের দেয়ালে সাজানো ছিল।

‘ওশানিয়া, দি সি, দি স্কাই’ – এই নামের আরেকটি দেয়ালচিত্র, মোমার কিউরেটর জানালেন এই কাজটি শুরু হয়েছিল আকস্মিকভাবে। মাতিস একদিন কাগজ কাটতে গিয়ে প্রথমে একটি পাখি কেটে তোলেন। তাঁর ঘরের একটি দেয়ালে ময়লা এক দাগ ঢাকার জন্য সেটি তিনি দেয়ালে সেঁটে দিলেন। দেখে ভালো লাগল, তারপর এক এক করে নানা কাটা কাগজ দিয়ে সেই দেয়াল পুরোটাই সাজিয়ে ফেললেন। এর আগে ১৯৩০ সালে – তখনো তিনি সুস্থ – মাতিস তাহিতি গিয়েছিলেন। সেখানে দেখা অরণ্য, পুষ্প, পক্ষী এবং উজ্জ্বল আলো ও ঘন মেঘের খেলার যে স্মৃতি তাঁর মনে ছিল, কাগজ কেটে তাদের পুনর্নির্মাণ করলেন, হয়ে দাঁড়াল আলো ঝলমলে এক দেয়ালচিত্র। এই দেয়ালচিত্রের স্ক্রিন প্রিন্ট আমরা বইতে দেখেছি, তা অতি মসৃণ, নির্ভেজাল একটি চিত্রকর্ম। কিন্তু মোমাতে যে কাজটি রয়েছে তা মাতিসের কাটা কাগজ, দেয়ালে তাঁর সহকারীরা যেভাবে সাজিয়েছিল, তার অবিকল পুনর্নির্মাণ। সবসময় সে শুধু একটি রং করা কাগজ তা নয়, কোথাও কোথাও এক কাগজের ওপর আরেক কাগজ। সে কথা উল্লেখ করে কোনো এক সমালোচক মাতিসের এই কাজগুলোকে ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

‘প্যারাকিট অ্যান্ড দি মারমেইড’ – এই নামে অতি দীর্ঘ একটি কাজ রয়েছে, যা দেখে মনে হয় রূপকথার এক খেয়ালি পুষ্প উদ্যান। মাতিস এই কাজটি প্রসঙ্গে ইসলামিক ‘ডেকোরেটিভ’ শিল্পের প্রভাব স্বীকার করেছেন। এই বাগান মর্ত্যে নয়, হয়তো অন্যত্র, সম্ভবত স্বর্গে দেখা পাব, কিঞ্চিৎ পরিহাসের সঙ্গে বলেছিলেন মাতিস। মারমেইড-টি চেনা সহজ। টিয়া পাখিটি এই রং, ফুল ও পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকে, তাকে যখন আবিষ্কার করি, একধরনের শিশুসুলভ আনন্দ আমাদের প্রীত করে।

কাগজ-কাটা এইসব ছবি স্থায়ী বা টেকসই হওয়ার কথা নয়। দেয়ালে পিন সাঁটা ছবি, সময়ের ব্যবধানে তার মূল শিল্প-ধারণা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কথা। মোমার এই প্রদর্শনী, যা এর আগে লন্ডনের টেট গ্যালারিতে বিপুল সমাদরে প্রদর্শিত হয়, তা মাতিসের মূল স্কেচ ও ফটোগ্রাফ দেখে অতি যত্নের সঙ্গে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এর জন্য সকল কৃতিত্ব মোমার তিন কুশলী
শিল্পী-কারিগরের। তাঁরা হলেন কার্ল বুচবার্গ, জোডি হাউপ্টম্যান ও সামান্থা ফ্রিডম্যান। ছবিগুলোর যে একধরনের অসম্পূর্ণতা রয়েছে – এগুলো ঠিক ‘ফিনিশড’ শিল্পকর্ম নয়, দেয়ালের ওপর পিনের দাগ, মাতিসের পেনসিলের মোটা চিহ্ন, কখনো কখনো একের ওপর আরেক কাগজের অসমান্তরাল চিহ্ন, সবই অক্ষত রয়েছে। এতে আমার মনে হয়েছে, কাজগুলো পেশাদারি কাগজ-কাটা শিল্প না হয়ে বরং তা অনেক মানবিক ও শৈল্পিক হয়েছে। কাট-আউট দিয়ে মাতিস ১৯৪৩-এ জ্যাজ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। সে বইয়ের একটি কপিও প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে। বইয়ের নামকরণ থেকেই বুঝি, মাতিস জ্যাজের সুরের খেলার মতো রং ও আকারের খেলা নিয়ে মত্ত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি তাঁকে যা আকৃষ্ট করেছিল তা স্বাধীনতা। আমি যা খুশি করব, যেমন খুশি করব, তোমরা একে ছবি বলো বা না বলো, তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। জ্যাজ বা আমাদের ‘খেয়াল’ গানের তো সেটাই আসল শক্তি।

মাতিসের ছবি তাঁর বিমূর্ত চরিত্রের জন্য নয়, বরং তার ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ ভাবমুখীনতা, তার স্পষ্টতার জন্য পরিচিত। এই ছবি দেখে আমাদের মাথা চুলকাতে হয় না। ফভ পর্যায়ের ছবিগুলো থেকেই আমরা জানি উজ্জ্বল রং ও কিছুটা অসম্পূর্ণ নির্মাণের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। এই কাট-আউটগুলোও সেই উজ্জ্বল রঙের জন্য স্মরণীয়, তবে যেহেতু ঘন রঙের মেঝেতে আকারগুলো সাজানো, ফলে তাতে একধরনের ‘সংযমী’ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

মাতিসের কাট-আউট প্রসঙ্গে একজন মার্কিন সমালোচক তাঁকে শৈশবে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিজের শৈশবে মাতিস হেমন্তের পড়ো পাতা কুড়িয়ে আনতেন এবং তা নানা রঙে সাজাতেন। মাতিস নিজেও বলেছেন, ভাসেঁর বাড়িতে প্রথম ক্রিসমাসের সময় সারারাত তাঁর নোট বইতে একটি মাত্র ওক গাছের পাতা এঁকেছেন, সে পাতা বইয়ের এক পৃষ্ঠা থেকে আরেক পৃষ্ঠা, এইভাবে পুরো বইটাই হয়ে দাঁড়ায় ‘একটি পত্র-পুষ্পিত ফেস্টুন’। এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পাতাগুলো কীভাবে বেড়ে উঠছে, তারা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের একে অপরের মধ্যে স্থানগত ব্যবধানের আনুপাতিক হিসাব।

মাতিসের জীবনের শেষ চোদ্দ বছরের কাজ এ
কাট-আউটগুলো। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর মাতিস ধরে নিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু সফল অস্ত্রোপচারের পর যখন নতুন জীবন ফিরে পেলেন, মাতিস ঠিক করলেন ছবি আঁকা নিয়ে আর কসরত করবেন না। যা তাঁর মন চায়, যা খুশি, কেবল তাই করবেন। মাতিস নিজেই বলেছেন, জীবনে শুধু এই কটা বছরই তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত, সম্পূর্ণ স্বাধীন বোধ করেছেন।

কিন্তু একথাও ঠিক, মাতিস তাঁর এই শেষ বছরগুলোতে মানসিক যন্ত্রণাতেও ভুগেছেন। রুশ তন্বী সহকারী তাঁকে গুরুর শ্রদ্ধায় ও প্রেমিকার ভালোবাসায় আগলে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু এই লিদিয়ার জন্যই তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল। আমেলি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, হয় আমি – নয় লিদিয়া। মাতিস লিদিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন। সদ্য বিপত্নীক, পুত্র ও কন্যা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপনকালে মাতিস যে মনস্তাপে ভুগেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। নিজেকে ভোলাবার জন্য – কঠিন বহির্জগৎ থেকে নিজেকে আড়াল রাখার জন্য – বোধহয় এমন একটি প্রায়-শিশুতোষ ক্রীড়ার প্রয়োজন তাঁর ছিল। মনে রাখা ভালো, এই চোদ্দ বছর মাতিস মূলত স্মৃতি থেকে ছবি এঁকেছেন, ফলে বস্ত্ত বা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি রয়েছে, যে পৌনঃপুনিকতা তিনি লাঘব করেন একদিকে রঙের ঔজ্জ্বল্যে, অন্যদিকে বিভিন্ন বস্ত্ত, দেহ বা দৃশ্যের একের প্রতি অন্যের অবস্থানগত সম্পর্ক নির্মাণ ও বিনির্মাণে। স্থানগত সামঞ্জস্য ও সমভারের বদলে তাদের বৈসাদৃশ্য।

সম্ভবত সে কারণে আমাদের কাছে মাতিসের এই কাজগুলোকে ‘সিম্ফোনিক’ নয়, জ্যাজের মতো অনর্গল মনে হয়। জ্যাজের মতোই এই কাট-আউটগুলো খোলা অর্গল দিয়ে অবারিত ধ্বনি-বন্যায় আমাদের এক আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত রঙের উৎসবে ভিজিয়ে দেয়।

 

২৭ অক্টোবর ২০১৪

নিউইয়র্ক

 

Leave a Reply